বুধবার, ৮ সেপ্টেম্বর, ২০১০

প্রাইভেট গাড়ীর সেবাদাস

প্রাইভেট গাড়ীর সেবাদাস

সেবাদাস হচ্ছে এমন একটি শ্রেণী যার মূল কাজ হচ্ছে যে কোন মূল্যে মনিবের সার্বিক সুবিধা নিশ্চিত করা। সেবাদাসগন তার শ্রেণী অপেক্ষাও মনিবের সুবিধাকে অগ্রাধিকার প্রদান করে থাকে। আমাদের সমাজ ব্যবস্থা ও মনমানসিকতাও কি সেদিকেই যাচ্ছে?
নগর পরিকল্পনায় কিছু মানুষের বাহনের সুবিধা নিশ্চিত করাই কি আমাদের মূল লক্ষ্য?

গত ২৪ আগষ্ট ২০০৯ তারিখে পত্রিকায় প্রকাশিত একটি সংবাদের দেখছি সিলেট রেজিষ্ট্রি মাঠ হকারমুক্ত করা হয়েছে। কিন্তু ব্যক্তির সহযোগিতায় এই মাঠটি হকারা ব্যবহার করে আসছিল। ফলে মাঠের পার্শ্বে থাকা পূর্ত ভবনের কর্মকর্তা কর্মচারীদের গাড়ী পার্কিং করতে হতো রাস্তার উপর। উচ্ছেদের পর মাঠটি এখন ব্যবহার করা হচ্ছে গাড়ী পাকিং করার জন্য। কারো মতে হয়তো বিষয়টি যৌক্তিক, আর এ প্রেক্ষিতে আমার মনে কিছু প্রশ্নের সৃষ্টি হয়েছে। এইটি মাঠটিতে ৫০টির বেশি হকারের দোকান ছিল। যদি ধরে নেওয়া যায় প্রতিটি দোকানের কর্মচারী ও পরিবারের লোকেজন মিলে দোকান প্রতি ৪ জন করে লোক এই দোকানের উপর নির্ভর ছিল, তবে প্রায় ২০০ লোক এই দোকান হতে তাদের জীবিকা নির্ভাহ করত। কিন্তু হকার উচ্ছেদের পর, গাড়ী পাকিং করার কত লোকের জীবিকার সংস্থা হয়েছে, কতলোক সুবিধা পাচ্ছে? রাষ্ট্র, সরকার এবং সমাজের কাছে প্রশ্ন, গাড়ীর পাকিং ও মানুষের জীবকার মাঝে কোনটির সুবিধাকে অগ্রাধিকার দেওয়া প্রয়োজন?

ঢাকা শহরের বিভিন্ন স্থানে গাড়ীর পার্কিংএর ব্যবস্থা রয়েছে। ঢাকা সিটি কর্পোরেশন জনগনের টাকায় মাত্র ১০-২০ টাকায় ঘন্টাখানেক এখানে গাড়ী রাখতে পারেন। এই জায়গাগুলো পাবলিক প্রার্পাটি। যদি প্রস্তাব করা এই জায়গায় একই মূল্যে হকারদের বসার জন্য সুযোগ দেওয়া হবে কি না? এ প্রশ্নের উত্তর অবশ্যই না আসবে। ঢাকা শহরের গাড়ী পাকিংকে যেমন একটি সমস্যা মনে করা হয়, তেমটি হকারদের বসার ব্যবস্থা একটি তার চেয়ে দীর্ঘ ও পুরাতন সমস্যা। গাড়ীর জন্য ঢাকা শহরের বিভিন্ন স্থানে পাকিং সুবিধা নিশ্চিত করা হয়েছে, কিন্তু হকারদের সুবিধার জন্য স্থায়ী ও স্বল্পমূল্যে এ ধরনের কোন উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়নি। ফুটপাত দখল করে রাখার জন্য প্রতিনিয়ত হকার উচ্ছেদ কার্যক্রম পরিচালিত হয়। কিন্তু ফুটপাত দখল করে রাখার জন্য গাড়ীর উচ্ছেদ কার্যক্রম হয় না। ঢাকা শহরের রাস্তার একটি বড় অংশ দখল করে রাখে প্রাইভেট গাড়ী। যা একটি ব্যক্তিগত পরিবহন এবং একক মানুষের সুবিধাকে নিশ্চিত করে।

ঢাকা শহরের বিভিন্ন রাস্তায় রিকশা চলাচল নিষিদ্ধ করা হয়, বর্তমানে এ সকল রাস্তার একটি বড় অংশ জুড়ে থাকে প্রাইভেট গাড়ীর পাকিং। ঢাকা শহরের নিউমার্কেট এর ভিতরে দিয়ে রিকশা চলাচলের ব্যবস্থা করা হয়েছে। সাথে সাথে নোটিশ প্রদান করা রয়েছে রিকশা পাকিং নিষিদ্ধ, কিন্তু গাড়ী পার্কিং রয়েছে। গাড়ীর পাকিং করার জন্য এখানে সৃষ্টি হচ্ছে যানজট। কয়েক বছরে ধরে এখানে একটি মার্কেট গড়ে উঠছে। এই মার্কেট এ প্রায় ১০০০ টি দোকান রয়েছে। যেখানে গাড়ী ব্যবহারকারীদের জন্য গাড়ীর পাকিং করার ব্যবস্থা রয়েছে। ভাবছি যখন এই মার্কেট চালু হবে তখন কি অবস্থা হবে। গাড়ীর জটে মানুষ এখানে প্রবেশ করতে পারবে না। তখন নতুন কোন সমস্যা দেখিয়ে এ রাস্তায় শুধু রিকশা নিষিদ্ধ করা হবে। নিশ্চিত করা হবে প্রাইভেট গাড়ীর চলাচল।

ঢাকা শহরের প্রায় ২% শতাংশ মানুষের প্রাইভেট গাড়ী রয়েছে। অবাক বিষয় হচ্ছে প্রতিটি মার্কেট ও বাড়ীতে প্রাইভেট গাড়ীর জন্য জায়গা রাখা বাধ্যতামূলক। এটি হচ্ছে রাজউকের ইমারত বিধিমালার নিয়ম। অথচ শহরের পথচারী, বাস ব্যবহারকারী বা রিকশা ব্যবহারকারীদের জন্য কোন বিশেষ ব্যবস্থা নেই মার্কেট ও রাস্তায়। প্রাইভেট গাড়ী ব্যবহার আজ সমাজের অভিজাত্যের প্রতীকী। আমাদের চিন্তায় কে কোন ব্রান্ডের গাড়ী ব্যবহার করে তার উপর নির্ভর করে মানুষের কত উচু মানের। যার যত দামী ও আধুনিক গাড়ীর তার দাম তত বেশী। গাড়ীর হচ্ছে মানুষের অবস্থান নির্ণয়ের সুচক।

ঢাকা শহরের শিশুদের একটি বড় সমস্যা হচ্ছে তাদের বিনোদনের অবস্থা। খেলা জায়গার অভাবে তারা বেড়ে উঠছে টিভি, কম্পিউটার, শপিংমল সংস্কৃতিতে। যা তাদের মানসিক ও শারিরীক বিকাশকে ধ্বংশ করেছে। পরিবেশবাদীরা নিয়মিতই মাঠ পার্কের দাবি করে আসছে। কিন্তু ফলফল শূন্য। বরং মাঠগুলো দখল হয়ে যাচ্ছে মেলা ও গাড়ীর পার্কিং এর নামে। সরকারের কর্তৃপক্ষের কাছে মাঠের আবেদন করা হলে বলে জায়গার সংকট। স¤প্রতি পত্রিকায় দেখলাম কাউরান বাজার উচ্ছেদ করে গাড়ীর পাকিং করা হবে। গাড়ীর পাকিং উচ্ছেদ করে শিশুদের খেলার জায়গা করা যায় না? সরকারে সংস্থাগুলোর মধ্যে নূন্যতম শতাংশের মানুষের জন্য রাজউকের আরো বলিষ্ট উদ্যোগ রয়েছে। বাড়ীতের গাড়ী থাক আর নাই থাকা গাড়ীর জন্য জায়গা রাখতে হবে। ঢাকা শহরের এমন অনেক স্থান রয়েছে, যেখানের রাস্তা সরু থাকার কারণে গাড়ী প্রবেশ করতে পারবে না। কিন্তু রাজউকের নিয়ম অনুসারে এ সকল স্থানে গাড়ীর জন্য জায়গা রাখতে হবে। রাজউকের ইমারত নির্মাণ বিধিমালা সুপষ্টভাবেই এই নির্দেশনা প্রদান করে। ঢাকা অনুকরণে দেশের অন্যান্য শহরেরও এধরনের নীতি গ্রহণ করা হচ্ছে। কিন্তু প্রতিটি বাড়ীতে শিশু থাকা স্বত্বেও বাড়ীতে শিশুর খেলাধূলা বা বিকাশের জন্য কি ব্যবস্থা থাকতে হবে, তার কোন নির্দেশনা নেই। তবে কি গাড়ী আমাদের শিশু অপেক্ষা জরুরি? একটি মানুষের জীবনে গাড়ী না থাকলেও চলে, কিন্তু একটি মানুষের শিশু না থাকলে কি সে শান্তি পায়? যদি গাড়ী শিশু অপেক্ষা আমাদের এত প্রিয় হয়ে থাকে, তবে সেই সকল ব্যক্তিদের জন্য উপদেশ শিশু গ্রহণ না করে একটি আধুনিক গাড়ীকে দত্তক হিসেবে গ্রহণ করুন। শিশুদের শারিরীক ও মানসিক বিকাশের সুবিধার ক্ষেত্রে বিভিন্ন সীমাবদ্ধতা দেখিয়ে, প্রাইভেট গাড়ীর জন্য সুবিধা নিশ্চিত করা কোন সভ্য সমাজের চিন্তা ও মানসিকতা হতে পারে না। যদি শিশুরা আগামী দিনের বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ হবে বলে আমরা বিশ্বাস করি, তবে প্রাইভেট গাড়ীর সুবিধা নিশ্চিত না করে, শিশুদের পরিবেশ কিভাব নিশ্চিত করা যায় তা চিন্তা করা উচিত।

বাংলাদেশের সংবিধানের ১৪ এবং ১৫ অনুচ্ছেদর অনুসারে শ্রমিক ও অগ্রসর জনগোষ্ঠীকের শোষণ হতে মুক্তি প্রদান এবং মৌলিক প্রয়োজনের ব্যবস্থা নিশ্চিত করা রাষ্ট্রের অন্যতম দায়িত্ব্। অনুচ্ছেদ ২০ (১) অনুসারে কর্ম হচ্ছে কর্মক্ষম প্রত্যেক নাগরিকের পক্ষে অধিকার, কর্তব্য এবং সম্মানের বিষয়। আর যদি সংবিধান আমাদের রাষ্ট্রনীতিতে প্রাধন্য পায়, তবে অধিকাংশ জনগনের চলাচলের ব্যবস্থা, শিশুদের শারিরীক ও মানসিক বিকাশ এবং হকারদের কর্ম করার ব্যবস্থা অগ্রাধিকার পাবে। বাংলাদেশ সরকার শিশু অধিকার সনদ, মানবাধিকার সনদসহ বিভিন্ন সনদের স্বাক্ষর করেছে। এ সকল সনদের মানুষকে রাষ্ট্র কর্তৃক বিভিন্ন সুবিধা নিশ্চিত করার কথা বলা হয়েছে। সংবিধান ও এ সকল আন্তর্জাতিক সনদের কোথাও প্রাইভেট গাড়ীকে সুবিধা প্রদানের কাজ উল্লেখ্য নেই। কিন্তু অবাক হলেও জন্য রাষ্ট্রীয় কোষাগার হতে অর্থ নিয়ে, ঋণ গ্রহণ করে, বিভিন্ন পরিকল্পনার মাধ্যমে প্রাইভেট গাড়ীর জন্য পার্কিং, ফ্লাইওভার, বিশাল রাস্তার করার পরিকল্পনা মস্ত সরকারী সংস্থাগুলো। কিন্তু অধিকাংশ মানুষের চলাচল, শিশুদের বিনোদন, দরিদ্র হকারদের কর্মসংস্থান, রিকাশ চলকদের ক্ষেত্রে সংস্থাগুলোর চিন্তা ও কর্মের সীমাবদ্ধতা বিস্ময়ের।

যানবাহন ও নগর পরিকল্পনার যে কোন সিদ্ধান্তে প্রথমেই চিন্তুা করা হয় জড় মনিব প্রাইভেট গাড়ী কিভাবে যাবে। প্রাইভেট গাড়ীর কিভাবে নিভিগ্নে চলাচল করবে? প্রাইভেট গাড়ীকে কোথায় থাকবে। গুটি কয়েক প্রাইভেট গাড়ীর মালিকের জন্য অধিকাংশ মানুষের অর্থ খরচ করে এত পরিকল্পনা কেন? রাষ্ট্রীয় ও আন্তর্জাতিক নীতি অনুসারে অধিকাংশ মানুষের কেন অগ্রাধিকার পাবে না। তাই মনে হয় অভিজাত্য আর অহংকারে প্রতীকী দেখাতে গিয়ে আমরা হয়ে পড়েছি গাড়ীর সেবাদাস। সত্যিই ভাবতে আবাক লাগে একটি জড়বস্তু কিভাবে সভ্য ও জ্ঞানী সমাজের প্রতিনিধি মানুষকে সেবাদাসে পরিণত করতে পারে। হয়তো এ লেখা পড়ে কেহ কেহ প্রতিবাদ করবে এবং প্রাইভেট গাড়ীর পক্ষে যুক্তি দিতে চেষ্টা করবেন। এ কাজের পূর্বে বিনীত একটি অনুরোধ একবার ভাবুন আপনি কি অধিকাংশ মানুষের যাতায়াত সুবিধা, শিশুদের বিনোদন, হকারদের ব্যবসার সুবিধা, রিকাশ চলাচলের নিশ্চিত জন্য এভাবে যুক্তি উপস্থাপন করবেন।

দেশের নিরাপত্তা, অর্থনীতি ও যোগাযোগ ব্যবস্থা উন্নয়নে রেলওয়ের বিরাষ্ট্রীয়করণ বন্ধ করতে হবে


দেশের নিরাপত্তা, অর্থনীতি ও যোগাযোগ ব্যবস্থা উন্নয়নে
রেলওয়ের বিরাষ্ট্রীয়করণ বন্ধ করতে হবে

পরিবেশ, অর্থনীতি, জনসেবা, রাষ্ট্রীয় দায়িত্ব, নিরাপত্তা, দারিদ্র বিমোচন, কর্মসংস্থান এর ক্ষেত্রে বাংলাদেশ রেলওয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। সরকার রেলের মাধ্যমে পরিবহণ সুবিধা প্রদান করে দেশের কোটি কোটি মানুষের ভাগ্যোন্নয়নের লক্ষ্যে কাজ করে যাচ্ছে। দেশের পরিবহণ ব্যবস্থা ও সার্বিক উন্নয়নে রেল যোগাযোগ আরো বিস্তৃত করা প্রয়োজন। এ লক্ষ্যে পূর্ব-পশ্চিমাঞ্চাল রেল যোগাযোগ ব্যবস্থা জোরদার সহ রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থাপনায় রেল উন্নয়নে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহন করা জরুরী। সেক্ষেত্রে রেল পরিচালনার জন্য জাতীয় বাজেটে রেলের বরাদ্দ আরো বেশি দেওয়া প্রয়োজন।

ঋণ প্রদানকারী সংস্থাগুলো পরিবহণ ব্যবস্থার উন্নয়নের নামে সড়কপথেই বেশিরভাগ ঋণ প্রদান করায় রেলওয়ের উন্নয়ন বরাবরই উপেক্ষিত থেকেছে। কিন্তু গবেষক ও পরিবেশ বিশেষজ্ঞদের মতো সড়ক পথে অপরিকল্পিত বিনিয়োগ বর্তমানে পরিবেশ দূষণ, দুঘর্টনা, অর্থনৈতিক ক্ষতিসহ বিভিন্ন সমস্যার সৃষ্টি করেছে। বিগত দিনে ঋণ প্রদানকারী সংস্থা কর্র্তৃক রেলওয়ের উন্নয়নে ঋণ প্রদান করেছে। কিন্তু এ সকল ঋণ সহায়তায় রেল উন্নয়নে স্টেশন রি মডেলিংয়ের নামে শত শত কোটি টাকা এরকম অনুৎপাদনশীল খাতে ব্যয় করা হয়েছে। স্টেশন আধুনিক করা অপেক্ষা রেল লাইন উন্নয়ন ও রেলে বগি, ইঞ্জিন বাড়ানো জরুরি ছিল। কিন্তু সে দিকে নজর দেওয়া হয়নি। একদিকে বলা হচ্ছে ঋণ ছাড়া চলা সম্ভব নয়, অপর দিকে এমন খাতে ঋণ দেওয়া বা নেওয়া হচ্ছে যা অপ্রয়োজনীয়। কথিত ঋণ সহযোগীদের পরামর্শ ও দিক নির্দেশায় এ ধরনের উন্নয়ন গৃহীত এবং হয়েছে এবং হচ্ছে।

দুঃখজনক হলেও সত্য যেসব খাতে বিনিয়োগ করলে রেলওয়ে সেবাকে জনগণের কাছে সহজলভ্য ও রেলের রাজস্ব বৃদ্ধিতে সরাসরি সহায়ক হতো সেসব খাতে যথেষ্ট বরাদ্দ দেওয়া হয়নি। ফলে রেলের অনুৎপাদনশীল খাতে ব্যয়িত ঋণের টাকা সুদে আসলে পরিশোধ করতে হচ্ছে। বস্তুতপক্ষে ঋণপ্রদানকারী সংস্থার কারণে রেলের সত্যিকার উন্নয়ন বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। ঋণ গ্রহনের পূর্বে অবশ্যই বিবেচনা করা প্রয়োজন এ অর্থ কিভাবে পরিশোধ করা হবে? এ ঋণ হতে কি পরিমান লাভ হবে? ঋণপ্রদানকারী সংস্থাগুলোর সম্পর্কে বিভিন্ন মহলের অভিযোগ এবং অনুযোগ সর্তকতার সাথে বিবেচনা করা দরকার। কারণ ইতিপূর্বে যে সকল প্রতিষ্ঠানের উন্নয়নে এডিবি এবং বিশ্বব্যাংক পরামর্শ দিয়েছে সেগুলো আশানুরূপ ফলাফল অর্জনে ব্যর্থ হয়েছে। পৃথিবীর অনেক দেশেই এ বিষয়ে প্রশ্ন উঠছে। উদ্ভুত পরিস্থিতিতে বাংলাদেশ রেলওয়ের বৃহত্তর স্বার্থে ঋণ প্রদানকারী সংস্থার পরামর্শ ও শর্ত বর্জন করা প্রয়োজন। রেলের উন্নয়নে দেশের নীতিমালার আলোকে ঋণ নিতে হবে এবং এর প্রেক্ষিতে রেলের মাধ্যমে পরিবহণ ব্যবস্থার যথাযথ উন্নয়ন সম্ভব হবে। সেক্ষেত্রে প্রথমেই রেলের কোন কোন খাতে সংস্কার করতে হবে তা সঠিকভাবে চিহ্নিত করতে হবে। কোন ঋণ প্রদানকারীর সংস্থার পরামর্শে বা শর্ত পূরণের জন্য ঋণ গ্রহণ করা হলে কাঙ্খিত সাফল্য পাওয়া সম্ভব নয়।

বিগত দিনে এডিবি, বিশ্ব ব্যাংক, আই এম এফ ঋণপ্রদানকারী স্ংস্থার পরমার্শে রেলওয়ের বিভিন্ন উন্নয়ন বিনিয়োগ করা হয়েছে। এখন এ সব সংস্থার পরার্মশে ও চাপে রেলকে প্রাইভেটাইজ করার পায়তারা করছে। বাংলাদেশ রেলওয়ে শুধু একটি রাষ্ট্রীয় সেবা প্রতিষ্ঠানই নয়। এ প্রতিষ্ঠানের সাথে জড়িয়ে আছে ঐতিহ্য, সাংবিধানিক অধিকার, রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা, পরিবেশ, জ্বালানি, দারিদ্র বিমোচন, জনগণের অধিকারের বিষয়সমূহ। রেলের মতো একটি রাষ্ট্রীয় সম্পদ বেসরকারীকরণ করা হলে রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা বিঘিœত হবে এবং অর্থনীতিতে বিপর্যয় নেমে আসায় জনগণ একটি চক্রের কাছে জিম্মি হবে। রেলওয়েকে বেসরকারীকরণের ফলে বিশাল জনগোষ্ঠী এবং সম্পদের ক্ষতি করা হয়।

রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠার বেসরকারীকরণ সমাধান নয় বরং দেশীয় বিশেষ্ণগদের রেল উন্নয়নের লক্ষ্যে সরকারকে সঠিক ও যুগোপযোগী পরামর্শ দিয়ে রাষ্ট্রীয় এই প্রতিষ্ঠানকে সতিকার জনসেবামূলক প্রতিষ্ঠানে রূপান্তরের জন্য পদক্ষেপ গ্রহণ প্রয়োজন। ঋণপ্রদানকারী সংস্থাগুলোর চাপে রেলের বিরাষ্ট্রীয়করণ বন্ধে সরকারকে সঠিক পরামর্শ ও সমর্থন দিয়ে সহযোগিতা করা আমাদের সকলের কর্তব্য।

সৈয়দ মাহবুবুল আলম
নীতিবিশ্লেষক

যাতায়ত পরিকল্পনায় পথচারীদের স্থান নেই


যাতায়ত পরিকল্পনায় পথচারীদের স্থান নেই

রাস্তা পথচারীদের জন্য চলাচলের জন্য। অধিকাংশ মানুষ যে মাধ্যমে চলাচল করে যে মাধ্যমকেই অগ্রাধিকার প্রধান করা উচিত। কিন্তু আমাদের দেশের অধিকাংশ মানুষের সুবিধাকে উপক্ষো করে প্রধান্য দেওয়া হয় ধনীদের যানবাহন চলাচলকে। গুটি কয়েক মানুষের সুবিধা নিশ্চিত করে গিয়ে এক দিকে যেমন সৃষ্টি হচ্ছে যানজট, অপর দিক অধিকাংশ মানুষ স্বীকার হচ্ছে দুর্ভোর্গের। গবেষনায় দেখা যায় ঢাকা শহরের ৭৬% শতাংশ মানুষ ৫ কিলোমিটারে মধ্যে চলাচল করে, তার অর্ধেক হেটে চলাচল করে। কিন্তু ঢাকা শহরের মানুষের হাঁটার অবস্থা কি তা সকলের জানা। পেডিট্রাইন ফার্ট পলিসি বলা হলেও আসলে বাস্তবিক পলিসি হচ্ছে ব্যবসা ও ধনীদের জন্য। আর তাই কোটি কোটি টাকার খচরের পরও যানজট অস্বাভাবিক বৃদ্ধি পাচ্ছে। নতুন নতুন প্রকল্প আসছে, সমস্যার সমাধান না হলেও ঋণ প্রদানগোষ্টীর অব্যাহত ঋণের ব্যবসাও কিছু লোকের ব্যবসা হবে তা সুনিশ্চিত। প্রতিটি মানুষকে যাতায়াতের জন্য কিছুটা হাঁটতে হয়। নিম্নবিত্ত বা দরিদ্র মানুষের জন্য হাঁটাই একমাত্র প্রধান মাধ্যম। হাঁটার ক্ষেত্রে অনেকগুলো প্রতিবন্ধকতা থাকলেও, আজকের হাঁটার ক্ষেত্রে ফুটওভার ব্রিজের ভূমিকা কতটুকু তা তুলে ধরছি।

ঢাকা শহরের পথচারীদের জন্য উন্নতব্যবস্থার কথা বললেই, একটি বিষয় বেশ জোরশোরে উচ্চারিত হয় তা হল ফুটওভার ব্রিজ। নগর পরিকল্পনাবিদ ও আইন প্রয়োগকারী সংস্থাসহ বিভিন্ন মহলের অভিযোগ রয়েছে, পথচারীরা ফুটওভার ব্রিজ ব্যবহার করে না। ঋণ প্রদানকারীসংস্থাগুলো ঋণ নিয়ে ঢাকা শহরে অনেক ফুটওভার ব্রিজ তৈরি হয়েছে। পথচারীরা পথপারপারের জন্য ব্যবহার করেনি, ব্যবহার হয়েছে অসামাজিক কাজ ও মলমুত্র ত্যাগের জন্য। আবার টাকা খরচ করে এগুলো তুলে নেয়া হয়েছে। জনগনের টাকা খরচ করে এ ভাঙ্গা গড়ার খেলা একটি উদ্দেশ্য তা হলো ব্যবসা। আর অপর উদ্দেশ্য বুঝতে বেশ সময় লেগেছে তা হলো গাড়ীকে নির্ভিগ্নে চলাচলের সুযোগ করে দেওয়া।

তবে বিস্ময়ের বিষয় হচ্ছে মানুষ এগুলো ব্যবহার না করলেও পরিকল্পনাবিদরা এগুলো গড়ার জন্য কেন অব্যাহত পরামর্শ প্রদান করে আসছে। এগুলো কেন পথচারীরা ব্যবহার করে না তা একবারও ভেবে দেখা হয় না। সম্প্রতি আরো ফুটওভার ব্রিজ করার পরিকল্পনা করা হয়েছে। বিগত সময়ে ঢাকা শহরের উপর নিচে অনেক ধরনের যাতায়াতের ব্যবস্থা হয়েছে। কিন্তু কাজে আসেনি কোনটি। মানুষ উপর দিয়েই চলাচল করে। কিছু স্থানে পুলিশের মাধ্যমে মানুষকে ফুটওভার ব্রিজে উঠানো হচ্ছে, তারপরও মানুষ সুযোগ পেলেই উঠে না। কর্তৃপক্ষ ও পরিকল্পনকারীদের অব্যাহত অভিযোগ মানুষ ফুটওভার ব্রিজে উঠে না? আমরা প্রশ্ন কেন উঠবে? যারা পরিকল্পনা করেন তা কি এগুলো নিয়মিত ব্যবহার করেছেন? পরীক্ষা করে দেখেছেন এগুলো ব্যবহারে প্রতিবন্ধকতা কোথায়? এগুলো ব্যবহারের কত পরিমান কষ্ট হয়? দেখেনি বলেই আপনারা এ ধরনের একটি অমানবিক বিষয়কে চাপিয়ে দিতে চান। অপর দিকে যেহেতু ফুটওভার ব্রিজ মানুষের সহজাত বৈশিষ্ট্য এর সাথে সঙ্গতিপূর্ণ নয়, তাই মানুষ ফুটওভার ব্রিজ ব্যবহারে করে না। একবার কি ভেবে দেখেছেন একজন বৃদ্ধ মানুষ, হৃদরোগী, শিশু, গর্ভবতী মহিলার পক্ষে কি সক্ষম এ পর্বত অতিক্রম করা? একজন অসুস্থ্য রোগে কি পারবে এই পর্বত অতিক্রম করতে? হুইল চেয়ারে বাস একজন ব্যক্তি কিভাবে এই পর্বত অতিক্রম করবে?

যখন ফুটওভার ব্রিজ দিয়ে পথচারীদের পারাপারের পরিকল্পনা করা হয়, তখন নিশ্চিতই এই বিষয়গুলো চিন্তা করা হয় না। যদি চিন্তা করা হতো, তবে প্যাডিট্রাইন ফার্ষ্ট পলিসির নামে মানুষকে পর্বত অতিক্রমের জন্য চাপ প্রদানের কথা আসতো না। ধরুন একজন মানুষকে ঢাকা সিটি কলেজ হতে নীলক্ষেত এবং নিউমার্কেট হয়ে আবার ঢাকা কলেজ আসতে হবে। এই পথ অত্রিক্রম করতে তাঁকে দুটি ওভারব্রিজে উঠতে হবে। যদি তার হতে মালামাল থাকে, তবে তার শারীরিক অবস্থা কি হবে তা কি ভেবে দেখেছেন। একজন মানুষ যখন হাটে তখন এমনিতেই তাকে অনেক পরিশ্রম করতে হয়, তার উপর যদি তাকে এ ধরনের পর্বত অতিক্রম করতে হয়, তবে এ মানুষ আর অন্য কোন কাজ করতে পারবে না। যারা ফুটওভার ব্রিজ তৈরির পরিকল্পনাও সমর্থন করেন তাদের জন্য একটি অনুরোধ, ঘরে বা গাড়ীতে বসে পরিকল্পনা না করে, নূন্যতম ১৫ দিন এই রাস্তায় একজন সাধারণ মানুষের মতো হেটে পরীক্ষা করে দেখুন, আপনি নিজে পারেন কি না? যদি পরীক্ষা পাস করতে পারেন তাহলেই পরিকল্পনার জন্য সুপারিশ করুন। তবে যদি অধিকাংশ সাধারণ মানুষ আপনাদের পরিকল্পনা বিষয়বস্তু না হয়ে থাকে এবং ধনীদের বাহন গাড়ীর যাতায়াত নিশ্চিত করতে চান, তবে আমার বক্তব্য প্রাসঙ্গিক নয়।

বাংলাদেশে অনেক লোক আর্থেপেটিক্স এ ভোগে। অনেকেই লোক হৃদরোগে আক্রান্ত। অনেক লোক শারিরীক প্রতিন্ধী। অনেক লোক আছে হাঁটা যাদের যাতায়াতের অন্যতম মাধ্যম। বলুন তো এ লোকগুলো কিভাবে এই পর্বত অতিক্রম করবে। আসলে যারা এই ফুটওভার ব্রিজের পরিকল্পনা করেন তারা হয়তো শৌখিন পথচারী। ঘরে বসে ও গাড়ীতে চড়ে পরিকল্পনা করতে করতে তারা সাধারণ মানুষের হাঁটতে কি কষ্ট হয় তা ভুলে গেছেন। সাধারণ মানুষের যাতায়াত সুবিধা নিশ্চিত করা করা তাদের মাথাব্যাথা নয়। নিশ্চিত করতে হবে গাড়ীর চলাচল। কারণ হয়তো তাদের চিন্তা হচ্ছে মানুষ হচ্ছে গাড়ীর সেবা দাস।

প্যাডিট্রাইন ফার্ষ্ট পলিসি হিসেবে, পথচারীরা অগ্রাধিকার পাবে। সে ক্ষেত্রে মানুষের হাঁটার জন্য বিভিন্ন সুবিধা নিশ্চিত করা হবে। উন্নত দেশের অভিজ্ঞতা আলোকে বলা যায়, রাস্তায় মানুষের বসার জন্য একটু বসার ব্যবস্থা থাকবে, জ্রেবা ক্রসিং থাকবে, ক্রসিং হেটে চলাচলকারী মানুষ অগ্রাধিকার পাবে। কিন্তু একি অদ্বুত নিয়ম মানুষকে পর্বত সমান ফুটওভার ব্রিজ অতিক্রম করার জন্য পরিকল্পনা করা হচ্ছে। আমি যে ব্যবস্থার কথা বলছি তা কোন অলৌকিক কিছু নয়, এগুলো বাস্তব। আমাদের ঢাকা শহরেরও অনেকগুলো জেব্র“ ক্রসিং ছিল। কিন্তু অলৌকিকভাবে যেগুলো হরিয়ে গেছে। পথচারীদের এখন খাচায় বন্ধী পশুর মতো চলাচল করতে হয়। যে সকল দেশের উদাহরণ ও উপদেশ নিয়ে আমাদের দেশের পরিকল্পনা আর মানবাধিকার নিশ্চিতের কথা বলা হয়, যে সকল দেশের পথচারীদের অবস্থা অনেক উন্নত। এশিয়ার অন্যতম গাড়ী উৎপাদনকারী দেশ জাপানেও পথচারীদের হাঁটতে নানাভাবে উৎসাহিত করা হয়।

হৃদরোগ, ডায়বেটিস, ওবেসিটিসহ বিভিন্ন অসংক্রাম রোগ প্রতিরোধে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের সরকার মানুষকে হাঁটাতে উৎসাহিত করার লক্ষ্যে নানা পদক্ষেপ গ্রহণ করছে। অথচ আমাদের দেশে মানুষকে হাঁটাতে নিরুৎসাহিত করা হচ্ছে। ২ শতাংশ মানুষের পরিবহন প্রাইভেট গাড়ীর পাকিং এবং যাতায়াতের জন্য ফ্লাইওভার ব্রিজ তৈরি করতে কর্তৃপক্ষ যতটুকু চিন্তিত ও সচেতন। ততটুকু পথচারীদের জন্য নয়। কারণ হয়তো পথচারীদের জন্য সুবিধা তৈরি করতে যে ব্যয় হবে তা খুব বেশি নয় এবং দীর্ঘস্থায়ী। প্রতিনিয়ত ব্যবসায়িক ও বিভিন্ন সুবিধা না থাকায় এ ধরনের পরিকল্পনা বর্জন করাই শ্রেয়। অথবা অধিকাংশ সাধারণ মানুষের চলাচলে সুবিধা ও দুভোর্গ লাঘবের জন্য কর্তৃপক্ষ এবং পরিকল্পনাকারীদের বাস্তবিক জ্ঞান যথেষ্ট নয়।

সংবিধান অনুসারে অগ্রসর জনগোষ্টীকে অগ্রাধিকার প্রদান এবং জনস্বাস্থ্যের উন্নয়নে রাষ্ট্রের অন্যতম দায়িত্ব। কিন্তু সরকারী সংস্থাগুলো সাধারণ মানুষের হাঁটার অধিকারকে দুরহ করে সংবিধান লঙ্গন করছে। গুটি কয়েক মানুষের সুবিধার জন্য রাস্তাকে ব্যবহার করা অসংবিধানিক ও অন্যায়। মানুষের সাভাবিক চলাচলকে ব্যহত করে কেন পরিকল্পনার বাস্তবায়ন করা সম্ভব নয়। নূন্যতম হাঁটার পর স্বাভাবিক ভাবেই কোন মানুষ এই পর্বত সমান ফুটওভার ব্রিজ অতিক্রম করতে পারে না। মানুষের শরীর ও মন এই পর্বত অতিক্রম করতে সায় দেয় না। আর এ পর্বত অতিক্রম করার পর অন্য কোন কাজ করা কঠিন। বৃদ্ধ, শিশু, গর্ভবর্তী মহিলা, অর্থোপেটিক্স রোগী, হুইল চেয়ার ব্যবহারকারী, মলামাল বহনকারী, হৃদরোগী ইত্যাদি শ্রেণীর ব্যক্তির জন্য এই পর্বত অতিক্রম শুধু কঠিনই নয় ঝুকিপূর্নও।

মানুষকে হেঁটে চলাচলের উৎসাহী করার মাধ্যমে স্বাস্থ্য, পরিবেশ, অর্থনীতিক উন্নয়ন এবং যানজট হ্রাস করা সম্ভব। তাই দাতা তথা ঋণপ্রদানকারীদের পরামর্শে এধরনের জনস্বার্থ বিরোধী কর্মকান্ড বন্ধ করে। সাধারণ মানুষের যাতায়ত ব্যবস্থার উন্নয়নে সকলকে এগিয়ে আসার আহবান জানাই। অন্যথায় যানবাহন পরিকল্পনা ঋণের অর্থদিয়ে বিগত দিনের যানজট বৃদ্ধিকারী প্রকল্প হিসেবেই এগিয়ে যাবে।

নিরাপত্তাহীনতা ও স্বাস্থ্য ঝুকিতে পথচারী জেব্রা ক্রসিংগুলো নিশ্চিত: ফুটওভারব্রিজ পথচারীবান্ধব নয়

নিরাপত্তাহীনতা ও স্বাস্থ্য ঝুকিতে পথচারী
জেব্রা ক্রসিংগুলো নিশ্চিত: ফুটওভারব্রিজ পথচারীবান্ধব নয়

সিটিকর্পোরেশন, পরিবেশ অধিদপ্তর, রাজউক এবং ট্রাফিক পুলিশের অবহেলা ও উদাসীনতার কারণে নিরাপত্তাহীনতা ও স্বাস্থ্য ঝুকিতে পথচারী। আর্দশ নগর যোগাযোগ ব্যবস্থায় পথচারী পারাপারের চলাচলের জন্য ভাল ফুটপাত ও জেব্রা ক্রসিং থাকার প্রয়োজন হলেও, ঢাকা শহরের অধিকাংশ এলাকায় জেব্রা ক্রসিং নেই। অপর দিকে ফুটপাতগুলো পরিবেশ সম্মত নয় এবং ফুটপাত দখলের জন্য হকারদের দোষী করা হলেও, ঢাকা অধিকাংশ ফুটপাত এখন দখল করে রাখবে প্রাইভেট গাড়ী। পথচারী পারাপারের জন্য ঢালাওভাবে ফুটওভার ব্রিজ তৈরির কথা বললেও, ফুটওভারব্রিজ মহিলা, শিশু, বৃদ্ধ, মালামালবহনকারী বা প্রতিবন্ধীদের জন্য ব্যব্যহারের অনুনোপযোগী। অপর দিকে প্রচন্ড শব্দদূষণ ও বায়ুদুষণের কারণে পথচারীরা শারিরীক ও মানসিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।

ফুটপাত, জ্রেবা ক্রসিং, বায়ু ও শব্দ দূষণ নিয়ন্ত্রণের জন্য সিটিকর্পোরেশন, পরিবেশ অধিদপ্তর, রাজউক এবং ট্রাফিক পুলিশ বিভাগগুলোর পরিকল্পনা ও বাস্তবায়নের দায়িত্ব থাকলেও এ প্রতিষ্ঠানগুলোর মাঝে পথচারীদের অধিকার রক্ষায় নেই কোন সমন্বয় ও পরিকল্পনা। দিনের পর দিন পরিকল্পনা আর প্রকল্পের সুপারিশে বন্দী পথচারীদের অধিকার। প্রকল্প, লোকদেখানো কার্যক্রম আর গতানুগতিক কার্যক্রমের কাছে আসহায় প্রায় অধিকাংশ মানুষের চলাচল ব্যবস্থা।

ঢাকার যাতায়াত ব্যবস্থার উন্নয়নে প্রণীত এসটিপি পরিকল্পনায় পথচারীদের অগ্রাধিকার প্রদানের কথা বলা হলেও, বাজেটে তার কোন বরাদ্ধ নেই। ফুটপাত ভাঙ্গাগড়া এবং হকার উচ্ছেদের মাঝেই ফুটপাত উন্নয়নের কাজ সীমাবদ্ধ। পরিবেশবিদ ও নগর যাতায়াত গবেষকদের মতে ফুটপাতগুলোকে পথচারীবান্ধব করতে গাছের ছায়া, বসার ব্যবস্থা, নির্দিষ্ট দুরুত্বে টয়লেটের ব্যবস্থা করা প্রয়োজন। পথচারীদের জন্য ফুটপাত নিরাপদ এবং আকৃষ্টময় করতে ফুটপাতের পাশে হকারদের লাইসেন্স-র এর মাধ্যমে বসার ব্যবস্থা করার সুপারিশ করেন। গবেষকদের মতো পথচারীদের হাটাঁর অভ্যাস বৃদ্ধির মাধ্যমে সরকার যানজট নিয়ন্ত্রণ, সামাজিক সম্পর্ক বৃদ্ধি এবং রোগপ্রতিরোধ ব্যবস্থার বিষয়কগুলো নিশ্চিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালণ করতে পারে।

এসটিপি পরিকল্পনায় পথচারীদের অগ্রাধিকার থাকলেও সরকারের সংশ্লিষ্ট বিভাগগুলো যানবাহনের সুবিধা এবং বানিজ্য নির্ভর প্রকল্প ফ্লাইওভার, পার্কিং, ওভারপাস ইত্যাদি ব্যবসা নির্ভর প্রকল্প নিয়ে ব্যস্ত। রাজউক মার্কেট বা আবাসন প্রকল্পে গাড়ীর পার্কিং সুবিধা নিশ্চিত করলেও, পথচারীদের যাতায়াতের জন্য কোন নির্দেশনা প্রদানের করছে না। সিটিকর্পোরেশন, ট্রাফিক পুলিশ এবং রাজউকের উদাসীনতা বা অবহেলার ঢাকার মতো মেগাসিটি পথচারীদের নিরাপত্তা বিঘ্ন হচ্ছে। রাস্তা পরাপার করতে গিয়ে মানুষ আহত হচ্ছে। শিশু, বৃদ্ধ, মহিলা ও প্রতিবন্ধীদের জন্য এ শহরের হাটার পরিবেশ নেই।

শব্দদুষণ ও বায়দুষণ দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। পরিবেশ অধিদপ্তরের কার্যক্রম বিভিন্ন প্রকল্পেই সীমাবদ্ধতা। বাস্তবায়নে অধিদপ্তর কখনো কখনো মোবাইল কোর্ট পরিচালনা করে। শব্দদুষণ ও বায়দুষনের জন্য জরিমানার ক্ষমতা পরিবেশ অধিদপ্তরের নিকট থাকায় ট্রাফিক পুলিশ শব্দদুষণ ও বায়দুষনের ক্ষেত্রে কোন পদক্ষেপ গ্রহণ করতে পারছে না।

বহুতল ভবনে অগ্নিকান্ড: প্রাসঙ্গিক ভাবনা

বহুতল ভবনে অগ্নিকান্ড: প্রাসঙ্গিক ভাবনা
বহুতল ভবনের প্রচলন এদেশে খুব বেশি দিনের না হলেও এরই মধ্যে ঢাকা শহরে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক বহুতল ভবন বিদ্যমান। প্রচলিত বিধি বিধান অনুসারে বহুতল ভবন সম্পর্কে অনেকগুলি দিক নির্দেশনা রয়েছে। বিশেষ করে অগ্নি প্রতিরোধ এবং নির্বাপণ সম্পর্কে রয়েছে মোটামুটি সুস্পষ্ট দিক নির্দেশনা। এগুলির যথাযথ বাস্তবায়ন এবং তদারকির অভাবে ঝুঁকির আশঙ্কা বেড়ে চলেছে। যার প্রমাণ মিলতে শুরু করেছে বড় বড় খেসারত দেওয়ার মধ্য দিয়ে।

গত ১৩ মার্চ রাজধানী ঢাকার বসুন্ধরা সিটি ভবনে সংঘটিত হলো ভয়াবহ অগ্নিকান্ড। সেখানে ৭ জন নিহত এবং প্রায় ৫০ জন আহত হয়েছেন। বিনষ্ট হয়েছে কোটি কোটি টাকার সম্পদ। এই আগুন নেভাতে ও সামগ্রিক পরিস্থিতি সামাল দিতে নিয়োজিত করা হয়েছিল সংশ্লিষ্ট সামরিক ও বেসামরিক সকল সংস্থাকে। কয়েক ঘন্টার জন্য এই ঘটনাকে কেন্দ্র করে ঢাকার জীবন স্থবির হয়ে পড়েছিল। আগুনের কারণে ঐদিনের সব ক্ষতিই পুষিয়ে নেওয়া সম্ভব হবে। কিন্তু প্রাণের ক্ষতিগুলো অপূরণীয়। ২০০৭ সালে বসুন্ধরা সিটি ভবনের অদূরেই বিএসইসি ভবনে সংঘটিত হয়েছিল আরেকটি ভয়াবহ অগ্নিকান্ড। আমরা এ ধরনের ঘটনার পুনরাবৃত্তি আর দেখতে চাই না।

এর জন্য বহুতল ভবনের অগ্নি নির্বাপণের জন্য ইমারত নির্মাণ বিধিমালা ও অগ্নি প্রতিরোধ ও নির্বাপণ আইন অনুযায়ী যে সকল ব্যবস্থা থাকার কথা সেগুলি নিশ্চিত করা প্রয়োজন। এছাড়া সেসব যেন যথাসময়ে ব্যবহার করা যায় তার জন্য প্রশিক্ষিত দল থাকাটাও আবশ্যক। থাকতে হবে নিয়মিত অগ্নি নির্বাপণ মহড়ার ব্যবস্থাও। কারণ সর্বশেষ অগ্নিকান্ড ঘটে যাওয়া বসুন্ধরা সিটিতে বিদ্যমান বিধি বিধান অনুসারে প্রায় সকল ব্যবস্থা থাকা সত্ত্বেও ব্যবহারিক ক্ষেত্রে দূর্বলতার জন্য মূলত কাঙ্খিত সময়ে আগুন নিয়ন্ত্রণে আনা সম্ভব হয় নি।

নতুন করে ভবন নির্মাণের ক্ষেত্রে উপরোক্ত বিষয়গুলো অবশ্যই যথাযথভাবে প্রয়োগ হওয়া প্রয়োজন। এছাড়া পুরোনো যে সকল বহুতল ভবন রয়েছে সেগুলিতে প্রয়োজনমাফিক ব্যবস্থা নেওয়া জরুরী। বহুতল ভবনে অগ্নিকান্ডের ক্ষয়ক্ষতি শুধুমাত্র এর মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকে না ছড়িয়ে পড়ে আশে পাশে। যেমনটি দেখেছি বসুন্ধরা সিটি ভবনে আগুন লাগার পর আশে-পাশের কিছু দোকান ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে।

বহুতল ভবনে অগ্নিকান্ড ছাড়াও ভূমিকম্পের ঝুঁকি প্রতিরোধ কিভাবে হবে সেটিও আমলে নিয়ে এখনই পদক্ষেপ নেওয়া প্রয়োজন। বহুতল ভবন নির্মাণের জন্য কোথায় অনুমোদন দেওয়া হচ্ছে তা সঠিকভাবে নির্ধারণ করার প্রতিও খেয়াল করতে হবে। সেক্ষেত্রে আশ পাশে জলাশয় ও যথেষ্ট পরিমাণে ফাঁকা স্থান আছে কিনা দেখতে হবে। বহুতল ভবনের অন্যান্য প্রভাব যেমন-যানজট, বিদ্যূৎ ব্যবস্থাপনা সম্পর্কেও যাচাই বাছাই করা জরুরী।

রাজধানী ঢাকায় অগ্নিঝুঁকি বাড়ছে। শুধুমাত্র বহুতল ভবনের অগ্নিকান্ড নয়, বস্তি থেকে শুরু করে বানিজ্যিক ও আবাসিক এলাকাসহ সর্বত্রই এ ধরনের দূর্ঘটনা প্রতিরোধে যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।

১.১ বহুতল ভবন ও যানজট:
ঢাকায় যানজট অন্যতম একটি সমস্যা। যত্রতত্র স্থাপনা গড়ে ওঠার কারণে এই সমস্যা আরো প্রকট আকার ধারণ করছে। একটি বহুতল নির্মাণের পূর্বে চিন্তা করা হয় না এখানে কি পরিমান যাতায়াত সংঘটিত হবে। যাচাই বাছাই করা হয় না পুরো ট্রাফিক সিস্টেমে তার প্রভাব সম্পর্কে। এ ধরনের কর্মকান্ডের দরুন নগরবাসীকে পোহাতে হয় এক নিদারুন বিড়ম্বনা। এ ধরনের পরিস্থিতি যেন মোকাবিলা করতে না হয় সে বিষয়ে পূর্বেই সতর্কতার সঙ্গে পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। এ বিষয়ে জাপান গার্ডেন সিটি ভবনের কথা বলা যেতে পােের। যে সকল বহুতল ভবন বা বৃহৎ প্রকল্প বাস্তবায়নাধীন সেগুলি থেকে সৃষ্ট যানজট সমস্যা কিভাবে মোকাবিলা করা যায় সে সম্পর্কে এবং নতুন করে প্রকল্প অনুমোদনের পূর্বে সঠিক দিক নির্দেশনা থাকা জরুরী।

১.২ বহুতল ভবন ও বিদ্যুৎ সঙ্কট:
দেশে বিদ্যুৎ ঘাটতি একটি স্থায়ী সমম্যা হিসেবে দেখা দিয়েছে। লোডশেডিংয়ের কারণে শিল্প কলকারখানায় উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে, সেচের কাজে বিঘœ ঘটছে খাদ্য ঘাটতি থাকার পরও, এখন পর্যন্ত সারাদেশে প্রতিটি বাড়িতে অন্তত একটি বাল্ব জ্বালানোর ব্যবস্থা করার কথা ভাবাও যায় না, যাতে শিশুদের পড়ালেখা সহজ হয়। অথচ বহুতল ভবনগুলিতে নিরবিচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ প্রবাহ নিশ্চিত করা হচ্ছে। যেখানে লিফট, এসকেলেটর ও এসি পরিচালনার জন্য প্রচুর বিদ্যুৎ ব্যবহার করা হয়ে থাকে। এখানেও দেখতে হবে সমতা বিধান করা যায় কিভাবে। দেশের প্রতিটি মানুষ কর প্রদান করে থাকে রাষ্ট্রীয় কিছু সুবিধা পেতে। অথচ যারা বড় বড় শপিং মল গড়ে নিজেদের প্রতিষ্ঠানের ব্যপ্তি বাড়াচ্ছে তাদের জন্য আপামর জনসাধারণ দূর্ভোগ পোহাবে কেন। তারাতো নিজেরাই এক্ষেত্রে বিনিয়োগের জন্য এগিয়ে আসতে পারেন। সেক্ষেত্রে রাষ্ট্রীয়ভাবে নীতিমালা প্রণয়ন করা প্রয়োজন। যেন বহুতল ভবনসহ এ ধরনের বৃহৎ প্রকল্পে নিজস্ব বিদ্যুৎ উৎপাদনের ব্যবস্থা করা হয়। আশা করি এ বিষয়ে প্রকল্প কর্তৃপক্ষের উদ্যেগ থাকবে।

উপরোক্ত বিষয়গুলো বিবেচনায় নিয়ে সমন্বিত পরিকল্পনার মাধ্যমে নগর উন্নয়ন করা হলে অগ্নিকান্ড থেকে শুরু করে অন্যান্য ঝুঁকি হ্রাস করা সম্ভব হবে। সেক্ষেত্রে নগরের কোন কোন এলাকায় বহুতল ভবন নির্মাণ করা হবে তার সুস্পষ্ট উল্লেখ থাকা প্রয়োজন। আশা করি বর্তমানে প্রণয়নের প্রক্রিয়াধীন ডিটেইলড এরিয়া প্লান-এ বিষয়গুলো সংযোজন করা হবে।

বহুতল ভবনের অন্যান্য ঝুঁকি হ্রাসে করষীয় :
ক্স সমন্বিত নীতিমালার ভিত্তিতে বহুতল ভবনের অনুমোদন দেয়া।
ক্স বহুতল ভবনের নকশা সংশ্লিষ্ট বিভাগ কর্তৃক ছাড় করনের পর নির্মাণ ও অনুমতি সাপেক্ষে ব্যবহারের জন্য চালু করা।
ক্স বহুতল ভবনের পাশে যথেষ্ট পরিমানে ফাঁকা স্থান রাখা।
ক্স বহুতল ভবনের পাশে জলাশয় রাখা।
ক্স সড়কে ট্রাফিক ব্যবস্থা স্বাভাবিক থাকবে কিনা যাচাই সাপেক্ষে বহুতল ভবন নির্মাণের অনুমোদন করা।
ক্স বহুতল ভবনের অভ্যন্তরে অগ্নি নির্বাপনের সকল ব্যবস্থা রাখা ও নিয়মিত মহড়ার ব্যবস্থা করা।
ক্স বস্তি এলাকার পাশে পানির ব্যবস্থা রাখা ও বস্তিবাসীকে নিয়ে নিয়মিত মহড়া করা
ক্স ফায়ার সাভির্সের উন্নয়ন করা।
ক্স স্কুল-কলেজসহ সকল সরকারী বেসরকারী প্রতিষ্ঠানে নিয়মিত অগ্নি নির্বাপণ মহড়া করা।

জনস্বাস্থ্য ও পরিবেশ রক্ষায় সাইকেলে চলাচল উপযোগী পরিবেশ সৃষ্টি করা প্রয়োজন

জনস্বাস্থ্য ও পরিবেশ রক্ষায়
সাইকেলে চলাচল উপযোগী পরিবেশ সৃষ্টি করা প্রয়োজন

সারা বিশ্বে সাইকেল দীর্ঘদিনের পরীক্ষিত বাহন এবং দূষণ ও জ্বালানীমুক্ত বাহন হিসাবে যাতায়াত ব্যবস্থায় এর গুরুত্ব অপরিসীম। নিয়মিত সাইকেলে চলাচলের মাধ্যমে মুটিয়ে যাওয়া, ব−াড প্রেসার, স্ট্রোক, হৃদরোগ ও ডায়াবেটিসের মতো জটিল অসংক্রামক রোগসমূহ প্রতিরোধ করা যায়। রাস্তায় চলাচলের ক্ষেত্রেও সাইকেল খুব কম জায়গা দখল করে। যা যানজট নিয়ন্ত্রণের পাশাপাশি নানামূখী সুবিধা অর্জনে সহায়ক।

প্রতিদিন ৩০ মিনিট অথবা বছরে ২১০০কিমি সাইক্লিং করলে ৫০ভাগ মুটিয়ে যাওয়া, ৩০ভাগ ব্ল¬াড প্রেসার, ৫০ভাগ হৃদরোগ, ৫০ভাগ ডায়াবেটিসের ঝুঁকি হ্রাস পায়। প্রাইভেট কার যানজট সৃষ্টির অন্যতম কারণ। এছাড়া যান্ত্রিক যানবাহনের আধিক্যে বৃদ্ধি পাচ্ছে বায়ূ ও শব্দদূষণ এবং সড়ক দূর্ঘটনা বিশ্বে পরিবহণ খাতে জীবাশ্ম জ্বালানী ব্যবহারজনিত কারণে ২৫শতাংশ কার্বন নির্গমণ হয়, যা জলবায়ু পরিবর্তনের অন্যতম কারণ। ঢাকায় ৭৬ ভাগ যাতায়াত হয় ৫ কি.মি. এর মধ্যে, যার অর্ধেক আবার ২ কি.মি. এর কম। উপযুক্ত পরিবেশ সৃস্টি করা গেলে এই দূরত্বে হেঁটে এবং সাইকেলে করেই যাতায়াত করা সম্ভব।

বিশ্বের উন্নত দেশগুলিতে নগরকেন্দ্রিক যাতায়াত ব্যবস্থায় হাঁটাকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেওয়া হয়। এরপরই প্রাধান্য দেওয়া হচ্ছে সাইকেলে চলাচলকারীদের। সাইকেল ব্যবহারের একটি উত্তম উদাহরণ হচ্ছে ডেনমার্ক। ২০০৭ সালের হিসাবমতে, ডেনমার্কে সাইকেলে ৩৬ ভাগ যাতায়াত হয়েছে এবং তারা উদ্যোগ গ্রহণ করেছে ২০১৫ সাল নাগাদ সাইকেলে ৫০ ভাগ যাতায়াত করবে। সেখানে তুষারপাতের মধ্যেও সাইকেল ব্যবহারকারীদের ৭০ ভাগ মানুষ সাইকেলে করেই যাতায়াত করেন।

ঢাকায় সাইকেলে চলাচলের ক্ষেত্রেও নানাধরনের প্রতিবন্ধকতা রয়েছে। যান্ত্রিক যানবাহনের সঙ্গে একই লেনে সাইকেলে চলতে অনেকেই নিরাপত্তা বোধ করেন না। সাইকেল নিয়ে গন্তব্যে পৌঁছানোর পর রাখার মতো নিরাপদ ব্যবস্থা নেই। পৃথক লেন, পথ ও স্ট্যান্ড তৈরি করা হলে সাইকেলে চলাচল উৎসাহিত হবে। সাইকেলের উপর কর কমানো, কারখানার প্রসারে উদ্যোগ গ্রহণ করা প্রয়োজন।

ঢাকা শহর তথা সারা বাংলাদেশে যাতায়াত ব্যবস্থায় সাইকেলকে প্রাধান্য দিয়ে সঠিক পরিকল্পনা গ্রহণ ও তার যথাযথ বাস্তবায়ন করা প্রয়োজন। সঠিক পরিকল্পনা ও তার যথাযথ বাস্তবায়ন সাইকেলে চলাচলে উৎসাহিত করবে। যা পরিবেশ, অর্থনীতি ও স্বাস্থ্যগত উন্নয়ন এবং জ্বালানী নির্ভরতা হ্রাসে ভূমিকা রাখবে। পাশাপাশি শহরকে আন্তরিক ও বসবাসযোগ্য করতে সাহায্য করবে। সাইকেলকে জনপ্রিয় করার লক্ষ্যে বিশ্বের অনেক দেশেই নানা ধরনের উদ্যোগ নেয়া হচ্ছে। আসুন, নিজেদের এবং ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য সাইকেলে চলাচল উপযোগী পরিবেশ সৃষ্টির লক্ষ্যে সকলে একযোগে কাজ করি।

ইকো নগরায়ন: কিছু মৌলিক বিষয়

পরিবেশ দূষণ বর্তমানে মানুষের স্বাস্থ্য সমস্যার একটি বড় কারণ। পরিবেশ দুষণের কারণে প্রাকৃতিক বিপর্যয়সহ নানা ধরনের প্রতিবন্ধকতার সম্মুখীন হচ্ছে মানব সভ্যতা। ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে অর্থনীতি, উন্নয়ন, মানুষের বিকাশ। নগরায়ন ও শিল্পায়ন পরিবেশ দূষণের অন্যতম প্রদান কারণ। কিন্তু এ সত্য জানার পরও থেমে নেই পরিবেশ দূষণের মাত্র। দিন দিন তা বৃদ্ধি পাচ্ছে। অর্থনৈতিক উন্নয়নের অজব লক্ষে জিডিপি বৃদ্ধির উম্মদনায় ধ্বংশ করা হচ্ছে পরিবেশ, মানবতা, স্বাস্থ্য, সংস্কৃতি। জিডিপির অংক বৃদ্ধি পেলে অন্যান্য সমস্যাগুলোর সাথে বাড়ছে দারিদ্র মানুষের ভোগান্তি আর বিনষ্ট হচ্ছে সামাজিক স¤প্রতি। ধনী আরো ধনী হচ্ছে, গরীব আরো গবীর হচ্ছে। নগরগুলো হচ্ছে শোষনের আবাসস্থল। অধিকাংশ মানুষের সুবিধাকে ছিনিয়ে উন্নয়নে নামে করা হচ্ছে নগরায়ন।

শত বছরের পুরাতন এই ঢাকা নগরীতে হাজার হাজার কোটি টাকা খচর করার পরও বিজ্ঞজনের আশংকা এই নগরী মানুষের বসবাসের অযোগ্য হয়ে পড়ছে। এই নগরীর পরিবেশ দূষণ, যানজট, স্বাস্থ্য, পানি, শিক্ষা, যোগাযোগ কোন বিষয়েই পরিবেশ বান্ধব হয়নি। বরং দিন দিন খারাপ হচ্ছে। অথচ একদিন এই শহরই ছিল একটি আর্দশ নগরী। কিভাবে ধ্বংশ করা হলো সেই পরিবেশ বান্ধব নগরীকে, কেন করা হলো? কেন সমস্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে? আমাদের পরিকল্পনা মৌলিকতা কি কোন ভূল আছে? না এ প্রশ্ন খোজার চেষ্টা হয়নি। বরং একটি ভুলকে ঢাকতে আরো একটি ভূল করা হচ্ছে। সবচেয়ে ভয়কর বিষয় হচ্ছে ঢাকা নগরীর পরিকল্পনাগুলো দেশের অন্য এলাকাগুলোতেও করার চেষ্টা করা হচ্ছে। বিগত দিনের ভুলগুলো হতে শিক্ষা নিয়ে পরিবেশ, অর্থনীতি ও মানুষের স্বাস্থ্য রক্ষায় একটি পরিবেশ বান্ধব নগরী গড়ার কোন বিকল্প নেই।

উন্নত জীবনের সন্ধানে এই নগরে ছুটে আসলেও, এ নগর মানুষের উন্নত জীবনের অন্তরায়। জীবন ধারনের অন্যতম প্রধান উৎপাদন বায়ু, শব্দ, পানি দূষণ কারণের মানুষ বিভিন্ন প্রানঘাতী রোগে আক্রান্ত হচ্ছে। নগরের যাতায়াত ও অবকাঠামোর প্রতিবন্ধকতার কারণে হ্রদরোগ, স্ট্রোক, ডায়বেটিক অতিরিক্ত মোটা হওয়াসহ নানা ধরনের অসংক্রামক রোগ বৃদ্ধি পাচ্ছে। খেলাধুলা ও পর্যাপ্ত বিনোদনের অভাবের কারণে শিশু-কিশোরদের মানসিক ও শারিরীক বিকাশ বাধাগ্রস্ত হচ্ছে।

একটি শহরের পরিকল্পনা নাগরিকদের দৈনন্দিন জীবন এবং কার্যক্রমকে নানাভাবে প্রভাবিত করে। নগর পরিকল্পনা হওয়া প্রয়োজন মানুষের কথা মাথায় রেখে। একটি সুষ্ঠু সুন্দর পরিবেশবান্ধব পরিকল্পিত নগরী দক্ষ মানবগোষ্ঠী গড়ে তুলতে সহায়ক। গণমুখী টেকসই সমন্বিত নগর পলিল্পনা প্রণয়নের মাধ্যমে মানুষের জীবনযাত্রার মান যেমন উন্নত হবে, তেমনি একটি আন্তরিক, পরিবেশবান্ধব বসবাস উপযোগী শহর গড়ে তোলা সম্ভব।

আমাদের শহরগুলো হওয়া উচিত এইরূপÑযেখানে বাসস্থানের পাশাপশি প্রচুর গাছপালা থাকবে, প্রাকৃতিক পরিবেশ ক্ষতিগ্রস্থ হবে না, শিশুরা ঘরের বাইরে নিরাপদে খেলাধূলার পরিবেশ পাবে, নগরবাসী পাবে একটি সুস্থ বিনোদনের পরিবেশ, প্রতিবেশীদের মধ্যে থাকবে আন্তরিক সম্পর্ক, প্রয়োজনীয় খাদ্যের যোগানের জন্য বাসস্থানের কাছাকাছি পর্যাপ্ত কৃষি জমি থাকবে। যেখানে নগরের গতানুগতিক যান্ত্রিকতা এড়িয়ে আন্তরিকতাপূর্ণ সুন্দর জীবন উপভোগ করা সম্ভব হবে। বর্তমানে সারা বিশ্বব্যপী জলবায়ু পরিবর্তনের ব্যপক প্রভাব পড়ছে। জলবায়ু পরিবর্তন রোধে ইকো নগরায়ন অত্যন্ত কার্যকরী ভূমিকা পালন করতে পারে।

একটি পরিবেশ বান্ধব নগরের জন্য অনেকগুলো বিষয়ে মধ্যে বিনোদন, উম্মুক্ত স্থান, আবাসন, যাতায়াত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। এ পর্যায়ের আলোচনায় একটি শহরের এ বিষয়গুলো কিভাবে নিশ্চিত করা যায় তা সম্পর্কে নিম্নে সংক্ষিপ্ত আলোচনা করা হলো।

বিনোদন ও উম্মুক্ত স্থান
একে অন্যকে সাহায্য, আতিথেয়তা, বন্ধুপরাণয়তা, সুখ-দুখে এগিয়ে আসা এ দেশের সামাজিক রীতিনীতি অংশ। এ কারণে পুরো গ্রাম, মহল্লাকে আবদ্ধ হয় একটি পরিবারের অটুট বন্ধনে। উঠোন, খোলা মাঠ, বাড়ীর সামনে খোলা জায়গা, বৈঠক ঘরগুলো এদেশের মানুষকে মনের ভাব আদান প্রদান ও বিনোদনের সুযোগ করে দিত।

আমাদের অনেকেই সেই ছেলেবেলার স্মৃতিতে ভেসে উঠে সেই সুখের দিনগুলো। কিন্তু কালের আর্বতে হারিয়ে যাচ্ছে সেই সুযোগগুলো। শহর ও নগরগুলোতেও একই সমস্যা। নেই খেলাধূলা, হাঁটা, বাস, মেলামেশার জন্য পর্যাপ্ত জায়গা। ঘরে বন্দী মানুষগুলো সীমিত হচ্ছে মেলামেশার সুযোগগুলো, বাড়ছে দুরুত্ব। এ দুরুত্ব বৃদ্ধি করছে হাতাশা, একাকীত্ব, অপসংস্কৃতি, নিরাপত্তাহীনতা, অপরাধ বিনষ্ট করছে সামাজিক সম্পৃতি। মানুষের পরিপূর্ণ মানসিক বিকাশ, বিনোদন, খেলাধূলা এবং শরীরচর্চা, সামাজিক নিরাপত্তা বৃদ্ধিতে পার্ক ও পাবলিক স্পেস এর গুরুত্ব অনেক বেশি।

বিনোদন মানুষের অধিকার। মানুষের পরিপূর্ণ মানসিক বিকাশের জন্য বিনোদন, খেলাধূলা এবং শরীরচর্চার গুরুত্ব অপরিসীম। শুধুমাত্র অবকাশযাপন নয়, বিনোদনকেন্দ্রগুলো সামাজিকীকরণের জন্য আদর্শ স্থান। সর্ব সাধারনের জন্য উন্মুক্ত এসব বিনোদনকেন্দ্রগুলোতে বিভিন্ন শ্রেনীপেশার মানুষ সমবেত হয়, এর মাধ্যমে একে অন্যের সাথে পরিচিত হবার সুযোগ থাকে। ফলে বিভিন্ন মানুষের মধ্যে একটি যোগসূত্র স্থাপিত হয়। সমাজে একটি সুন্দর আদর্শ সামাজিক পরিবেশ বিরাজ করে।

শিশু-কিশোরদের খেলাধুলার সুবিধা প্রদান এবং নগরবাসীর সুস্থ সুন্দর বিনোদনের জন্য শহরগুলোতে পর্যাপ্ত বিনোদনকেন্দ্র, পার্ক, খেলার মাঠ প্রয়োজন। দিনে দিনে ঢাকা সহ ঢাকার বাইরে বিভিন্ন স্থানে মানুষের বাইরে উন্মুক্তস্থানে বিনোদন বা সামাজিক কার্যক্রমগুলোর পরিধি ক্রমশই সংকুচিত হচ্ছে। পরিকল্পনায় ঘাটতি কিংবা সীমাবদ্ধতার কারণে প্রতিনিয়তই মানুষকে এর উন্নয়ন কিংবা সুবিধা বৃদ্ধির জন্য সংগ্রাম করতে হচ্ছে। পরিকল্পনার দৈন্যতার কারণে মানুষ তার এই মৌলিক সুবিধাগুলো থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। খেলার মাঠ, পার্ক কিংবা উদ্যানের সল্পতা কিংবা আবাসিক এলাকায় প্রকৃতির অনুপস্থিতি ক্রমশই মানুষকে গৃহকেন্দ্রিক কিংবা টেলিভিশন নির্ভর করে তুলছে। ফুটপাতে হাঁটার পরিবেশের অভাব কিংবা মাঠে খেলাধুলার পরিবেশের অভাবও প্রকট আকারে পরিলক্ষিত হয়। শিশু, প্রাপ্তবয়স্ক কিংবা বৃদ্ধ বিবেচনায় উন্মুক্তস্থানের পরিকল্পনা প্রণয়ন এবং প্রয়োজনীয় সুযোগ সুবিধা নিশ্চিত করা আবশ্যক। নগর পরিকল্পনা পুরো অবকাঠামোর সাথে সমন্বয় রেখে, পরিকল্পিতভাবে জনসাধারনের জন্য গুনগতমান সম্পন্ন পর্যাপ্ত বিনোদনকেন্দ্র গড়ে তোলা প্রয়োজন।

একটি বিষয় মনে রাখতে হবে বিনোদনকেন্দ্র বলতে শুধুমাত্র বাণিজ্যিকভাবে তৈরী কিছু রাইড সম্মিলিত স্থানগুলো নির্দেশ করে না। বর্তমানে কিছু বিনোদনকেন্দ্র গড়ে উঠছে ব্যক্তিমালিকানাধীনভাবে, ফলে সর্বস্তরের জনগণের জন্য তা উন্মুক্ত হয় না। ফলে মুষ্টিমেয় কিছু মানুষ তা ব্যবহার করতে পারে, সাধারণ মানুষ বিনোদনের সুযোগ পায় না। নিরাপত্তা এবং পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতার বিষয়গুলোর প্রতি দৃষ্টি রেখে পাকর্, খেলার মাঠ এবং উন্মুক্তস্থানগুলো যেন সর্ব সাধারণের ব্যবহার জন্য উন্মুক্ত হয় সে বিষয়টি গুরুত্বের সাথে বিবেচনা করতে হবে।

উন্মুক্তস্থানের বিশেষত্ব হচ্ছে যেখানে সহজেই লোক সমাগম ঘটে এবং সেই জায়গাগুলোতে সামাজিক, সাংস্কৃতিক, বিনোদনমূলক কর্মকান্ড সংগঠিত হয়। যেখানে প্রকৃতি বর্তমান। মানুষে মানুষে যোগাযোগের সুবিধা, আড্ডা কিংবা খেলাধুলার সুবিধা বিদ্যমান। যদি উন্মুক্ত স্থানের পরিবেশে এর ঘাটতি দেখা দেয় তাহলে সেখানে মানুষের আগমন কিংবা প্রাণচাঞ্চল্য হারিয়ে যায়। মানুষের উন্মুক্তস্থানের কর্মকান্ডগুলো আকর্ষনীয় এবং অর্থবহ করে তুলতে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণের পাশাপাশি উন্মুক্ত স্থানের বরাদ্দ এবং পরিকল্পনায় পূর্বেই নজর দেয়া জরুরী।

পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে নগরবাসীর সুস্থ সুন্দর মানসিক ও শারীরিক বিকাশের কথা চিন্তা করে বিনোদন ও খেলাধূলার জন্য বিভিন্ন উদ্যোগ গৃহীত হলেও বাংলাদেশে এ ধরনের উদ্যোগ উপেক্ষিত। বাংলাদেশের বিভিন্ন শহরে বিশেষ করে ঢাকায় বিনোদনের সুযোগ খুবই সীমিত। ঢাকায় হাতে গোনা যে পার্ক ও খেলার মাঠ রয়েছে তা প্রয়োজনের তুলনায় খুবই অপ্রতুল। তবে যে কয়টি পার্ক, মাঠ রয়েছে, প্রয়োজনীয় রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে বর্তমানে এই পার্ক ও খেলার মাঠগুলোর খুবই বেহাল দশা। বর্তমানে এর সাথে যুক্ত হয়েছে অন্য এক নতুন সমস্যা, প্রতি মাসেই নগীরর কোন না কোন মাঠে মেলা বসে। এছাড়া সৌন্দর্যবর্ধনসহ বিভিন্ন অযুহাতে পার্ক, খেলার মাঠগুলো অবৈধভাবে দখল করার প্রচেষ্টা চলে। এভাবেই আরো সংকুচিত হয়ে পড়ছে নাগরিকদের বিনোদনের সুযোগ সুবিধা।

বর্তমানে সীমিত সংখ্যক পার্ক, খেলার মাঠের কারণে শিশু-কিশোররা বঞ্চিত হচ্ছে বাইরে খেলাধূলার এবং বিনোদনের সুযোগ থেকে। তাদের অবসর সময় কাটছে টিভি দেখে বা কম্পিউটারে গেমস্ খেলে, যা তাদের পরিপূর্ণ শারীরিক ও মানসিক বিকাশে বাধা সৃষ্টি করছে। এছাড়া বিনোদনের অপ্রতুল সুযোগ নাগরিকদের দৈনন্দিন কর্মব্যস্ত জীবনকে একঘেয়ে করে তুলছে। শিশু-কিশোরদের খেলাধূলার সুবিধা প্রদান, নগরবাসীর বিনোদনের জন্য শহরগুলোতে পর্যাপ্ত বিনোদনকেন্দ্র হিসেবে পার্ক, খেলার মাঠ গড়ে তোলা এবং পুরোনোগুলোর সংস্কার অত্যাবশ্যকীয়। একই সাথে নগরবাসীর শারীরিক ও মানসিক সুস্থতার কথা চিন্তা করে পায়ে হেঁটে চলাচল ও শরীরচর্চার জন্য উপযুক্ত পরিবেশ তৈরী খুবই গুরুত্বপূর্ণ।

পরিবেশ বান্ধব নগরীর আবাসন ব্যবস্থা
নগর পরিকল্পনায় সর্বপ্রথম আমাদের মনে রাখতে হবে নগর তৈরীর উদ্দেশ্য। একটি শহর গড়ে ওঠে মানুষকে উন্নত কর্মসংস্থান, শিক্ষা ও স্বাস্থ্য সেবা প্রদান, বিনোদনের সুযোগ প্রদান এবং মানুষের পাস্পরিক সম্পর্ক বৃদ্ধির মিলনকেন্দ্র হিসাবে। এই সমস্ত সুবিধাগুলো মানুষের হাতের নাগালের মধ্যেই থাকা উচিত। এই সুবিধাগুলো প্রদানের মাধ্যমেই নগরগুলোকে ধ্বংসের হাত থেকে রক্ষা করা সম্ভব।

নগরের আবাসন সংস্থান করতে গিয়েও আমরা মানুষের কল্যাণের দিকটি চরমভাবে উপেক্ষা করছি। নগরের মধ্যে এবং শহরের নিকটবর্তী স্থানে বিভিন্ন আবাসিক এলাকা গড়ে তোলার ক্ষেত্রে প্লট ভিত্তিক উন্নয়ন করায় মানুষের মধ্যে পারষ্পরিক যোগাযোগের সুযোগ কমে যাচ্ছে। এ ধরনের আবাসিক এলাকায় কাছাকাছি বাজার, শিক্ষা ও স্বাস্থ্য সেবা প্রতিষ্ঠান, অফিস না থাকায় দূরে যাওয়ার প্রয়োজন পড়ে এছাড়া বিনোদনের সুবিধা ও মানুষের মেলামেশার জন্য উন্মূক্তস্থান না থাকায় পারস্পরিক যোগাযোগ ব্যহত হয় । একইভাবে এপার্টমেন্ট ভিত্তিক যে আবাসন ব্যবস্থা গড়ে উঠছে তাতেও মানুষের সাথে মানুষের সামাজিক যোগাযোগের সুযোগ রাখা হচ্ছে না। ফলে আগে আমাদের এলাকা ভিত্তিক যে আন্তরিক পরিবেশ ছিল তা ক্রমেই নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। মানুষের সাথে মানুষের দূরত্ব বেড়ে যাচ্ছে যা সমাজের সার্বিক নিরাপত্তার জন্য হুমকি স্বরূপ।

সুষ্ঠু পরিবহণ ব্যবস্থা গড়ে তুলতে নগর ও পরিবহণ পরিকল্পনার মধ্যে সমন্বয় থাকা প্রযোজন। নগর পরিচালনার সুবিধার্থে এলাকা ভাগ করা হয়ে থাকে। সেক্ষেত্রে মিশ্র এলাকা অথবা পৃথক এলাকা কোনটি হবে তার উপর নির্ভর করে পরিবহণ ব্যবস্থা কেমন হবে। এলাকায় বাসা, স্কুল, বাজার, কর্মস্থল, হাসপাতাল ও বিনোদন অল্প দূরত্বের মধ্যে থাকায় যাতায়াতের চাহিদা হ্রাস করে। মিশ্র এলাকা নির্মাণে কিছু বিষয়ের প্রতি নজর দেওয়া প্রয়োজন। সেটি হচ্ছে মিশ্র এলাকায় কি কি থাকবে এবং কি কি থাকবে না। এছাড়া মিশ্র উন্নয়নের জন্য নির্ধারিত এলাকায় কাঙ্খিত জনসংখ্যা অনুপাতে প্রতিষ্ঠান ও সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করতে হবে। যেন কম বা বেশি কোনটিই না হয় সেদিকে লক্ষ্য রাখতে হবে। এভাবে প্রতিটি এলাকায় প্রয়োজন অনুসারে উন্নয়নের মাধ্যমে এক এলাকা থেকে অন্য এলাকায় যাতায়াতের চাহিদা বেশিরভাগই কমিয়ে আনা সম্ভব হবে ।

ঢাকা’র বেশিরভাগ এলাকার উন্নয়ন মিশ্রভাবে হয়েছে। যার জন্য বেশিরভাগ যাতায়াত অল্প দূরত্বে। গবেষণায় দেখা যায়, ঢাকার ছিয়াত্তর ভাগ যাতায়াত পাঁচ কিমি এর মধ্যে যার অর্ধেক আবার দুই কিমি এর মধ্যে। তবে ঢাকায় এই ধরণের উন্নয়ন সুপরিকল্পিত ও সুষমভাবে না হওয়ায় যানজটসহ বেশ কিছু সমস্যা দেখা দিচ্ছে। এখানে কোন এলাকায় জনসংখ্যা অনুপাতে অধিক প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছে, আবার কোন কোন এলাকায় প্রয়োজনীয় সুযোগ-সুবিধা নেই। এর জন্য বিশেষ কিছু এলাকার দিকে মানুষের বেশি বেশি যাওয়ার প্রয়োজন পড়ছে, সৃষ্টি হচ্ছে যানজট। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, সব এলাকায় ভালো স্কুল না থাকায় শিশুদের স্কুলে আনা-নেওয়ার জন্য দূরে দূরে যাতায়াত করা যানজট সৃষ্টির অন্যতম কারণ। শুধুমাত্র স্কুলে যাওয়া-আসার জন্য ব্যবহার হচ্ছে প্রচুর পরিমাণে গাড়ি। অথচ বাসা থেকে দেড়/দুই কিমি এর মধ্যে স্কুল থাকলে শিশুদের হেঁটেই নিয়ে যাওয়া সম্ভব। এতে সময় বাঁচবে, সাস্থ্য ভালো থাকবে, যাতায়াত খরচ লাগবে না। তবে ক্ষতিকর শিল্প-কারখানা মিশ্র এলাকার বাইরে রাখতে হবে।

ঢাকা মেট্রোপলিটন ডেভেলপমেন্ট প্লান (১৯৯৫-২০১৫) এর অধীনে স্ট্রাকচার প্লান এ মিশ্র এলাকা নির্মাণের দিক-নির্দেশনা রয়েছে। সেই আলোকেই ডিটেইল এরিয়া (ডিএপি) প্লান তৈরি করার নিয়ম। কিন্তু খসড়া ডিএপি-এ কার্যক্রমের ভিত্তিতে পৃথক এলাকা নির্মাণের প্রস্তাব করা হয়েছে। স্ট্রাকচার প্লান অনুসারে ডিএপি প্রণীত হলে ঢাকা শহরকে বাসযোগ্য রাখতে সহায়ক হবে। আশা করি সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ নিয়মানুসারে স্ট্রাকচার প্লান মেনে এবং যাতায়াত চাহিদা হ্রাস করতে ডিএপি-তে মিশ্র গড়ে তোলার প্রতি মনযোগী হবেন।

নগরীর পরিবহন ব্যবস্থা
যানজট শুধু ঢাকা নয়, বিশ্বের অনেক শহরেরই দীর্ঘদিনের একটি সমস্যা। ঢাকা মহানগরীর যানজট নিরসনে ইতিপূর্বে অনেক পদক্ষেপই গ্রহণ করা হয়েছে, যার কোনটির সঙ্গে কোনটির সমন্বয় করা হয় নি। ফলে কাঙ্খিত সমাধান আসেনি। যানজট নিয়ন্ত্রণ ও একটি সুষ্ঠু পরিবহণ ব্যবস্থা গড়ে তুলতে একটি সমন্বিত পরিকল্পনা জরুরী। বর্তমানে পরিবহণ ব্যবস্থার উন্নয়নে বেশ কিছু উদ্যোগ লক্ষ্যণীয়। তবে সেগুলি বাস্তবায়নের পূর্বে দেশীয় এবং বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে আরো ভালোভাবে যাচাই বাছাই করা প্রয়োজন। ঢাকা’র চলমান পদক্ষেপসমূহ বাস্তবায়নের আগে ইতিপূর্বে বাস্তবায়িত কার্যক্রমের ফলাফল বিশ্লেষন করা প্রয়োজন। এসবের সঙ্গে প্রায়োগিক ক্ষেত্রে বাস্তবমূখী ভাবনা যানজট নিয়ন্ত্রণ তথা পরিবহণ ব্যবস্থার উন্নয়নে কার্যকর ভূমিকা রাখবে।

মানুষ বনাম গাড়িকেন্দ্রিক পরিবহণ পরিকল্পনা:
ঢাকায় এ পর্যন্ত গাড়িকে কেন্দ্র করেই পরিবহণ নীতিমালা ও পরিকল্পনাসমূহ তৈরি হয়েছে। সাধারণত এ ধরনের পরিকল্পনা প্রণয়নের ক্ষেত্রে দেখা হয় একটি সড়কে কি পরিমাণ গাড়ি ধারণ করতে পারে অথবা সড়কটি দিয়ে কতগুলি গাড়ি অতিক্রম করতে পারবে। এর উপর ভিত্তি করেই কত বিনিয়োগ এবং কি ধরনের অবকাঠামো নির্মাণ করা হবে সে বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। মানুষের যাতায়াতের প্রয়োজনে গাড়ির প্রয়োজন রয়েছে। এখানে গাড়িই মূখ্য নয়।

পরিবহণ পরিকল্পনার কেন্দ্রবিন্দু হচ্ছে মানুষ। মানুষের যাতায়াতের প্রয়োজনে কোন ধরনের বাহন কি পরিমাণ ব্যবহার করা হবে সেটি পরের বিষয়। প্রথমে দেখতে কি পরিমাণ মানুষের যাতায়াতের প্রয়োজন রয়েছে। যাতায়াতের দূরত্ব কতটুকু এবং কোন মাধ্যমটি সবচেয়ে উপযোগী। উপযোগীতা নিরূপণে যাতায়াত খরচ, সময়, নিরাপত্তা, দূষণ ও জ্বালানী ব্যবহারের মতো বিষয়গুলি বিবেচনায় নিতে হবে। গাড়িকেন্দ্রিক পরিকল্পনায় হেঁটে ও জ্বালানীমুক্ত যানে চলাচলকারীরা অবহেলিত থেকে যায় এবং নানা প্রতিবন্ধকতার সম্মূখীন হয়।

ঢাকা’র পরিবহণ ব্যবস্থার উন্নয়নে চলমান পরিকল্পনা ও পদক্ষেপসমূহ পর্যালোচনা করলে দেখা যায় প্রতিনিয়ত প্রাইভেট কারকে সর্বোচ্চ প্রাধান্য দেওয়া হচ্ছে। এরপর ক্রমানুসারে বাস, রিকশা ও সাইকেল এবং হেঁটে চলাচলকারীরা সকল দিক থেকেই অবহেলা ও নানা প্রতিবন্ধকতার শিকার । অথচ এই ধরনের ব্যবস্থা থেকে সাময়িক সুবিধা পাচ্ছে দুই শতাংশ মানুষ যাদের প্রাইভেট কারের মালিকানা রয়েছে। এখানে সাময়িক সুবিধা এই অর্থে বলা হচ্ছে এই কারণে যে, আর অল্প কিছু সংখ্যক প্রাইভেট কার বৃদ্ধি পেলে বর্তমানকার সুবিধাও থাকবে না। যে সুবিধা তৈরি করা হয়েছে জ্বালানীমুক্ত যান চলাচল নিষিদ্ধ করে এবং হেঁটে ও পাবলিক পরিবহণকে উপেক্ষা করে। ফলশ্রতিতে আটানব্বই শতাংশ মানুষ যাতায়াতের ক্ষেত্রে অধিকার বঞ্চিত থেকে যাচ্ছে।

পরিবহণ পরিকল্পনায় দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন আনতে হবে। বিশ্বব্যাপী নগর পরিবহণ ব্যবস্থায় হেঁটে চলাচলকারীদের প্রাধান্য সর্বাগ্রে । ঢাকায় বেশিরভাগ পায়ে হেঁটে যাতায়াত হয়ে থাকে। আরো বেশি মানুষকে হেঁটে চলাচলে উৎসাহী করতে উপযোগী পরিবেশ সৃষ্টিতে সঠিক পরিকল্পনা, বিনিয়োগ এবং অতিদ্রুত তা বাস্তবায়নে পদক্ষেপ নেয়া প্রয়োজন। এরপর ক্রমানুসারে জ্বালানীমুক্ত যান ও পাবলিক পরিবহণের সুবিধা বৃদ্ধি এবং প্রাইভেট কারের অবস্থান থাকবে সবার শেষে। বর্তমানে ঢাকার বেলায়ও একই কথা বলা হচ্ছে। তবে তা এখন পর্যন্ত কথাবার্তার মধ্যেই সীমাবদ্ধ। এ ক্রমটি বিনিয়োগ ও পরিকল্পনার ক্ষেত্রে নিশ্চিত করা হলে গণমূখী পরিবহণ ব্যবস্থা চালুর পথটি সুগম হবে।

গণমুখী সমন্বিত পরিবহন পরিকল্পনা
আমাদের নগর পরিকল্পনায় পরিবহন ব্যবস্থা এবং তার সাথে সম্পৃক্ত আন্যান্য বিষয়গুলোকে বিবেচনা করা প্রয়োজন। আমাদের মনে রাখতে হবে মানুষের মূল উদ্দেশ্য যাতায়াত নয় বরং দ্রব্য এবং সেবা প্রাপ্তি। আমাদের পরিবহন পরিকল্পনার মূল সমস্যা এখানেই যে যাতায়াত উদ্দেশ্য বিবেচনা না করেই পরিকল্পনা করা হয়। মানুষ যদি তার প্রয়োজনীয় জিনিষগুলো হাতের কাছেই পেয়ে যায় তাহলে তার দূরে যাবার প্রয়োজন হয়না। শহরের অবকাঠমো এমনভাবে তৈরী করা প্রয়োজন যার ফলে মানুষের দূরে যাবার প্রয়োজনীয়তা অনেকাংশে হ্রাস পায়।

এখন পর্যন্ত আমাদের শহরগুলোতে কাছাকাছি বাজার, শিক্ষা ও স্বাস্থ্য সেবা প্রতিষ্ঠান, কর্মসংস্থান, বিনোদনের সুবিধা অধিকাংশ যাতায়াতই হয়ে থাকে স্বল্প দূরত্বে। আর এর জন্য হেঁটে চলা বা অযান্ত্রিক যানের ব্যবহার হয়ে থাকে সবচেয়ে বেশী । কিন্তু আমাদের নগরের পরিবহন পরিকল্পনাগুলো কখনই এই সকল গুরুত্বপূর্ণ যোগাযোগ মাধ্যমকে যথাযথ গুরুত্ব পায়নি। একই সাথে নগরের ভূমি ব্যবহার পরিকল্পনা এবং পরিবহন পরিকল্পনার মধ্যে যে ওতোপ্রোত সম্পর্ক বিদ্যমান তাও কখনও তেমন ভাবে অনুধাবন করা হয়নি।

কাছে যাতায়াতের থেকে যখন দূরের যাতায়াত বেশী সুবিধাজনক হবে মানুষ তখন দূরে যাতায়াত করতে আগ্রহী হবে। মানুষের বাসস্থান থেকে তার কর্মক্ষেত্র, বাচ্চাদের স্কুল ইত্যাদি দূরে দূরে থাকবে। উদাহরনস্বরূপ বলা যায় আজিমপুর থেকে ধানমন্ডি যাওয়ার থেকে আজিমপুর থেকে উত্তরা যাওয়া বেশী সুবিধাজনক হলে মানুষ উত্তরা থেকে আজিমপুর যেতে আগ্রহী হবে। মানুষের দূরে যাতায়াতের প্রবণতা বৃদ্ধি পেলে, যতবেশী রাস্তাঘাটই নির্মাণ করা হোক না কেন শহরের যানযট বৃদ্ধি পায়। অপরদিকে মানুষ সহজে কাছকাছি দুরত্বে যাতায়াত করার সুযোগ পেলে তার বাসস্থানের কাছাকাছি সবকিছু পেতে চেষ্টা করবে, এবং এর ফলে যানযট কমবে। ফলে একদিকে যেমন সময়ের অপচয় কম হবে অন্যদিকে মানুষের জীবন যাত্রার মান বৃদ্ধি পাবে এবং পাশাপাশি স্বল্প দূরত্বে যাতায়াতের ফলে জ্বালানীর অপচয় কম হবে এবং শব্দ ও বায়ু দূষনের হারও কমবে। একস্থান থেকে অন্যস্থানে দ্রুত এবং কমখরচে যাওয়া যাবে। যানবাহনের তুলনায় মানুষের জন্য বেশী জায়গা প্রদান করা হলে মানুষের বিনোদনের সুযোগ বৃদ্ধি পাবে।

সড়ক অবকাঠামো ও অনিয়ন্ত্রিতভাবে প্রাইভেট কারের বৃদ্ধি এবং তার প্রভাব:
ঢাকা শহরে সুষ্ঠু পরিবহণ ব্যবস্থা গড়ে তোলার জন্য কিছু সংযোগ সড়কের প্রয়োজন রয়েছে। তবে আগে দেখতে বিদ্যমান সড়ক অবকাঠামোর সর্বোচ্চ ব্যবহারের মাধ্যমে সমস্যা নিরসন করা যায় কি না। এসটিপি’র সুপারিশে সংযোগ সড়ক নির্মাণের দিক নির্দেশনা রয়েছে। যা বাস্তবায়নের পূর্বে এর প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে ভালোভাবে সমীক্ষার প্রয়োজন রয়েছে। কেউ কেউ বলে থাকেন একটি শহরে সড়কের জন্য ২৫ % জায়গা প্রয়োজন। ঢাকা শহরে সড়কের পরিমাণ ৮% হওয়ায় যানজট সৃষ্টি হচ্ছে। এই কথার যথার্থতা কতটুকু? মূলত প্রাইভেট কার নির্ভর পরিবহণ ব্যবস্থায় বেশি বেশি সড়কের প্রয়োজন পড়ে। উন্নয়নশীল এশিয়ান দেশগুলির তুলনায় আমেরিকান শহরগুলিতে প্রাইভেট গাড়ি নির্ভর যাতায়াত ব্যবস্থা হওয়ায় সড়কের পরিমাণ মাথাপিছু ১০ গুন বেশি হলেও যানজট অনেক বেশি । ৩৩% সড়ক হওয়ার পরও লসএঞ্জেলস বিশ্বের মধ্যে অন্যতম যানজটপূর্ণ শহর।

ইউরোপিয়ান অনেক শহরেই ৫-৬% সড়ক নিয়েই সুষ্ঠু পরিবহণ ব্যবস্থা গড়ে তোলা সম্ভব হয়েছে। সড়কের পরিমাণ নির্ভর করে কোন ধরনের মাধ্যমকে পরিবহণ ব্যবস্থায় প্রাধান্য দেওয়া হচ্ছে তার উপর। পাবলিক পরিবহণের উন্নয়ন ও প্রাইভেট কারের ব্যবহার নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হলে কম পরিমাণ সড়ক নিয়েও পরিবহণ ব্যবস্থার উন্নয়ন সম্ভব। ঢাকা শহরে বর্তমানে অনিয়নন্ত্রিতভাবে প্রাইভেট কারের ব্যবহার বৃদ্ধি পাচ্ছে। ফলে সড়কে সংকুলান না হওয়ায় লাগছে যানজট। কেউ কেউ বলছেন ঢাকা শহরে সড়কের পরিমাণ কম, কিন্তু প্রকৃতার্থে প্রাইভেট কারের সংখ্যা বেড়ে যাচ্ছে। শুধুমাত্র গত বছর ঢাকা শহরে ৪৮,০০০ প্রাইভেট কার যোগ হয়েছে। যানজট নিয়ন্ত্রণ ও বিদ্যমান সড়ক অবকাঠমো কাজে লাগিয়ে সুষ্ঠু পরিবহণ ব্যবস্থা গড়ে তুলতে পাবলিক বাসের মানোয়ন্নের মাধ্যমে প্রাইভেট কার নিয়ন্ত্রণ করা প্রয়োজন। পাশাপাশি রেল, নৌ-পরিবহণ, হেঁটে, সাইকেলে ও রিকশায় চলাচলের উপযোগী পরিবেশ সৃষ্টি করতে দ্রুত পদক্ষেপ নিতে হবে।

এশিয়ান শহরগুলির তুলনায় আমেরিকান শহরগুলিতে পরিবহণ খাতে জ্বালনী ব্যবহারের পরিমাণ মাথাপিছু ৮ গুণের বেশি। এছাড়া পরিবহণ থেকে কার্বণ উৎপাদনের পরিমাণ মাথাপিছু প্রায় সাড়ে ৫ গুন । আমেরিকান শহরগুলিই বিশ্বে যানজটপূর্ণ শহরগুলির শীর্ষে অবস্থান করছে। ২০০৯ সালে টেক্সাস ট্রান্সপোর্টেশন ইন্সটিটিউট এর আরবান মবিলিটি রিপোর্টে দেখা যায়, লস এঞ্জেলসে যানজটের কারণে ৪৮,৫০,২২,০০০ কর্মঘন্টা নষ্ট হয়, অতিরিক্ত জ্বালানী ব্যয় হয় ৩৬,৬৯,৬৯,০০০ গ্যালন। এর জন্য সর্বমোট প্রায় ১০,৩২৮ মিলিয়ন ডলার অপচয় হয় ।

ঢাকায় যানজটের কারণে বছরে সর্বমোট প্রায় ৭৭১ মিলিয়ন ডলার অপচয় হয়। আমরা অবশ্যই এই সমস্যা থেকে উত্তরণ চাই। তবে সমাধান হিসেবে বেশি বেশি সড়ক ও এলিভেটেড এক্সপ্রেসেওয়ের মতো অবকাঠামো নির্মান করলে উল্টো খেসারত দিতে হবে। যা আমেরিকান শহরগুলির দিকে তাকালে পরিলক্ষিত হয়। ঢাকায় ভূমির পরিমাণ খুবই সীমিত জনসংখ্যা অনেক বেশি। এখানে পরিবহণ ব্যবস্থায় প্রাইভেট কার নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। পাশাপাশি পাবলিক পরিবহণ, পথচারী, সাইকেল ও রিকশাকে প্রাধান্য প্রয়োজন। যা যানজট নিয়ন্ত্রণের সাথে সাথে দূষণ, জ্বালানীর ব্যবহার, দূর্ঘটনা, অবকাঠামো নির্মাণ ব্যয় ও যাতায়াত খরচ কমানোর ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে।

সড়কের পরিমাণ বাড়ালেই যে যানজট সমস্যার সমাধান করা যাবে না এ বিষয়টি স্পষ্ট। আমেরিকার তুলনায় এশিয়ান শহরগুলিতে জনঘনত্ব প্রায় ১২ গুন। এছাড়া পাবলিক পরিবহণ ও অযান্ত্রিক যান ব্যবহারের পরিমাণ প্রায় ৪ গুন। যে কারণে জ্বালানী ব্যবহার ও দূষণের পরিমাণ তুলনামূলকভাবে খুবই কম।

পাবলিক বাস এর সঙ্গে পথচারী ও জ্বালানীমুক্ত যানের সমন্বয় :
পরিবহণ ব্যবস্থায় মাধ্যমগুলির ক্রমনির্ধারণ করার পাশাপাশি এর মধ্যে সঠিকভাবে সমন্বয় করা প্রয়োজন। যেমন-মানুষকে বাসে চলাচলে উৎসাহী করতে সেবামান বাড়ানো এবং এর সঙ্গে অন্যান্য মাধ্যমের সমন্বিত ব্যবস্থাপনা গড়ে তুলতে হবে। বাসা থেকে বাস স্টপেজে যাওয়ার জন্য সুবিধাজনকভাবে হেঁটে, সাইকেল ও রিকশায় চলাচলে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করা প্রয়োজন। একইভাবে বাসস্টপেজ থেকে নেমে কর্মস্থলে পৌঁছানোর জন্য ব্যবহৃত মাধ্যমের উপযোগী পরিবেশ সৃষ্টি করতে হবে।

ঢাকা শহরে বাস র‌্যাপিড ট্রানজিট (বিআরটি) চালুর প্রস্তাব রয়েছে। কারো কারো মতে ঢাকায় বিআরটি চালুর জন্য সড়কের পরিমাণ অপ্রতুল। বিআরটি হচ্ছে বিশেষ বাস সার্ভিস। এই ব্যবস্থায় বাসের জন্য পৃথক লেন থাকবে। এর একটি হচ্ছে একেবারে ডিভাইডার দিয়ে লেন আলাদা করা থাকবে। অন্য কোন বাহন এই লেনে ঢুকে বাস চলাচলে প্রতিবন্ধকতা তৈরি করতে পারবে না। যেখানে শুধুমাত্র জরুরী বাহন যেমন-এ্যাম্বুলেন্স, ফায়ার সার্ভিস এর গাড়ি এবং পুলিশ ভ্যান ঢুকতে পারবে। বিআরটি লেন ডিভাইডার ছাড়াও হয়। শুধুমাত্র দাগ দিয়ে বাসের জন্য লেন বরাদ্দ দেওয়া হয়। তবে বিআরটি এর সর্বোচ্চ সুবিধা পেতে ডিভাইডার দিয়ে পৃথক লেন তৈরি করা প্রয়োজন। এসটিপি গবেষণায় দেখানো হয়েছে কিভাবে ঢাকা শহরে আট মিটার থেকে শুরু করে চল্লিশ মিটার প্রস্থের সড়কে বিআরটি করা যাবে। কত মিটার সড়কে বাসের সঙ্গে কোন কোন মাধ্যমের সমন্বয় করা হবে তা সুনির্দ্দিষ্টভাবে উল্লেখ রয়েছে। বিআরটি সঠিকভাবে করা না হলে হীতে বিপরীত হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। এই ব্যবস্থায় বাসের সঙ্গে পথচারী সাইকেল এবং রিকশার সমন্বয় এর উপর গুরুত্ব দিতে হবে। পাশাপাশি প্রাইভেট কারকে যতটা সম্ভব নিরুৎসাহিত করতে হবে। ঢাকার প্রেক্ষাপটে খুব সহজেই এই কাজটি সম্পন্ন করা সম্ভব।

আমেরিকার শহরগুলির তুলনায় উন্নয়নশীল এশিয়ান শহরগুলিতে পাবলিক পরিবহণ, হেঁটে ও জ্বালানীমুক্ত যানে অনেক বেশি চলাচল হয়ে থাকে। যে কারণে জ্বালানীর ব্যবহার এবং দূষণ তুলনামূলক অনেক কম। ঢাকায় একই অবস্থা বিদ্যমান। তবে এই সকল মাধ্যমের সমন্বয়ে সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনা গড়ে তুলতে পদক্ষেপ গ্রহণ জরুরী।

বিকেন্দ্রীকরণ
রাজধানী শহর হিসেবে ঢাকা মহানগরীর গুরুত্ব অবশ্যই অনেক বেশি। দেশের সার্বিক উন্নয়ন ও তার সুফল সর্বত্র সুষম বন্টনের লক্ষ্যে অন্যান্য শহরগুলির উন্নয়ন জরুরী। কিন্তু দেশে সব কিছুই ঢাকার মধ্যে পুঞ্জীভূত করা হচ্ছে। প্রশাসনিক-নিরাপত্তা কর্মকান্ড থেকে ব্যাবসা-বাণিজ্য, কল-কারখানা, শিক্ষা-স্বাস্থ্যসেবা, অফিস আদালত সব কিছুই ঢাকাকে কেন্দ্র করে। তাই চাকরি, ব্যবসা, ছেলেমেয়েদের পড়ালেখা, পরিবারের সুচিকিৎসা, বিনোদন এসব কিছুর আশায় মানুষ আজ ঢাকামূখী। তাছাড়া দেশে যে কোন দূর্যোগে সর্বহারা মানুষ দু-মুঠো ভাত পাবার আশায় কাজের জন্য ছুটে আসছে ঢাকা শহরে । এই অতিরিক্ত মানুষের চাপে ঢাকার জনজীবনে নানা সঙ্কট বৃদ্ধি পাচ্ছে। ধীরে ধীরে লোপ পেতে বসেছে মানুষের সকল সুযোগ-সুবিধা। কোন কোন ক্ষেত্রে পোহাতে হচ্ছে অবর্ণনীয় দূর্ভোগ। যার মধ্যে যানজট সমস্যা অন্যতম। ঢাকা শহরের উদ্ভূত যানজট পরিস্থিতি মোকাবিলায় ঢাকা শহরের সঙ্গে সঙ্গে দেশের অন্যান্য শহরগুলির উন্নয়নে জরুরী পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে।

পরিশিষ্ট
নগর পরিকল্পনায় পুরো অবকাঠামোর সাথে সমন্বয় রেখে, পরিকল্পিতভাবে বিনোদনস্থান, নাগরিক বিনোদন কেন্দ্র গড়ে তোলা জরুরী। নগর মানেই শুধু ইট, কাঠ, পাথরের বসতি বা যান্ত্রিকতা নয়। বহুমানুষের মিলনকেন্দ্রই হচ্ছে নগর। একটি নগরীর গড়ে ওঠা নগরবাসীর শারীরিক ও মানসিক বিকাশকে নানাভাবে প্রভাবিত করে। একটি সুষ্ঠু সুন্দর পরিকল্পিত নগরী, দক্ষ মানবগোষ্ঠী গড়ে তুলতে সহায়ক। পরিকল্পিত নগরী গড়ে তোলার ক্ষেত্রে বিষয়টি প্রাধান্য দেয়া হোক এটি আমাদের সকলেরই কাম্য।

ভবনে অগ্নিকান্ড: প্রতিরোধে করণীয়

ভবনে অগ্নিকান্ড: প্রতিরোধে করণীয়
সৈয়দ মাহবুবুল আলম, নীতিবিশ্লেষক,

বিগত সময়ে ঢাকা শহরের বিভিন্ন স্থানে অগ্নিকান্ড সংগঠিত হয়েছে। এ সকল অগ্নিকান্ডেও মানুষের প্রাণহানী ঘটেছে। সকল ঘটনাকে ছাড়িয়ে গত ৩ জুন ২০১০ তারিখে পুরান ঢাকার নিমতলী এলাকায় ভয়াবহ অগ্লিকান্ড সংগঠিত হয়। এ ভয়াবহ অগ্নিকান্ডে মারা যায় ১১৭জন এবং দগ্ধ হয়ে হাসপাতালে চিকিৎসাধীন রয়েছে আরো ৩৯ জন এবং আহত দুই শতাধিক। স্মরণকালের এই অগ্নিকান্ডে বিপুল প্রাণহানির প্রেক্ষিতে সরকার জাতীয় শোক দিবস ঘোষণা করে। এ ভয়াবহ দুঘর্টনা দেশের মানুষকে নিস্তদ্ধ করে দেয়। এ ঘটনায় নিস্তব্ধ হয়ে যায় গোটা এলাকা। দেশের এত মানুষের মৃত্যুতে আমরা শোকাবিত। আমরা তাদের বিদেহী আত্মার মাগফেরাত কামনা করছি।

ঢাকার শহরে এ ধরনের অগ্নিকান্ড প্রথম নয়। পুর্বেও এ ধরনের অগ্নিকান্ড সংগঠিত হয়ে্েছ। বসুন্ধরা সিটি, বিসিআইসি ভবনের অগ্নিকান্ডের কথা আমাদের সকলেরই মনে আছে। অত্যাধূনিক প্রযুক্তি ও বিপুল অর্থে তৈরি এ সকল ভবনেও অগ্নিনির্বাপনে পর্যাপ্ত ব্যবস্থা ছিল না। বিভিন্ন প্রতিকুলতার কারণে ফায়ার সার্ভিসের কর্মীদের পক্ষে এ সকল স্থানেও অগ্নিকান্ড নিয়ন্ত্রণ করার কঠিন ছিল। অর্থাৎ পুরান এবং নতুন ঢাকা কোথাও অগ্নিনির্বাপনে আমাদের প্রস্তুতি যথার্থ নয়।

আগুন লাগার কারণ
ঢাকার নিমতলীর অগ্নিকান্ড প্রাথমিকভাবে বিদ্যুতের ট্রান্সফরমার বিস্ফোরণের কারণ হিসেবে বলা হয়। পরবর্তীতে দেখা যায় উক্ত বাড়ির নিচতলায় বিয়ের অনুষ্ঠানের রান্নার তাপে উক্ত ভবনের নিচতলায় গোডাউনে রাখা কেমিক্যালের দাহ্য হয়ে আগুনেও সূত্রপাত হয়, যা পরে গোডাউনে রাখা ক্যামিক্যালের কারনে যা আশেপাশে ছড়িয়ে পড়ে।

আগুনের ক্ষয়ক্ষতি
আগুনের কারণে কি পরিমান আর্থিক ক্ষতি হয়েছে তা এখনো সঠিক নিরূপন করা সম্ভব হয়নি। তবে এ ভয়াবহ অগ্নিকান্ডে মারা যায় ১১৭জন এবং দগ্ধ হয়ে হাসপাতালে চিকিৎসাধীন রয়েছে আরো ৩৯ জন এবং আহত দুই শতাধিক। এছাড়া আগুনে সাত-আটটি বাড়ি, কয়েকটি দোকানপাট ও ব্যবয়ামাগারসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান পুড়ে যায়। কিন্তু বেশ কয়েকটি পরিবারের কেউ বেঁচে নেই। আবার অনেক পরিবারের দু-একজন ছাড়া কেউ বেঁচে নেই। সময়ের ব্যবধানে হয়ত এই আর্থিক ক্ষতি পুষিয়ে নেয়া সম্ভব। কিন্তু গুটি গুয়েক লোকের ব্যবসায়িক স্বার্থে গড়ে ওঠা এসব রাসায়নিক পদার্থের দোকানের কারনে যে প্রাণগুলো ঝড়ে গেল এবং যারা এখনও মুত্যু যন্ত্রনায় কাতরাচ্ছে তাদের ক্ষতি কি পূরণ করা সম্ভব?

দেশের বিভিন্ন স্থানে ভয়াবহ অগ্নিকান্ড
শুধু পুরান ঢাকা নয়, দেশের কোথাও না কোথাও প্রতিদিনই ঘটছে দু-চারটি অগ্লিকান্ড। এমন ক্ষয়ক্ষতির পরিমান কোটি কোটি টাকা বা অপূরনীয়। ২০০৮ সালে আগা সাদেক রোডের এক বাড়িতে অগ্লিকান্ডে ওই পরিবারের ৯ সদস্যই প্রাণ হারান। এ ছাড়া রাজধানীর বসুন্ধরা সিটি সুপার মার্কেট, অ্যালিফ্যান্ট রোডের ইয়াকুব মার্কেট, ২০০৬ সালের ২৬ ফেব্র“য়ারি কারওানবাজারে বিএসইসি ভবন, পাবনার স্কয়ার কনজুমার প্রোডাক্টস লিমিটেড গাজীপুরের নাওজোরের বিএইচটি ইন্ডাস্ট্রিজ, ২০০৬ সালের ২ নভেম্বর সাভারের প্যাসিফিকউইন্টার ওয়্যা সোয়েটার ফ্যাক্টরি, মতিঝিলের এল্লাল টেম্বারে অগ্রণী ব্যংক ওয়াপদা শাখা, সাভারের জিরাবোতে প্লস্টিক কারখানা ও ২০০৬ সালের ২৫ জুন ভালকায় ক্রউন সোয়েটার ফ্যাক্টরিতে অগ্লিকান্ড ঘটে।

একই বছরের ২৪ ফেব্র“য়ারি চট্রগ্রামের কালুরঘাট বিসিক শিল্প এলাকার কোটিএস টেক্সটাইল মিলসে ভয়ানক অগ্লিকান্ডে ৫৬ জন নিহত, ওই বছর ৯ ফেব্র“য়ারি গাজীপুরের কালিয়কৈর উপজেলার শফিপুর শিল্পঞ্চলে যমুনা স্পিনিং মিলে অগ্লিকান্ডে ওই প্রতিষ্ঠানের শীর্ষ দুই কার্মকর্তসহ সাতজন নিহত হন, ২০০৫ সালের ২৬ আগস্ট সাভার ইপিজেডের নতুন জোনে কোং কিং স্পিনিং অ্যান্ড ডাযিং টেক্সটাইল ফ্যাক্টরিতে অগ্লিকান্ডে ক্ষতি হয় ১৬৫ কোটি টাকা। ওই বছরের ১৩ অক্টোবর চট্রগ্রামের পূর্ব মাদারবাড়ি এলাকায় একটি গোডাউনে এবং ২০০৫ সারের ১৯ জুন সাভারের রাজফুলবাড়িয়া বাসস্ট্যান্ডে বিশ্বাস টেক্সটাইল লিমিটেডে অগ্লিকান্ডে প্রায় ১০০ কোটি টকার ক্ষতি হয়। একই বছর ৭ জানুয়ারি নারাযণগঞ্জের সিদ্ধিরগঞ্জ জেলেপাড়া ব্রিজের কাছে নিট গার্মেন্টসে অগ্লিকান্ডে ২৮ শ্রমিকের মর্মান্তিক মৃত্যু ঘটে। এ খন্ড চিত্রের বাইরেও অসংখ্য ঘটনা ঘটেছে।


অগ্নিকান্ড ও প্রতিরোধ ব্যবস্থা:
আমাদের দেশে শহর ও গ্রামে অনেক কারণেই অগ্নিকান্ড সংগঠিত হয়ে থাকে। তবে শহর অঞ্চলের জনবসতি অপেক্ষাকৃত ঘন হওয়ার কারণে হতাহত ও ক্ষতির পরিমান বেশি হয়ে থাকে। তথাপিও শহর অঞ্চলে অগ্নি প্রতিরোধ ব্যবস্থা জোরালো নয়। প্রতিটি অগ্নিকান্ডের পর জোরদার বক্তব্য থাকলেও কিছু দিন পর তা আবার ঝিমিয়ে পড়ে। সংস্থাগুলোর উদ্যোগ ঝিমিয়ে পড়ে, সাধারণ মানুষও ভুলে যায়। আবার একটি অগ্নিকান্ড সংগঠিত হয় আবার কিছু দিন পর ভুলে যায়। কিন্তু বারবার এ দূঘর্টনায় আর্থিক ক্ষতির পাশাপাশি ঝড়ে যায় অনেক অমূল্য প্রাণ।

ভবন ও শিল্পকারখানায় অগ্নি নির্বাপণের জন্য পর্যাপ্ত যে ব্যবস্থা থাকার কথা তা অধিকাংশ ক্ষেত্রেই থাকে না। আবার যেখানে রয়েছে সেখানে দীর্ঘদিন ধরে ব্যবহার না করার প্রেক্ষিতে নষ্ট হয়ে গেছে। অনেক ক্ষেত্রে ভাল থাকলেও ব্যবহার অনেক করতে জানে না। অনেক ভবন ও প্রতিষ্ঠানের অগ্নি প্রতিরোধ করার লক্ষ্যে যথেষ্ট ব্যবস্থাও গ্রহণ করা হয় না।

অগ্নিকান্ডের কারণ হিসেবে অনেকে অপরিকল্পিত বাসস্থান বা ভবন তৈরিকে দায়ী করে থাকেন। কিন্তু যদি আমরা বসুন্ধরার সিটি ও বিসিআইসি ভবনের দিকে তাই তাহলে বুঝতে পারবো সমস্যা অন্য কোথায়। কেহ কেহ আবার মনিটরিং এর অভাবকে দায়ী করে থাকেন। মনিটরিংকারী সংস্থাগুলো লোকবল বা সরজ্জামের অভাব বলে থাকেন। কিন্তু অনুসন্ধান করলে দেখা যাবে এ অবৈধ ভবন বা কারাখনা তৈরির অনুমোদনের ক্ষেত্রে ঠিকই অনৈতিক অর্থ লেনদেন হয়েছে। অর্থাৎ বিষয়টি যে অবৈধ হচ্ছে তা সংশ্লিস্ট কর্মকর্তার নজরে রয়েছে। এ প্রক্রিয়ার মাধ্যমে একে অনের উপর দোষ চাপিয়ে আসছে। দিন দিন বাড়ছে দুঘর্টনা এবং মানুষের মৃত্যু।

অগ্নিকান্ড সংগঠনের পর পর অগ্নিনির্বাপনে কতিপয় সমস্যা প্রায়শই দেখা দেয়া। এ সমস্যাগুলোর মধ্যে পর্যাপ্ত পানির অভাব, খেলাজায়গার সমস্যা, অগ্নিকান্ডের প্রেক্ষিতে করণীয় বিষয়ে অজ্ঞতা, সরু রাস্তার কারণে অগ্নিনির্বাপক গাড়ী প্রবেশ সমস্যা, অগ্নিনির্বাপন ব্যবস্থার অভাব, অগ্নিকান্ডের প্রেক্ষিতে বিকল্প পথে বেরুনোর ব্যবস্থা না থাকা ইত্যাদি কারণগুলো প্রায়শই দেখা যায়। অথচ তারপরও সরকারী সংস্থাগুলো ঘিঞ্চি জায়গায় বহুতল ভবন নির্মাণের অনুমোদন দিচ্ছে, খোলা জায়গা ও জলাশয়গুলো ভরাট হচ্ছে বিল্ডার্স দ্বারা। সরু রাস্তা চিরসত্য হলেও এ রাস্তাগুলোতে প্রবেশের উপযোগী ফায়ার সার্ভিস গাড়ী ব্যবস্থার কোন উদ্যোগ নেই। যত উৎসাহী হয়ে বিভিন্ন প্রকল্পে বা ভবনের অনুমোদন দেয়া হচ্ছে তত উৎসাহ নেই মানুষকে রক্ষায় কোন কার্যক্রম গ্রহনের।

দিন দিন ঘটে চলা অগ্নিকান্ড। অগ্নিকান্ডে প্রতিরোধে দায়িত্বপ্রাপ্ত সংস্থাগুলোর নিস্ত্রিয়তা, জনগণে প্রতি প্রতিষ্ঠানগুলোর কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের উদাসীনতা ও অবজ্ঞার প্রমান করে। যত পরিকল্পনা ও বাজেট বরাদ্ধ করা হোক না কেন দায়িত্ব প্রতিষ্ঠানগুলোর মনিটরিং, দায়বদ্ধতা ও জবাবদিহীতা নিশ্চিত করা না গেলে এ দুঘর্টনা ও মৃত্যু কতটুকু হ্রাস করা সম্ভব হবে তা প্রশ্নবিধ বিষয়।
৭ জুন ২০১০, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, পরিবেশ বাঁচাও আন্দোলন

অগ্নিকান্ডের ঝুঁকি হ্রাসে কতিপয় সুপারিশ :
ক্স সমন্বিত নীতিমালার ভিত্তিতে বহুতল ভবনের অনুমোদন দেয়া।
ক্স ভবনের নকশা সংশ্লিষ্ট বিভাগ কর্তৃক ছাড় করনের পর নির্মাণ ও অনুমতি সাপেক্ষে ব্যবহারের জন্য চালু করা।
ক্স ভবনের পাশে যথেষ্ট পরিমানে ফাঁকা স্থান রাখা।
ক্স ভবনের পাশে জলাশয় রাখা।
ক্স সড়কে ট্রাফিক ব্যবস্থা স্বাভাবিক থাকবে কিনা যাচাই সাপেক্ষে বহুতল ভবন নির্মাণের অনুমোদন করা।
ক্স বহুতল ভবনের অভ্যন্তরে অগ্নি নির্বাপনের সকল ব্যবস্থা রাখা ও নিয়মিত মহড়ার ব্যবস্থা করা।
ক্স বস্তি এলাকার পাশে পানির ব্যবস্থা রাখা ও বস্তিবাসীকে নিয়ে নিয়মিত মহড়া করা
ক্স সরু রাস্তায় প্রবেশের উপযোগী ফায়ার সার্ভিস গাড়ী ব্যবস্থা।
ক্স ফায়ার সাভির্সের উন্নয়ন করা।
ক্স স্কুল-কলেজসহ সকল সরকারী বেসরকারী প্রতিষ্ঠানে নিয়মিত অগ্নি নির্বাপণ মহড়া করা।
তথ্যসুত্র:
১. বিভিন্ন জাতীয় দৈনিক
২. বহুতর ভবনে অগ্নিকান্ড, প্রাসঙ্গিক ভাবনা, সৈয়দ মাহবুবুল আলম, নীতিবিশ্লেষক, পরিবেশ বাঁচাও আন্দোলন।

বাসযোগ্য নগরী : জলাশয় ও উন্মূক্ত স্থানের অপরিহার্যতা এবং করণীয়

বাসযোগ্য নগরী : জলাশয় ও উন্মূক্ত স্থানের অপরিহার্যতা এবং করণীয়
সৈয়দ মাহবুবুল আলম, এল এল বি, নীতিবিশ্লেষক

বিশ্বে এখন প্রায় অর্র্ধেক জনগোষ্ঠী নগরে বাস করছে। দ্রুত নগরায়নের এই ধাক্কা লেগেছে বাংলাদেশেও। দেশের ২৬ শতাংশ মানুষ আজ নগরের বাসিন্দা, যার মধ্যে ৪০ শতাংশই রাজধানী ঢাকার অধিবাসী। কিন্তু অতিরিক্ত জনসংখ্যা ও সঠিক পরিকল্পনার অভাবে ঢাকায় নাগরিক সুয়োগ-সুবিধা প্রতিনিয়ত সংকুচিত হচ্ছে। আবাসন, যাতায়াত, পানি, বিদ্যুত, বিনোদনসহ নানা সঙ্কটে ঢাকাবাসীর দৈনন্দিন জীবনে দম বেরুনোর জোগাড় হয়েছে। এখনই পরিকল্পনা মাফিক এ সকল সঙ্কট নিরসন করার উদ্যোগ না নিলে, আমাদের প্রিয় ঢাকা নগরী পরিত্যক্ত হিসেবে পরিগণিত হতে পারে বলে আশঙ্কা রযেছে। আর সে জন্যই ঢাকায় বসবাসযোগ্য করে তোলতে জলাধার এবং উন্মূক্ত স্থানের অপরিহার্যতা সম্পর্কে বিশেষভাবে অবগত ও সমর্থন প্রদান প্রয়োজন।

নগর মানেই ইট-কাঠ-পাথর আর যন্ত্রের সমাহার নয়। নগর যেখানে থাকবে এক সুষম কাঠমো বিন্যাস, যা মানুষকে ব্যস্ত জীবনে একটু প্রাণের ছোয়া পেতে খোরাক জোগাবে। জলাধার ও উন্মুক্ত স্থান সেই কাঙ্খিত জীবনের বাস্তব রূপ দিতে অত্যাবশ্যকীয় উপাদান। কিন্তু তথাকথিত উন্নয়নের নামে শুধু ভবনের পর ভবনের সারি আর রাস্তাঘাট, জলাধার ও উন্মূক্ত স্থানের জন্য হুমকি হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। যার খেসারত দিতে হচ্ছে মানুষকে। এই ব্যবস্থার অবসান করতে হবে, গড়ে তুলতে হবে একটি মানবিক, বৈষম্যহীন নাগরিক সুবিধা সম্বলিত নগরী। সেই লক্ষ্যকে সামনে রেখে জলাধার ও উন্মূক্ত স্থান সংরক্ষন ও তা মানুষের সর্বাঙ্গীন মঙ্গলের জন্য কাজে লাগাতে হবে। এই ঢাকা নগরী আমাদের সকলের, একে বসবাসযোগ্য করার জন্য প্রত্যেকের অবস্থান থেকে কাজ করতে হবে।

জলাধারের প্রয়োজনীয়তা:
মানুষের জীবন জন্য পানির কোন বিকল্প নেই। ঢাকা শহরের পানি সমস্যা নিয়ে নতুন করে বক্তব্য দেয়ার কোন প্রয়োজন নেই, কারণ ভোক্তভোগী আমরা সবাই। ঢাকা শহরের বর্তমানে পানির ঘাটতির পরিমান ৫০ কোটি লিটার। পানির চাহিদা ২২০ কোটি লিটার হলেও উত্তোলন হয় ১৭০ কোটি লিটার। ঢাকা ওয়াসা সরবারহকৃত পানির ১৩% নদীর এবং বাড়ী ৮৭% পানি নলকুপের। কিন্তু আশংকার বিষয় হচ্ছে, প্রতিনিয়ত পানির স্তর নিমে নেমে যাচ্ছে। আগামী ৫ বছর পর ঢাকার পানি সংকট আরো প্রচন্ড হবে।

ঢাকায় অতিরিক্ত ভুগর্ভস্থ পানি উত্তোলন ভূমিধ্বস এর ঝুঁকিসহ পরিবেশকে নানা হুমকির সম্মুখীন করছে। খুব অচিরেই ভুগর্ভস্তস্তর হতে পানি উত্তোলন করা আমাদের জন্য কঠিন হয়ে পড়বে। বর্তমানে বাংলাদেশের শহরের ৭০% দরিদ্র মানুষের জন্য বিশুদ্ধ পানির ব্যবস্থা নেই। অপরদিকে নিরাপদ পানির অভাবে দেশ লক্ষাধিক লোক মারা যাচ্ছে। নিরাপদ পানি নিশ্চিত করা সম্ভব হলে ৭ হাজার কোটি টাকা বাঁচাবে। আমাদের পানির উৎস জলাধারগুলো রক্ষা না করা হলে, এই বিপুর জনগোষ্ঠীর পানির সমস্যা কিভাবে মোকাবেলা করা সম্ভব নয়। তাই পানি সংকট রোধে যে কোন মূল্যে আমাদের জলাধারগুলো রক্ষা করতে হবে।

জলাধারগুলো ধ্বংস করার প্রেক্ষিতে একদিকে আমরা যখন পানি সংকট ভোগছি। অপর দিকে বর্ষা মৌসুমে বৃষ্টির পানি নিষ্কাশনের অভাবে সৃষ্টি হচ্ছে জলাবদ্ধতা। ২০০৯ সালে ৯ ঘন্টার ৩৩৩ মিলিমিটার বৃষ্টিতে তলিয়ে যায় এই নগর। প্রতিবছর ভরা বর্ষায় ৬ ঘন্টায় ১৫০ মিলিমিটার বা তারও বেশি বৃষ্টি হয়। তখন যে পরিমান পানি নিষ্কাশণ করা বর্তমান ড্রেনেজ ব্যবস্থায় অসম্ভব। জলাবদ্ধতার কারণে মানুষ চলাচলসহ নানা সমস্যা মোকাবেলা করছে। পানির সমস্যা ও জলাবদ্ধতা এই দুটি আমাদের দৃশ্যমান সমস্যা। জলাধারগুলো আমাদের মৎস সম্পদের একটি বড় আধার। কিন্তু ঢাকার মতো এই বৃহৎ শহরের জলাধারা না থাকায় আজ এ শহরের নিজস্ব মৎস সম্পদের ভান্ডার শূন্য। নূন্যতম নিজেদের চাহিদের মেটানোর ব্যবস্থাও নেই আমাদের এই নগরে।


জলাধারগুলো না থাকলে আমাদের পরিবেশ উত্তপ্ত হয়ে উঠবে। ধ্বংশ হবে আমাদের জীববৈচিত্র। কেননা জলাধারগুলো শুধু মাছ আর পানির ক্ষেত্রেই নয়। জলাধারগুলোতে থাকে নানা প্রজাতির জীব। জলাধারগুলো ভরাটের প্রেক্ষিতে আমরা ধ্বংশ করে ফেলছি আমাদের সেই জীববৈচিত্রের আধার। এগুলো সংরক্ষন করা হলে, হতে পারে আমাদের বিনোদনের অন্যতম ক্ষেত্রে। ধানমন্ডি লেক এ ক্ষেত্র একটি উল্লেখযোগ্য উদাহরণ। আর ঢাকা শহরের খালগুলো উদ্বার করা হলে, এ নগরে একটি আর্দশ নৌযোগাযোগ ব্যবস্থা করে তোলা সম্ভব।

দখল হয়ে যাওয়া জলাধার:
ভৌগলিক কারণেই ঢাকা নগরী জলাধারের জন্য অত্যন্ত সমৃদ্ধ। ঢাকা চারপাশ বুড়িগঙ্গা, শীতলক্ষা, বালু ও তুরাগ এই চারটি নদী দ্বারা বেষ্টিত। এছাড়াও ঢাকার অভ্যন্তরেও রয়েছে ছোট বড় অসংখ্য খাল, পুকুর। ঢাকা ওয়াসার হিসেবমতে একসময় ঢাকায় ৪৭টি খাল ছিল। কিন্তু সংরক্ষণের অভাবে আজ মাত্র ২৬টি খালের হিসেব পাওয়া যায়। সরকারী এবং বেসরকারী উদ্যোগে খালগুলিকে হত্যা করা হয়েছে।

জলাবদ্ধতা নিরসনের মূল দায়িত্ব ঢাকা সিটি কর্পোরেশনের। অথচ ডিসিসি খালগুলো সংরক্ষনের পরিবর্তে দখল করে ১৯ টি রাস্তা নির্মাণ করেছে। ড্রেনেজ ব্যবস্থা উন্নয়নের নামে অনেক রাস্তার উপর বক্স কালভার্ট নির্মাণ করা হয়েছে। তার নিচের যে সকল খাল রয়েছে, সেগুনবাগিচা খাল অন্যতম। অপর দিকে বর্তমানে খালগুলো উদ্ধারের নামে যে, কার্যক্রম হাতে নেয়া হয়েছে তাও শুভকর নয়। সুরক্ষার নাম খালগুলো দুই পাশ বাধাই করা হচ্ছে। খালের দুই ধার বাধাই করে খালকে রক্ষা করা নামান্তরে খাল ড্রেনে পরিণত হচ্ছে। খালের জীববৈচিত্র ও পরিবেশ ধ্বংশ হচ্ছে। কল্যাণপুর লেক তার একটি প্রকৃত উদাহরণ।

ঢাকায় ১৯৮৪ ও ১৯৮৫ সালে পুকুরের সংখ্যা ছিল ২ হাজার এবং ১৯৮৮ ও ১৯৮৯ সালে তা কমে দাড়ায় ১ হাজার ২ শতে। ডিসিসি সুত্র অনুসারে তাদের ১০ টি অঞ্চলে মোট পুকুর ও ঝিলের পরিমাণ ৫ হাজার ১শ ৪২ বিঘা। বর্তমানে ঢাকার পুকুর হতে গোনা এবং যে কয়েকটি পুকুর আছে তার অস্তিত্বও সংকটে। পুরাতন ঢাকার সিক্কাটুলিতে একটি পুকুর রয়েছে যা উক্ত এলাকার একমাত্র পুকুর। কিন্তু এ পুকুরটি দখলের পায়তারা চলছে। এলাকাবাসী আর পরিবেশবিদরা অব্যাহত আন্দোলন বজায় রেখেছে। জলাধার রক্ষায় এত আলোড়নের পরও পুকুরটি রক্ষায় সরকারী সংস্থার উদ্যোগ হতাশা ব্যঞ্চক।

বর্তমানে এত আলোড়নের পরও নদী ও জলাধার রক্ষা থেমে নেই। বিভিন্ন ভাবে জলাধারগুলো দখল ও ধ্বংশ করা হচ্ছে। প্রায় সাত হাজার দখলদারের কব্জায় ঢাকার নদীপাড়ের বিপুর অংশ। জলাধারগুলো দখলের জন্য শুধু দখল দায়ী নয়, বর্জ্য ফেলার মাধ্যমেও ভারট করা হচ্ছে নদী। বুড়িগঙ্গায় যে পরিমান বর্জ্য ফেলা হয়েছে তার ১ কিলোমিটারের বর্জ রাখতে ২১ একর জমি লাগবে। অপর দিকে পরিকল্পিতভাবে ব্রিজ বা কলাভার্ট নির্মাণ করে জলাধারগুলোর পানি প্রবাহ ও নৌপথ রোধ করা হচ্ছে। তার প্রকৃত উদাহরণ রাজধানী চারপাশে বৃত্তাকার নৌপথের বড় বাধা ১৪ টি সেতু। স¤প্রতিক সময়েই খাল ভরাট করে নির্মাণ করা হচ্ছে পুর্বাচলগামী তিনশ ফুট রাস্তা। এ রাস্তার কারণে ৩০ ফুট ডুমুরি খারের অস্তিত্ব আজ সংকটে।

নদীগুলিও নির্মম অবহেলা আর যতেচ্ছা ব্যবহারের শিকার। আশার কথা হচ্ছে বর্তমান সরকারও এ ব্যাপারে ভীষণ আন্তরিক। এমনকি বিচার বিভাগ থেকেও বেশকিছু যুগান্তকারী দিক-নির্দেশনামূলক সিদ্ধান্ত এসেছে। যা জনমনে আশার সঞ্চার করেছে। কিন্তু তারপরও একটি অশুভ চক্রের অপতৎপরতা রোধ করা রীতিমত চ্যালেঞ্জ হয়ে দাড়িয়েছে। এদের মোকাবিলার মধ্য দিয়ে অবশিষ্ট সুবিধাটুকু জনসাধারণের নিকট পৌঁছে দিতে সরকারের সকল শুভ উদ্যোগকে আমরা সাধুবাদ জানাই এবং সেই সঙ্গে আমাদের সহযোগিতা অব্যাহত রাখার প্রয়াস ব্যক্ত করছি। এরই সঙ্গে ঢাকার বুকে রমনা, সোহরাওয়ার্দী, ধানমন্ডি লেকসহ ছোট বড় অসংখ্য উন্মুক্ত স্থান রয়েছে। সেগুলি রক্ষাকল্পে সরকারের সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনা ও তার যথাযথ বাস্তবায়ন প্রত্যাশা করছি।


উন্মুক্তস্থান এবং বিনোদন ব্যবস্থা:
মানুষে মানুষে যোগাযোগ, সামাজিক সম্পৃত্তি জন্য প্রয়োজন উম্মুক্ত স্থান, পার্ক, খেলার মাঠ। কিন্তু এ নগরে দিন দিন তা ধ্বংশ করা হচ্ছে। ঢাকা একটি নগর বলা হলেও, নগরে সুবিধা হতাশা ব্যঞ্জক। সুস্থ্য বিনোদনের সুযোগ নেই বললেই চলে। বিনোদনের পর্যাপ্ত স্থানের অভাবে এক শ্রেণীর শিশুরা বড় হচ্ছে কম্পিউটার আর ভিডিও গেমসের খেলে, চার দেয়ালে বন্দী তাদের জীবন। অপর দিকে একটি অংশের শিশুরা বিনোদনের অভাবে জড়িয়ে পড়ছে নানা সামাজিক অপরাধে। খেলাধূলার অভাবে শিশুদের পূর্ণাঙ্গ মানসিক ও শারিরীক বিকাশ ঘটছে না। অতিরিক্ত মোটা হওয়া, মানসিক সমস্যা ও সামাজিক অপরাধমূলক কার্যক্রম অব্যাহত বৃদ্ধি পাচ্ছে।

শিশু-কিশোরদের খেলাধুলার সুবিধা প্রদান এবং নগরবাসীর সুস্থ সুন্দর বিনোদনের জন্য শহরগুলোতে পর্যাপ্ত বিনোদনকেন্দ্র, পার্ক, খেলার মাঠ প্রয়োজন। দিনে দিনে ঢাকাসহ বাইরের বিভিন্ন স্থানে মানুষের বাইরে উন্মুক্তস্থানে বিনোদন বা সামাজিক কার্যক্রমগুলোর পরিধি ক্রমশই সংকুচিত হচ্ছে। পরিকল্পনায় ঘাটতি কিংবা সীমাবদ্ধতার কারণে প্রতিনিয়তই মানুষকে এর উন্নয়ন কিংবা সুবিধা বৃদ্ধির জন্য সংগ্রাম করতে হচ্ছে। খেলার মাঠ, পার্ক কিংবা উদ্যানের সল্পতা কিংবা আবাসিক এলাকায় প্রকৃতির অনুপস্থিতি ক্রমশই মানুষকে গৃহকেন্দ্রিক কিংবা টেলিভিশন নির্ভর করে তুলছে। ফুটপাতে হাঁটার পরিবেশের অভাব কিংবা মাঠে খেলাধুলার পরিবেশের অভাবও প্রকট আকারে পরিলক্ষিত হয়। শিশু, প্রাপ্তবয়স্ক কিংবা বৃদ্ধ বিবেচনায় উন্মুক্তস্থানের পরিকল্পনা প্রণয়ন এবং প্রয়োজনীয় সুযোগ সুবিধা নিশ্চিত করা আবশ্যক।

উম্মুক্ত স্থান, পার্ক, খেলার মাঠের বিষয়ে আমাদের নগর পরিকল্পনাকারী সংস্থাগুলো এখনো ঘুমন্ত। ঢাকা সিটি কর্পোরেশনের হিসেবে ৪৭ টি পার্ক রয়েছে। কিন্তু বাস্তবে কয়েকটি পার্ক কোন রকমে নিজের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখলেও বাকীগুলো হদিস নেই। ঢাকা পার্কগুলো দখল হয়েছে পানির পাম্প, প্রাইভেট গাড়ীর পার্কিং, মার্কেট, গ্যারেজসহ নানা কর্মকান্ড। খেলার মাঠগুলো রক্ষণাবেক্ষনের কোন উদ্যোগ নেই। বরং খেলার মাঠগুলো বানিজিক নানা কর্মকান্ডে ব্যবহার করে খেলার পরিবেশ ব্যহত করা হচ্ছে।

সিটি কর্পোরেশনের পর আসা যাক রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (রাজউক)-র নিকট। রাজউক নগর পরিকল্পনার প্রাণ হিসেবে কাজ করে, কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য মানুষের বিনোদন, সামাজিকতা, মানসিক ও শারিরীক বিকাশে নগর পরিকল্পনায় এগুলো নিশ্চিত করার সীমাবদ্ধতা এখনো রয়েছে। উদাহরণ স্বরূপ বলা যেতে পারে ঢাকা শহরের মাত্র ২% লোক প্রাইভেট গাড়ী ব্যবহার করে, বাকী ৯৮% মানুষের গাড়ী নেই। ইমারত নির্মাণ বিধিমালায় প্রতিটি বাড়ী ও মার্কেটে সুনির্দিষ্ট ও সুপষ্টভাবে প্রাইভেট গাড়ীর রাখার জন্য নির্দেশনা প্রদান করা হয়েছে। শুধু তাই নয় স¤প্রতি রাজউক নিজ উদ্যোগে গাড়ীর জন্য পার্কিং তৈরি করার পরিকল্পনা গ্রহণ করেছে। অথচ প্রতিটি বাড়ীতে শিশু থাকা স্বত্বেও শিশুদের শারিরীক ও মানসিক বিকাশে এপার্টমেন্টগুলো তৈরিতে এমন কোন নির্দেশনা নেই। প্রাইভেট গাড়ী অপেক্ষা মানুষের শিশু কম গুরুত্ব পাচ্ছে নগর পরিকল্পনাকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর কাছে।

শহরের সামগ্রিক পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষায় পার্ক এবং উন্মূক্ত স্থানের গুরুত্ব অপরিসীম। শিশুদের খেলাধূলা, বয়স্কদের আড্ডাসহ সব মানুষের সামাজিক আদান প্রদানের জন্য পার্ক এবং উন্মূক্ত স্থান সঠিকভাবে রাখার ব্যবস্থা করতে হবে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, প্রতি এক হাজার জনের জন্য ৪.২৩ একর জায়গা পার্ক এবং উন্মূক্ত স্থান এর জন্য থাকা প্রয়োজন। এমনকি সবচাইতে জনবহুল হংকং শহরেও প্রতি এক হাজার জনের জন্য ০.৭১ একর জায়গা রয়েছে, যা প্রস্তাবানুযায়ী ঢাকার চেয়ে ৫ গুন বেশি। ডিটেইল এরিয়া প্লান এ প্রতি এক হাজার জনের জন্য ০.১৩ একর জায়গা পার্ক এবং উন্মূক্ত রাখার কথা বলা হয়েছে। সেটিও সুস্পষ্টভাবে কোথায় হবে তা নির্দ্দিষ্ট করে বলা হয়নি। অথচ বানিজ্যিক কাজে ব্যবহারের জন্য সকল কিছুর জন্য সুনির্দ্দিষ্টভাবে জায়গা রাখা হয়েছে। ডিটেইল এরিয়া প্লান বাস্তবায়নের পূর্বে অবশ্যই এ বিষয়টি সংশোধন সাপেক্ষে পর্যাপ্ত পরিমাণ জায়গা পার্ক এবং উন্মুক্ত স্থানের জন্য রাখা হবে।

একটি বিষয় মনে রাখতে হবে বিনোদনকেন্দ্র বলতে শুধুমাত্র বাণিজ্যিকভাবে তৈরী কিছু রাইড সম্মিলিত স্থানগুলো নির্দেশ করে না। বর্তমানে কিছু বিনোদনকেন্দ্র গড়ে উঠছে ব্যক্তিমালিকানাধীনভাবে, ফলে সর্বস্তরের জনগণের জন্য তা উন্মুক্ত হয় না। ফলে মুষ্টিমেয় কিছু মানুষ তা ব্যবহার করতে পারে, সাধারণ মানুষ বিনোদনের সুযোগ পায় না। নিরাপত্তা এবং পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতার বিষয়গুলোর প্রতি দৃষ্টি রেখে পাকর্, খেলার মাঠ এবং উন্মুক্তস্থানগুলো যেন সর্ব সাধারণের ব্যবহার জন্য উন্মুক্ত হয় সে বিষয়টি গুরুত্বের সাথে বিবেচনা করতে হবে।


উন্মুক্তস্থানের বিশেষত্ব হচ্ছে যেখানে সহজেই লোক সমাগম ঘটে এবং সেই জায়গাগুলোতে সামাজিক, সাংস্কৃতিক, বিনোদনমূলক কর্মকান্ড সংগঠিত হয়। যেখানে প্রকৃতি বর্তমান। মানুষে মানুষে যোগাযোগের সুবিধা, আড্ডা কিংবা খেলাধুলার সুবিধা বিদ্যমান। যদি উন্মুক্ত স্থানের পরিবেশে এর ঘাটতি দেখা দেয় তাহলে সেখানে মানুষের আগমন কিংবা প্রাণচাঞ্চল্য হারিয়ে যায়। মানুষের উন্মুক্তস্থানের কর্মকান্ডগুলো আকর্ষনীয় এবং অর্থবহ করে তুলতে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণের পাশাপাশি উন্মুক্ত স্থানের বরাদ্দ এবং পরিকল্পনায় পূর্বেই নজর দেয়া জরুরী।

নগর পরিকল্পনা মানুষের জীবনযাত্রাকে নানাভাবে প্রভাবিত করে। জীবনমানের উন্নয়ন শহরের পরিকল্পনার উপর নির্ভরশীল। শহরের পরিকল্পনা প্রণয়নে যদি বিনোদন অথবা প্রাকৃতিক বিষয়ের উপর গুরুত্ব আরোপ করা হয়, সেই সাথে মানুষের মৌলিক প্রয়োজনের বিষয়গুলোকেও স্থান দেয়া হয় তাহলে সেটি একটি প্রাণবন্ত শহরের অবয়ব পেতে পারে। অন্যদিকে নগর পরিকল্পনায় এই বিষয়গুলোর ঘাটতি থাকলে কিংবা বিবেচনায় নেয়া না হলে শহরটি প্রাণহীন শহরে পরিণত হতে বাধ্য। নগর মানেই শুধু ইট, কাঠ, পাথরের বসতি বা যান্ত্রিকতা নয়। বহুমানুষের মিলনকেন্দ্রই হচ্ছে নগর। একটি সুষ্ঠু সুন্দর পরিকল্পিত নগরী দক্ষ মানবগোষ্ঠী গড়ে তুলতে সহায়ক। শিশু-কিশোরদের খেলাধুলার সুবিধা প্রদান এবং নগরবাসীর সুস্থ সুন্দর বিনোদনের জন্য শহরগুলোতে পর্যাপ্ত বিনোদনকেন্দ্র, পার্ক, খেলার মাঠ প্রয়োজন। এ কারণে একটি পরিকল্পিত নগরী গড়ে তোলার ক্ষেত্রে নগরবাসীর জন্য এসব সুযোগ সুবিধা প্রদানের বিষয়টি প্রাধান্য দেয়া আমাদের সকলেরই কাম্য।

জলাধার ও উন্মুক্ত স্থান সংরক্ষণে সুপারিশ:
১. ঢাকার জলাধার ও উন্মুক্ত স্থান চিহ্নিতকরণ নিদিষ্ট করে দেয়া।
২. জলাধার ও উম্মুক্ত স্থান দখলকারীদের বিরুদ্ধে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি ব্যবস্থা করা।
৩. বিশুদ্ধ পানির উৎসঃ নদ-নদী, খাল-বিল ও জলাশয় রক্ষায় বিদ্যমান আইন প্রয়োগ প্রয়োজনে সংশোধন করা।
৪. সরকারী প্রতিষ্ঠান কর্তৃক কোন ধরনের স্থাপনা নির্মাণের পূর্বে পরিবেশ ছাড়পত্র বাধ্যতামূলক করা এবং প্রচলিত আইন লঙ্ঘনকারীদের শাস্তির আওতায় নিয়ে আসা।
৫. পুকুর, দীঘি, খাল-বিল-নদীসহ যে কোন জলাশয় ভরাট বন্ধে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ।
৬. নদী, খাল, বিলসহ যে কোন ধরনের জলাশয়কে পেছনে দিয়ে এ ধরনের স্থাপনা বা পরিকল্পনা নিষিদ্ধের লক্ষ্যে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ। যদি জলাশয় সামনে থাকে তবে মানুষ এ সকল স্থানে ময়লা আর্বজনা ফেলবে না।
৭. নদী ও খালের দুইপারে মানুষের বিনোদনের জন্য হাঁটার ব্যবস্থা রাখা।
৮. খালগুলো উদ্ধার ও সংস্কার করে নৌ-পথগুলো চালু ও স¤প্রসারণ করা ।
৯. ইমারত নির্মাণ বিধিমালা সংশোধন করে পার্কিং এর পরিবর্তে শিশুদের খেলাধূলার জায়গা রাখার বিধান করা।
১০. প্রতিটি এলাকায় মাঠ, পার্ক ও উম্মুক্ত স্থানগুলো সংরক্ষন ও ব্যবহার উপযোগী করা।
১১. ডিটেল এরিয়া চুড়ান্ত বাস্তবায়নের পূর্বে, জলাধার সংরক্ষন ও উম্মুক্ত স্থান নিশ্চিত করাসহ সুপষ্ট দিকনির্দেশনা প্রদান করা।

৩১ আগষ্ট ২০১০, জাতীয় প্রেস ক্লাব, পরিবেশ বাঁচাও আন্দোলন এর গোলটেবিল বৈঠকে উপস্থাপিত

তথ্যসুত্র
১. জীবন ও স্থাপত্য, ডাব্লিউবিবি ট্রাস্ট
২. টেলিভিশনের নেতিবাচক প্রভাব ও আমাদের শিশু, ডাব্লিউবিবি ট্রাস্ট
৩. http://www.emnbd.net/
৪. আমাদের অর্থনীতি, ৯ মার্চ ২০১০
৫. প্রথম আলো, ২২ মার্চ ২০১০
৬. দৈনিক জনকণ্ঠ, ২৮ জুন ২০০৯
৭. মানবজনিম, ২৯ জুন ২০০৯
৮. বাংলাদেশ সময়, ২৯ জুন ২০০৯
৯. দৈনিক ইত্তেফাক, ০৩ আগষ্ট ২০০৯
১০. দৈনিক ডেসটিনি, ২০ জুলাই ২০০৯
১১. সমকাল, ২৭ জুন ২০০৯
১২. নয়াদিগন্ত, ১৫ ফেব্র“য়ারি ২০১০
১৩. আমাদের সময়, ৭ জানুয়ারি ২০১০
১৪. প্রথম আলো ১২ জানুয়ারি ২০১০
১৫. নয়াদিগন্ত, ১ ফেব্র“য়ারি ২০১০

মঙ্গলবার, ৩১ আগস্ট, ২০১০

বাসযোগ্য নগরী : জলাশয় ও উন্মূক্ত স্থানের অপরিহার্যতা এবং করণীয়

বিশ্বে এখন প্রায় অর্র্ধেক জনগোষ্ঠী নগরে বাস করছে। দ্রুত নগরায়নের এই ধাক্কা লেগেছে বাংলাদেশেও। দেশের ২৬ শতাংশ মানুষ আজ নগরের বাসিন্দা, যার মধ্যে ৪০ শতাংশই রাজধানী ঢাকার অধিবাসী। কিন্তু অতিরিক্ত জনসংখ্যা ও সঠিক পরিকল্পনার অভাবে ঢাকায় নাগরিক সুয়োগ-সুবিধা প্রতিনিয়ত সংকুচিত হচ্ছে। আবাসন, যাতায়াত, পানি, বিদ্যুত, বিনোদনসহ নানা সঙ্কটে ঢাকাবাসীর দৈনন্দিন জীবনে দম বেরুনোর জোগাড় হয়েছে। এখনই পরিকল্পনা মাফিক এ সকল সঙ্কট নিরসন করার উদ্যোগ না নিলে, আমাদের প্রিয় ঢাকা নগরী পরিত্যক্ত হিসেবে পরিগণিত হতে পারে বলে আশঙ্কা রযেছে। আর সে জন্যই ঢাকায় বসবাসযোগ্য করে তোলতে জলাধার এবং উন্মূক্ত স্থানের অপরিহার্যতা সম্পর্কে বিশেষভাবে অবগত ও সমর্থন প্রদান প্রয়োজন।

নগর মানেই ইট-কাঠ-পাথর আর যন্ত্রের সমাহার নয়। নগর যেখানে থাকবে এক সুষম কাঠমো বিন্যাস, যা মানুষকে ব্যস্ত জীবনে একটু প্রাণের ছোয়া পেতে খোরাক জোগাবে। জলাধার ও উন্মুক্ত স্থান সেই কাঙ্খিত জীবনের বাস্তব রূপ দিতে অত্যাবশ্যকীয় উপাদান। কিন্তু তথাকথিত উন্নয়নের নামে শুধু ভবনের পর ভবনের সারি আর রাস্তাঘাট, জলাধার ও উন্মূক্ত স্থানের জন্য হুমকি হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। যার খেসারত দিতে হচ্ছে মানুষকে। এই ব্যবস্থার অবসান করতে হবে, গড়ে তুলতে হবে একটি মানবিক, বৈষম্যহীন নাগরিক সুবিধা সম্বলিত নগরী। সেই লক্ষ্যকে সামনে রেখে জলাধার ও উন্মূক্ত স্থান সংরক্ষন ও তা মানুষের সর্বাঙ্গীন মঙ্গলের জন্য কাজে লাগাতে হবে। এই ঢাকা নগরী আমাদের সকলের, একে বসবাসযোগ্য করার জন্য প্রত্যেকের অবস্থান থেকে কাজ করতে হবে।

জলাধারের প্রয়োজনীয়তা:
মানুষের জীবন জন্য পানির কোন বিকল্প নেই। ঢাকা শহরের পানি সমস্যা নিয়ে নতুন করে বক্তব্য দেয়ার কোন প্রয়োজন নেই, কারণ ভোক্তভোগী আমরা সবাই। ঢাকা শহরের বর্তমানে পানির ঘাটতির পরিমান ৫০ কোটি লিটার। পানির চাহিদা ২২০ কোটি লিটার হলেও উত্তোলন হয় ১৭০ কোটি লিটার। ঢাকা ওয়াসা সরবারহকৃত পানির ১৩% নদীর এবং বাড়ী ৮৭% পানি নলকুপের। কিন্তু আশংকার বিষয় হচ্ছে, প্রতিনিয়ত পানির স্তর নিমে নেমে যাচ্ছে। আগামী ৫ বছর পর ঢাকার পানি সংকট আরো প্রচন্ড হবে।

ঢাকায় অতিরিক্ত ভুগর্ভস্থ পানি উত্তোলন ভূমিধ্বস এর ঝুঁকিসহ পরিবেশকে নানা হুমকির সম্মুখীন করছে। খুব অচিরেই ভুগর্ভস্তস্তর হতে পানি উত্তোলন করা আমাদের জন্য কঠিন হয়ে পড়বে। বর্তমানে বাংলাদেশের শহরের ৭০% দরিদ্র মানুষের জন্য বিশুদ্ধ পানির ব্যবস্থা নেই। অপরদিকে নিরাপদ পানির অভাবে দেশ লক্ষাধিক লোক মারা যাচ্ছে। নিরাপদ পানি নিশ্চিত করা সম্ভব হলে ৭ হাজার কোটি টাকা বাঁচাবে। আমাদের পানির উৎস জলাধারগুলো রক্ষা না করা হলে, এই বিপুর জনগোষ্ঠীর পানির সমস্যা কিভাবে মোকাবেলা করা সম্ভব নয়। তাই পানি সংকট রোধে যে কোন মূল্যে আমাদের জলাধারগুলো রক্ষা করতে হবে।

জলাধারগুলো ধ্বংস করার প্রেক্ষিতে একদিকে আমরা যখন পানি সংকট ভোগছি। অপর দিকে বর্ষা মৌসুমে বৃষ্টির পানি নিষ্কাশনের অভাবে সৃষ্টি হচ্ছে জলাবদ্ধতা। ২০০৯ সালে ৯ ঘন্টার ৩৩৩ মিলিমিটার বৃষ্টিতে তলিয়ে যায় এই নগর। প্রতিবছর ভরা বর্ষায় ৬ ঘন্টায় ১৫০ মিলিমিটার বা তারও বেশি বৃষ্টি হয়। তখন যে পরিমান পানি নিষ্কাশণ করা বর্তমান ড্রেনেজ ব্যবস্থায় অসম্ভব। জলাবদ্ধতার কারণে মানুষ চলাচলসহ নানা সমস্যা মোকাবেলা করছে। পানির সমস্যা ও জলাবদ্ধতা এই দুটি আমাদের দৃশ্যমান সমস্যা। জলাধারগুলো আমাদের মৎস সম্পদের একটি বড় আধার। কিন্তু ঢাকার মতো এই বৃহৎ শহরের জলাধারা না থাকায় আজ এ শহরের নিজস্ব মৎস সম্পদের ভান্ডার শূন্য। নূন্যতম নিজেদের চাহিদের মেটানোর ব্যবস্থাও নেই আমাদের এই নগরে।


জলাধারগুলো না থাকলে আমাদের পরিবেশ উত্তপ্ত হয়ে উঠবে। ধ্বংশ হবে আমাদের জীববৈচিত্র। কেননা জলাধারগুলো শুধু মাছ আর পানির ক্ষেত্রেই নয়। জলাধারগুলোতে থাকে নানা প্রজাতির জীব। জলাধারগুলো ভরাটের প্রেক্ষিতে আমরা ধ্বংশ করে ফেলছি আমাদের সেই জীববৈচিত্রের আধার। এগুলো সংরক্ষন করা হলে, হতে পারে আমাদের বিনোদনের অন্যতম ক্ষেত্রে। ধানমন্ডি লেক এ ক্ষেত্র একটি উল্লেখযোগ্য উদাহরণ। আর ঢাকা শহরের খালগুলো উদ্বার করা হলে, এ নগরে একটি আর্দশ নৌযোগাযোগ ব্যবস্থা করে তোলা সম্ভব।

দখল হয়ে যাওয়া জলাধার:
ভৌগলিক কারণেই ঢাকা নগরী জলাধারের জন্য অত্যন্ত সমৃদ্ধ। ঢাকা চারপাশ বুড়িগঙ্গা, শীতলক্ষা, বালু ও তুরাগ এই চারটি নদী দ্বারা বেষ্টিত। এছাড়াও ঢাকার অভ্যন্তরেও রয়েছে ছোট বড় অসংখ্য খাল, পুকুর। ঢাকা ওয়াসার হিসেবমতে একসময় ঢাকায় ৪৭টি খাল ছিল। কিন্তু সংরক্ষণের অভাবে আজ মাত্র ২৬টি খালের হিসেব পাওয়া যায়। সরকারী এবং বেসরকারী উদ্যোগে খালগুলিকে হত্যা করা হয়েছে।

জলাবদ্ধতা নিরসনের মূল দায়িত্ব ঢাকা সিটি কর্পোরেশনের। অথচ ডিসিসি খালগুলো সংরক্ষনের পরিবর্তে দখল করে ১৯ টি রাস্তা নির্মাণ করেছে। ড্রেনেজ ব্যবস্থা উন্নয়নের নামে অনেক রাস্তার উপর বক্স কালভার্ট নির্মাণ করা হয়েছে। তার নিচের যে সকল খাল রয়েছে, সেগুনবাগিচা খাল অন্যতম। অপর দিকে বর্তমানে খালগুলো উদ্ধারের নামে যে, কার্যক্রম হাতে নেয়া হয়েছে তাও শুভকর নয়। সুরক্ষার নাম খালগুলো দুই পাশ বাধাই করা হচ্ছে। খালের দুই ধার বাধাই করে খালকে রক্ষা করা নামান্তরে খাল ড্রেনে পরিণত হচ্ছে। খালের জীববৈচিত্র ও পরিবেশ ধ্বংশ হচ্ছে। কল্যাণপুর লেক তার একটি প্রকৃত উদাহরণ।

ঢাকায় ১৯৮৪ ও ১৯৮৫ সালে পুকুরের সংখ্যা ছিল ২ হাজার এবং ১৯৮৮ ও ১৯৮৯ সালে তা কমে দাড়ায় ১ হাজার ২ শতে। ডিসিসি সুত্র অনুসারে তাদের ১০ টি অঞ্চলে মোট পুকুর ও ঝিলের পরিমাণ ৫ হাজার ১শ ৪২ বিঘা। বর্তমানে ঢাকার পুকুর হতে গোনা এবং যে কয়েকটি পুকুর আছে তার অস্তিত্বও সংকটে। পুরাতন ঢাকার সিক্কাটুলিতে একটি পুকুর রয়েছে যা উক্ত এলাকার একমাত্র পুকুর। কিন্তু এ পুকুরটি দখলের পায়তারা চলছে। এলাকাবাসী আর পরিবেশবিদরা অব্যাহত আন্দোলন বজায় রেখেছে। জলাধার রক্ষায় এত আলোড়নের পরও পুকুরটি রক্ষায় সরকারী সংস্থার উদ্যোগ হতাশা ব্যঞ্চক।

বর্তমানে এত আলোড়নের পরও নদী ও জলাধার রক্ষা থেমে নেই। বিভিন্ন ভাবে জলাধারগুলো দখল ও ধ্বংশ করা হচ্ছে। প্রায় সাত হাজার দখলদারের কব্জায় ঢাকার নদীপাড়ের বিপুর অংশ। জলাধারগুলো দখলের জন্য শুধু দখল দায়ী নয়, বর্জ্য ফেলার মাধ্যমেও ভারট করা হচ্ছে নদী। বুড়িগঙ্গায় যে পরিমান বর্জ্য ফেলা হয়েছে তার ১ কিলোমিটারের বর্জ রাখতে ২১ একর জমি লাগবে। অপর দিকে পরিকল্পিতভাবে ব্রিজ বা কলাভার্ট নির্মাণ করে জলাধারগুলোর পানি প্রবাহ ও নৌপথ রোধ করা হচ্ছে। তার প্রকৃত উদাহরণ রাজধানী চারপাশে বৃত্তাকার নৌপথের বড় বাধা ১৪ টি সেতু। স¤প্রতিক সময়েই খাল ভরাট করে নির্মাণ করা হচ্ছে পুর্বাচলগামী তিনশ ফুট রাস্তা। এ রাস্তার কারণে ৩০ ফুট ডুমুরি খারের অস্তিত্ব আজ সংকটে।

নদীগুলিও নির্মম অবহেলা আর যতেচ্ছা ব্যবহারের শিকার। আশার কথা হচ্ছে বর্তমান সরকারও এ ব্যাপারে ভীষণ আন্তরিক। এমনকি বিচার বিভাগ থেকেও বেশকিছু যুগান্তকারী দিক-নির্দেশনামূলক সিদ্ধান্ত এসেছে। যা জনমনে আশার সঞ্চার করেছে। কিন্তু তারপরও একটি অশুভ চক্রের অপতৎপরতা রোধ করা রীতিমত চ্যালেঞ্জ হয়ে দাড়িয়েছে। এদের মোকাবিলার মধ্য দিয়ে অবশিষ্ট সুবিধাটুকু জনসাধারণের নিকট পৌঁছে দিতে সরকারের সকল শুভ উদ্যোগকে আমরা সাধুবাদ জানাই এবং সেই সঙ্গে আমাদের সহযোগিতা অব্যাহত রাখার প্রয়াস ব্যক্ত করছি। এরই সঙ্গে ঢাকার বুকে রমনা, সোহরাওয়ার্দী, ধানমন্ডি লেকসহ ছোট বড় অসংখ্য উন্মুক্ত স্থান রয়েছে। সেগুলি রক্ষাকল্পে সরকারের সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনা ও তার যথাযথ বাস্তবায়ন প্রত্যাশা করছি।

উন্মুক্তস্থান এবং বিনোদন ব্যবস্থা:
মানুষে মানুষে যোগাযোগ, সামাজিক সম্পৃত্তি জন্য প্রয়োজন উম্মুক্ত স্থান, পার্ক, খেলার মাঠ। কিন্তু এ নগরে দিন দিন তা ধ্বংশ করা হচ্ছে। ঢাকা একটি নগর বলা হলেও, নগরে সুবিধা হতাশা ব্যঞ্জক। সুস্থ্য বিনোদনের সুযোগ নেই বললেই চলে। বিনোদনের পর্যাপ্ত স্থানের অভাবে এক শ্রেণীর শিশুরা বড় হচ্ছে কম্পিউটার আর ভিডিও গেমসের খেলে, চার দেয়ালে বন্দী তাদের জীবন। অপর দিকে একটি অংশের শিশুরা বিনোদনের অভাবে জড়িয়ে পড়ছে নানা সামাজিক অপরাধে। খেলাধূলার অভাবে শিশুদের পূর্ণাঙ্গ মানসিক ও শারিরীক বিকাশ ঘটছে না। অতিরিক্ত মোটা হওয়া, মানসিক সমস্যা ও সামাজিক অপরাধমূলক কার্যক্রম অব্যাহত বৃদ্ধি পাচ্ছে।

শিশু-কিশোরদের খেলাধুলার সুবিধা প্রদান এবং নগরবাসীর সুস্থ সুন্দর বিনোদনের জন্য শহরগুলোতে পর্যাপ্ত বিনোদনকেন্দ্র, পার্ক, খেলার মাঠ প্রয়োজন। দিনে দিনে ঢাকাসহ বাইরের বিভিন্ন স্থানে মানুষের বাইরে উন্মুক্তস্থানে বিনোদন বা সামাজিক কার্যক্রমগুলোর পরিধি ক্রমশই সংকুচিত হচ্ছে। পরিকল্পনায় ঘাটতি কিংবা সীমাবদ্ধতার কারণে প্রতিনিয়তই মানুষকে এর উন্নয়ন কিংবা সুবিধা বৃদ্ধির জন্য সংগ্রাম করতে হচ্ছে। খেলার মাঠ, পার্ক কিংবা উদ্যানের সল্পতা কিংবা আবাসিক এলাকায় প্রকৃতির অনুপস্থিতি ক্রমশই মানুষকে গৃহকেন্দ্রিক কিংবা টেলিভিশন নির্ভর করে তুলছে। ফুটপাতে হাঁটার পরিবেশের অভাব কিংবা মাঠে খেলাধুলার পরিবেশের অভাবও প্রকট আকারে পরিলক্ষিত হয়। শিশু, প্রাপ্তবয়স্ক কিংবা বৃদ্ধ বিবেচনায় উন্মুক্তস্থানের পরিকল্পনা প্রণয়ন এবং প্রয়োজনীয় সুযোগ সুবিধা নিশ্চিত করা আবশ্যক।

উম্মুক্ত স্থান, পার্ক, খেলার মাঠের বিষয়ে আমাদের নগর পরিকল্পনাকারী সংস্থাগুলো এখনো ঘুমন্ত। ঢাকা সিটি কর্পোরেশনের হিসেবে ৪৭ টি পার্ক রয়েছে। কিন্তু বাস্তবে কয়েকটি পার্ক কোন রকমে নিজের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখলেও বাকীগুলো হদিস নেই। ঢাকা পার্কগুলো দখল হয়েছে পানির পাম্প, প্রাইভেট গাড়ীর পার্কিং, মার্কেট, গ্যারেজসহ নানা কর্মকান্ড। খেলার মাঠগুলো রক্ষণাবেক্ষনের কোন উদ্যোগ নেই। বরং খেলার মাঠগুলো বানিজিক নানা কর্মকান্ডে ব্যবহার করে খেলার পরিবেশ ব্যহত করা হচ্ছে।

সিটি কর্পোরেশনের পর আসা যাক রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (রাজউক)-র নিকট। রাজউক নগর পরিকল্পনার প্রাণ হিসেবে কাজ করে, কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য মানুষের বিনোদন, সামাজিকতা, মানসিক ও শারিরীক বিকাশে নগর পরিকল্পনায় এগুলো নিশ্চিত করার সীমাবদ্ধতা এখনো রয়েছে। উদাহরণ স্বরূপ বলা যেতে পারে ঢাকা শহরের মাত্র ২% লোক প্রাইভেট গাড়ী ব্যবহার করে, বাকী ৯৮% মানুষের গাড়ী নেই। ইমারত নির্মাণ বিধিমালায় প্রতিটি বাড়ী ও মার্কেটে সুনির্দিষ্ট ও সুপষ্টভাবে প্রাইভেট গাড়ীর রাখার জন্য নির্দেশনা প্রদান করা হয়েছে। শুধু তাই নয় স¤প্রতি রাজউক নিজ উদ্যোগে গাড়ীর জন্য পার্কিং তৈরি করার পরিকল্পনা গ্রহণ করেছে। অথচ প্রতিটি বাড়ীতে শিশু থাকা স্বত্বেও শিশুদের শারিরীক ও মানসিক বিকাশে এপার্টমেন্টগুলো তৈরিতে এমন কোন নির্দেশনা নেই। প্রাইভেট গাড়ী অপেক্ষা মানুষের শিশু কম গুরুত্ব পাচ্ছে নগর পরিকল্পনাকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর কাছে।

শহরের সামগ্রিক পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষায় পার্ক এবং উন্মূক্ত স্থানের গুরুত্ব অপরিসীম। শিশুদের খেলাধূলা, বয়স্কদের আড্ডাসহ সব মানুষের সামাজিক আদান প্রদানের জন্য পার্ক এবং উন্মূক্ত স্থান সঠিকভাবে রাখার ব্যবস্থা করতে হবে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, প্রতি এক হাজার জনের জন্য ৪.২৩ একর জায়গা পার্ক এবং উন্মূক্ত স্থান এর জন্য থাকা প্রয়োজন। এমনকি সবচাইতে জনবহুল হংকং শহরেও প্রতি এক হাজার জনের জন্য ০.৭১ একর জায়গা রয়েছে, যা প্রস্তাবানুযায়ী ঢাকার চেয়ে ৫ গুন বেশি। ডিটেইল এরিয়া প্লান এ প্রতি এক হাজার জনের জন্য ০.১৩ একর জায়গা পার্ক এবং উন্মূক্ত রাখার কথা বলা হয়েছে। সেটিও সুস্পষ্টভাবে কোথায় হবে তা নির্দ্দিষ্ট করে বলা হয়নি। অথচ বানিজ্যিক কাজে ব্যবহারের জন্য সকল কিছুর জন্য সুনির্দ্দিষ্টভাবে জায়গা রাখা হয়েছে। ডিটেইল এরিয়া প্লান বাস্তবায়নের পূর্বে অবশ্যই এ বিষয়টি সংশোধন সাপেক্ষে পর্যাপ্ত পরিমাণ জায়গা পার্ক এবং উন্মুক্ত স্থানের জন্য রাখা হবে।

একটি বিষয় মনে রাখতে হবে বিনোদনকেন্দ্র বলতে শুধুমাত্র বাণিজ্যিকভাবে তৈরী কিছু রাইড সম্মিলিত স্থানগুলো নির্দেশ করে না। বর্তমানে কিছু বিনোদনকেন্দ্র গড়ে উঠছে ব্যক্তিমালিকানাধীনভাবে, ফলে সর্বস্তরের জনগণের জন্য তা উন্মুক্ত হয় না। ফলে মুষ্টিমেয় কিছু মানুষ তা ব্যবহার করতে পারে, সাধারণ মানুষ বিনোদনের সুযোগ পায় না। নিরাপত্তা এবং পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতার বিষয়গুলোর প্রতি দৃষ্টি রেখে পাকর্, খেলার মাঠ এবং উন্মুক্তস্থানগুলো যেন সর্ব সাধারণের ব্যবহার জন্য উন্মুক্ত হয় সে বিষয়টি গুরুত্বের সাথে বিবেচনা করতে হবে।


উন্মুক্তস্থানের বিশেষত্ব হচ্ছে যেখানে সহজেই লোক সমাগম ঘটে এবং সেই জায়গাগুলোতে সামাজিক, সাংস্কৃতিক, বিনোদনমূলক কর্মকান্ড সংগঠিত হয়। যেখানে প্রকৃতি বর্তমান। মানুষে মানুষে যোগাযোগের সুবিধা, আড্ডা কিংবা খেলাধুলার সুবিধা বিদ্যমান। যদি উন্মুক্ত স্থানের পরিবেশে এর ঘাটতি দেখা দেয় তাহলে সেখানে মানুষের আগমন কিংবা প্রাণচাঞ্চল্য হারিয়ে যায়। মানুষের উন্মুক্তস্থানের কর্মকান্ডগুলো আকর্ষনীয় এবং অর্থবহ করে তুলতে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণের পাশাপাশি উন্মুক্ত স্থানের বরাদ্দ এবং পরিকল্পনায় পূর্বেই নজর দেয়া জরুরী।

নগর পরিকল্পনা মানুষের জীবনযাত্রাকে নানাভাবে প্রভাবিত করে। জীবনমানের উন্নয়ন শহরের পরিকল্পনার উপর নির্ভরশীল। শহরের পরিকল্পনা প্রণয়নে যদি বিনোদন অথবা প্রাকৃতিক বিষয়ের উপর গুরুত্ব আরোপ করা হয়, সেই সাথে মানুষের মৌলিক প্রয়োজনের বিষয়গুলোকেও স্থান দেয়া হয় তাহলে সেটি একটি প্রাণবন্ত শহরের অবয়ব পেতে পারে। অন্যদিকে নগর পরিকল্পনায় এই বিষয়গুলোর ঘাটতি থাকলে কিংবা বিবেচনায় নেয়া না হলে শহরটি প্রাণহীন শহরে পরিণত হতে বাধ্য। নগর মানেই শুধু ইট, কাঠ, পাথরের বসতি বা যান্ত্রিকতা নয়। বহুমানুষের মিলনকেন্দ্রই হচ্ছে নগর। একটি সুষ্ঠু সুন্দর পরিকল্পিত নগরী দক্ষ মানবগোষ্ঠী গড়ে তুলতে সহায়ক। শিশু-কিশোরদের খেলাধুলার সুবিধা প্রদান এবং নগরবাসীর সুস্থ সুন্দর বিনোদনের জন্য শহরগুলোতে পর্যাপ্ত বিনোদনকেন্দ্র, পার্ক, খেলার মাঠ প্রয়োজন। এ কারণে একটি পরিকল্পিত নগরী গড়ে তোলার ক্ষেত্রে নগরবাসীর জন্য এসব সুযোগ সুবিধা প্রদানের বিষয়টি প্রাধান্য দেয়া আমাদের সকলেরই কাম্য।

জলাধার ও উন্মুক্ত স্থান সংরক্ষণে সুপারিশ:
১. ঢাকার জলাধার ও উন্মুক্ত স্থান চিহ্নিতকরণ নিদিষ্ট করে দেয়া।
২. জলাধার ও উম্মুক্ত স্থান দখলকারীদের বিরুদ্ধে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি ব্যবস্থা করা।
৩. বিশুদ্ধ পানির উৎসঃ নদ-নদী, খাল-বিল ও জলাশয় রক্ষায় বিদ্যমান আইন প্রয়োগ প্রয়োজনে সংশোধন করা।
৪. সরকারী প্রতিষ্ঠান কর্তৃক কোন ধরনের স্থাপনা নির্মাণের পূর্বে পরিবেশ ছাড়পত্র বাধ্যতামূলক করা এবং প্রচলিত আইন লঙ্ঘনকারীদের শাস্তির আওতায় নিয়ে আসা।
৫. পুকুর, দীঘি, খাল-বিল-নদীসহ যে কোন জলাশয় ভরাট বন্ধে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ।
৬. নদী, খাল, বিলসহ যে কোন ধরনের জলাশয়কে পেছনে দিয়ে এ ধরনের স্থাপনা বা পরিকল্পনা নিষিদ্ধের লক্ষ্যে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ। যদি জলাশয় সামনে থাকে তবে মানুষ এ সকল স্থানে ময়লা আর্বজনা ফেলবে না।
৭. নদী ও খালের দুইপারে মানুষের বিনোদনের জন্য হাঁটার ব্যবস্থা রাখা।
৮. খালগুলো উদ্ধার ও সংস্কার করে নৌ-পথগুলো চালু ও স¤প্রসারণ করা ।
৯. ইমারত নির্মাণ বিধিমালা সংশোধন করে পার্কিং এর পরিবর্তে শিশুদের খেলাধূলার জায়গা রাখার বিধান করা।
১০. প্রতিটি এলাকায় মাঠ, পার্ক ও উম্মুক্ত স্থানগুলো সংরক্ষন ও ব্যবহার উপযোগী করা।
১১. ডিটেল এরিয়া চুড়ান্ত বাস্তবায়নের পূর্বে, জলাধার সংরক্ষন ও উম্মুক্ত স্থান নিশ্চিত করাসহ সুপষ্ট দিকনির্দেশনা প্রদান করা।

সৈয়দ মাহবুবুল আলম, নীতিবিশ্লেষক
০১৫৫০৬০০২০৬

তথ্যসুত্র
১. জীবন ও স্থাপত্য, ডাব্লিউবিবি ট্রাস্ট
২. টেলিভিশনের নেতিবাচক প্রভাব ও আমাদের শিশু, ডাব্লিউবিবি ট্রাস্ট
৩. িি.িবসহনফ.হবঃ
৪. আমাদের অর্থনীতি, ৯ মার্চ ২০১০
৫. প্রথম আলো, ২২ মার্চ ২০১০
৬. দৈনিক জনকণ্ঠ, ২৮ জুন ২০০৯
৭. মানবজনিম, ২৯ জুন ২০০৯
৮. বাংলাদেশ সময়, ২৯ জুন ২০০৯
৯. দৈনিক ইত্তেফাক, ০৩ আগষ্ট ২০০৯
১০. দৈনিক ডেসটিনি, ২০ জুলাই ২০০৯
১১. সমকাল, ২৭ জুন ২০০৯
১২. নয়াদিগন্ত, ১৫ ফেব্র“য়ারি ২০১০
১৩. আমাদের সময়, ৭ জানুয়ারি ২০১০
১৪. প্রথম আলো ১২ জানুয়ারি ২০১০
১৫. নয়াদিগন্ত, ১ ফেব্র“য়ারি ২০১০
http://www.somewhereinblog.net/blog/tahin2000/29232958

সোমবার, ১৯ জুলাই, ২০১০

সেবাখাত বিরাষ্ট্রীয়করনে প্রেক্ষাপট-জনগনের সেবা প্রাপ্তির অধিকার

উন্নয়ন যে কোন জাতি ও মানুষের পরম একটি কাঙ্গিত বিষয়। কিন' উন্নয়ন কি? আমরা কিসের উন্নয়রেন জন্য কাজ করছি? আমরা কি প্রত্যাশিত উন্নয়নের দিকে যাচ্ছি? এ বিষয়গুলো নিয়ে অনেকেরই মত বিরোধ রয়েছে। তবে প্রচলিত অর্থে অনেকেই আমরা উন্নয়ন বলতে অর্থনৈতিক উন্নয়নের কথা বুঝে থাকি। আর এখানেই প্রশ্ন অর্থনৈতিক উন্নয়ন কিসের জন্য? আমরা অর্থনৈতিক উন্নয়ন চাই, যাতে মানুষের মৌলিক চাহিদাগুলোর নিশ্চিত করা যায়। কিন' বিগত দিনে আমাদের পদক্ষেপর ফলে কি মানুষের মৌলিক চাহিদাগুলো নিশ্চিত হয়েছে? না আরো অনেক মানুষের জীবন অনিশ্চয়তা দিকে এগিয়ে যাচ্ছে? সমাজে সুখ, শানিত্ম, সম্পৃতি কি বৃদ্ধি পেয়েছে? উন্নয়ন মানে কি শুধু সুউচ্চ দালাল কোটা, দামী গাড়ী, প্রশসত্ম রাসত্মা, আধূনিক যন্ত্রপাতি, দামী রেষ্টুরেন্ট, কিছু লোকের ধনী হওয়া, অর্থনৈতিক সুচক বৃদ্ধি, বিদেশী বিনিয়োগ? উন্নয়নের সুচক হওয়া উচিত রাষ্ট্র সুবিধা বঞ্চিত মানুষের মৌলিক অধিকার নিশ্চিতে কতটুকু সক্ষমতা অর্জন করতে সামর্থ হয়েছে।

বাংলাদেশের উন্নয়ন প্রত্যেক মানুষের স্বপ্ন। আমরা সকলেই চাই এ দেশ এগিয়ে যাক সুখ ও সমৃদ্ধির দিকে। সরকার এ স্বপ্ন বাসবায়নের অন্যতম কান্ডারী। রাষ্ট্রীয় সম্পদ তথা রাষ্ট্র যন্ত্রের যথাপোযুক্ত ব্যবহার নিশ্চিত করার মাধ্যমে এই লক্ষ্য অর্জন করা সম্ভব। বাংলাদেশের সংবিধানের ১৪ নং অনুচ্ছেদ অনুসারে ’’রাষ্ট্রের অন্যতম মৌলিক দায়িত্ব হইবে মেহনতি মানুষ (কৃষক ও শ্রমিক) কে এবং অনগ্রসর জনগনের অংশ সমূহকে সকল প্রকার শোষণ হইতে মুক্তি দান করা’’ এবং অনুচ্ছেদ ০৭ অনুসারে জনগনই প্রজাতন্ত্রের সকল ক্ষমতা উৎস, অনুচ্ছেদ ৪৭ অনুসারে বাংলাদেশে রাষ্ট্রয়াত প্রতিটি প্রতিষ্ঠান এবং খনিজ সম্পদের মালিক জনগন। কিন' রাষ্ট্রীয় সেবাখাত বিরাষ্ট্রীয়করনের মাধ্যমে এ দেশের মানুষকে অধিকারকে ক্ষুন্ন করা হয়েছে। রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলো হতে নির্বিচারে শ্রমিক ছাটাই করার মাধ্যমে দেশে দারিদ্রতা ও বেকারত্ব বৃদ্ধি করা হয়েছে।

অর্থনৈতিকভাবে শক্তিশালী দেশগুলো বিশ্বব্যাংক, আই এম এফ, এডিবি-র মতো ঋণলগ্নিকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর মাধ্যমে তাদের স্বার্থে আমাদের মতো দেশের সেবাখাত বিরাষ্ট্রীয়করণের দিকে ঠেলে দেয়। আর এ দেশের মানুষের সম্পদ লুটপাট করে নেয় বহুজাতিক কোম্পানিগুলোর মাধ্যমে। অর্থনৈতিক উন্নয়নের নামে এ সকল কার্যক্রম গ্রহণ করে হলেও অর্থনৈতিক উন্নয়ন আসেনি। জনগনের সম্পদ ব্যক্তির খাতে তুলে দিয়ে জনগনকে ব্যক্তির নিকট জিম্মি করার সংবিধান সম্পন্ন নয়। রাষ্ট্রীয় সম্পদ বিরাষ্ট্রীয়করণের ফলে মানুষের অর্থনীতি, পরিবেশ, সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা বিঘ্নিত হচ্ছে। দেশ জিম্মি হয়ে পড়ে বহুজাতিক কোম্পানি ও গুটি কয়েক ব্যক্তির কাছে।

বর্তমান বিশ্বে অর্থনৈতিক মন্দার কথা আমাদের সকলের জানা। বিশ্বের অন্যতম সম্পদশালী দেশ হওয়ার পরও আমেরিকা, ইংল্যান্ড এর মতো দেশগুলো অর্থনৈতিক মন্দার প্রকোপ হতে রক্ষা পাচ্ছে না। এ সকল রাষ্ট্র ব্যাংক, রেলসহ বিভিন্ন সেবা প্রদানকারী প্রতিষ্ঠান রাষ্ট্রায়ত্ব করেছে। আইসল্যান্ড তাদের সর্ববৃহৎ ব্যাংক রাষ্ট্রায়ত্ব করেছে। এ সকল দেশের অনেক প্রতিষ্ঠান দেউলিয়া হওয়ার প্রেক্ষিতে সরকার রাষ্ট্রীয় কোষাগার হতে অর্থ প্রদাণ করে এ সকল প্রতিষ্ঠান রাষ্ট্রায়ত্ব করেছে। আর ঠিক একই সময়ে বাংলাদেশে একের পর এক রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান কোম্পানি করার নামান-রে বিরাষ্ট্রীয়করণ করার পদক্ষেপ গ্রহণ করা হচ্ছে। এ বছর সরকার আর কোন রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানকে বিরাষ্ট্রীয়করন না করার চিন-া করছেন, যা অবশ্যই সাধুবাদ পাওয়ার যোগ্য। কিন' উৎকণ্ঠা রয়েই যাচ্ছে কারণ আগামী বছর কি আবার কোম্পানির নামানত্মরে বিরাষ্ট্রীয়করণ করা হবে।

সেবাখাত বানিজিককরণ
অর্থনীতিতে সেবা খাতের অবদান অত্যেনত্ম দূ্রত হারে বেড়ে যাবার ফলে এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ খাত হিসেবে আর্বিভুত হয়েছে । এ ধরনের একটি প্রেক্ষাপটে বিশ্ব বানিজ্য সংস'ায় সেবাখাত সংক্রানত্ম চুক্তি (জেনারেল এগ্রিমেন্ট অন ট্রেড ইন সার্ভিসেস’বা গ্যাটসের ) মাধ্যমে সেবা খাতকে আনুষ্টানিক ভাবে বিশ্ব বানিজ্য ব্যবস'ার অধীনে আনা হয় । এ চুক্তিতে যেসব যেসবসেবাখাত অনত্মর্ভুক্ত হয়েছে সেগুলোকে ১২ াট ভাগে ভাগ করা হয়েছে যার মধ্যে রয়েছে ১৬০টি উপখাত । মূল খাত গুলোর মধ্যে রয়েছে ব্যবসায়িক সেবা যোগাযোগ সেবা ,নির্মাণ ও সংশ্লিষ্ট প্রকৌশল সেবা ,বিতরন সেবা,শিক্ষা সেবা,পরিবেশগত সেবা , আর্থিক সেবা ,স্বাস'্য সংক্রানত্ম ও সামাজিক সেবা ,পর্যটন ও ভ্রমন সংক্রানত্ম সেবা ,বিনোদন সেবা , এবং অন্যান্য সেব িযেগুলো অন্য কোথাও উল্লেখ্য করা হয়নি ।

১৯৯৫ সালে গ্যাটস প্রতিষ্ঠার সময়ে সিদ্বানত্ম হয় যে , প্রতিষ্টার পাচঁ বছরের মধ্যে আলোচনা শুরু করতে হবে । সে অনুযায়ী ২০০০সালের জানুয়ারি মাসের আলোচনা শুরু হয় । গ্যাটস প্রতিষ্টার সময়ে কিছু কিছু বিষয় অমীমাংসিত ছিল যে গুলো পরবর্তীতে আলোচনার সময় নিষ্পত্তি করার সিদ্ধানত্ম হয় । ২০০০থেকে ২০০১সালের মার্চ পর্যনত্ম আলোচনা চলার পর সেবাখাতে বানিজ্য উদারীকরনের একটি নীতিমালা প্রণীত হয় । এতে দ্বিপাক্ষিক, বহুপাক্ষিক , ও সার্বজনীন আলোচনার মাধ্যমে সেবাখাত উন্মুক্ত করার রূপরেখা ঠিককরা হয় । আর আলোচনার উপায় হিসাবে অনুরোধ-প্রসত্মাব পদ্ধতি নির্ধারন করা হয় । একটি দেশ অন্য একটি দেশকে সেদেশের কোন একটি সেবা খাত উন্মুক্ত করার অনুরোধ জানাবে । প্রত্যুত্তরে এই দেশটি কোন কোন খাত কি পরিমানে উন্মুক্ত করতে পারবে তার প্রসত্মাব দেবে ।


ভতুর্কী, ঋণ, সহায়তা, বিনিয়োগ এবং অনুদান
দেশের নাগরিক হিসেবে প্রতিটি নাগরিক কর প্রদান করে আসছে। সরকার কর আদায় বৃদ্ধির লক্ষ্যে বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। নাগরিক হিসেবে এ কর প্রদানের উদ্দেশ্য আমরা কিছু সেবা পাবো। কিন' যদি রাষ্ট্রীয় সকল সেবাখাতগুলো বেসরকারী করে, তবে জনগনের কর প্রদানের উদ্দেশ্য বিষয়ে প্রশ্ন জাগে, জনগণ কেন কর প্রদান করবে? একদিকে রাজস্ব বৃদ্ধির জন্য জনসাধারণকে চাপ দেওয়া এবং অপর দিকে রাষ্ট্রীয় সুবিধাসমূহ সংকুচিত করার কোনভাবেই রাষ্ট্রীয় নীতি হতে পারে না।

অর্থনীতির ভাষার পারম্যাচে অনেক ক্ষেত্রেই দেশের মানুষদের বিভ্রানত্ম করা হয়। ভতুর্কী, ঋণ, সহায়তা, বিনিয়োগ এবং অনুদান যে নামেই অভিহিত করা হোক না কেন, এর ব্যয় বহন করতে হয় জনগনকে। অথবা বলা যেতে পারে জনগনের অর্থে এ সকল খাতে খরচ করা হয়। ঋণলগ্নিকারী সংস'াগুলো জনগনের কল্যাণে সেবাখাতে ভর্তুকীকে নিরুৎসাহিত করে থাকে এবং ভতুর্কীকে আর্থিক ক্ষতি হিসেবে অবহিত করে। কিন' অপর দিকে সরকারকে একের পর এক ঋণ গ্রহনের জন্য উৎসাহী করে থাকে। ঋণ ও ভতুর্কী উভয় খাতের অর্থই জনগনকে বহন করতে হয়।

ঋণলগ্নিকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর পরামর্শে উন্নয়নে দোহাই দিয়ে সেবাখাত বিরাষ্ট্রীয়করণ করা হলেও বিগত কয়েক বছরের এ দেশের দরিদ্রতা বৃদ্ধি পেয়েছে ৩গুন, ২০০৯-১১ সালের মধ্যে ২ কোটি ৬৫ লাখ ৮০ হাজার লোক বেকার হবে এবং বৈদেশিক ঋণের পরিমান হ্রাস পেলেও, ঋণ অর্থ পরিশোধের পরিমান বৃদ্ধি পেয়েছে। বাংলাদেশের ঋণের পরিমান ১ লক্ষ ৪২ হাজার কোটি টাকা এবং দেশের প্রতিটি শিশু ১১ হাজার টাকা ঋণের বোঝা নিয়ে জন্ম গ্রহণ করছে। বাংলাদেশকে ১ ডলার বৈদেশিক ঋণের বিপরীতে সুদসহ পরিশোধ করতে হচ্ছে দেড় ডলার। আর এ সকল ঋণের একটি বড় অংশ গ্রহণ করা করা হয় বিশ্বব্যাংক, আই এম এফ, এডিবি-র মতো প্রতিষ্ঠানগুলো হতে অহেতুক খাতে। এ প্রতিষ্ঠানগুলো একদিকে ঋণ দিয়ে ব্যবসা করছে, অপর দিকে তাদের দোসর কোম্পানির হাতে এ দেশের মানুষের সম্পদ তুলে দিচ্ছে বিরাষ্ট্রীয়করণের মাধ্যমে। ২০০৭ সালের সরকার বৈদেশিক ঋণের সুদ-আসল পরিশোধ করতে রাজস্ব বাজেটে প্রায় শতকরা ২৫ ভাগ ব্যয় করেছে। অর্থনৈতিক উন্নয়ন এই আজব সুত্রে পিষ্ট হচ্ছে উন্নয়নশীল দেশের প্রতিটি জনগন।

বেসরকারী খাতে র্দুনীতি নিয়ে ঋণলগ্নিকারী গোষ্টীর মৌনতা:
রাষ্ট্রীয়খাতে ব্যক্তি পর্যায়ের দুর্নীতির কারণে রাষ্ট্রীয় বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান বিরাষ্ট্রীকরণ করার পরামর্শ প্রদান করা হচ্ছে। অথচ বেসরকারীখাতে দূনীতির বিষয়ে ঋণপ্রদানকারী সংস'া, উন্নয়ন সহযোগি এবং দূনীতি বিরোধী সংস'াগুলো নিরব ভূমিকা পালন করছে। বিভিন্ন বিদেশী মোবাইল কোম্পানিগুলোর বিরুদ্ধে হাজার কোটি হাজার ভিওআইপির সমস্যা থাকা স্বত্বেও কোন পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়নি। সমপ্রতি অবৈধ ভিওআইপি কার্যক্রম পরিচালনার জন্য বিদেশী মোবাইল কোম্পানিগুলোকে জরিমানা করা হয়। অথচ বিগত কয়েক বছর ধরে কোম্পানিগুলো নগ্নভাবে এ ধরনের অপতৎপরতার মাধ্যমে দেশের রাজস্ব ক্ষতি করলেও তাদের বিরুদ্ধে এ সকল প্রতিষ্ঠান কোন উচ্চবাচ্য করেনি বরং অনেকে এই সময় গবেষণা করে বের করেছে রাষ্ট্রীয় সেবা প্রতিষ্ঠান বিটিটিবিতে কোন ব্যক্তি কি পরিমাণ দূনীতি করেছে। যদি সরকার কর্মকর্তা ঘুষ করে করে থাকে, তবে সে বেসরকারী কোম্পানি ঘুষ প্রদান করেছে তারাও দুনীতিবাজ। রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোতে ব্যক্তি পর্যায়ে দূনীতি করা হলেও, বেসরকারীখাতে দূনীতি করা হয় কোম্পানির মাধ্যমে। কোম্পানির এ ধরনের কার্যক্রম রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে অপরাধ। বেসরকারী কোম্পানিগুলোর বিজ্ঞাপনে/উপঢৌকনে মগ্ন থাকার কারণে অনেক দূনীতি বিরোধী ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান নীরব ভূমিকা পালন করছে। কিন' একতরফা রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে প্রচারণা রাষ্ট্রীয় সেবা খাতকে দূর্বল করছে এবং বিদেশী কোম্পানী/প্রতিষ্ঠানগুলোকে অবৈধভাবে জনগণকে শোষণ করতে সহযোগিতা প্রদান করছে।

রাষ্ট্রায়াত খাত শক্তিশালীকরণ উন্নয়নে পূর্বশর্ত

রাষ্ট্রায়াত খাত শক্তিশালীকরণ উন্নয়নে পূর্বশর্ত

উন্নয়ন যে কোন জাতি ও মানুষের পরম একটি কাঙ্গিত বিষয়। কিন' উন্নয়ন কি? আমরা কিসের উন্নয়রেন জন্য কাজ করছি? আমরা কি প্রত্যাশিত উন্নয়নের দিকে যাচ্ছি? এ বিষয়গুলো নিয়ে অনেকেরই মত বিরোধ রয়েছে। তবে প্রচলিত অর্থে অনেকেই আমরা উন্নয়ন বলতে অর্থনৈতিক উন্নয়নের কথা বুঝে থাকি। আর এখানেই প্রশ্ন অর্থনৈতিক উন্নয়ন কিসের জন্য?

বাংলাদেশের উন্নয়ন প্রত্যেক মানুষের স্বপ্ন। আমরা সকলেই চাই এ দেশ এগিয়ে যাক সুখ ও সমৃদ্ধির দিকে। সরকার এ স্বপ্ন বাসবায়নের অন্যতম কান্ডারী। তাই সকলের প্রয়োজন, সরকারের এ কার্যক্রমকে বাস-বায়নের লক্ষ্যে সহযোগিতা করা। রাষ্ট্রীয় সম্পদ তথা রাষ্ট্র যন্ত্রের যথাপোযুক্ত ব্যবহার নিশ্চিত করার মাধ্যমে এই লক্ষ্য অর্জন করা সম্ভব। কিন' বিগত ২৫/২৬ বছর যাবত রাষ্ট্রীয় সম্পদগুলো চক্রান- করে ধ্বংস করে ফেলা হয়েছে। ফলে এ দেশের মানুষের অর্থনীতি, পরিবেশ, সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা বিঘ্নিত হচ্ছে। দেশ জিম্মি হয়ে পড়ছে বিদেশী কোম্পানি ও গুটি কয়েক ব্যক্তির কাছে।

বিশ্বব্যাংক, আইএম এফ তথা অর্থলগ্নিকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর পরামর্শে উন্নয়নের দোহাই দিয়ে সেবাখাত বিরাষ্ট্রীয়করণ করা হলেও বিগত কয়েক বছরে এ দেশের দারিদ্রতা বৃদ্ধি পেয়েছে ৩ গুন, ২০০৯-১১ সালের মধ্যে ২ কোটি ৬৫ লাখ ৮০ হাজার লোক বেকার হবে এবং বৈদেশিক ঋণের পরিমান হ্রাস পেলেও, ঋণের অর্থ পরিশোধের পরিমান বৃদ্ধি পেয়েছে। বাংলাদেশের ঋণের পরিমান ১ লক্ষ ৪২ হাজার কোটি টাকা এবং দেশের প্রতিটি শিশু ১১ হাজার টাকা ঋণের বোঝা নিয়ে জন্ম গ্রহণ করছে। বাংলাদেশকে ১ ডলার বৈদেশিক ঋণের বিপরীতে সুদসহ পরিশোধ করতে হচ্ছে দেড় ডলার। আর এ সকল ঋণের একটি বড় অংশ গ্রহণ করা হয় বিশ্বব্যাংক, আই এম এফ, এডিবি’র মতো প্রতিষ্ঠানগুলো হতে, যা তাদের পরামর্শ মোতাবেক অপ্রয়োজনীয় খাতে ব্যবহার করতে হয়। এ প্রতিষ্ঠানগুলো একদিকে ঋণ দিয়ে ব্যবসা করছে, অপর দিকে তাদের দোসর কোম্পানির হাতে এ দেশের মানুষের সম্পদ তুলে দিচ্ছে, বিরাষ্ট্রীয়করণের মাধ্যমে। ২০০৭ সালে সরকার বৈদেশিক ঋণের সুদ-আসল পরিশোধ করতে রাজস্ব বাজেটে প্রায় শতকরা ২৫ ভাগ ব্যয় করেছে। অর্থনৈতিক উন্নয়ন এই আজব সুত্রে পিষ্ট হচ্ছে উন্নয়নশীল দেশের প্রতিটি জনগন।

বিশ্বব্যাংকের প্রতিবেদন অনুসারে প্রতিবছর দরিদ্র হ্রাসের হার মাত্র ১%, হতদরিদ্র সংখ্যা বেড়েছে ৪০ লাখের বেশি, ধনী ও দরিদ্রের মধ্যে আয় বৈষম্য অতিমাত্রায় বৃদ্ধি পাচ্ছে, মুদ্রাস্ফীতির হার ক্রমবর্ধমান এবং তা বেড়ে ২ অংকে স্পর্শ করেছে যা দরিদ্র এবং মধ্যবিত্ত শ্রেণীর লোকদের জীবনধারণকে কঠিন করছে। বেকারত্বের সংখ্যা প্রায় ৪ কোটি। বাজেটে বৈদেশিক ঋণ শোধের জন্য বরাদ্ধ রাজস্ব বাজেটের ২০.৫%। স্বাস'্যখাতে বরাদ্ধ বৈদেশিক দেনা পরিশোধের বরাদ্ধের অর্ধেক। ২০০৭-০৮ অর্থবছরে স্বাস'্য খাতে বরাদ্ধ ৭০০ মিলিয়ন ডলার পক্ষানত্মরে ঋণ পরিশোধ খাতে বরাদ্ধ ১৫৬৩ মিলিয়ন ডলার। দেশে সাামজিক অবস'ার অবনতি হয়েছে, অপরাধ, মাদক ব্যবহার, শিক্ষা-সাংস্কৃতিক সবকিছুর অবস'াই সনেত্মাষজনক নয়।

রাষ্ট্রীয় সম্পত্তি বিরাষ্ট্রীকরণে প্রথমেই অর্থনৈতিক উন্নয়নের দোহাই দেওয়া হয়। এই অর্থনৈতিক উন্নয়নের সোনার হরিণের লোভে আমাদের অনেক রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান বিরাষ্ট্রীকরণ এবং পরিবেশ ধ্বংস করে বৈদেশিক বিনিয়োগ বৃদ্ধি করা হলেও দরিদ্রতা কতটুকু হ্রাস পেয়েছে বা দেশের মানুষের সত্যিকার উন্নয়ন কতটুকু হয়েছে তা বিবেচ্য বিষয়। যদি বৈদেশিক বিনিয়োগ অর্থনৈতিক উন্নয়নের সূচক ধরা হয়, তবে এখন প্রশ্ন করার সময়, বিগত দিনের বিনিয়োগের প্রেক্ষিতে কতজন মানুষের স্বাস'্য সেবা, শিক্ষার মতো মৌলিক প্রয়োজন মেটানোর সামর্থ রাষ্ট্রের হয়েছে। নতুন নতুন রাসত্মা, দালান বা বাহারী বিজ্ঞাপন অবশ্যই রাষ্ট্রীয় উন্নয়নের মাপকাটি নয়। দেশের পিছিয়ে পড়া মানুষদের মৌলিক চাহিদা পূরণে রাষ্ট্র কতটুকু সেবা বা সহযোগিতা প্রদান বৃদ্ধি করতে পেরেছে এটিই রাষ্ট্রীয় উন্নয়নের মাপকাটি হওয়া প্রয়োজন।

নতুন নতুন রাস-া, দালান বা বাহারী বিজ্ঞাপন অবশ্যই রাষ্ট্রীয় উন্নয়নের মাপকাঠি নয়। দেশের পিছিয়ে পড়া মানুষদের মৌলিক চাহিদা পূরণে রাষ্ট্র কতটুকু সেবা বা সহযোগিতা প্রদান বৃদ্ধি করতে পেরেছে এটিই রাষ্ট্রীয় উন্নয়নের মাপকাঠি হওয়া বাঞ্ছনীয়। কিন' রাষ্ট্রীয় ক্ষমতাকে সংকুচিত করে ব্যক্তি তথা কোম্পানির ক্ষমতা বৃদ্ধির ফলে গুটি কয়েক মানুষের উন্নয়ন হলেও, দরিদ্র, ক্ষুদা ও বঞ্চনার শিকার হচ্ছে অধিকাংশ মানুষ। ধনী ও গরীদের ব্যবধান বৃদ্ধি পাচেছ দিন দিন। ধনীরা দিন দিন ধনী হচ্ছে এবং দরিদ্ররা আরো দরিদ্র হচ্ছে। ধনী ও গরীদের ব্যবধান সৃষ্টি করছে সামাজিক অশানিত্ম ও অরাজগতা। এই ব্যবধান শুধু দেশের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়, ছড়িয়ে পড়েছে দেশে দেশে। গবেষণা দেশে ব্‌শ্িব জনসংখ্যার ৫ ভাগ যারা ধনী দেশে বাস করে এবং ৫ ভাগ যারা গরীব দেশে বাস করে তাদের মধ্যে আয়ের ব্যবধান ১৯৬০ থেকে ১৯৯০ এর মধ্যে দ্বিগুন হয়ে ৩০:১ তে গিয়ে পৌছায়। ১৯৯৮ সালে এটা হঠাৎ করে আবার বেড়ে যায় এবং ব্যবধান বেড়ে ৭৮:১ হয়ে য়ায়।
বাংলাদেশে স্বাধীনতার পর থেকে কি পরিমান শিল্প প্রতিষ্ঠান বন্ধ করা হয়েছে তার ইয়ত্তা নেই। ঋণের টাকায় রাষ্ট্রীয় ব্যয় হ্রাস এবং উন্নয়নের নামে এ সকল প্রতিষ্ঠান বিরাষ্ট্রীয়করণ করা হয়। কর্মচূত্য করার হয় লক্ষ লক্ষ শ্রমিকদের। কিন' শিল্প উন্নয়ন কি হয়েছে। কি অবস'ায় আছে সেই সকল বিরাষ্ট্রীয়করণ বা বন্ধকৃত শিল্পপ্রতিষ্ঠানগুলো। বিরাষ্ট্রীয়করনের ফল শিল্প কারখানার সম্পদ ব্যক্তিদের হাতে লুটপাত হয়েছে। তবে দেশের জনগেনর কি লাভ হলো। রাষ্ট্রের জনগনের সম্পদ এইভাবে বিরাষ্ট্রীকরন, বিরাষ্ট্রীয়করনের জন্য ঋণ গ্রহণ বা প্রদান কি দুনীতি নয়? বিশ্বব্যাংক বা এডিবিকে প্রশ্ন করা উচিত তাদের অকার্যকর পরিকল্পনা ও ঋণের উদ্দেশ্যকি রাষ্ট্রীয় সেবাখাতকে ধ্বংশ করা? আমাদের প্রত্যক্ষ উদাহরণ আদমীজুট মিল। আদমজীর বন্ধের প্রেক্ষিতে ১৭০০০ লোকের কর্মসংস'া হারায়। কিভাবে বাচবে এই লোকগুলো। তাদের পরিবারগুলো কিভাবে চলবে। কর্মসংস'ার বন্ধের প্রেক্ষিতে তাদের যে মৌলিক অধিকারগুলো ক্ষুন্ন হচ্ছে, এই দায় কিভাবে সরকার এড়িয়ে যাবে? কর্মসংস'ানহীনতা তাদের অনেকেই অপরাধী করবে না তার কিইবা নিশ্চিয়তা রয়েছে। এসকল লোকের অপরাধী হিসেবে তৈরি করার দায় কার। মানুষের কাধে ঋণের বোঝা চাপিয়ে এগুলো সমস্যা সৃষ্টি করার অর্থ যদি অর্থনৈতিক উন্নয়ন হয়। তবে তা উম্মাদনা ছাড়া আর কিছুই নয়।

এ সমস্যা শুধুমাত্র বাংলাদেশে নয়। দেশের বাইরেও বিভিন্ন কোম্পানী ও সম্পত্তির মালিকানা গুটিকতক ব্যাক্তির হতে কুন্ঠিগত রাখার পরিক্লপনা করা হচ্ছে। ইতিমধ্যে বশ্বের বড় ২০০ টি কোম্পানি সমগ্র পৃথিবীর ৩০ ভাগ অর্থনীতি নিয়ন্ত্রণ করলেও শ্রমবাজাররের মাত্র এক শতাংশ তারা কাজে নিযুক্ত রেকেছে। ১৯৮৩ থেকে ১৯৯৯ এর মধ্যে তাদের মুনাফা বেড়ে ৩৬২.৪% ভাগ হলেও শ্রমিকের সংখ্যা বেড়েছে মাত্র ১৪.২ ভাগ। এসব কোম্পানি যত বড় হচ্ছে এবং বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে পড়ছে, তত তারা প্রতিদ্বন্দ্বীদের কিনে ফেলছে এবং একই রকম চাকুরী তারা নি:শেষ করে দিচ্ছে। বর্তমানে আমাদের নিজেদের অসিত্মত্ব রক্ষার স্বার্থে কোম্পানী ও সম্পত্তির মালিকানা গুটিকতক ব্যাক্তির হতে কুন্ঠিগত রেখে রাষ্ট্রিয় সম্পত্তি বিরাষ্ট্রিয়করনে প্রবনতা প্রতিহত করতে হবে।

বর্তমান বিশ্বে অর্থনৈতিক মন্দার কথা আমাদের সকলের জানা। বিশ্বের অন্যতম সম্পদশালী দেশ হওয়ার পরও আমেরিকা, ইংল্যান্ড এর মতো দেশগুলো অর্থনৈতিক মন্দার প্রকোপ হতে রক্ষা পাচ্ছে না। এ সকল রাষ্ট্র ব্যাংক, রেলসহ বিভিন্ন সেবা প্রদানকারী প্রতিষ্ঠান রাষ্ট্রায়ত্ব করেছে। সমপ্রতি আইসল্যান্ড তাদের সর্ববৃহৎ ব্যাংক রাষ্ট্রায়ত্ব করেছে। এ সকল দেশের অনেক প্রতিষ্ঠান দেউলিয়া হওয়ার প্রেক্ষিতে সরকার রাষ্ট্রীয় কোষাগার হতে অর্থ প্রদাণ করে এ সকল প্রতিষ্ঠান রাষ্ট্রায়ত্ব করেছে। আর ঠিক একই সময়ে বাংলাদেশে একের পর এক রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান কোম্পানি করার নামান-রে বিরাষ্ট্রীয়করণ করার পদক্ষেপ গ্রহণ করা হচ্ছে। সম্প্রতি সরকার আর কোন রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানকে বিরাষ্ট্রীয়করন না করার চিন-া করছেন, যা অবশ্যই সাধুবাদ পাওয়ার যোগ্য। খেয়াল রাখতে হবে কোন অবস'াতেই যেন আর কোন রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানকে বিরাষ্ট্রীয়করন না করা হয়।

রাষ্ট্রীয় সম্পদ বিরাষ্ট্রীয়করণের ফলে শুধুমাত্র পরিবেশ নয়, ক্ষতিগ্রসত্ম হচ্ছে অর্থনীতি, সংস্কৃতি এবং সর্বোপরি দেশের মানুষ। রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণ না থাকায় বিভিন্ন কোম্পানির অনিয়ন্ত্রিত এবং অনৈতিক ব্যবসায় সর্বশানত্ম হচ্ছে মানুষ। সরকারী মনিটরিং সংস'াগুলোকে সুকৌশলে দূর্বল করার মাধ্যমে চিকিৎসা, ঔষধ এবং খাদ্যের মতো অত্যাবশকীয় জিনিসগুলোকে জিম্মি করে জনসাধারণকে প্রতারিত করা হচ্ছে। শুধু তাই নয়, বিগত কয়েক বছরে বিভিন্ন সেবাখাতগুলোর উপর রাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রণ হ্রাস করার ফলে বিদেশী কোম্পানিগুলো যোগাযোগ, শিল্প ও বাণিজ্য খাত হতে হাজার হাজার কোটি টাকা দেশের বাইরে নিয়ে যাচ্ছে এবং সেই সাথে ধ্বংস করছে পরিবেশ ও সংস্কৃতি। কোম্পানিগুলোর অনৈতিক ও অনিয়ন্ত্রিত কার্যক্রমে বৃদ্ধি পাচ্ছে মানুষের জীবন যাত্রার ব্যয়। বিরাষ্ট্রীয়করনের ফলে দেশের যোগাযোগ, স্বাস'্য, শিক্ষা, অর্থ, পরিবেশ সকল ক্ষেত্রই আজ জিম্মি অনৈতিক ব্যবসায়ীদের হাতে। খাদ্যে অযৌক্তিক মূল্য বৃদ্ধি, নিয়ন্ত্রণহীন যাতায়াত ভাড়া, চিকিৎসা খরচ বৃদ্ধি, ঔষধদের অনিয়ন্ত্রিত মূল্য, বীজ সংকট, মোবাইল কোম্পানিগুলোর অস্বাভাবিক রেট, ব্যাংকগুলোর অযৌক্তিক চার্জ, বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মানহীন শিক্ষা ব্যবস'া ইত্যাদি রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণহীনতার ফসল। প্রশ্ন হচ্ছে, এই অবস'া হতে আমরা কি উত্তরন চাই?

যদি মানুষের উন্নয়ন করতে হয় তবে মানুষের মৌলিক চাহিদাগুলো নিশ্চিত করতে হবে। আর মানুষের মৌলিক চাহিদাগুলো নিশ্চিত করতে রাষ্ট্রকে নিশ্চিত করতে হবে। রাষ্ট্রীয় সেবা প্রতিষ্ঠানগুলোকে কার্যকর ও সক্রিয় করার মাধ্যমেই এই অবস'া নিশ্চিত করা সম্ভব। কোম্পানির হাতে মানুষের মৌলিক চাহিদাগুলো তুলে দেওয়া হলে, তা তাদের ব্যবসায় রূপানত্মর হবে। মানুষের সমস্যা হবে তাদের ব্যবসার উপাদান। আর এ প্রক্রিয়ার মাধ্যমে দেশের উন্নয়ন সম্ভব নয়। টাকার অংকে হয়তো জিডিপি ও মাথাপিছু আয় বাড়বে, হয়তো বাহানী বিজ্ঞাপন ও সুউচ্চ অট্টালিকা ও দামি গাড়ি হবে। কিন' তার পিছনে আড়াল হয়ে যাবে কোটি কোটি দরিদ্র মানুষ। আমরা বিশ্বাস করি, অতীতের ভুল হতে শিক্ষা নিয়ে আমাদের নীতিনির্ধারকগণ রাষ্ট্রীয় সম্পদ রক্ষায় প্রয়োজনীয় উদ্যোগ গ্রহণ করবে। রাষ্ট্র দায়িত্ব নেবে মানুষের মৌলিক চাহিদা নিশ্চিতের, যা মানুষকে প্রকৃত উন্নয়নের দিকে এগিয়ে নিয়ে যাবে।