মঙ্গলবার, ২৭ এপ্রিল, ২০১০

ইকো নগরায়ন: কিছু মৌলিক বিষয়

ইকো নগরায়ন: কিছু মৌলিক বিষয়

পরিবেশ দূষণ বর্তমানে মানুষের রোগ ও স্বাস'্য সমস্যার একটি বড় কারণ। পরিবেশ দুষণের কারণে প্রাকৃতিক বিপর্যয়সহ নানা ধরনের প্রতিবন্ধকতার সম্মুখীন হচ্ছে মানব সভ্যতা। ক্ষতিগ্রসৱ হচ্ছে অর্থনীতি, উন্নয়ন, মানুষের বিকাশ। নগরায়ন ও শিল্পায়ন পরিবেশ দূষণের অন্যতম প্রদান করা। কিন' এ সত্য জানার পরও থেমে নেই পরিবেশ দূষণের মাত্র। দিন দিন তা বৃদ্ধি পাচ্ছে। অর্থনৈতিক উন্নয়নের অজব লক্ষে জিডিপি বৃদ্ধির উম্মদনায় ধ্বংশ করা হচ্ছে পরিবেশ, মানবতা, স্বাস'্য, সংস্কৃতি। জিডিপির অংক বৃদ্ধি পেলে অন্যান্য সমস্যাগুলোর সাথে বাড়ছে দারিদ্র মানুষের ভোগানিৱ আর বিনষ্ট হচ্ছে সামাজিক সমপ্রতি। ধনী আরো ধনী হচ্ছে, গরীব আরো গবীর হচ্ছে। নগরগুলো হচ্ছে শোষনের আবাসস'ল। অধিকাংশ মানুষের সুবিধাকে ছিনিয়ে উন্নয়নে নামে করা হচ্ছে নগরায়ন।

শত বছরের পুরাতন এই ঢাকা নগরীতে হাজার হাজার কোটি টাকা খচর করার পরও বিজ্ঞজনের আশংকা এই নগরী মানুষের বসবাসের অযোগ্য হয়ে পড়বে। এই নগরীর পরিবেশ দূষণ, যানজট, স্বাস'্য, পানি, শিক্ষা, যোগাযোগ কোন বিষয়েই পরিবেশ বান্ধব হয়নি। বরং দিন দিন খারাপ হচ্ছে। অথচ একদিন এই শহরই ছিল একটি আর্দশ নগরী। কিভাবে ধ্বংশ করা হলো সেই পরিবেশ বান্ধব নগরীকে, কেন করা হলো? কেন সমস্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে? আমাদের পরিকল্পনা মৌলিকতা কি কোন ভূল আছে? না এ প্রশ্ন খোজার চেষ্টা হয়নি। বরং একটি ভুলকে ঢাকতে আরো একটি ভূল করা হচ্ছে। সবচেয়ে ভয়কর বিষয় হচ্ছে এ নগরীর পরিকল্পনাগুলো দেশের অন্য এলাকাগুলোতেও করার চেষ্টা করা হচ্ছে। বিগত দিনের ভুলগুলো হতে শিক্ষা নিয়ে পরিবেশ, অর্থনীতি ও মানুষের স্বাস'্য রক্ষায় একটি পরিবেশ বান্ধব নগরী গড়ার কোন বিকল্প নেই।

নগরের পরিবেশ ও স্বাস'্য ঃ
উন্নত জীবনের সন্ধানে এই নগরে ছুটে আসলেও, এ নগর মানুষের উন্নত জীবনের অনৱরায়। জীবন ধারনের অন্যতম প্রধান উৎপাদন বায়ু দূষণ, শব্দদূষণ, পানি দূষণ কারণের মানুষ বিভিন্ন প্রানঘাতী রোগে আক্রানৱ হচ্ছে। নগরের যাতায়াত ও অবকাঠামোর প্রতিবন্ধকতার কারণে হ্রদরোগ, স্ট্রোক, ডায়বেটিক অতিরিক্ত মোটা হওয়াসহ নানা ধরনের অসংক্রামক রোগ বৃদ্ধি পাচ্ছে। খেলাধুলা ও পর্যাপ্ত বিনোদনের অভাবের কারণে শিশু-কিশোরদের মানসিক ও শারিরীক বিকাশ বাধাগ্রসৱ হচ্ছে।

মানুষের সার্বিক কল্যাণের কথা চিন-া করে একটি টেকসই নগর গড়ে তোলার জন্য গণমুখী ইকো নগরায়নের প্রতি গুরুত্ব দেয়া প্রয়োজন। গণমুখী ইকো নগর পরিকল্পনায় নগরকে কিভাবে সর্বস-রের মানুষের জন্য বাসযোগ্য এবং আন-রিক হিসেবে গড়ে তোলা যায় সেদিকে নজর দেয়া হয় । নগরের যে কোন অবকাঠামো বা উন্নয়ন কর্মকান্ড কিভাবে পরিবেশবান্ধব এবং সকল শ্রেণীর মানুষের জন্য সহজগম্য করা যায় সেটিই গণমুখী নগর পরিকল্পনার মূল লক্ষ্য।

একটি শহরের পরিকল্পনা নাগরিকদের দৈনন্দিন জীবন এবং কার্যক্রমকে নানাভাবে প্রভাবিত করে। নগর পরিকল্পনা হওয়া প্রয়োজন মানুষের কথা মাথায় রেখে। একটি সুষ্ঠু সুন্দর পরিবেশবান্ধব পরিকল্পিত নগরী দক্ষ মানবগোষ্ঠী গড়ে তুলতে সহায়ক। গণমুখী টেকসই সমন্বিত নগর পলিল্পনা প্রণয়নের মাধ্যমে মানুষের জীবনযাত্রার মান যেমন উন্নত হবে, তেমনি একটি আনৱরিক, পরিবেশবান্ধব বসবাস উপযোগী শহর গড়ে তোলা সম্ভব।

আমাদের শহরগুলো হওয়া উচিত এইরূপ-যেখানে বাসস'ানের পাশাপশি প্রচুর গাছপালা থাকবে, প্রাকৃতিক পরিবেশ ক্ষতিগ্রস' হবে না, শিশুরা ঘরের বাইরে নিরাপদে খেলাধূলার পরিবেশ পাবে, নগরবাসী পাবে একটি সুস' বিনোদনের পরিবেশ, প্রতিবেশীদের মধ্যে থাকবে আন-রিক সম্পর্ক, প্রয়োজনীয় খাদ্যের যোগানের জন্য বাসস'ানের কাছাকাছি পর্যাপ্ত কৃষি জমি থাকবে। যেখানে নগরের গতানুগতিক যান্ত্রিকতা এড়িয়ে আনৱরিকতাপূর্ণ সুন্দর জীবন উপভোগ করা সম্ভব হবে।

বর্তমানে সারা বিশ্বব্যপী জলবায়ু পরিবর্তনের ব্যপক প্রভাব পড়ছে। জলবায়ু পরিবর্তন রোধে ইকো নগরায়ন অত্যনৱ কার্যকরী ভূমিকা পালন করতে পারে। বর্তমানে বেশীরভাগ শহর পরিবেশ দূষণের অন্যতম প্রধান উৎস হিসাবে আবর্তিত হচ্ছে। কিন' শহরগুলো হতে পারে। শহরের বিভিন্ন সমস্যার প্রধান কারণ পরিকল্পনাবিহীন শহর গঠন নয় বরং আমাদের নির্ধারণ করতে হবে আমরা কোন কোন বিষয়কে অধিক প্রাধান্য প্রদান করব। ইউরোপের বিভিন্ন শহরের সবচেয়ে আকর্ষণীয় অংশগুলো দেখা যায় অনেক পুরানো এবং এগুলো গড়ে উঠেছিলো কোন রকম পরিকল্পনা ছাড়া শহরে বসবাসকারীদের বিভিন্ন প্রয়োজনের ধারাবাহিকতায়।

অপরদিকে দেখা যাচ্ছে যে আধুনিক পরিকল্পিত নগরী নগরজীবনে বিভিন্ন সমস্যা তৈরি করেছে। পরিকল্পনার মাধ্যমে একটি কংক্রীটে ঘেরা নগরী আমারা তৈরী করতে পারব কিন' সেটা অবশ্যই আদর্শ বসবাস উপযোগী নগরী হবে না। বর্তমানে নগর পরিকল্পনায় যেটি প্রধান সমস্যা আমরা নগরীর অন্যান্য সবরকম চিন-া বাদ দিয়ে সবচেয়ে বেশী প্রাধান্য দিচ্ছি নগরীর যাতায়াত ব্যবস'্যকে এবং যাতায়াত ব্যবস'ায় সবচেয়ে বেশী প্রাধান্য দিচ্ছি প্রাইভেট গাড়ীকে।

নগর পরিকল্পনায় সর্বপ্রথম আমাদের মনে রাখতে হবে নগর তৈরীর উদ্দেশ্য। একটি শহর গড়ে ওঠে মানুষকে উন্নত কর্মসংস'ান, শিক্ষা ও স্বাস'্য সেবা প্রদান, বিনোদনের সুযোগ প্রদান এবং মানুষের পাস্পরিক সম্পর্ক বৃদ্ধির মিলনকেন্দ্র হিসাবে। এই সমস- সুবিধাগুলো মানুষের হাতের নাগালের মধ্যেই থাকা উচিত। এই সুবিধাগুলো প্রদানের মাধ্যমেই নগরগুলোকে ধ্বংসের হাত থেকে রক্ষা করা সম্ভব।

নগরের আবাসন সংস'ান করতে গিয়েও আমরা মানুষের কল্যাণের দিকটি চরমভাবে উপেক্ষা করছি। নগরের মধ্যে এবং শহরের নিকটবর্তী স'ানে বিভিন্ন আবাসিক এলাকা গড়ে তোলার ক্ষেত্রে প্লট ভিত্তিক উন্নয়ন করায় মানুষের মধ্যে পারষ্পরিক যোগাযোগের সুযোগ কমে যাচ্ছে। এ ধরনের আবাসিক এলাকায় কাছাকাছি বাজার, শিক্ষা ও স্বাস'্য সেবা প্রতিষ্ঠান, অফিস না থাকায় দূরে যাওয়ার প্রয়োজন পড়ে এছাড়া বিনোদনের সুবিধা ও মানুষের মেলামেশার জন্য উন্মূক্তস'ান না থাকায় পারস্পরিক যোগাযোগ ব্যহত হয় । একইভাবে এপার্টমেন্ট ভিত্তিক যে আবাসন ব্যবস'া গড়ে উঠছে তাতেও মানুষের সাথে মানুষের সামাজিক যোগাযোগের সুযোগ রাখা হচ্ছে না। ফলে আগে আমাদের এলাকা ভিত্তিক যে আন-রিক পরিবেশ ছিল তা ক্রমেই নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। মানুষের সাথে মানুষের দূরত্ব বেড়ে যাচ্ছে যা সমাজের সার্বিক নিরাপত্তার জন্য হুমকি স্বরূপ।

একটি বসবাস উৎযোগী নগরী গড়ে তোলার ক্ষেত্রে নগর পরিকল্পনায় যে বিষয়গুলো প্রাধান্য দেয়া প্রয়োজন:-

মিশ্র এলাকা
মিশ্র এলাকা একটি শহরের জন্য উত্তম। আমাদের মনে রাখতে হবে মানুষের মূল উদ্দেশ্য যাতায়াত নয় বরং দ্রব্য এবং সেবা প্রাপ্তি। এই সকল সুবিধা বাসস'ানের খুব কাছাকাছি পাওয়া গেলে আমাদের যাতায়াতের প্রয়োজনীয়তা হ্রাস পায়, এর ফলে অবকাঠামো গঠনের সময় আমরা রাস-াঘাট নির্মাণের থেকে অনা্যন্য প্রয়োজনীয় বিষয়ে অধিক গুরুত্ব প্রদান করতে পারি। উপোরক্ত সুবিধাগুলো নগর পলিল্পনায় সমন্বিত করার মাধ্যমে মানুষের জীবনযাত্রার মান যেমন উন্নত হবে, তেমনি একটি আনৱরিক, পরিবেশবান্ধব বসবাস উপযোগী শহর গড়ে তোলা সম্ভব। আমাদের দেশের নগরগুলোর অধিকাংশ এলাকা মিশ্র ব্যবহার ভিত্তিক। এখানে খুব অল্প দূরত্বেই প্রায় সব নাগরিক সুবিধাদি পাওয়া যায়। কিন' আমাদের বর্তমান নগর পরিকল্পনা বা পরিবহন পরিকল্পনা বিশেষ করে ঢাকায় ক্রমেই এই সুবিধাটুকু নষ্ট করে দিচ্ছে। মানুষ ক্রমেই বেশী দূরত্বে যাতায়াত করতে বাধ্য হচ্ছে, যা বাড়িয়ে দিচ্ছে যানজট।

ঢাকা শহরের কর্মকান্ডকে সুষ্ঠুভাবে পরিচালনার লক্ষ্যে ১৩ টি জোনে বিভক্ত করা হয়েছে। কোন জোন কি কাজে ব্যবহৃত হবে সেটিও নির্ধারণ করার চেষ্টা করা হয়েছে। কোনটি আবাসিক কোনটি আবার বাণিজ্যিক। শহরেরে কর্মকান্ড সুষ্ঠুভাবে পরিচালনার জন্য জোন ভাগ করার প্রয়োজন রয়েছে। তবে প্রতিটি জোন এর জন্য কি কি সুবিধা থাকা প্রয়োজন তা নির্ধারণ করা কঠিন। তারপরও কিছু বিষয় বা উপাদান রয়েছে যেগুলি মানুষের বসবাসের ক্ষেত্রে অত্যাবশ্যকীয়। যেমন-শিক্ষা, স্বাস'্য, বাজার, বিনোদন, আবাসন, কর্মসংস'ান ইত্যাদি। প্রতিটি জোনে অল্প দূরত্বে এ সকল সুবিধা থাকলে যাতায়াতের চাহিদা কমানো যাবে। এদিক থেকে ঢাকা শহরের কাঠামোটি ইতিবাচক। তবে সমস্যা হলো ঢাকার বিভিন্ন অঞ্চলে মধ্যে বৈষম্য বৃদ্ধি পাচ্ছে। শহরে কোন একটি এলাকায় গড়ে উঠছে ভালো ভালো শিক্ষা-স্বাস'্য সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠান, বাজার, অফিস, বিনোদন কেন্দ্র। শহরের প্রতিটি জোনে প্রয়োজনের ভিত্তিতে এ সকল সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করতে হবে। যা যানজট নিয়ন্ত্রণ করবে এবং যাতায়াতের চাহিদা হ্রাস পাওয়ায় মানুষ অতিরিক্ত খরচের হাত থেকে মুক্তি পাবে।

গণমুখী সমন্বিত পরিবহন পরিকল্পনা
আমাদের নগর পরিকল্পনায় পরিবহন ব্যবস'া এবং তার সাথে সম্পৃক্ত আন্যান্য বিষয়গুলোকে বিবেচনা করা প্রয়োজন। আমাদের মনে রাখতে হবে মানুষের মূল উদ্দেশ্য যাতায়াত নয় বরং দ্রব্য এবং সেবা প্রাপ্তি। আমাদের পরিবহন পরিকল্পনার মূল সমস্যা এখানেই যে যাতায়াত উদ্দেশ্য বিবেচনা না করেই পরিকল্পনা করা হয়। মানুষ যদি তার প্রয়োজনীয় জিনিষগুলো হাতের কাছেই পেয়ে যায় তাহলে তার দূরে যাবার প্রয়োজন হয়না। শহরের অবকাঠমো এমনভাবে তৈরী করা প্রয়োজন যার ফলে মানুষের দূরে যাবার প্রয়োজনীয়তা অনেকাংশে হ্রাস পায়।

এখন পর্যনৱ আমাদের শহরগুলোতে কাছাকাছি বাজার, শিক্ষা ও স্বাস'্য সেবা প্রতিষ্ঠান, কর্মসংস'ান, বিনোদনের সুবিধা অধিকাংশ যাতায়াতই হয়ে থাকে স্বল্প দূরত্বে। আর এর জন্য হেঁটে চলা বা অযান্ত্রিক যানের ব্যবহার হয়ে থাকে সবচেয়ে বেশী । কিন' আমাদের নগরের পরিবহন পরিকল্পনাগুলো কখনই এই সকল গুরুত্বপূর্ণ যোগাযোগ মাধ্যমকে যথাযথ গুরুত্ব পায়নি। একই সাথে নগরের ভূমি ব্যবহার পরিকল্পনা এবং পরিবহন পরিকল্পনার মধ্যে যে ওতোপ্রোত সম্পর্ক বিদ্যমান তাও কখনও তেমন ভাবে অনুধাবন করা হয়নি।

কাছে যাতায়াতের থেকে যখন দূরের যাতায়াত বেশী সুবিধাজনক হবে মানুষ তখন দূরে যাতায়াত করতে আগ্রহী হবে। মানুষের বাসস'ান থেকে তার কর্মক্ষেত্র, বাচ্চাদের স্কুল ইত্যাদি দূরে দূরে থাকবে। উদাহরনস্বরূপ বলা যায় আজিমপুর থেকে ধানমন্ডি যাওয়ার থেকে আজিমপুর থেকে উত্তরা যাওয়া বেশী সুবিধাজনক হলে মানুষ উত্তরা থেকে আজিমপুর যেতে আগ্রহী হবে। মানুষের দূরে যাতায়াতের প্রবণতা বৃদ্ধি পেলে, যতবেশী রাস-াঘাটই নির্মাণ করা হোক না কেন শহরের যানযট বৃদ্ধি পায়। অপরদিকে মানুষ সহজে কাছকাছি দুরত্বে যাতায়াত করার সুযোগ পেলে তার বাসস'ানের কাছাকাছি সবকিছু পেতে চেষ্টা করবে, এবং এর ফলে যানযট কমবে। ফলে একদিকে যেমন সময়ের অপচয় কম হবে অন্যদিকে মানুষের জীবন যাত্রার মান বৃদ্ধি পাবে এবং পাশাপাশি স্বল্প দূরত্বে যাতায়াতের ফলে জ্বালানীর অপচয় কম হবে এবং শব্দ ও বায়ু দূষনের হারও কমবে। একস'ান থেকে অন্যস'ানে দ্রুত এবং কমখরচে যাওয়া যাবে। যানবাহনের তুলনায় মানুষের জন্য বেশী জায়গা প্রদান করা হলে মানুষের বিনোদনের সুযোগ বৃদ্ধি পাবে।

বিকেন্দ্রীকরণ
রাজধানী শহর হিসেবে ঢাকা মহানগরীর গুরুত্ব অবশ্যই অনেক বেশি। দেশের সার্বিক উন্নয়ন ও তার সুফল সর্বত্র সুষম বন্টনের লক্ষ্যে অন্যান্য শহরগুলির উন্নয়ন জরুরী। কিন' দেশে সব কিছুই ঢাকার মধ্যে পুঞ্জীভূত করা হচ্ছে। প্রশাসনিক-নিরাপত্তা কর্মকান্ড থেকে ব্যাবসা-বাণিজ্য, কল-কারখানা, শিক্ষা-স্বাস'্যসেবা, অফিস আদালত সব কিছুই ঢাকাকে কেন্দ্র করে। তাই চাকরি, ব্যবসা, ছেলেমেয়েদের পড়ালেখা, পরিবারের সুচিকিৎসা, বিনোদন এসব কিছুর আশায় মানুষ আজ ঢাকামূখী। তাছাড়া দেশে যে কোন দূর্যোগে সর্বহারা মানুষ দু-মুঠো ভাত পাবার আশায় কাজের জন্য ছুটে আসছে ঢাকা শহরে । এই অতিরিক্ত মানুষের চাপে ঢাকার জনজীবনে নানা সঙ্কট বৃদ্ধি পাচ্ছে। ধীরে ধীরে লোপ পেতে বসেছে মানুষের সকল সুযোগ-সুবিধা। কোন কোন ক্ষেত্রে পোহাতে হচ্ছে অবর্ণনীয় দূর্ভোগ। যার মধ্যে যানজট সমস্যা অন্যতম। ঢাকা শহরের উদ্ভূত যানজট পরিসি'তি মোকাবিলায় ঢাকা শহরের সঙ্গে সঙ্গে দেশের অন্যান্য শহরগুলির উন্নয়নে জরুরী পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে।

বিনোদন সুবিধা
বিনোদন মানুষের অধিকার। মানুষের পরিপূর্ণ মানসিক বিকাশের জন্য বিনোদন, খেলাধূলা এবং শরীরচর্চার গুরুত্ব অপরিসীম। শুধুমাত্র অবকাশযাপন নয়, বিনোদনকেন্দ্রগুলো সামাজিকীকরণের জন্য আদর্শ স'ান। সর্ব সাধারনের জন্য উন্মুক্ত এসব বিনোদনকেন্দ্রগুলোতে বিভিন্ন শ্রেনীপেশার মানুষ সমবেত হয়, এর মাধ্যমে একে অন্যের সাথে পরিচিত হবার সুযোগ থাকে। ফলে বিভিন্ন মানুষের মধ্যে একটি যোগসূত্র স'াপিত হয়। সমাজে একটি সুন্দর আদর্শ সামাজিক পরিবেশ বিরাজ করে।

পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে নগরবাসীর সুস' সুন্দর মানসিক ও শারীরিক বিকাশের কথা চিনৱা করে বিনোদন ও খেলাধূলার জন্য বিভিন্ন উদ্যোগ গৃহীত হলেও বাংলাদেশে এ ধরনের উদ্যোগ উপেক্ষিত। বাংলাদেশের বিভিন্ন শহরে বিশেষ করে ঢাকায় বিনোদনের সুযোগ খুবই সীমিত। ঢাকায় হাতে গোনা যে পার্ক ও খেলার মাঠ রয়েছে তা প্রয়োজনের তুলনায় খুবই অপ্রতুল। তবে যে কয়টি পার্ক, মাঠ রয়েছে, প্রয়োজনীয় রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে বর্তমানে এই পার্ক ও খেলার মাঠগুলোর খুবই বেহাল দশা। বর্তমানে এর সাথে যুক্ত হয়েছে অন্য এক নতুন সমস্যা, প্রতি মাসেই নগীরর কোন না কোন মাঠে মেলা বসে। এছাড়া সৌন্দর্যবর্ধনসহ বিভিন্ন অযুহাতে পার্ক, খেলার মাঠগুলো অবৈধভাবে দখল করার প্রচেষ্টা চলে। এভাবেই আরো সংকুচিত হয়ে পড়ছে নাগরিকদের বিনোদনের সুযোগ সুবিধা।

বর্তমানে ঢাকায় মোট পার্ক , উদ্যান, খেলার মাঠের সংখ্যা প্রায় ৮০ - ১২০ টি । এর মধ্যে ঢাকা সিটি কর্পোরেশনের অধীনে রয়েছে ৪৭টি পার্ক এবং ১০ টি খেলার মাঠ। পি. ডাব্লিউ.ডি এর অধীনে রয়েছে রমনা পার্ক, সোহরাওয়ার্র্দী উদ্যান, চন্দ্রিমা উদ্যান সহ আরো কয়েকটি পার্ক এবং মাঠ। অন্যান্য সরকারী প্রতিষ্ঠানের আওতাধীন রয়েছে ঢাকা চিড়িয়াখানা, বোটানিক্যাল গার্ডেন, বলধা গার্ডেন সহ ছোট বড় প্রায় ২৭ টি পার্ক এবং খেলারমাঠ। এছাড়া পাবলিক স্পেস হিসাবে ব্যবহৃত হয়ে থাকে ধানমন্ডি লেক, টি.এস.সি ইত্যাদি কয়েকটি স'ান। এসব মিলিয়ে ঢাকার উন্মুক্ত স'ান রয়েছে প্রায় ৫০৩.৬৪ একর। এর মধ্যে আহসান মজ্ঞিল, লালবাগ দূর্গ রয়েছে। বর্তমানে ঢাকার জনসংখ্যা প্রায় ১ কোটি ২০ লক্ষ। পরিসংখ্যান অনুযায়ী ঢাকায় প্রতি ১,০০০ জনে উন্মুক্তস'ান রয়েছে প্রায় ৪ শতাংশ । ব্রিটেনের জাতীয় ক্রীড়াক্ষেত্র সমিতির মতে প্রতি ১,০০০ জনপিছু ৬ একর পরিমিত উন্মুক্তস'ান, খেলারমাঠ থাকা উচিত, যার ৪ একর সার্বজনীন আর ২ একর ব্যক্তিগত। এছাড়া প্রতি ১,০০০ জনে ১ একর থাকবে বাগ এবং ৩ একর থাকবে বিদ্যালয় ক্রীড়াক্ষেত্র। এভাবে সর্বমোট ১০ একর খোলা জায়গা থাকতে হবে প্রতি ১,০০০ লোকের জন্য। এই পরিসংখ্যান অনুযাযী দেখা যাচ্ছে ঢাকায় পার্ক, খেলার মাঠ, বিনোদনকেন্দ্রের পরিমান নিতান-ই অপর্যাপ্ত।

বর্তমানে সীমিত সংখ্যক পার্ক, খেলার মাঠের কারণে শিশু-কিশোররা বঞ্চিত হচ্ছে বাইরে খেলাধূলার এবং বিনোদনের সুযোগ থেকে। তাদের অবসর সময় কাটছে টিভি দেখে বা কম্পিউটারে গেমস্‌ খেলে, যা তাদের পরিপূর্ণ শারীরিক ও মানসিক বিকাশে বাধা সৃষ্টি করছে। এছাড়া বিনোদনের অপ্রতুল সুযোগ নাগরিকদের দৈনন্দিন কর্মব্যসৱ জীবনকে একঘেয়ে করে তুলছে। শিশু-কিশোরদের খেলাধূলার সুবিধা প্রদান, নগরবাসীর বিনোদনের জন্য শহরগুলোতে পর্যাপ্ত বিনোদনকেন্দ্র হিসেবে পার্ক, খেলার মাঠ গড়ে তোলা এবং পুরোনোগুলোর সংস্কার অত্যাবশ্যকীয়। একই সাথে নগরবাসীর শারীরিক ও মানসিক সুস'তার কথা চিন-া করে পায়ে হেঁটে চলাচল ও শরীরচর্চার জন্য উপযুক্ত পরিবেশ তৈরী খুবই গুরুত্বপূর্ণ।

নগর পরিকল্পনায় পুরো অবকাঠামোর সাথে সমন্বয় রেখে, পরিকল্পিতভাবে বিনোদনস'ান, নাগরিক বিনোদন কেন্দ্র গড়ে তোলা জরুরী। নগর মানেই শুধু ইট, কাঠ, পাথরের বসতি বা যান্ত্রিকতা নয়। বহুমানুষের মিলনকেন্দ্রই হচ্ছে নগর। একটি নগরীর গড়ে ওঠা নগরবাসীর শারীরিক ও মানসিক বিকাশকে নানাভাবে প্রভাবিত করে। একটি সুষ্ঠু সুন্দর পরিকল্পিত নগরী, দক্ষ মানবগোষ্ঠী গড়ে তুলতে সহায়ক। পরিকল্পিত নগরী গড়ে তোলার ক্ষেত্রে বিষয়টি প্রাধান্য দেয়া হোক এটি আমাদের সকলেরই কাম্য।

গণমুখী নগর পরিকল্পনার স্বার্থে কিছু সুপারিশমালা:
ক্স নগর পরিকল্পনায় মিশ্র এলাকা গড়ে তোলার উপর মনযোগ দিতে হবে। যেমন-আবাসন, শিক্ষা ও স্বাস'্যসেবা প্রতিষ্ঠান, বাজার, কর্মস'ল, বিনোদন ইত্যাদি সুযোগ সুবিধা কাছাকাছি দূরত্বে থাকে।
ক্স ঢাকার জলাধারগুলো সংরক্ষণে প্রয়োজনীয় ব্যবস'া গ্রহণ করতে হবে।
ক্স জলাবদ্ধতা নিরসনে রিটেনসন পন্ড রাখার ব্যবস'া করতে হবে।
ক্স সুয়্যারেজ বর্জ্য অপসরেেণর বা ট্রিটমেন্ট প্ল্যন্ট তৈরী করার পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে
ক্স নাগরিকদের বিনোদনের জন্য পর্যাপ্ত পরিমান উন্মুক্তস'ানের ব্যবস'া করতে হবে।
ক্স নগরের পরিবহন পরিকল্পনায় পায়ে হাঁটাকে সবচেয়ে গুরুত্ব দিতে হবে এবং পথচারীদের সুবিধার কথা চিন-া করেই সকর অবকাঠামো নির্মাণ/সংস্কার করতে হবে।
ক্স ঢাকা শহরের সঙ্গে সঙ্গে দেশের অন্যান্য শহরগুলির উন্নয়নে জরুরী পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে।

দেশের নিরাপত্তা, অর্থনীতি ও যোগাযোগ ব্যবস্থা উন্নয়নে রেলওয়ের বিরাষ্ট্রীয়করণ বন্ধ করতে হবে

দেশের নিরাপত্তা, অর্থনীতি ও যোগাযোগ ব্যবস'া উন্নয়নে
রেলওয়ের বিরাষ্ট্রীয়করণ বন্ধ করতে হবে

পরিবেশ, অর্থনীতি, জনসেবা, রাষ্ট্রীয় দায়িত্ব, নিরাপত্তা, দারিদ্র বিমোচন, কর্মসংস'ান এর ক্ষেত্রে বাংলাদেশ রেলওয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। সরকার রেলের মাধ্যমে পরিবহণ সুবিধা প্রদান করে দেশের কোটি কোটি মানুষের ভাগ্যোন্নয়নের লক্ষ্যে কাজ করে যাচ্ছে। দেশের পরিবহণ ব্যবস'া ও সার্বিক উন্নয়নে রেল যোগাযোগ আরো বিস-ৃত করা প্রয়োজন। এ লক্ষ্যে পূর্ব-পশ্চিমাঞ্চাল রেল যোগাযোগ ব্যবস'া জোরদার সহ রাষ্ট্রীয় ব্যবস'াপনায় রেল উন্ন্‌য়নে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহন করা জরুরী। সেক্ষেত্রে রেল পরিচালনার জন্য জাতীয় বাজেটে রেলের বরাদ্দ আরো বেশি দেওয়া প্রয়োজন।

ঋণ প্রদানকারী সংস'াগুলো পরিবহণ ব্যবস'ার উন্নয়নের নামে সড়কপথেই বেশিরভাগ ঋণ প্রদান করায় রেলওয়ের উন্নয়ন বরাবরই উপেক্ষিত থেকেছে। কিন' গবেষক ও পরিবেশ বিশেষজ্ঞদের মতো সড়ক পথে অপরিকল্পিত বিনিয়োগ বর্তমানে পরিবেশ দূষণ, দুঘর্টনা, অর্থনৈতিক ক্ষতিসহ বিভিন্ন সমস্যার সৃষ্টি করেছে। বিগত দিনে ঋণ প্রদানকারী সংস'া কর্র্তৃক রেলওয়ের উন্নয়নে ঋণ প্রদান করেছে। কিন' এ সকল ঋণ সহায়তায় রেল উন্নয়নে স্টেশন রি মডেলিংয়ের নামে শত শত কোটি টাকা এরকম অনুৎপাদনশীল খাতে ব্যয় করা হয়েছে। স্টেশন আধুনিক করা অপেক্ষা রেল লাইন উন্নয়ন ও রেলে বগি, ইঞ্জিন বাড়ানো জরুরি ছিল। কিন' সে দিকে নজর দেওয়া হয়নি। একদিকে বলা হচ্ছে ঋণ ছাড়া চলা সম্ভব নয়, অপর দিকে এমন খাতে ঋণ দেওয়া বা নেওয়া হচ্ছে যা অপ্রয়োজনীয়। কথিত ঋণ সহযোগীদের পরামর্শ ও দিক নির্দেশায় এ ধরনের উন্নয়ন গৃহীত এবং হয়েছে এবং হচ্ছে।

দুঃখজনক হলেও সত্য যেসব খাতে বিনিয়োগ করলে রেলওয়ে সেবাকে জনগণের কাছে সহজলভ্য ও রেলের রাজস্ব বৃদ্ধিতে সরাসরি সহায়ক হতো সেসব খাতে যথেষ্ট বরাদ্দ দেওয়া হয়নি। ফলে রেলের অনুৎপাদনশীল খাতে ব্যয়িত ঋণের টাকা সুদে আসলে পরিশোধ করতে হচ্ছে। বস'তপক্ষে ঋণপ্রদানকারী সংস'ার কারণে রেলের সত্যিকার উন্নয়ন বাধাগ্রসৱ হচ্ছে। ঋণ গ্রহনের পূর্বে অবশ্যই বিবেচনা করা প্রয়োজন এ অর্থ কিভাবে পরিশোধ করা হবে? এ ঋণ হতে কি পরিমান লাভ হবে? ঋণপ্রদানকারী সংস'াগুলোর সম্পর্কে বিভিন্ন মহলের অভিযোগ এবং অনুযোগ সর্তকতার সাথে বিবেচনা করা দরকার। কারণ ইতিপূর্বে যে সকল প্রতিষ্ঠানের উন্নয়নে এডিবি এবং বিশ্বব্যাংক পরামর্শ দিয়েছে সেগুলো আশানুরূপ ফলাফল অর্জনে ব্যর্থ হয়েছে। পৃথিবীর অনেক দেশেই এ বিষয়ে প্রশ্ন উঠছে। উদ্ভুত পরিসি'তিতে বাংলাদেশ রেলওয়ের বৃহত্তর স্বার্থে ঋণ প্রদানকারী সংস'ার পরামর্শ ও শর্ত বর্জন করা প্রয়োজন। রেলের উন্নয়নে দেশের নীতিমালার আলোকে ঋণ নিতে হবে এবং এর প্রেক্ষিতে রেলের মাধ্যমে পরিবহণ ব্যবস'ার যথাযথ উন্নয়ন সম্ভব হবে। সেক্ষেত্রে প্রথমেই রেলের কোন কোন খাতে সংস্কার করতে হবে তা সঠিকভাবে চিহ্নিত করতে হবে। কোন ঋণ প্রদানকারীর সংস'ার পরামর্শে বা শর্ত পূরণের জন্য ঋণ গ্রহণ করা হলে কাঙ্খিত সাফল্য পাওয়া সম্ভব নয়।

বিগত দিনে এডিবি, বিশ্ব ব্যাংক, আই এম এফ ঋণপ্রদানকারী স্‌ংস'ার পরমার্শে রেলওয়ের বিভিন্ন উন্নয়ন বিনিয়োগ করা হয়েছে। এখন এ সব সংস'ার পরার্মশে ও চাপে রেলকে প্রাইভেটাইজ করার পায়তারা করছে। বাংলাদেশ রেলওয়ে শুধু একটি রাষ্ট্রীয় সেবা প্রতিষ্ঠানই নয়। এ প্রতিষ্ঠানের সাথে জড়িয়ে আছে ঐতিহ্য, সাংবিধানিক অধিকার, রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা, পরিবেশ, জ্বালানি, দারিদ্র বিমোচন, জনগণের অধিকারের বিষয়সমূহ। রেলের মতো একটি রাষ্ট্রীয় সম্পদ বেসরকারীকরণ করা হলে রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা বিঘ্নিত হবে এবং অর্থনীতিতে বিপর্যয় নেমে আসায় জনগণ একটি চক্রের কাছে জিম্মি হবে। রেলওয়েকে বেসরকারীকরণের ফলে বিশাল জনগোষ্ঠী এবং সম্পদের ক্ষতি করা হয়।

রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠার বেসরকারীকরণ সমাধান নয় বরং দেশীয় বিশেষ্ণগদের রেল উন্নয়নের লক্ষ্যে সরকারকে সঠিক ও যুগোপযোগী পরামর্শ দিয়ে রাষ্ট্রীয় এই প্রতিষ্ঠানকে সতিকার জনসেবামূলক প্রতিষ্ঠানে রূপানৱরের জন্য পদক্ষেপ গ্রহণ প্রয়োজন। ঋণপ্রদানকারী সংস'াগুলোর চাপে রেলের বিরাষ্ট্রীয়করণ বন্ধে সরকারকে সঠিক পরামর্শ ও সমর্থন দিয়ে সহযোগিতা করা আমাদের সকলের কর্তব্য।

যানজট, জলাবদ্ধতা: অতঃপর হয়নি শিক্ষা?

ঢাকা শহরের যানজট ও জলাবদ্ধতা প্রাকৃতিক দুযোর্গসহ বিভিন্ন কারণে একটি বহুল আলোচিত সমস্যা। এ সমস্যা আজকের নয়, অনেক দিনেরই। এ দুই সমস্যার জন্য বিশ্বব্যাংক, এডিবি সহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের ঋণ নিয়ে কি পরিমান গবেষণা আর প্রকল্প বাসৱবায়ন হয়েছে তার ইয়ত্তা নেই। তবে ঋণের টাকা এবং তথাকথিত পরিকল্পনাকারীদের পরামর্শের ফলাফল বর্তমানের অসহনীয় যানজট এবং জলাবদ্ধতা। পরিকল্পনা ও উন্নয়নের নামে অনেক সংস'া ও ব্যক্তির পকেট ভারী হলেও জনগনের কাধে চেপেছে ঋণ, যানজট ও জলাবদ্ধতা। বতর্মান সংকটের অবস'ায় ভয় হচ্ছে, আবার কোন প্রকল্প আসছে কিনা ! কোন একটি সমস্যাকে টিকিয়ে রাখা একটি ভাল ব্যবসা। ঢাকা শহরের যানজটও হয়তো এ ধরনের একটি বিষয়, তাই অব্যাহত বৃদ্ধি পাচ্ছে। তার সাথে সাথে আসছে নতুন নতুন প্রকল্প, আর নিয়মিত ব্যবসা। এর পরিণতিই বা কি হবে? যদি বিগত দিনের মতো অনুউর্ব্বর অপরিপক্ক ভুল পরিকল্পনা ও পরামর্শ অনুসারে তাড়াহুড়ো করে লোক দেখানো কাজ করা হয়, তবে এই অবস'া আরো ভয়ংকর হবে, তা বলার অবকাশ রাখেন।

ঢাকা শহরের যানজটের কারণ জিজ্ঞেস করলে বলা হয় রিকশা ও ফুটপাত দখল। যদি বলি ভাই যে সকল রাসৱায় রিকশা চলে না, সে সকল রাসৱায় যানজটের কারণ কি? তাহলে বলবে এলোপাথারি বাস রাখা। ফুটপাত দখল করে রাখে হকার, বাস ও রিকশা নিয়ম না মেনে রাসৱায় চলে, ফলে সৃষ্টি হয় যানজট। তাই বিগত দিনে যানজট নিয়ন্ত্রণে ঢাকা শহরের ট্রাক চলাচল নিয়ন্ত্রণ, বাস নিয়ন্ত্রণ, মানুষকে পর্বত সমান ফুটওভার ব্রিজ দিয়ে চলার ব্যবস'া, ট্রেনের সময় পরিবর্তন, বিভিন্ন রাসৱায় রিকশা নিষিদ্ধ, ফুটপাত হতে হকার উচ্ছেদসহ নানা পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়। কিন' সমাধান আসেনি বরং বেড়েছে।

পাঠকগণ একটু লক্ষ্য করলে দেখুন যে, সকল বিষয়ে সিদ্ধানৱ গ্রহণ করা হয়েছে তার সবকিছুই সাধারন মানুষের জীবনের সাথে সম্পর্কিত। শুধু প্রাইভেট কার বিষয়ে কোন সিদ্ধানৱ গ্রহণ করা হয়নি। ঢাকার যে সকল রাসৱায় বর্তমানে যানজটের সৃষ্টি হচ্ছে, সেই সকল রাসৱায় শুধু প্রাইভেট গাড়ীর অধিপত্য। প্রাইভেট গাড়ী দখল করছে রাসৱা আর ফুটপাত। কিন' এ ব্যক্তিগত যানবাহন নিয়ন্ত্রণের জন্য আজ পর্যনৱ কোন পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়নি। বরং জনগনের টাকায় পাকিং, ফ্লাইওভার মতো প্রকল্প গ্রহণ করে ব্যক্তিগত যানবাহন চলাচলের সুবিধা নিশ্চিত করা হচ্ছে বা করার পরিকল্পনা গ্রহণ করছে।

প্রাইভেট গাড়ী কেন নিয়ন্ত্রণের উদ্যোগ গ্রহণ করা হয় না, তা আশা করি সকলের অনুমেয়। তথাপিও একটু ব্যাখা করছি, প্রথমত যারা সিদ্ধানৱ নেন তারা এই যানবাহনে চলাচল করেন। তারা তাদের সুবিধা নিশ্চিত করে বা করার মানসিকতা নিয়ে সিদ্ধানৱ গ্রহণ করেন। দ্বিতীয়ত এ সাথে জড়িত প্রাইভেট গাড়ী, তেল, পাকিং, ফ্লাইওভার সংক্রানৱ ব্যবসা। ঋণপ্রদানকারী গোষ্ঠীর সহযোগিরা (যেমন বিশ্বব্যাংক, আইএমএফ, এডিবি) তারাও সকল কিছু নিয়ন্ত্রণে কথা বললেও প্রাইভেট গাড়ী নিয়ন্ত্রণে কথা বলে না। কারণ ঋণের ব্যবসার সাথে সাথে প্রাইভেট গাড়ী সংক্রানৱ ব্যবসার পরিবেশ নিশ্চিত করাই যেন তাদের অন্যতম দায়িত্ব। ঢাকা শহরের এই অব্যাহত যানজটের প্রেক্ষিতে তারা আবারো হয়তো ঋণ প্রদান করবে নতুন গবেষণা বা প্রকল্পের জন্য। সমাধান হোক না হোক তাদের ব্যবসা হবেই, কারণ ঋণের অর্থতো পরিশোধ করতে হবে দেশের জনগনকে। যানজট একটি লাভজনক ব্যবসা। তার পরিসমাপ্তি হবে তখন যখন মানুষের সুবিধা নিশ্চিত করে পরিকল্পনা করা হবে।

ঢাকা শহরের অধিকাংশ মানুষ বাসে, হেটে, রিকশায় ও সাইকেলে যাতায়াত করে। কিন' স্বাধীনতার পর থেকে আজ পর্যনৱ বাস সার্ভিসের মান নিম্নমূখী হয়েছে। অধিকাংশ বাসে চলাচল এ প্রকার যন্ত্রণাদায়ক এবং অর্থদন্ডের শামিল। বাস কাউন্টারগুলোতে মানুষের দাড়ানো অবস'া কি তা নিজেই প্রতিদিন দেখছেন। আর একটি অদ্ভুত বিষয় হচ্ছে, কাউন্টারগুলোকে অব্যাহতভাবে স'ান ত্যাগ করতে হচ্ছে। যেমন সিটি কলেজে যে কাউন্টারগুলো ছিল তা এসেছে এলিয়েন্স ফ্রান্সিসেসর কাছে, ঝিগাতলা কাউন্টার চলে এসেছে ধানমন্ডি ৪/এ কাছে। তথাকথিত পরিকল্পনাকারী ও সরকারের সংশ্লিস্ট প্রতিষ্ঠানগুলো এত টাকার ঋণের প্রকল্পের পর একটি মানসম্মত বাস কাউন্টারও নিশ্চিত করতে পারেনি, এ হচ্ছে জনগনের পরিবহন বাসের অবস'া।

আসুন রিকশার কথা দেখি, ঢাকায় বিভিন্ন রাসৱায় রিকশা উচ্ছেদের সময়, জনগনকে তুষ্ট করতে ললিপপের মতো কিছু বিআরটিসি বাস নামানো হয়েছিল। এ সকল বাসগুলো কোথায় গিয়েছে? কেন গিয়েছে তা সকলের অনুমেয়। আমরা জনগনও তুষ্ট। ফলাফল নিউমার্কেটের সামনে প্রাইভেট গাড়ীগুলোর পার্কিং ব্যবস'া। আর আমরা সাধারণ জনগনের নিউমার্কেট থেকে কখনো কখনো সিটি কলেজ পুলিশ বক্স পর্যনৱ সরু লম্বা রিকশার লাইনে অপেক্ষায়। সমপ্রতি দেখছি নিউমার্কেটে পিছনে একটি মার্কেট হয়েছে, ঐ মার্কেটের ১০০০ গাড়ী পার্কিংর ব্যবস'া রয়েছে, রয়েছে হেলিকাপ্টারের যাবার ব্যবস'া। বড়লোক ও প্রাইভেট গাড়ীর মালিকগণ কিভাবে যাবে তা বুঝেছি, কিন' ঐ মার্কেট পুরোপুরি চালু হলে সাধারণ মানুষ এই সরু রাসৱায় রিকশা বা হেঁটে কিভাবে যাবে তা বোধগম্য নয়। এই সরু রাসৱায় রাজউক কি বুঝে এতবড় একটি মার্কেটের অনুমোদন দিয়েছে তাও একটি বিস্ময়।

স্বাস'্য অর্থনীতি ও পরিবেশকে প্রধান্য দিয়ে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে যখন হাঁটাকে অগ্রাধিকার প্রদান করা হচ্ছে। তখন আমাদের দেশে হাঁটার অবস'া কি? আমি আর এ বিষয়ে ব্যাখায় যাই না, কারণ আমরা সাধারণ মানুষকে নিয়মিত এই তিক্ত অভিজ্ঞতা নিয়েই চলতে হয়। শুধু একটি বিষয়ে অদ্ভুত বিষয়ে আপনাদের দৃষ্টি আর্কষণ করছি। ঢাকার যাতায়াত পরিকল্পনা নাকি তৈরি হচ্ছে, পথচারীদের অগ্রাধিকার দিয়ে। তবে কেন একজন মানুষকে পর্বত সমান ফুটওভার ব্রিজ পার হতে হবে? কেন জ্রেবা ক্রসিং থাকবে না? পৃথিবীর কোন সভ্য দেশে হেটে চলার জন্য মানুষকে এ ধরনের পর্বত অতিক্রম করতে হয়? পরিকল্পনাবিদ, সরকারের সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিবর্গ কি একবারও ভাবেন না? একজন বৃদ্ধ, শিশু, মহিলা বা গর্ভবতী মানুষ কিভাবে এই পর্বতে উঠবে? নূন্যতম এককিলোমিটার হাটার পর কোন মানুষের পক্ষে কি এই পর্বত সমান ফুটওভার ব্রিজ অতিক্রম সম্ভব? হাতে কোন মালামাল থাকার পর কি এই ব্রিজ স্বাভাবিকভাবে অতিক্রম সম্ভব? অবশ্যই সম্ভব নয় করো পক্ষে। তথাপিও কেন ঋণে টাকা নিয়ে জেব্রা ক্রসিংগুলো তুলে দিয়ে ফুটওভার ব্রিজ করা হচ্ছে তা বিস্ময়কর।

অদ্ভুত লাগে ভাবতে পথচারীদের অগ্রাধিকার প্রদানের এই অবস'া। সংবিধান অনুসারেও হেটে চলাচলকারী মানুষগুলো প্রধান্য পাওয়া উচিত। কিন' অদ্ভুত হলেও সত্য শরীরের ঘাম ঝড়িয়ে, কষ্ট করে চলাচলকারী মানুষকে পর্বত সমান ব্রিজ অতিক্রম করতে হয়। আরো অদ্ভুত হচ্ছে অনেক স'ানে আইন প্রয়োগকারী লোকদের নিয়োগ করা মানুষকে ফুটওভার ব্রিজে উঠতে বাধ্য করা হচ্ছে । আমি নিজেও একটু হাটার পর এই পর্বতে উঠতে পারি না, হাপিয়ে উঠি, বেশ কয়েকবার বাকবিতন্ডা হয়েছে। গুটি কয়েক মানুষের বাহন গাড়ী অপেক্ষা একটি বড় অংশের মানুষ হেঁটে যায়, তাদের জন্য কেন জ্রেবা ক্রসিং থাকবে না? এই অধিকাংশ সাধারণ মানুষ কেন রাসৱায় হাটতে অগ্রাধিকার পাবে না? অধিকাংশ মানুষের চলাচলে বিঘ্ন ঘটিয়ে যানজট নিরসন আর বৈষম্যহীন সমাজ প্রতিষ্ঠান, এগুলো মানুষের সাথে উপহাস বৈ অন্য কি? যারা ফুটওভার ব্রিজের জন্য পরিকল্পনা বা সুপারিশ করেন, তাদের পরীক্ষামূলক একমাস এই ব্যবস'া যাতায়াতের জন্য বাধ্য করা উচিত। যদি তারা নিজেরা এই ব্যবস'ায় চলতে পারেন, তবেই তা মানুষের জন্য উম্মুত্ত করা উচিত।

জলাবদ্ধতা ঢাকার একটি ভয়ংকর অবস'া। একটু বৃষ্টি হলেই সৃষ্টি হয় জলাবদ্ধতা। প্রশ্ন্‌ হচ্ছে এই জলাবদ্ধতা কেন সৃষ্টি হয়েছে? সহজ ও সরল উত্তর ভূল পরিকল্পনার কারণ। কিন' কারা, কেন, কিভাবে এই ভুল পরিকল্পনা গ্রহণ করেছে তা কি তলিয়ে দেখা হবে? এই ভুল পরিকল্পনার জন্য কত অর্থ খরচ করা হয়েছে? কারা দিয়েছে? পরবর্তীতে সিদ্ধানৱ গ্রহনের পূর্বে এই বিষয়গুলো বিবেচনা করা কি বাঞ্চনীয় নয়? কারণ এই জলাবদ্ধতার জন্য দায়ী সরকারের সংশ্লিষ্ট বিভাগ ও বিশ্বব্যাংক এবং এডিবি-র মতো ঋণপ্রদানকারী প্রতিষ্ঠানগুলো। ঋণ প্রদানকারী এই প্রতিষ্ঠানগুলোর ঋণের অর্থে বক্সকালভার্ট নির্মাণ করে ঢাকা খালগুলো ধ্বংস করছে সরকারী সংস'ার কতিপয় ব্যক্তিবর্গ এবং তাদের দোসর কতিপয় পরিকল্পনাকারী। তখন বলা হয়েছিল এই বক্সকালভার্ট হলে নানা সুবিধা হবে, তাদেরই প্রতিষ্ঠান হয়তো পরিবেশ ইমপ্যাক্ট স্ট্যাডি ও এসেমেন্ট রিপোর্ট প্রণয়ন করছে। মন ভুলানো পরিকল্পনায় আমরা অনেকেই মুগ্ধ ছিলাম। পরিবেশকর্মীদের দাবিতে তখন অহেতুক চিৎকার মনে হয়েছে। আর ফলাফল এখন বর্তমান ঢাকার ৪৩টি খাল গিলে খেয়েছে তথাকথিত পরিকল্পনাকারী, অসাধু কর্মকর্তা এবং বিশ্বব্যাংক ও এডিবি-র মতো প্রতিষ্ঠানের চক্র। তাতে তাদের লাভ বৈ ক্ষতি হয়নি। প্রতিবছর আবার পরিস্কার ও উন্নয়নের নামে ঋণ দিয়েছে, লুটপাটও হয়েছে। এখন আবার ঋণ দেবে খালগুলো উদ্ধারে বা অন্যকোন উপায়ে এই জলাবদ্ধতা হ্রাস, ঋণের ব্যবসা অব্যাহত হয়তো থাকবে। কিন' আমাদের শিক্ষা কি? আমরা কি আবারো এভাবেই পরিকল্পনা ও সিদ্ধানৱ গ্রহণ করবো বা সায় দেবো?

সরকারী সংস'া ও ঋণপ্রদানকারী সংস'াগুলো আমাদেরই প্রতিষ্ঠান। এ প্রতিষ্ঠানগুলোর মাধ্যমে মানুষের সমস্যাকে পুজি করে, ব্যবসা করছে একটি চক্র। আমাদের সমস্যাকে চক্র করে অব্যাহত ব্যবসা হতে মুক্তির পথ খুজতে হবে। তবে পরবর্তীতে যে কোন পরিকল্পনা পূর্বে একটি সিদ্ধানৱ গ্রহণ করা প্রয়োজন। বিগত দিনের প্রকল্পগুলো কেন ব্যর্থ হয়েছে? কারা লাভবান হয়েছে? যদি আমরা সুনিপুনভাবে বিগত কাজগুলো হতে শিক্ষা নিতে পারি তবে যানজট ও জলাবদ্ধতা হতে মুক্তি। নয়তো আবারো কোন প্রকল্প ব্যবসায়ীর পন্য হবে জনগন... চলতেই থাকবে যানজট ও জলাবদ্ধতার সমস্যা ও ব্যবসা।

রাষ্ট্রায়াত খাত শক্তিশালীকরণ উন্নয়নে পূর্বশর্ত

উন্নয়ন যে কোন জাতি ও মানুষের পরম একটি কাঙ্গিত বিষয়। কিন' উন্নয়ন কি? আমরা কিসের উন্নয়রেন জন্য কাজ করছি? আমরা কি প্রত্যাশিত উন্নয়নের দিকে যাচ্ছি? এ বিষয়গুলো নিয়ে অনেকেরই মত বিরোধ রয়েছে। তবে প্রচলিত অর্থে অনেকেই আমরা উন্নয়ন বলতে অর্থনৈতিক উন্নয়নের কথা বুঝে থাকি। আর এখানেই প্রশ্ন অর্থনৈতিক উন্নয়ন কিসের জন্য?

বাংলাদেশের উন্নয়ন প্রত্যেক মানুষের স্বপ্ন। আমরা সকলেই চাই এ দেশ এগিয়ে যাক সুখ ও সমৃদ্ধির দিকে। সরকার এ স্বপ্ন বাসবায়নের অন্যতম কান্ডারী। তাই সকলের প্রয়োজন, সরকারের এ কার্যক্রমকে বাস-বায়নের লক্ষ্যে সহযোগিতা করা। রাষ্ট্রীয় সম্পদ তথা রাষ্ট্র যন্ত্রের যথাপোযুক্ত ব্যবহার নিশ্চিত করার মাধ্যমে এই লক্ষ্য অর্জন করা সম্ভব। কিন' বিগত ২৫/২৬ বছর যাবত রাষ্ট্রীয় সম্পদগুলো চক্রান- করে ধ্বংস করে ফেলা হয়েছে। ফলে এ দেশের মানুষের অর্থনীতি, পরিবেশ, সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা বিঘ্নিত হচ্ছে। দেশ জিম্মি হয়ে পড়ছে বিদেশী কোম্পানি ও গুটি কয়েক ব্যক্তির কাছে।

বিশ্বব্যাংক, আইএম এফ তথা অর্থলগ্নিকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর পরামর্শে উন্নয়নের দোহাই দিয়ে সেবাখাত বিরাষ্ট্রীয়করণ করা হলেও বিগত কয়েক বছরে এ দেশের দারিদ্রতা বৃদ্ধি পেয়েছে ৩ গুন, ২০০৯-১১ সালের মধ্যে ২ কোটি ৬৫ লাখ ৮০ হাজার লোক বেকার হবে এবং বৈদেশিক ঋণের পরিমান হ্রাস পেলেও, ঋণের অর্থ পরিশোধের পরিমান বৃদ্ধি পেয়েছে। বাংলাদেশের ঋণের পরিমান ১ লক্ষ ৪২ হাজার কোটি টাকা এবং দেশের প্রতিটি শিশু ১১ হাজার টাকা ঋণের বোঝা নিয়ে জন্ম গ্রহণ করছে। বাংলাদেশকে ১ ডলার বৈদেশিক ঋণের বিপরীতে সুদসহ পরিশোধ করতে হচ্ছে দেড় ডলার। আর এ সকল ঋণের একটি বড় অংশ গ্রহণ করা হয় বিশ্বব্যাংক, আই এম এফ, এডিবি’র মতো প্রতিষ্ঠানগুলো হতে, যা তাদের পরামর্শ মোতাবেক অপ্রয়োজনীয় খাতে ব্যবহার করতে হয়। এ প্রতিষ্ঠানগুলো একদিকে ঋণ দিয়ে ব্যবসা করছে, অপর দিকে তাদের দোসর কোম্পানির হাতে এ দেশের মানুষের সম্পদ তুলে দিচ্ছে, বিরাষ্ট্রীয়করণের মাধ্যমে। ২০০৭ সালে সরকার বৈদেশিক ঋণের সুদ-আসল পরিশোধ করতে রাজস্ব বাজেটে প্রায় শতকরা ২৫ ভাগ ব্যয় করেছে। অর্থনৈতিক উন্নয়ন এই আজব সুত্রে পিষ্ট হচ্ছে উন্নয়নশীল দেশের প্রতিটি জনগন।

বিশ্বব্যাংকের প্রতিবেদন অনুসারে প্রতিবছর দরিদ্র হ্রাসের হার মাত্র ১%, হতদরিদ্র সংখ্যা বেড়েছে ৪০ লাখের বেশি, ধনী ও দরিদ্রের মধ্যে আয় বৈষম্য অতিমাত্রায় বৃদ্ধি পাচ্ছে, মুদ্রাস্ফীতির হার ক্রমবর্ধমান এবং তা বেড়ে ২ অংকে স্পর্শ করেছে যা দরিদ্র এবং মধ্যবিত্ত শ্রেণীর লোকদের জীবনধারণকে কঠিন করছে। বেকারত্বের সংখ্যা প্রায় ৪ কোটি। বাজেটে বৈদেশিক ঋণ শোধের জন্য বরাদ্ধ রাজস্ব বাজেটের ২০.৫%। স্বাস'্যখাতে বরাদ্ধ বৈদেশিক দেনা পরিশোধের বরাদ্ধের অর্ধেক। ২০০৭-০৮ অর্থবছরে স্বাস'্য খাতে বরাদ্ধ ৭০০ মিলিয়ন ডলার পক্ষানৱরে ঋণ পরিশোধ খাতে বরাদ্ধ ১৫৬৩ মিলিয়ন ডলার। দেশে সাামজিক অবস'ার অবনতি হয়েছে, অপরাধ, মাদক ব্যবহার, শিক্ষা-সাংস্কৃতিক সবকিছুর অবস'াই সনেৱাষজনক নয়।

রাষ্ট্রীয় সম্পত্তি বিরাষ্ট্রীকরণে প্রথমেই অর্থনৈতিক উন্নয়নের দোহাই দেওয়া হয়। এই অর্থনৈতিক উন্নয়নের সোনার হরিণের লোভে আমাদের অনেক রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান বিরাষ্ট্রীকরণ এবং পরিবেশ ধ্বংস করে বৈদেশিক বিনিয়োগ বৃদ্ধি করা হলেও দরিদ্রতা কতটুকু হ্রাস পেয়েছে বা দেশের মানুষের সত্যিকার উন্নয়ন কতটুকু হয়েছে তা বিবেচ্য বিষয়। যদি বৈদেশিক বিনিয়োগ অর্থনৈতিক উন্নয়নের সূচক ধরা হয়, তবে এখন প্রশ্ন করার সময়, বিগত দিনের বিনিয়োগের প্রেক্ষিতে কতজন মানুষের স্বাস'্য সেবা, শিক্ষার মতো মৌলিক প্রয়োজন মেটানোর সামর্থ রাষ্ট্রের হয়েছে। নতুন নতুন রাসৱা, দালান বা বাহারী বিজ্ঞাপন অবশ্যই রাষ্ট্রীয় উন্নয়নের মাপকাটি নয়। দেশের পিছিয়ে পড়া মানুষদের মৌলিক চাহিদা পূরণে রাষ্ট্র কতটুকু সেবা বা সহযোগিতা প্রদান বৃদ্ধি করতে পেরেছে এটিই রাষ্ট্রীয় উন্নয়নের মাপকাটি হওয়া প্রয়োজন।

নতুন নতুন রাস-া, দালান বা বাহারী বিজ্ঞাপন অবশ্যই রাষ্ট্রীয় উন্নয়নের মাপকাঠি নয়। দেশের পিছিয়ে পড়া মানুষদের মৌলিক চাহিদা পূরণে রাষ্ট্র কতটুকু সেবা বা সহযোগিতা প্রদান বৃদ্ধি করতে পেরেছে এটিই রাষ্ট্রীয় উন্নয়নের মাপকাঠি হওয়া বাঞ্ছনীয়। কিন' রাষ্ট্রীয় ক্ষমতাকে সংকুচিত করে ব্যক্তি তথা কোম্পানির ক্ষমতা বৃদ্ধির ফলে গুটি কয়েক মানুষের উন্নয়ন হলেও, দরিদ্র, ক্ষুদা ও বঞ্চনার শিকার হচ্ছে অধিকাংশ মানুষ। ধনী ও গরীদের ব্যবধান বৃদ্ধি পাচেছ দিন দিন। ধনীরা দিন দিন ধনী হচ্ছে এবং দরিদ্ররা আরো দরিদ্র হচ্ছে। ধনী ও গরীদের ব্যবধান সৃষ্টি করছে সামাজিক অশানিৱ ও অরাজগতা। এই ব্যবধান শুধু দেশের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়, ছড়িয়ে পড়েছে দেশে দেশে। গবেষণা দেশে ব্‌শ্িব জনসংখ্যার ৫ ভাগ যারা ধনী দেশে বাস করে এবং ৫ ভাগ যারা গরীব দেশে বাস করে তাদের মধ্যে আয়ের ব্যবধান ১৯৬০ থেকে ১৯৯০ এর মধ্যে দ্বিগুন হয়ে ৩০:১ তে গিয়ে পৌছায়। ১৯৯৮ সালে এটা হঠাৎ করে আবার বেড়ে যায় এবং ব্যবধান বেড়ে ৭৮:১ হয়ে য়ায়।
বাংলাদেশে স্বাধীনতার পর থেকে কি পরিমান শিল্প প্রতিষ্ঠান বন্ধ করা হয়েছে তার ইয়ত্তা নেই। ঋণের টাকায় রাষ্ট্রীয় ব্যয় হ্রাস এবং উন্নয়নের নামে এ সকল প্রতিষ্ঠান বিরাষ্ট্রীয়করণ করা হয়। কর্মচূত্য করার হয় লক্ষ লক্ষ শ্রমিকদের। কিন' শিল্প উন্নয়ন কি হয়েছে। কি অবস'ায় আছে সেই সকল বিরাষ্ট্রীয়করণ বা বন্ধকৃত শিল্পপ্রতিষ্ঠানগুলো। বিরাষ্ট্রীয়করনের ফল শিল্প কারখানার সম্পদ ব্যক্তিদের হাতে লুটপাত হয়েছে। তবে দেশের জনগেনর কি লাভ হলো। রাষ্ট্রের জনগনের সম্পদ এইভাবে বিরাষ্ট্রীকরন, বিরাষ্ট্রীয়করনের জন্য ঋণ গ্রহণ বা প্রদান কি দুনীতি নয়? বিশ্বব্যাংক বা এডিবিকে প্রশ্ন করা উচিত তাদের অকার্যকর পরিকল্পনা ও ঋণের উদ্দেশ্যকি রাষ্ট্রীয় সেবাখাতকে ধ্বংশ করা? আমাদের প্রত্যক্ষ উদাহরণ আদমীজুট মিল। আদমজীর বন্ধের প্রেক্ষিতে ১৭০০০ লোকের কর্মসংস'া হারায়। কিভাবে বাচবে এই লোকগুলো। তাদের পরিবারগুলো কিভাবে চলবে। কর্মসংস'ার বন্ধের প্রেক্ষিতে তাদের যে মৌলিক অধিকারগুলো ক্ষুন্ন হচ্ছে, এই দায় কিভাবে সরকার এড়িয়ে যাবে? কর্মসংস'ানহীনতা তাদের অনেকেই অপরাধী করবে না তার কিইবা নিশ্চিয়তা রয়েছে। এসকল লোকের অপরাধী হিসেবে তৈরি করার দায় কার। মানুষের কাধে ঋণের বোঝা চাপিয়ে এগুলো সমস্যা সৃষ্টি করার অর্থ যদি অর্থনৈতিক উন্নয়ন হয়। তবে তা উম্মাদনা ছাড়া আর কিছুই নয়।

এ সমস্যা শুধুমাত্র বাংলাদেশে নয়। দেশের বাইরেও বিভিন্ন কোম্পানী ও সম্পত্তির মালিকানা গুটিকতক ব্যাক্তির হতে কুন্ঠিগত রাখার পরিক্লপনা করা হচ্ছে। ইতিমধ্যে বশ্বের বড় ২০০ টি কোম্পানি সমগ্র পৃথিবীর ৩০ ভাগ অর্থনীতি নিয়ন্ত্রণ করলেও শ্রমবাজাররের মাত্র এক শতাংশ তারা কাজে নিযুক্ত রেকেছে। ১৯৮৩ থেকে ১৯৯৯ এর মধ্যে তাদের মুনাফা বেড়ে ৩৬২.৪% ভাগ হলেও শ্রমিকের সংখ্যা বেড়েছে মাত্র ১৪.২ ভাগ। এসব কোম্পানি যত বড় হচ্ছে এবং বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে পড়ছে, তত তারা প্রতিদ্বন্দ্বীদের কিনে ফেলছে এবং একই রকম চাকুরী তারা নি:শেষ করে দিচ্ছে। বর্তমানে আমাদের নিজেদের অসিৱত্ব রক্ষার স্বার্থে কোম্পানী ও সম্পত্তির মালিকানা গুটিকতক ব্যাক্তির হতে কুন্ঠিগত রেখে রাষ্ট্রিয় সম্পত্তি বিরাষ্ট্রিয়করনে প্রবনতা প্রতিহত করতে হবে।

বর্তমান বিশ্বে অর্থনৈতিক মন্দার কথা আমাদের সকলের জানা। বিশ্বের অন্যতম সম্পদশালী দেশ হওয়ার পরও আমেরিকা, ইংল্যান্ড এর মতো দেশগুলো অর্থনৈতিক মন্দার প্রকোপ হতে রক্ষা পাচ্ছে না। এ সকল রাষ্ট্র ব্যাংক, রেলসহ বিভিন্ন সেবা প্রদানকারী প্রতিষ্ঠান রাষ্ট্রায়ত্ব করেছে। সমপ্রতি আইসল্যান্ড তাদের সর্ববৃহৎ ব্যাংক রাষ্ট্রায়ত্ব করেছে। এ সকল দেশের অনেক প্রতিষ্ঠান দেউলিয়া হওয়ার প্রেক্ষিতে সরকার রাষ্ট্রীয় কোষাগার হতে অর্থ প্রদাণ করে এ সকল প্রতিষ্ঠান রাষ্ট্রায়ত্ব করেছে। আর ঠিক একই সময়ে বাংলাদেশে একের পর এক রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান কোম্পানি করার নামান-রে বিরাষ্ট্রীয়করণ করার পদক্ষেপ গ্রহণ করা হচ্ছে। সম্প্রতি সরকার আর কোন রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানকে বিরাষ্ট্রীয়করন না করার চিন-া করছেন, যা অবশ্যই সাধুবাদ পাওয়ার যোগ্য। খেয়াল রাখতে হবে কোন অবস'াতেই যেন আর কোন রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানকে বিরাষ্ট্রীয়করন না করা হয়।

রাষ্ট্রীয় সম্পদ বিরাষ্ট্রীয়করণের ফলে শুধুমাত্র পরিবেশ নয়, ক্ষতিগ্রসৱ হচ্ছে অর্থনীতি, সংস্কৃতি এবং সর্বোপরি দেশের মানুষ। রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণ না থাকায় বিভিন্ন কোম্পানির অনিয়ন্ত্রিত এবং অনৈতিক ব্যবসায় সর্বশানৱ হচ্ছে মানুষ। সরকারী মনিটরিং সংস'াগুলোকে সুকৌশলে দূর্বল করার মাধ্যমে চিকিৎসা, ঔষধ এবং খাদ্যের মতো অত্যাবশকীয় জিনিসগুলোকে জিম্মি করে জনসাধারণকে প্রতারিত করা হচ্ছে। শুধু তাই নয়, বিগত কয়েক বছরে বিভিন্ন সেবাখাতগুলোর উপর রাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রণ হ্রাস করার ফলে বিদেশী কোম্পানিগুলো যোগাযোগ, শিল্প ও বাণিজ্য খাত হতে হাজার হাজার কোটি টাকা দেশের বাইরে নিয়ে যাচ্ছে এবং সেই সাথে ধ্বংস করছে পরিবেশ ও সংস্কৃতি। কোম্পানিগুলোর অনৈতিক ও অনিয়ন্ত্রিত কার্যক্রমে বৃদ্ধি পাচ্ছে মানুষের জীবন যাত্রার ব্যয়। বিরাষ্ট্রীয়করনের ফলে দেশের যোগাযোগ, স্বাস'্য, শিক্ষা, অর্থ, পরিবেশ সকল ক্ষেত্রই আজ জিম্মি অনৈতিক ব্যবসায়ীদের হাতে। খাদ্যে অযৌক্তিক মূল্য বৃদ্ধি, নিয়ন্ত্রণহীন যাতায়াত ভাড়া, চিকিৎসা খরচ বৃদ্ধি, ঔষধদের অনিয়ন্ত্রিত মূল্য, বীজ সংকট, মোবাইল কোম্পানিগুলোর অস্বাভাবিক রেট, ব্যাংকগুলোর অযৌক্তিক চার্জ, বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মানহীন শিক্ষা ব্যবস'া ইত্যাদি রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণহীনতার ফসল। প্রশ্ন হচ্ছে, এই অবস'া হতে আমরা কি উত্তরন চাই?

যদি মানুষের উন্নয়ন করতে হয় তবে মানুষের মৌলিক চাহিদাগুলো নিশ্চিত করতে হবে। আর মানুষের মৌলিক চাহিদাগুলো নিশ্চিত করতে রাষ্ট্রকে নিশ্চিত করতে হবে। রাষ্ট্রীয় সেবা প্রতিষ্ঠানগুলোকে কার্যকর ও সক্রিয় করার মাধ্যমেই এই অবস'া নিশ্চিত করা সম্ভব। কোম্পানির হাতে মানুষের মৌলিক চাহিদাগুলো তুলে দেওয়া হলে, তা তাদের ব্যবসায় রূপানৱর হবে। মানুষের সমস্যা হবে তাদের ব্যবসার উপাদান। আর এ প্রক্রিয়ার মাধ্যমে দেশের উন্নয়ন সম্ভব নয়। টাকার অংকে হয়তো জিডিপি ও মাথাপিছু আয় বাড়বে, হয়তো বাহানী বিজ্ঞাপন ও সুউচ্চ অট্টালিকা ও দামি গাড়ি হবে। কিন' তার পিছনে আড়াল হয়ে যাবে কোটি কোটি দরিদ্র মানুষ। আমরা বিশ্বাস করি, অতীতের ভুল হতে শিক্ষা নিয়ে আমাদের নীতিনির্ধারকগণ রাষ্ট্রীয় সম্পদ রক্ষায় প্রয়োজনীয় উদ্যোগ গ্রহণ করবে। রাষ্ট্র দায়িত্ব নেবে মানুষের মৌলিক চাহিদা নিশ্চিতের, যা মানুষকে প্রকৃত উন্নয়নের দিকে এগিয়ে নিয়ে যাবে।

সুস্থ্য বাঁচাতে চাই হাঁটা, সংকুচিত হচ্চে পথ !

সুস্থ্য বাঁচাতে চাই হাঁটা, সংকুচিত হচ্চে পথ !

সকাল বেলা ঢাকা শহরের কিছু রাসৱায় দাড়ালে দেখা যায়, হেঁটে চলা মানুষের জনস্রোত। এ সকল রাসৱায় দাড়ালে হাটতে হবে না এমনিতেই মানুষের স্রোতে এক স'ান হতে অন্য স'ানে চলে যেতে হয়। এ অবস'া অধিকাংশ স্বল্প আয়ের মানুষের যাতায়াতের। অপর দিকে সকাল-বিকাল শহরের বিভিন্ন শ্রেণীর পেশার মানুষ হৃদরোগ, অতিরিক্ত মোটা হওয়া, স্ট্রোকসহ নানা সমস্যা হতে মুক্তি পেতে মাঠ পার্কগুলোতে হেঁটে থাকেন। তার বাইরে কিছু মানুষ অনেক যাদের হাঁটা প্রয়োজন হলেও হাটতে পারেন না প্রতিবন্ধকতার কারণে। এ সকল শ্রেণীর মধ্যে প্রতিবন্ধী, বৃদ্ধি, মহিলা শিশু অন্যতম। এ অবস'া থেকেই অনুমান করা যায় হাঁটার অবস'া ভাল নয়। দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে প্রাইভেট গাড়ী, ফলে বৃদ্ধি পাচ্ছে যানজট, পরিবেশ দুষণ, জ্বালানি সংকটসহ নানা সমস্যাগুলো। অধিকাংশ মানুষ হেঁটে চলাচল করলেও অগ্রাধিকার পাচ্ছে না হাঁটার ব্যবস'া।

এক সময় ঢাকা শহরের প্রতিটি রাসৱায় হেটে পারাপারের জন্য জ্রেবা ক্রসিং ছিল। কিন' পথচারী অগ্রাধিকার দেওয়ার নামে মাত্র কযেক বছরের এ সকল জেব্রা ক্রসিংগুলো তুলে দিয়ে স'াপন করা হয়েছে ফুটওভার ব্রিজ। তিনতলা এই ফুটওভার ব্রিজগুলো কিভাবে পথচারী সহায়ক কার্যক্রম হয় তা বোধগম্য নয়। কারণ এ সকল ব্রিজ দিয়ে বৃদ্ধি, প্রতিবন্ধী, মহিলা, শিশু এবং মালামাল বহনকারী ব্যক্তিদের চলাচল কোনভাবেই সম্ভব নয়। তাছাড়া একটি সুস'্য সবল মানুষ যদি কিছু দূর হাটেন তার শরীর ও মনের পক্ষেও এ পর্বত সমান ফুটওভার ব্রিজ অতিক্রম করা সম্ভব নয়।

এ শহরে যেখানে অধিকাংশ মানুষ হেটে চলাচল করে তাদের জন্য জ্রেব্রা ক্রসিং বৃদ্ধি না করে কেনই বা পর্বত সমান ফুটওভার ব্রিজ তৈরি করা হচ্ছে না সত্যিই বিস্ময়ের বিষয়। সবচেয়ে অবাক বিষয় হচ্ছে বিগত কয়েক বছরের এ ধরনের অনেকগুলো ব্রিজ তৈরি করার পর ভেঙ্গে ফেলা হয়েছে মানুষ ব্যবহার না করার জন্য। তথাপিও নতুন নতুন তৈরি হচ্ছে ফুটওভার ব্রিজ। কিছু স'ানে আইনপ্রয়োগকারী সংস'ার লোকদের দিয়ে বাধ্য করানো হচ্ছে ব্রিজে উঠতে। ফুটওভার ব্রিজের স'ানে ব্যারিকেট তৈরি করা হচ্ছে যাতে মানুষ যত্রতত্র দিয়ে পারাপার না হতে পারে। যদি প্রশ্ন করার হয় একজন বৃদ্ধি, প্রতিবন্ধী, মহিলা, শিশু এবং মালামাল বহনকারী ব্যক্তি কিভাবে এ পর্বত অতিক্রম করবে। তার উত্তর কেনই দিতে পারবে না। বিগত দিনে ফুটওভার ব্রিজগুলো ভাঙ্গা এবং বল প্রয়োগ করেও ব্রিজ ব্যবহারে জনগনকে উৎসাহীত না করার ফলাফল হচ্ছে। এ প্রক্রিয়া জনগনের জন্য আরাম দায়াক ও সুবিধাজনক নয়। অর্থাৎ পরিকল্পনাবিদগন মানুষের সুবিধা ও মতামত বিবেচনা না করে এ সকল কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছেন। যা হাঁটার মানুষের প্রতি উপহাস বা অবহেলা হিসেবে প্রতীয়মান হয়। রাষ্ট্রীয় কোষাগারের অর্থে সরকারী প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে অধিকাংশ মানুষের সুবিধার প্রতি অবহেলা অসংবিধানিক ও গণতান্ত্রিক।

এবার আসা যাক হেটে চলাচল কেন আমাদের জন্য জরুরি। কেনই বা এ বিষয় এত বক্তব্য ও তর্কের অবতারণা। আমাদের দৈনন্দিন জীবনে যাতায়াত একটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। সুস'্য-স্বাভাবিকভাবে যাতায়াত করার জন্য সুষ্ঠু পরিবহন ব্যবস'া থাকা প্রয়োজন। ক্ষেত্রবিশেষে পাবলিক পরিবহন, অটোরিকশা, রিকশা, সাইকেল, হাঁটাকে প্রাধান্য দিতে হবে। তুলনামূলক বেশী দূরত্বের যাতায়াতের ক্ষেত্রে যেমন পাবলিক পরিবহন ব্যবহার করতে হবে, তেমনি স্বল্প দুরত্বের যাতায়াতের ক্ষেত্রে হাঁটাকে প্রাধান্য দিতে হবে। শুধুমাত্র স্বল্প দুরত্বের যাতায়াতের ক্ষেত্রেই নয় হাঁটার সাথে আমাদের শারীরীর সুস'্যতার সম্পর্ক রয়েছে।

আমাদের শারীরীক সুস'তা নিশ্চিত করার জন্য শুধুমাত্র পুষ্টিকর খাবারই নয় তার সাথে দরকার আমাদের নিয়মিত হাঁটাচলা বা ব্যায়াম করা। আমাদের শারীরীক সুস'্যতা নিশ্চিত করার জন্য প্রয়োজন নিয়মিত ব্যায়াম করা। কিন' আমাদের কর্মব্যসৱ জীবনে ব্যসৱতার কারনে নিয়মিত ব্যয়াম করা সম্ভব হয় না। তাছাড়া ব্যয়ামের জন্য যে সমসৱ জিম রয়েছে তাও ব্যায় সাপেক্ষ। অথচ আমরা যদি একটু সচেতন হয়ে স্বল্প দুরত্বের যাতায়াতের ক্ষেত্রে হেঁটে চলাচল করি তাহলে ব্যয়ামের জন্য আলাদা করে সময় এবং অর্থ ব্যয় করার প্রয়োজন হবে না। তাছাড়া রোগ প্রতিরোধের জন্য নিয়মিত হাঁটা কার্যকরী ভূমিকা পালন করে। বিশ্বস্বাস'্য সংস'ার মতে সুস'্য থাকার জন্য প্রতিদিন কমপক্ষ্যে ৩০ মি হাঁটা ও ওজন বৃদ্ধি হ্রাসের জন্য প্রতিদিন কমপক্ষে ১ ঘন্টা হাঁটা উচিত।

নিয়মিত হাঁটার ফলে হৃদরোগ, ডায়াবেটিস, মোটজনিত সমস্যাসহ নানা জটিল রোগসহ অনেক অসংক্রমক রোগ প্রতিরোধ করা সম্ভব। ২০০৫ সালের এপ্রিল মাসে প্রকাশিত তিনটা গবেষনায় দেখা গেছে নিয়মিত ৩০ মিনিট হাঁটলে হৃদরোগে আক্রানৱ হয়ে মৃত্যুর ঝুঁকি ৩৯% থেকে ৪৮% ভাগ পর্যনৱ কমায়। এবং ২০০৪ সালের সেপ্টেম্বর মাসের ৮ তারিখে "ঔড়ঁৎহধষ ড়ভ ঃযব অসবৎরপধহ গবফরপধষ অংংড়পরধঃরড়হ," একটা গবেষনা প্রকাশ করে যা ৯০৬ জন মহিলাকে নিয়ে করা হয়। গবেষনায় দেখা যায় নিয়মিত হাঁটাচলা না করা বা কায়িক শ্রমের অভাবে ৭৬% মহিলা ওজন জনিত সমস্যায় ভুগছে এবং ৪১% মহিলা অতিরিক্ত ওজন জনিত সমস্যায় ভুগছে, যা ভবিষতে হৃদরোগের ঝুঁকি বাড়ায়। তাছাড়া এমন অনেক অসংক্রমিক অনেক রোগ আছে যা হেঁটে চলাচলের মাধ্যমে প্রতিরোধ সম্ভব। তাছাড়া নিয়মিত হাঁটার ফলে শারীরীক সুস'্যতার সাথে সাথে মানসিক স্বাস'্য ঠিক রাখা সম্ভব।

সুস'্যভাবে বেঁচে থাকাই নয়, হাঁটার মাঝে রয়েছে এক ধরনের আনন্দ। কারণ হাঁটতে গিয়েই পরিচিতজন এবং নতুন মানুষের সাথে খুব সহজে সু-সম্পর্ক গড়ে তোলা সম্ভব। এর মাধ্যমে সামাজিক সম্পর্ক উন্নয়ন সম্ভব। নিয়মিত হেঁটে চলাচল করলে আশপাশের সকলের সাথে সখ্যতা সৃষ্টি হয়, যাতে সামাজিক নিরাপত্তা ও সম্পৃতি বৃদ্ধি পায়। ফলে আনন্দের সাথে অবসর সময় কাটানোর সুযোগ সৃষ্টি হয়। এতে শারীরীক সুস'্যতার সাথে সাথে মানসিক স্বাস'্য ভাল থাকে। তাছাড়া ধনি গরিব নির্বিশেষে হেঁটে চলাচল করলে সামাজে সমতা সৃষ্টি হয়।

শুধুমাত্র বড়দের জন্যই নয় শিশুদেরও সুস'্যভাবে বেড়ে ওঠার জন্য হাঁটা গুরুত্বপূর্ণ। এখনকার শিশুরা আগামী দিনের ভবিষ্যত। তাদের ওপর নির্ভর করে আগামী দিনের দেশের ভবিষ্যত। অতএব তাদের সুস'্যভাবে বেড়ে ওঠা নিশ্চিত করা প্রয়োজন। অথচ বর্তমানে আমাদের শিশুরা বড় হচ্ছে ইট-কাঠের তৈরী আবদ্ধ ঘরে। তাদের সময় কাটানো মাধ্যম হচ্ছে টিভি, কম্পিউটার, ভিডিও গেমস ইত্যাদি। উপযুক্ত খেলাধুলা ও হাঁটার পরিবেশ না থাকার কারনে আশে পাশে কারো সাথে মেলামেশার সুযোগ পাচ্ছে না। যা তাদের সুষ্ঠু বিকাশের ক্ষেত্রে অনৱরায়। এমনকি স্কুলে বা অন্য কোথাও যাতায়াতের জন্য বেশীরভাগ ক্ষেত্রে ব্যবহার করছে প্রাইভেট গাড়ী। স্কুলগুলোতেও পর্যাপ্ত খেলা ধুলার পরিবেশ নাই। ফলে শিশুদের প্রয়োজনীয় শারীরীক ব্যায়াম হচ্ছে না। অথচ শিশুদের যদি হেঁটে স্কুলে যাতায়াতের ব্যবস'া করি একদিকে যেমন শারীরীক ব্যয়াম হবে তেমনি আশে পাশে মানুষের সাথে মেলামেশার সুযোগ সৃষ্টি হবে। যা তাদের সুষ্ঠু ভাবে বেড়ে ওঠার জন্য প্রয়োজনীয়।

হাঁটার অনেক সুফল থাকলেও প্রয়োজনীয় অবকাঠামো না থাকার কারনে মানুষ অনেক ক্ষেত্রে হাঁটতে নিরুৎসাহীত হচেছ। ঢাকায় যেখানে যাতায়াতের ৮৪% যাতায়াত হচ্ছে হেঁটে ও জ্বালানীমুক্ত যান দ্বারা সেখানে দেশের পরিবহন পরিকল্পনা করা হচ্ছে যান্ত্রিক যানবাহনকে গুরুত্ব প্রদান করে। যান্ত্রিক যানবাহনকে সার্বাধিক গুরুত্ব প্রদান করায় যাতায়াতের ক্ষেত্রে জনসাধারনের উপর বাড়তি ভাড়া বাবদ অর্থনৈতিক চাপ সৃষ্টি হচ্ছে। যার প্রভাব পড়ছে শিক্ষা, স্বাস'্য, প্রভৃতি সেবার উপর। অথচ আমাদের শারীরীক সুস'তা, পরিবেশ বান্ধব, আর্থিক সাশ্রয়ী হওয়া স্বত্বেও অবকাঠামোগত উন্নয়নের ক্ষেত্রে হাঁটাকে প্রাধান্য দেওয়া হচ্ছে না। তৈরী করা হচ্ছে না হাঁটার উপযুগী পরিবেশ এবং ফুটপাত। তাছাড়া যেসমসৱ ফুটপাত রয়েছে তাও বেশিরভাগ ক্ষেত্রে ভাঙ্গা, অসমান, পথচারী বান্ধব নয়, এবং ফুটপাতগুলোতে গাড়ী পার্কিং করে রাখা হয়। ফুটপাত ও রাসৱায় গাড়ী পার্কিং করায় অনেক ক্ষেত্রে ঝুকিপূর্ণভাবে মানুষ ফুটপাত ছেড়ে রাসৱার মধ্য দিয়ে হাঁটতে বাধ্য হচ্ছে। ফুটপাতের পাশে ডাস্টবিন, ফেলে রাখা কনস্ট্রাকশনের জিনিসপত্র-ময়লা-আবর্জনা পরিবেশকে অস্বাস'্যকর করছে। এসমসৱ কারনে পথচারীরা নির্বিঘ্নে হেঁটে চলাচলের ক্ষেত্রে বাধাগ্রস' হচ্ছে এবং হেঁটে চলাচলে নিরুৎসাহীত হচ্ছে।

দেশের বাইরে যে সমসৱ দেশ সুষ্ঠু পরিবহন ব্যবস'া গড়ে তুলেছে সে সব দেশে হাঁটাকে অগ্রাধিকার দেওয়া হয়েছে এবং হেঁটে চলাচলের জন্য সেখানে প্রশসৱ ফুটপাত রয়েছে। শুধু তাই নয় প্রতিবন্ধি, শিশু ও বয়স্কদের হেঁটে চলাচলের আলাদা নীতিমালা আছে। তাছাড়া দেশের বাইরে যাতায়াতের ক্ষেত্রে পথচারীদের অগ্রাধীকার দেওয়া হয়। পথচারী হেঁটে যাচ্ছে দেখলে গাড়ির গতি থামিয়ে তাকে আগে যেতে দেয়া হয়। মনোমুগ্ধকর পরিবেশ পথচারীদের আকৃষ্ট করে তাই পথচারীদের চলাচলের সুবিধার্তে প্রচুর পরিমানে গাছ লাগানো হয়। নদীর পাশদিয়ে, সেতুতে রেল লাইনের পাশাপাশি হাঁটার জন্য আলাদা লেন বরাদ্দ আছে। হাঁটার পরিবেশ উন্নয়নের লক্ষ্যে বিভিন্ন দেশের বেশ কিছু শহরে সাপ্তাহিক ছুটির দিনে যান্ত্রিক যানবাহন নিষিদ্ধ থাকে।

অবকাঠামোগত পরিবেশ মানুষের মনের উপর প্রভাব ফেলে তাই হাঁটার জন্য সুন্দর, মনোমুগ্ধকর আর প্রাকৃতিক পরিবেশ তৈরী করতে হবে। আর এর জন্য রাসৱার দুইপাশে হাঁটার জন্য প্রশসৱ ফুটপাত তৈরী করতে হবে। যে সমসৱ রাসৱায় ফুটপাত রয়েছে তার বেশীরভাগই ভাঙ্গা এবং অসমান, পথচারী বান্ধব নয়। তাই নির্বিঘ্নে হাঁটার সুবিধার্থে ফুটপাত পথচারী বান্ধব করতে হবে। তাছাড়া বেশীর ভাগ রাসৱায় ফুটপাতগুলোতে গাড়ী পার্কিং করে রাখা হয়। ফলে নির্বিঘ্নে হেঁটে চলাচলের ক্ষেত্রে পথচারীরা বাধাগ্রস' হয়। তাই ফুটপাতে গাড়ী পার্কিং নিষিদ্ধ করতে হবে। ফুটপাতে ছায়ার জন্য পর্যাাপ্ত গাছ লাগানো এবং রাতে হেঁটে চলাচলের সুবিধার জন্য পর্যাপ্ত আলোর ব্যাবস'া থাকতে হবে। ফুটপাতের পাশে ডাস্টবিন সরিয়ে ফুটপাত ময়লা আবর্জনামুক্ত পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন করতে হবে।