বুধবার, ৮ সেপ্টেম্বর, ২০১০

ভবনে অগ্নিকান্ড: প্রতিরোধে করণীয়

ভবনে অগ্নিকান্ড: প্রতিরোধে করণীয়
সৈয়দ মাহবুবুল আলম, নীতিবিশ্লেষক,

বিগত সময়ে ঢাকা শহরের বিভিন্ন স্থানে অগ্নিকান্ড সংগঠিত হয়েছে। এ সকল অগ্নিকান্ডেও মানুষের প্রাণহানী ঘটেছে। সকল ঘটনাকে ছাড়িয়ে গত ৩ জুন ২০১০ তারিখে পুরান ঢাকার নিমতলী এলাকায় ভয়াবহ অগ্লিকান্ড সংগঠিত হয়। এ ভয়াবহ অগ্নিকান্ডে মারা যায় ১১৭জন এবং দগ্ধ হয়ে হাসপাতালে চিকিৎসাধীন রয়েছে আরো ৩৯ জন এবং আহত দুই শতাধিক। স্মরণকালের এই অগ্নিকান্ডে বিপুল প্রাণহানির প্রেক্ষিতে সরকার জাতীয় শোক দিবস ঘোষণা করে। এ ভয়াবহ দুঘর্টনা দেশের মানুষকে নিস্তদ্ধ করে দেয়। এ ঘটনায় নিস্তব্ধ হয়ে যায় গোটা এলাকা। দেশের এত মানুষের মৃত্যুতে আমরা শোকাবিত। আমরা তাদের বিদেহী আত্মার মাগফেরাত কামনা করছি।

ঢাকার শহরে এ ধরনের অগ্নিকান্ড প্রথম নয়। পুর্বেও এ ধরনের অগ্নিকান্ড সংগঠিত হয়ে্েছ। বসুন্ধরা সিটি, বিসিআইসি ভবনের অগ্নিকান্ডের কথা আমাদের সকলেরই মনে আছে। অত্যাধূনিক প্রযুক্তি ও বিপুল অর্থে তৈরি এ সকল ভবনেও অগ্নিনির্বাপনে পর্যাপ্ত ব্যবস্থা ছিল না। বিভিন্ন প্রতিকুলতার কারণে ফায়ার সার্ভিসের কর্মীদের পক্ষে এ সকল স্থানেও অগ্নিকান্ড নিয়ন্ত্রণ করার কঠিন ছিল। অর্থাৎ পুরান এবং নতুন ঢাকা কোথাও অগ্নিনির্বাপনে আমাদের প্রস্তুতি যথার্থ নয়।

আগুন লাগার কারণ
ঢাকার নিমতলীর অগ্নিকান্ড প্রাথমিকভাবে বিদ্যুতের ট্রান্সফরমার বিস্ফোরণের কারণ হিসেবে বলা হয়। পরবর্তীতে দেখা যায় উক্ত বাড়ির নিচতলায় বিয়ের অনুষ্ঠানের রান্নার তাপে উক্ত ভবনের নিচতলায় গোডাউনে রাখা কেমিক্যালের দাহ্য হয়ে আগুনেও সূত্রপাত হয়, যা পরে গোডাউনে রাখা ক্যামিক্যালের কারনে যা আশেপাশে ছড়িয়ে পড়ে।

আগুনের ক্ষয়ক্ষতি
আগুনের কারণে কি পরিমান আর্থিক ক্ষতি হয়েছে তা এখনো সঠিক নিরূপন করা সম্ভব হয়নি। তবে এ ভয়াবহ অগ্নিকান্ডে মারা যায় ১১৭জন এবং দগ্ধ হয়ে হাসপাতালে চিকিৎসাধীন রয়েছে আরো ৩৯ জন এবং আহত দুই শতাধিক। এছাড়া আগুনে সাত-আটটি বাড়ি, কয়েকটি দোকানপাট ও ব্যবয়ামাগারসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান পুড়ে যায়। কিন্তু বেশ কয়েকটি পরিবারের কেউ বেঁচে নেই। আবার অনেক পরিবারের দু-একজন ছাড়া কেউ বেঁচে নেই। সময়ের ব্যবধানে হয়ত এই আর্থিক ক্ষতি পুষিয়ে নেয়া সম্ভব। কিন্তু গুটি গুয়েক লোকের ব্যবসায়িক স্বার্থে গড়ে ওঠা এসব রাসায়নিক পদার্থের দোকানের কারনে যে প্রাণগুলো ঝড়ে গেল এবং যারা এখনও মুত্যু যন্ত্রনায় কাতরাচ্ছে তাদের ক্ষতি কি পূরণ করা সম্ভব?

দেশের বিভিন্ন স্থানে ভয়াবহ অগ্নিকান্ড
শুধু পুরান ঢাকা নয়, দেশের কোথাও না কোথাও প্রতিদিনই ঘটছে দু-চারটি অগ্লিকান্ড। এমন ক্ষয়ক্ষতির পরিমান কোটি কোটি টাকা বা অপূরনীয়। ২০০৮ সালে আগা সাদেক রোডের এক বাড়িতে অগ্লিকান্ডে ওই পরিবারের ৯ সদস্যই প্রাণ হারান। এ ছাড়া রাজধানীর বসুন্ধরা সিটি সুপার মার্কেট, অ্যালিফ্যান্ট রোডের ইয়াকুব মার্কেট, ২০০৬ সালের ২৬ ফেব্র“য়ারি কারওানবাজারে বিএসইসি ভবন, পাবনার স্কয়ার কনজুমার প্রোডাক্টস লিমিটেড গাজীপুরের নাওজোরের বিএইচটি ইন্ডাস্ট্রিজ, ২০০৬ সালের ২ নভেম্বর সাভারের প্যাসিফিকউইন্টার ওয়্যা সোয়েটার ফ্যাক্টরি, মতিঝিলের এল্লাল টেম্বারে অগ্রণী ব্যংক ওয়াপদা শাখা, সাভারের জিরাবোতে প্লস্টিক কারখানা ও ২০০৬ সালের ২৫ জুন ভালকায় ক্রউন সোয়েটার ফ্যাক্টরিতে অগ্লিকান্ড ঘটে।

একই বছরের ২৪ ফেব্র“য়ারি চট্রগ্রামের কালুরঘাট বিসিক শিল্প এলাকার কোটিএস টেক্সটাইল মিলসে ভয়ানক অগ্লিকান্ডে ৫৬ জন নিহত, ওই বছর ৯ ফেব্র“য়ারি গাজীপুরের কালিয়কৈর উপজেলার শফিপুর শিল্পঞ্চলে যমুনা স্পিনিং মিলে অগ্লিকান্ডে ওই প্রতিষ্ঠানের শীর্ষ দুই কার্মকর্তসহ সাতজন নিহত হন, ২০০৫ সালের ২৬ আগস্ট সাভার ইপিজেডের নতুন জোনে কোং কিং স্পিনিং অ্যান্ড ডাযিং টেক্সটাইল ফ্যাক্টরিতে অগ্লিকান্ডে ক্ষতি হয় ১৬৫ কোটি টাকা। ওই বছরের ১৩ অক্টোবর চট্রগ্রামের পূর্ব মাদারবাড়ি এলাকায় একটি গোডাউনে এবং ২০০৫ সারের ১৯ জুন সাভারের রাজফুলবাড়িয়া বাসস্ট্যান্ডে বিশ্বাস টেক্সটাইল লিমিটেডে অগ্লিকান্ডে প্রায় ১০০ কোটি টকার ক্ষতি হয়। একই বছর ৭ জানুয়ারি নারাযণগঞ্জের সিদ্ধিরগঞ্জ জেলেপাড়া ব্রিজের কাছে নিট গার্মেন্টসে অগ্লিকান্ডে ২৮ শ্রমিকের মর্মান্তিক মৃত্যু ঘটে। এ খন্ড চিত্রের বাইরেও অসংখ্য ঘটনা ঘটেছে।


অগ্নিকান্ড ও প্রতিরোধ ব্যবস্থা:
আমাদের দেশে শহর ও গ্রামে অনেক কারণেই অগ্নিকান্ড সংগঠিত হয়ে থাকে। তবে শহর অঞ্চলের জনবসতি অপেক্ষাকৃত ঘন হওয়ার কারণে হতাহত ও ক্ষতির পরিমান বেশি হয়ে থাকে। তথাপিও শহর অঞ্চলে অগ্নি প্রতিরোধ ব্যবস্থা জোরালো নয়। প্রতিটি অগ্নিকান্ডের পর জোরদার বক্তব্য থাকলেও কিছু দিন পর তা আবার ঝিমিয়ে পড়ে। সংস্থাগুলোর উদ্যোগ ঝিমিয়ে পড়ে, সাধারণ মানুষও ভুলে যায়। আবার একটি অগ্নিকান্ড সংগঠিত হয় আবার কিছু দিন পর ভুলে যায়। কিন্তু বারবার এ দূঘর্টনায় আর্থিক ক্ষতির পাশাপাশি ঝড়ে যায় অনেক অমূল্য প্রাণ।

ভবন ও শিল্পকারখানায় অগ্নি নির্বাপণের জন্য পর্যাপ্ত যে ব্যবস্থা থাকার কথা তা অধিকাংশ ক্ষেত্রেই থাকে না। আবার যেখানে রয়েছে সেখানে দীর্ঘদিন ধরে ব্যবহার না করার প্রেক্ষিতে নষ্ট হয়ে গেছে। অনেক ক্ষেত্রে ভাল থাকলেও ব্যবহার অনেক করতে জানে না। অনেক ভবন ও প্রতিষ্ঠানের অগ্নি প্রতিরোধ করার লক্ষ্যে যথেষ্ট ব্যবস্থাও গ্রহণ করা হয় না।

অগ্নিকান্ডের কারণ হিসেবে অনেকে অপরিকল্পিত বাসস্থান বা ভবন তৈরিকে দায়ী করে থাকেন। কিন্তু যদি আমরা বসুন্ধরার সিটি ও বিসিআইসি ভবনের দিকে তাই তাহলে বুঝতে পারবো সমস্যা অন্য কোথায়। কেহ কেহ আবার মনিটরিং এর অভাবকে দায়ী করে থাকেন। মনিটরিংকারী সংস্থাগুলো লোকবল বা সরজ্জামের অভাব বলে থাকেন। কিন্তু অনুসন্ধান করলে দেখা যাবে এ অবৈধ ভবন বা কারাখনা তৈরির অনুমোদনের ক্ষেত্রে ঠিকই অনৈতিক অর্থ লেনদেন হয়েছে। অর্থাৎ বিষয়টি যে অবৈধ হচ্ছে তা সংশ্লিস্ট কর্মকর্তার নজরে রয়েছে। এ প্রক্রিয়ার মাধ্যমে একে অনের উপর দোষ চাপিয়ে আসছে। দিন দিন বাড়ছে দুঘর্টনা এবং মানুষের মৃত্যু।

অগ্নিকান্ড সংগঠনের পর পর অগ্নিনির্বাপনে কতিপয় সমস্যা প্রায়শই দেখা দেয়া। এ সমস্যাগুলোর মধ্যে পর্যাপ্ত পানির অভাব, খেলাজায়গার সমস্যা, অগ্নিকান্ডের প্রেক্ষিতে করণীয় বিষয়ে অজ্ঞতা, সরু রাস্তার কারণে অগ্নিনির্বাপক গাড়ী প্রবেশ সমস্যা, অগ্নিনির্বাপন ব্যবস্থার অভাব, অগ্নিকান্ডের প্রেক্ষিতে বিকল্প পথে বেরুনোর ব্যবস্থা না থাকা ইত্যাদি কারণগুলো প্রায়শই দেখা যায়। অথচ তারপরও সরকারী সংস্থাগুলো ঘিঞ্চি জায়গায় বহুতল ভবন নির্মাণের অনুমোদন দিচ্ছে, খোলা জায়গা ও জলাশয়গুলো ভরাট হচ্ছে বিল্ডার্স দ্বারা। সরু রাস্তা চিরসত্য হলেও এ রাস্তাগুলোতে প্রবেশের উপযোগী ফায়ার সার্ভিস গাড়ী ব্যবস্থার কোন উদ্যোগ নেই। যত উৎসাহী হয়ে বিভিন্ন প্রকল্পে বা ভবনের অনুমোদন দেয়া হচ্ছে তত উৎসাহ নেই মানুষকে রক্ষায় কোন কার্যক্রম গ্রহনের।

দিন দিন ঘটে চলা অগ্নিকান্ড। অগ্নিকান্ডে প্রতিরোধে দায়িত্বপ্রাপ্ত সংস্থাগুলোর নিস্ত্রিয়তা, জনগণে প্রতি প্রতিষ্ঠানগুলোর কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের উদাসীনতা ও অবজ্ঞার প্রমান করে। যত পরিকল্পনা ও বাজেট বরাদ্ধ করা হোক না কেন দায়িত্ব প্রতিষ্ঠানগুলোর মনিটরিং, দায়বদ্ধতা ও জবাবদিহীতা নিশ্চিত করা না গেলে এ দুঘর্টনা ও মৃত্যু কতটুকু হ্রাস করা সম্ভব হবে তা প্রশ্নবিধ বিষয়।
৭ জুন ২০১০, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, পরিবেশ বাঁচাও আন্দোলন

অগ্নিকান্ডের ঝুঁকি হ্রাসে কতিপয় সুপারিশ :
ক্স সমন্বিত নীতিমালার ভিত্তিতে বহুতল ভবনের অনুমোদন দেয়া।
ক্স ভবনের নকশা সংশ্লিষ্ট বিভাগ কর্তৃক ছাড় করনের পর নির্মাণ ও অনুমতি সাপেক্ষে ব্যবহারের জন্য চালু করা।
ক্স ভবনের পাশে যথেষ্ট পরিমানে ফাঁকা স্থান রাখা।
ক্স ভবনের পাশে জলাশয় রাখা।
ক্স সড়কে ট্রাফিক ব্যবস্থা স্বাভাবিক থাকবে কিনা যাচাই সাপেক্ষে বহুতল ভবন নির্মাণের অনুমোদন করা।
ক্স বহুতল ভবনের অভ্যন্তরে অগ্নি নির্বাপনের সকল ব্যবস্থা রাখা ও নিয়মিত মহড়ার ব্যবস্থা করা।
ক্স বস্তি এলাকার পাশে পানির ব্যবস্থা রাখা ও বস্তিবাসীকে নিয়ে নিয়মিত মহড়া করা
ক্স সরু রাস্তায় প্রবেশের উপযোগী ফায়ার সার্ভিস গাড়ী ব্যবস্থা।
ক্স ফায়ার সাভির্সের উন্নয়ন করা।
ক্স স্কুল-কলেজসহ সকল সরকারী বেসরকারী প্রতিষ্ঠানে নিয়মিত অগ্নি নির্বাপণ মহড়া করা।
তথ্যসুত্র:
১. বিভিন্ন জাতীয় দৈনিক
২. বহুতর ভবনে অগ্নিকান্ড, প্রাসঙ্গিক ভাবনা, সৈয়দ মাহবুবুল আলম, নীতিবিশ্লেষক, পরিবেশ বাঁচাও আন্দোলন।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন