রবিবার, ১ জুলাই, ২০১২

আমার শরীর পণ্য নয়

আমার শরীর পণ্য নয়, বানিজ্যিক স্বাস্থ্য কার্যক্রম ও মানবাধিকার
সৈয়দ মাহবুবুল আলম, নীতিবিশ্লেষক

ভাই রোগীটা দেখেন, টঙ্গীতে ট্রাকের সাথে ধাক্কা খেয়েছে। দয়া করে রোগীটাকে চিকিৎসা দিন। আমরা টাকা নিয়ে আসছি। একটি বেসরকারী হাসপাতালের কর্তৃপরে নিকট মোবাইলে গুরুতর আহত একজন রোগীকে চিকিৎসা দিতে এভাবে আকুতি জানাচ্ছিলাম। ছেলেটার অপরিচ্ছন্ন কাপড় আর দরিদ্র সহচরদের দেখে কর্তৃপ চিকিৎসা দিচ্ছিল না। এত আকুতির পরও চিকিৎসা পায়নি মারাত্বকভাবে আহত দরিদ্র ছেলেটি..... বেসরকারী হাসপাতাল থেকে ছেলেটিকে পাঠিয়ে দেয়া হয় ঢাকা মেডিক্যাল কলেজে। ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ এ পৌঁছানো পর্যন্ত বাঁচেনি ছেলেটা.......সারান মনে হচ্ছিল যদি সময় মতো চিকিৎসা পেতো হয়তো ছেলেটা বাচঁতো।

‘‘ভাই আমাগো বাচ্ছাডা বাঁচবে না।’’ গভীর রাত। ঢাকায় একটি শিশু বিশেষাষ্ণায়িত হাসপাতালে বসে আছি। একজন মা ডাক্তারকে অনুরোধ করছে তার সন্তানকে এনআইসিইউতে রাখতে। সিট না থাকায় ডাক্তার তাকে অন্য হাসপাতালে নিতে পরামর্শ দিচ্ছেন। কিন্তু অন্য হাসপাতালে নিতে হলে প্রতিদিন প্রায় ২০ হাজার টাকার মতো খরচ লাগবে বিধায় মা তার শিশুটিকে এ হাসপাতালেই সিট না থাকলে অন্তত মাটিতে স্থান দিতে পীড়াপীড়ি করছিলেন। এটি বর্তমান বানিজ্যিক স্বাস্থ্য কার্যক্রমের চিত্র।

সেবা বলতে একটি মহৎকর্ম প্রচেষ্টাকে বুঝায়। অর্থের বিনিময়ে পরিচালিত স্বাস্থ্য কার্যক্রমকে স্বাস্থ্যসেবা বলা অযৌক্তিক। বেসরকারী স্বাস্থ্যসেবা বলতে সে সকল দাতব্য প্রতিষ্ঠানকে চিহ্নিত করা উচিত যারা মানুষকে তাদের সাধ্য অনুসারে সেবা প্রদান করা আসছে, এতে মুনাফা অর্জনই মূল উদ্দেশ্য নয়। শুধুমাত্র অর্থ উপার্জনের ল্েয নানা প্রক্রিয়ায় মানুষকে জিম্মি করার স্বাস্থ্য বিষয়ক কার্যক্রমকে বানিজ্যিক স্বাস্থ্য কার্যক্রম বলা উচিত। স্বাস্থ্য বিষয়ে নীতিনির্ধারণ ও আলোচনার েেত্র সরকারী স্বাস্থ্যসেবা, বেসরকারী স্বাস্থ্যসেবা এবং বানিজ্যিক স্বাস্থ্য কার্যক্রম এই মৌলিক বিষয়গুলো সুপষ্টভাবে চিহ্নিত করা প্রয়োজন। বেসরকারী স্বাস্থ্য সেবা শব্দটির আড়ালে স্বাস্থ্য নিয়ে বানিজ্য করায় মূল বিষয়টি হারিয়ে যায়। সেবার কথা বলে এই বানিজ্যিক প্রতিষ্ঠানগুলো রাষ্ট্র হতে নানা সুযোগ সুবিধা গ্রহণ করে। কিন্তু তাদের মূনাফা অর্জনের ল্য মাত্রায় পিষ্ট হয় রাষ্ট্রের জনগন।

স্বাস্থ্যখাত এর ক্রমবর্ধমান বানিজ্যকরণের অপর একটি কারণ হচ্ছে, স্বাস্থ্য বলতে অনেক সচেতন মানুষ শুধুমাত্র চিকিৎসাকেই চিন্তা করে। সকল পরিকল্পনা ও কার্যক্রমে চিকিৎসার মতো বানিজ্যিক েেত্রগুলোই প্রধান্য পায়। স্বাস্থ্য সেবা বলতে সুস্থ্য থাকার উপায় বা রোগ প্রতিরোধের মতো বিষয়গুলো স্থান পায় না। পরিবেশ দূষণ রোধ, খাদ্যভাস, কায়িক পরিশ্রম, সচেতনতা সুস্বাস্থ্য বজায় রাখার এ সকল খাতে বানিজ্য করার সুযোগ খুবই কম। অপরদিকে চিকিৎসা কার্যক্রমের সাথে রয়েছে অবকাঠামো, ঔষধ, টেস্ট, অপরেশন, ভিজিটসহ নানা ধরনের অর্থসংস্থানের সুযোগ। আর নিয়মিত অর্থ উৎপাদনের এ সুযোগের কারণে মানুষকে সুস্থ্য রাখা অপো চিকিৎসা ও বানিজ্যিক স্বাস্থ্য কার্যক্রমের প্রতি মনোযোগ, প্রকল্প, নীতি ও পরিকল্পনা অনেক বেশি।

স্বাস্থ্যখাত বানিজ্যিককরণের প্রক্রিয়া
স্বাধীনতার পর সত্তর দশকের শেষের দিকে এদেশের বানিজ্যিক স্বাস্থ্যখাতের বিকাশ শুরু হলেও তখন এ সংক্রান্ত কোন বিধি বিধান বা নীতিমালা তৈরী হয়নি। তথাপিও সে সময় হাসপাতাল, নার্সিং হোম, কিনিক স্থাপনের জন্য স্বল্প সুদে ব্যাংক ঋণদানের একটি স্কীম চালু করা হয়। ১৯৮২ সালে একটা অধ্যাদেশ জারীর মাধ্যমে বেসরকারি স্বাস্থ্যসেবা খাতকে আইনী বৈধতা দেওয়া হয়। উক্ত অধ্যাদেশ বেসরকারি কিনিক, হাসপাতাল, ল্যাবরেটরি নির্মানের েেত্র যন্ত্রপাতি ও বিশেষজ্ঞ নিয়োগের শর্ত নির্দিষ্ট করা হয়। ১৯৮৪ সালে পূর্ববর্তী অধ্যাদেশের সংশোধনীসহ আরেকটি অধ্যাদেশ জারী করা হয়। সে সময় গৃহীত তৃতীয় পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা এবং পরবর্তীতে ১৯৯১-৯৬ গৃহীত চতুর্থ পঞ্চবাষির্কী পরিকল্পনায় বেসরকারি খাত বিকাশের ল্েয সরকারি পরিকল্পনা সন্নিবেশিত হয়। ১৯৯৬-২০০১ সালে পঞ্চম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনায় বেসরকারি খাতকে বিকাশের পরিকল্পনা দৃঢ়ভাবে গ্রহণ করা হয়। পরবর্তীতে ২০০১-০৬ বেসরকারি খাতকে উৎসাহিত করার ল্েয সরকারীভাবে বিভিন্ন প্রোগ্রাম ও অর্থ সুবিধার বিধান হাতে নেওয়া হয়।

বাংলাদেশে খুব দ্রুত বেড়েছে এই বেসরকারী স্বাস্থ্যখাত। ১৯৮০ সালে সরকারী পরিচালনায় রাষ্ট্রায়াত হাসপাতাল ছিল ৫১০ টি এবং বেসরকারী ছিল ৩৯ টি, ১৯৯৮ সালে সরকারী হাসপাতালের সংখ্যা বেড়ে ৬৪৭ টি এবং বেসরকারী হাসপাতালের সংখ্যা দাড়ায় ৬২৬টি। ২০০৫-০৬ সালে এক তথ্যে দেখা যায় মোট ৪ হাজার ১৫টি চিকিৎসা প্রতিষ্ঠানের মাঝে ২ হাজার ১৬৮টি একক মালিকানায় প্রতিষ্ঠিত। বর্তমানে কত পরিমান হাসপাতাল, কিনিক ও প্যাথলজি ল্যাব রয়েছে তার সঠিক পরিসংখ্যান কারো কাছেই নেই। বেসরকারী চিকিৎসা সেবার মান উন্নয়নে বেসরকারি চিকিৎসা সেবা আইন ২০০০ খসড়া প্রণয়ন করা হয়। আইনটি ২০০৩ ও ২০০৪ সালে আরো অধিকতর উন্নয়ন করে
পাসের উদ্যোগ গ্রহণ করা হলেও, এখনো পর্যন্ত আলোর মুখ দেখেনি। তবে এই উদ্যোগের অংশ হিসেবে স্বাস্থ মন্ত্রণালয় আবার “বেসরকারি স্বাস্থ্য সেবা আইন-২০১০ (খসড়া) প্রণয়ন করেছে। তবে কবে পাশ হবে এবং মানুষের স্বার্থ রা করবে তা দেখার বিষয়।

বাংলাদেশে বেসরকারীখাতে স্বাস্থ্যসেবার চিত্র পাওয়া যায় বিশ্ব ব্যাংকের ২০০৩ সালের একটি প্রতিবেদনে। সেখানে উল্লেখ করা হয়েছে “স্বাস্থ্যসেবা গ্রহণকারীদের মধ্যে শতকরা ৭০ ভাগ বেসরকারী স্বাস্থ্যখাত থেকে সেবা নিয়ে থাকেন (নিবন্ধিত নয় এমন সেবা প্রদানকারীসহ)। অর্থ ব্যয়ের নিরিখেও বেসরকারি খাতের কলেবর সরকারি খাতের দ্বিগুণের বেশি। স্বাস্থ্য বিষয়ক মুখপত্র হেলথ বুলেটিন ২০১০ এর উপাত্তের দিকে দৃষ্টি দিলে দেখা যায় ১৯৯৬-৯৭ সালে সরকারি খাতে মোট ব্যয়ের পরিমান ছিলো সর্বমোট স্বাস্থ্য ব্যয়ের ৩৬% এবং বেসরকারি খাতে ৬৪%, ১৯৯৭-৯৮ সালে ৩৪% ও ৬৬ %, ১৯৯৮-৯৯ সালে ৩১% ও ৬৯%, ২০০১-০২ সালে ৩০% ও ৭০%, ২০০২-০৩ সালে ২৮% ও ৭২%, ২০০৪-০৫ ও ২০০৫-০৬ সালে ২৬% ও ৭৪%। বেসরকারি খাতের ব্যয় বলতে ব্যাক্তিগত খাতের ব্যয়, বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের ব্যয়, এনজিও ব্যয় ও উন্নয়ন সহযোগীদের ব্যয়সমূহকে বোঝানো হয়েছে।

উপরেররর চিত্র থেকে বোঝা যায় বাংলাদেশের মানুষ আজ বেসরকারী স্বাস্থ্য খাত তথা বানিজ্যিক স্বাস্থ্য খাতের নিকট জিম্মি। তবে বিশ্বব্যাংকের এ সকল তথ্য যথেষ্ট সতর্কতার সাথে গ্রহণ করা উচিত। বিশ্বব্যাংকের এ সকল তথ্যের পরবর্তী পদপে থাকে ব্যবসার পথ তৈরি করা। রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান ও সরকারে জনস্বার্থে গৃহীত কার্যক্রমগুলোকে অযোগ্য এবং অকার্যকর প্রমাণিত করার প্রকল্পগুলো বানিজ্যিক কার্যক্রমের পথ সুগম করে দেয়। রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানের স্বাস্থ্য সেবাকে সংকুচিত করার প্রেেিত মানুষ কোন উপায় না পেয়ে সহায় সম্বল বিক্রি করে ছুটছে বানিজ্যিক স্বাস্থ্য সেবা কার্যক্রমের দিকে সেবা পেতে। বানিজ্য তার নিয়মেই পরিচালিত হচ্ছে মানুষ ও মানবাধিকার সেখানে পণ্য।

স্বাস্থ্য ও মানবাধিকার
বর্তমান প্রোপটে বানিজ্য ও স্বাস্থ্য অধিকার পারস্পরিক সাংঘর্ষিক বিষয়। যদিও বলবৎ সংবিধান, আন্তর্জাতিক চুক্তি সকল সকল বিষয়ে স্বাস্থ্যকে মানবাধিকার হিসেবে স্বীকৃতি প্রদান করেছে। বাংলাদেশ সংবিধানের রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতিতে রাষ্ট্রের অন্যতম মৌলিক দায়িত্ব হিসেবে চিকিৎসাকে চিহ্নিত করা হয়েছে। পাশাপাশি জনগণের পুষ্টির স্তর-উন্নয়ন ও জনস্বাস্থ্যের উন্নতি সাধনকে রাষ্ট্র অন্যতম প্রাথমিক কর্তব্য বলে গণ্য করার কথা সংবিধানের সুপষ্ট উল্লেখ্য করা হয়েছে। জাতীয় স্বাস্থ্য নীতি অনুসারে প্রাথমিক স্বাস্থ্য পরিচর্যার অত্যাবশ্যক সেবাগুলি রাষ্ট্রীয় ভূখন্ডের যে কোন ভৌগলিক অবস্থানে প্রত্যেক নাগরিকের কাছে পৌছে দেওয়াকে মূলনীতিতে স্থান দেওয়া হয়েছে। রাষ্ট্র পরিচালনার মূল দলিল অনুসারে জনগনের স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করা সরকারের অন্যতম দায়িত্ব ও কর্তব্য।

সার্বজনীন মানবাধিকার ঘোষণার ধারা ২৫ এ বলা আছে, স্বাস্থ্য ও কল্যাণের জন্য উপযুক্ত জীবনযাত্রার মান প্রাপ্তির অধিকার প্রত্যেকেরই আছে। খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থান, শিা, চিকিৎসাসহ প্রয়োজনীয় সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় সেবা ও সুবিধা লাভের অধিকার প্রত্যেকেরই প্রাপ্য। অর্থনৈতিক, সামাজিক এবং সাংস্কৃতিক অধিকার বিষয়ক আন্তর্জাতিক চুক্তি (ওঈঊঝঈজ)-এর ১২ অনুচ্ছেদ অনুসারে প্রত্যেকের সর্বোত্তম শারীরিক এবং মানসিক স্বাস্থ্য উপভোগ করার অধিকার রয়েছে। ১৯৭৮ সালে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার আলমা আতা ঘোষণায় স্বাস্থ্যসেবার অভিগম্যতাকে একটি অধিকার হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে এবং পৃথিবীর সকল দেশ তা গ্রহণ করেছে। ২০০০ সালের জাতিসংঘ কর্তৃক ঘোষিত সহস্রাব্দ উন্নয়ন ঘোষণায়ও এ অধিকারের বিষয়টি পূর্ণব্যক্ত করে স্বাস্থ্যকে উন্নয়নের কেন্দ্রে স্থান দেয়া হয়েছে। নীতি ও আর্দশের দিক হতে স্বাস্থ্যকে মানবাধিকার হিসেবে বিবেচনা করা হলেও, স্বাস্থ্য কার্যক্রম ছুটছে বানিজ্যকরনের দিকে।

স্বাস্থ্যকে বানিজ্যিক দিকে নিয়ে যাওয়ার প্রক্রিয়া সম্পর্কে তথ্য পাওয়া যায় ফরিদা আকতারের স্বাস্থ্য সেবা কোন দিকে ছুটছে এ লেখা হতে ‘‘ স্বাধীনতার পরের সময়ে মোহাম্মদপুর, শ্যামলী মিরপুর এলাকার গরিব মহিলারা বিশেষ করে সোহরাওর্য়াদী জেনারেল হাসপাতালের কথা উল্লেখ করলেন। এখানে ১ টাকার টিকেট কেটে চিকিৎসা করছেন এবং বিনামূল্যে চিকিৎসা সেবা নিয়েছেন। মধ্যবিত্ত মহিলারা আরো একটি তথ্য দিলেন তা হচ্ছে হঠাৎ করে আশির দশকে অস্ত্র প্রচারের বিষয়টি চোখে পড়তে শুরু করলো। সন্তান জন্ম দিতে গিয়ে সিজারিয়ান অপরেশনে বাচ্চা হওয়া যেন স্বাভাবিক বিষয় হলে উঠলো। অথচ সবার জন্য তা দরকার ছিল কি না এখন যে প্রশ্ন উঠে। খরচের ব্যাপারটাও বেড়ে গেল । ১৯৮৮ সালে একজন মহিলার প্রথম বাচ্চা সিজারিয়ান অপারেশনে হবার সময় খরচ হলো ১৩,০০০ টাকায়, ১৯৯৪ সালে দ্বিতীয় বাচ্চা হবার সময় খরচ হলো ৩০,০০০ টাকা। বর্তমানে তা আরো বেড়ে গেছে।’’ আর এখন এর বড় অংশ নিয়ন্ত্রণ করছে বানিজ্যিক খাত।

বেড়েছে বানিজ্য, বাড়ছে রোগ
স্বাস্থ্যখাত বানিজ্যিককরণের প্রেেিত আমাদের কতটুকু অগ্রগতি হয়েছে তা বিবেচ্য বিষয়। আগের তুলনায় মানুষের মাঝে রোগ অনেক বৃদ্ধি পেয়েছে এবং অনেক লোক চিকিৎসা পাচ্ছে না। উদাহরণ হিসাবে বলা যায় দেশে নীরব ঘাতক ব্যধি ডায়াবেটিসে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা বাড়ছে এবং ৭৫ শতাংশ ডায়াবেটিস রোগী রয়েছে চিকিৎসা সেবার বাইরে। ডায়াবেটিস রোগীদের জীবন রাকারী ওষুধের দাম বেড়েছে দ্বিগুন-তিনগুন এখনো নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত হয়ে বাংলাদেশে প্রতি ঘন্টায় ৭ টি শিশু মারা যায়। প্রতি বছর মারা যায় ৫০ হাজার শিশু। অপুষ্টির কারণে প্রতিদিন ৯০০ শিশু মারা যাচ্ছে। বাংলাদেশে প্রায় দেশের ৪০ ভাগ এলাকায় স্যানিটেশন সুবিধা নেই, পানিবাহিত রোগে প্রতিদিন মারা যাচ্ছে ৩৪২ শিশু। দেশে প্রায় ৮ ল ক্যান্সার রোগী আছে, তাদের মাঝে ৭ ল লোক চিকিৎসা পাচ্ছে না।

বাংলাদেশ অসংক্রামক রোগ দিন দিন বাড়ছে। আমাদের কর্মব্যস্ত জীবনে পরিকল্পিত খাদ্যাভাস গড়ে তোলার পরিবর্তে আমরা অতিরিক্ত চর্বিযুক্ত খাবার, কার্বহাইড্রেট, ফাস্ট ফুড, জাঙ্ক ফুডে অভ্যস্ত হয়ে পড়ছি। ফলে আমরা আক্রান্ত হচ্ছি ডায়াবেটিস এবং অতিরিক্ত মোটাজনিত রোগে। বাংলাদেশের ২০ বছরের উর্দ্ধ বয়সী গ্রামের মানুষের মাঝে ৭% এবং শহরাঞ্চলে ১৭ % লোক ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হচ্ছে এবং মোট মৃত্যুর ৬.২% ভাগ মৃত্যু হয় ডায়াবেটিসের কারনে। এছাড়া উন্নয়নশীল দেশগুলোতে জনগণ পরিকল্পিত খাদ্যাভাস সম্পর্কে অজ্ঞতা, সচেতনতা কম এবং অর্থনৈতিক দূর্বলতার কারনে অপুষ্টিতে ভুগছে।

আমাদের দেশে কায়িক শ্রমের অভাবে একটি বড় অংশের মানুষ আক্রান্ত হচ্ছে হৃদরোগ এবং উচ্চরক্তচাপ জনিত সমস্যায়। বাংলাদেশের গ্রামাঞ্চলের ১৮ এর উর্দ্ধ বয়সীদের শতকরা ১৩% (পুরুষ ৯.৮% ও মহিলা ১৫.৬%) উচ্চ রক্তচাপে আক্রান্ত হচ্ছে। তাছাড়া মোট মৃত্যুর শতকরা ২.৪ ভাগ হার্ট অ্যটাক. ৩.৬ ভাগ স্ট্রোক এবং ৬.৫ ভাগ অন্যান্য হৃদরোগ অর্থাৎ সর্বমোট ১২.৫ % মৃত্যুর কারণ নানাবিধ হৃদরোগ। বাংলাদেশে বায়ূ দূষনের কারণে বেড়ে যাচ্ছে শ্বাসতন্ত্রের দীর্ঘমেয়াদী রোগ। দেশের জনগনের প্রতি হাজারে যথাক্রমে পুরুষ ও মহিলাদের ৪৫ ও ২২ জনের হাপাঁনি বহির্ভূত শ্বাসতন্ত্রের দীর্ঘমেয়াদী রোগ রয়েছে। ফলে এই রোগের কারণে মৃত্যুর পরিমান মোট মৃত্যুর ৩%।

বাংলাদেশে প্রাপ্ত বয়স্ক জনগোষ্ঠীর মাঝে গ্রামাঞ্চলের ৪৩% ও শহরের ৯০% অপর্যাপ্ত কায়িক শ্রম করেন। তাছাড়া বাংলাদেশে প্রাপ্ত বয়স্ক জনগোষ্ঠীর মধ্যে গ্রামাঞ্চলে বেশীর ভাগ মানুষ প্রয়োজনীয় খাদ্য পায়না, কিন্ত শহরাঞ্চলে চাহিদার ৫৮% অধিক শর্করা ও ১৬% অধিক চর্বি গ্রহণ করেন। বাংলাদেশের গ্রামাঞ্চলের শতকরা ৩ ভাগ মহিলা ’’বিপাকীয় উপর্স’’ বা মেটাবেলিক সিনড্রোমে ভোগে। বাংলাদেশে ২০ উর্দ্ধ গ্রামের মহিলাদের ৬.৫% এবং শহরের মহিলা ও পুরুষদের যথাক্রমে ৫০% ও ৩১% ওজনাধিক্যে ভুগছে।

অসংক্রামক রোগের বিষয়ে আমাদের এখনই সচেতন হতে হবে। চিকিৎসার চেয়ে রোগ প্রতিরোধকেই প্রাধান্য দিতে হবে। এক সময় মনে করা হত, অসংক্রামক রোগ প্রতিরোধযোগ্য নয়, প্রকৃত পে শতকরা ৮০% অপরিণত হৃদরোগ, স্ট্রোক ও ডায়াবেটিস এবং ৪০ ভাগ ক্যান্সার প্রতিরোধযোগ্য। বিভিন্ন গবেষনা হতে জানা গেছে যে, কমিউনিটি ভিত্তিক পদপে দ্বারা অসংক্রামক রোগসমূহ প্রতিরোধযোগ্য এবং এই সকল রোগ চিকিৎসা করার চেয়ে প্রতিরোধ করা অর্থনৈতিকভাবে অনেক বেশী সাশ্রয়ী।

শুধু বাংলাদেশ নয়, পৃথিবীর মানুষ নতুন নতুন সংক্রামক ব্যাধির ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে। দিন দিন ঝুঁকি বাড়ছে। গবেষকরা বলছেন, মনুষ্য প্রজাতি গত ২৫ বছরে ৩৫টি নতুন সংক্রামক ব্যাধিতে আক্রান্ত হয়েছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, জনসংখ্যার এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে ছড়িছে পড়ছে। রোগ তত্ত্ববিদেরা বলছেন, পৃথিবীর মানুষ নতুন নতুন রোগে আক্রান্ত হচ্ছে। যুক্তরাজ্যের এডিনবার্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষক মার্ক উলহাউস ২৫ বছরের তথ্য বিশ্লেষণ করে করেছেন, এই সময়ে মানুষ ৩৮টি নতুন রোগে আক্রান্ত হয়েছে। এই রোগ মানুষের মধ্যে আগে ছিল না। এসব রোগের ৭৫ শতাংশ এসেছে জীবজন্তু ও পশু-পাখি থেকে।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা সংক্রামক ব্যাধির বিস্তার নিয়ে পর্যালোচনা করেছে। (গ্লোবালাইজেশন অ্যান্ড ইনফেকশাস ডিজিজেস: এ রিভিউ অব দ্য লিংকেজ) তাতে দেখা যায়, ১৯৯৫ সাল থেকে ৩০টি নতুন ও পুরোনো রোগ “নতুনভাবে আবির্ভূত হচ্ছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বলছে, বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধি, রৈখিক জলবায়ু পরিবর্তন, বড় বড় বাধ নির্মান, বন উজাড় হওয়া, বিস্তীর্ণ ভূমি ন্যাড়া হওয়া-এসব কারনে (সিলেকটিভ অ্যাডভান্টেজ) রোগের আবির্ভাব হচ্ছে। প্রতি আট মাসে একটি নতুন রোগের ঝুঁকি প্রতিরোধে দেশের প্রস্তুতি যথেষ্ট নয়।

রোগ নিয়ন্ত্রণে মনোযোগী না হয়ে মনোযোগ হচ্ছে স্বাস্থ্য বানিজ্যিক খাতে বিস্তারে। কারণ এই খাতটি অন্যতম একটি লাভজনক ব্যবসা। দরিদ্র মানুষ ব্যক্তি মালিকানাধীন স্বাস্থ্য সেবার জন্য এত টাকা দিতে পারছে না। তথাপিও বানিজ্যিক স্বাস্থ্য সেবা প্রতিষ্ঠানগুলো ছুটছে মফস্বল ও গ্রামের দিকে। সমস্যা হচ্ছে ব্যক্তি মালিকানাধীন এই স্বাস্থ্য কার্যক্রম হতে দীর্ঘমেয়াদী স্বাস্থ্যসেবা, গৃহভিত্তিক সেবা, জটিল ও দীর্ঘস্থায়ী রোগ এবং অন্যান্য গুরুতর স্বাস্থ্য সমস্যার সেবা পাওয়া যাবে না। ফলে সবার জন্য স্বাস্থ্য নীতি মূখ থুবড়ে পড়বে।

আমাদের দেহ যখন পন্য
স্বাস্থ্যখাত একটি বিশাল বানিজ্যিক খাত। ২০০৯ সালে প্রকাশিত এক তথ্যে দেখা যায় ৮ বছরে বেসরকারী চিকিৎসালয়ের আয় বেড়েছে ৫৩৬ শতাংশ, দিন দিন এর পরিমান বাড়ছে। বানিজ্যিকখাতে চিকিৎসা ব্যয় অস্বাভাবিক হারে বৃদ্ধি পাচ্ছে। উদাহরণ স্বরূপ বলা যেতে পারে, দেশের ৩৫টি সরকারী ও বেসরকরী হাসপাতালে বছরে একশ’র বেশী রোগীর দেহে কিডনি সংযোজন করা হয়ে থাকে। বেসরকারী হাসপাতালে একজন রোগীর কাছ থেকে সাড়ে ছয় লাখ টাকা আদায় করা হয়। অথচ সরকারী হাসপাতালে এ বাবদ চার্জ ৪৫ শতাংশ কম। বাংলাদেশে শুধুমাত্র চিকিৎসা েেত্র বছরে কয়েক হাজার কোটি টাকা খরচ করা হয়। অথচ সুস্থ্য থাকার জন্য পরিবেশ এবং সচেতন হলেই অনেক অসংক্রমক রোগ রয়েছে যেগুলো প্রতিরোধ করা সম্ভব ফলে এসব েেত্র ব্যায় করা অর্থ অন্য প্রয়োজনীয় খাতে ব্যবহার করা সম্ভব হবে।

বেসরকারী হাসপাতালগুলোতে স্বাস্থ্য ও চিকিৎসা একটি রমরমা বানিজ্যে পরিণত হয়েছে। আর অর্থ উৎপাদনের এই আধূনিক ব্যবস্থায় পিষ্ট হচ্ছে মানুষ। চিকিৎসার জন্য বিদেশগামী মানুষের স্রোত ঠেকাতে বিভিন্ন দেশী বিদেশী হাসপাতালকে অনুমতি প্রদান করা হলেও, বিগত সময়ের তুলনায় চিকিৎসার জন্য বিদেশ গমনের পরিমান অনেকাংশে বৃদ্ধি পেয়েছে। চিকিৎসাখাতে এই লাগামহীন বানিজ্য মানুষকে জিম্মি করে তুলছে। সংসদীয় কমিটির সুত্রে জানা যায়, বেসরকারী হাসপাতালগুলোতে ৩০ শতাংশ কম খরচে গরীব মানুষকে সেবা দেবে এই শর্তে হাসপাতালগুলোকে সরকারী অনুদান দেয়া হয়। কিন্তু হাসাপাতালগুলো নিয়ম মানে না।

রাষ্ট্রীয় মূলনীতি হিসেবে স্বাস্থ্য একটি মৌলিক অধিকার হলেও, অর্থনীতি উন্নয়নের উম্মাদনায় আমাদের বিচার বিবেচনা লোভ পাচ্ছে। বিশ্বব্যাংক ও আইএমএফর এর প্রভাবে ও চাপের কারণে সরকারী কিছূ নিয়ম কানুনের মধ্যে এটি পণ্য হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। তারই প্রেেিত স্বাস্থ্য সেবার টেষ্টসহ বিভিন্ন কার্যক্রমের উপর ভ্যাট আরোপ করা হয়। পরবর্তীতে একটি রিটের প্রেেিত সুপ্রিমকোর্টের হাইকোর্ট বিভাগ রোগীদের কাছ থেকে চিকিৎসাপত্র, প্যাথলজিক্যাল টেস্ট এবং সব ধরনের রোগ নির্ণয়, পরীা-নিরীার েেত্র প্রত্য বা পরোভাবে ভ্যাট আদায় করা বে-আইনি, সংবিধান পরিপন্থী ও অবৈধ ঘোষণা করে। পাশাপাশি ভ্যাট আদায় না করতে সরকার এবং সংশ্লিষ্টদের নির্দেশ দিয়েছে হাইকোর্ট।

অপর দিকে বিশ্বব্যাংকের ঋণ প্রকল্পের আওতায় (লোন#৪০৫২ বিডি) সরকারী পরিচালনাধীন রাষ্ট্রীয় হাসপাতালগুলো ইজারা দেওয়ার জন্য চাপ প্রয়োগ করে। পরবর্তীতে জনগনের আন্দোলনের প্রেেিত এই ইজারাদান বন্ধ হয়। তারপরও রাষ্ট্রীয় হাসপাতালগুলো কার্যক্রম বানিজ্যিকরণের ল্েয ইউজার ফি বৃদ্ধি এবং বন্টনের পরিকল্পনা গ্রহণ করে। জনগনের আন্দোলন এবং সুপ্রীম কোর্টের হাইকোর্টে ডিভিশনে রীটের প্রেেিত এ কার্যক্রম ও স্থগিত হয়। বাংলাদেশের প্রায় ৪০% মানুষ বিদ্যমান সরকারি-বেসরকারী উন্নয়ন সংস্থা পরিচালিত সামগ্রিক সুযোগ পাচ্ছে। ২৫% মুত্যু পথযাত্রী রোগী শিতি চিকিৎসকের পরামর্শ পায় না। ৭০% প্রসুতি নারী প্রসব-পূর্ব চেকআপ থেকে বঞ্চিত, ৭০% নারী রক্তশূন্যতার শিকার। এ অবস্থায় রাষ্ট্রীয় হাসপাতালগুলো সরকারী স্বাস্থ্যসেবা কার্যক্রম সংকুচিত করে মানুষের বাঁচার পথ থাকবে না।

স্বাস্থ্যখাতে অপর এক অনিয়ন্ত্রিত অবস্থার নাম ঔষধ বানিজ্য। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সাবেক মহাপরিচালক বলেছেন, বর্তমান চিকিৎসকদের ক্যাশ টাকা দিয়ে ওষুধ কোম্পানিগুলো তাদের নিজেদের ঔষধের নাম লিখিয়ে নিচ্ছে। ওষুধ প্রশাসনের হিসেব মতে দেশে এলোপ্যাথিক ২৩৭টি, হোমিওপ্যাথিক, আয়ুবের্দিক ও হারবালসহ ৮০০(আটশত) ওষুধ কোম্পানি আছে। ২২২টি কোম্পানির ওষুধ তৈরীর অনুমতি আছে। ১৬৪টি কোম্পানি ঔষুধ উৎপাদন করছে। এমন কোনো কোম্পানি আছে যার মাত্র ০৫টি ঔষধ এর উৎপাদনের অনুমতি থাকলেও উৎপাদন করছে প্রায় ২০টি ঔষুধ। এসব কোম্পানি অবৈধভাবে ঔষুধ উৎপাদন করে দেশের আইন ও প্রশাসনকে বৃদ্ধাঙ্গুলী প্রদর্শন করছে। কিছুদিন পূর্বে ভেজাল ও নিম্নমান বা নকল প্যারাসিটামল সিরাপ ব্যবহারে ২৪টি শিশুর অকাল মৃত্যু হয়। তথাপিও তা নিয়ন্ত্রণে কোন ধরনের উদ্যোগ নেই। সরকারী ঔষধ কারাখানাটিকে অকার্যকর করে রাখা হয়েছে বেসরকারী কোম্পানিগুলোর বাজার সৃষ্টির জন্য। ২০০৮ সালের এক তথ্য অনুসারে দেখা যায় বাংলাদেশে ঔষুধখাতে বানিজ্যের পরিমান আনুমানিক ৬০০০ কোটি টাকা।

ঔষধ বানিজ্যের চিত্র পাওয় যায়, ডাঃ মুনির উদ্দিন আহমদ এর লেখায় ‘‘১৯৮১ সালে বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থার সহযোগিতায় জাতিসংঘের শিল্প উন্নয়ন সংস্থা বাজারজাতকৃত ২ লাখ ওষুধ থেকে মাত্র ২৬টি ওষুধের একটি তালিকা প্রকাশ করে যেগুলোকে অপরিহর্য বলে বিবেচনা করা হয়। তাহলে অন্য অসংখ্য ওষুধের কাজ কী ? যদি সেগুলো অপরিহার্য না হয়ে থাকে। ১৯৭২ সালে চিলি এবং ১৯৭৮ সালে শ্রীলংকার মেডিকেল কমিশন বাজার জরিপ করে দেখতে পায়, মাত্র কয়েক ডজন ওষুধ জীবন ও সুস্থ্যতার জন্য প্রয়োজনীয়। মজার ব্যাপার হল- এ তথ্য প্রকাশ পাওয়ার পর দুই দেশের সরকার উৎখাত হয়ে গিয়েছিল মার্কিন সমর্থিত সরকার দ্বারা। পরবর্তী সময়ে মার্কিন সমর্থিত সরকারদ্বয় তাদের দেশে আমেরিকান কেমিক্যালস ও ফার্মাসিউটিক্যাল প্রোডাক্টস আমদানি ও ব্যবসার সুযোগ করে দিয়েছিল।

একটু খোলামন নিয়ে উপলব্ধি করতে চেষ্টা করলে বুঝতে কারও অসুবিধা হওয়ার কথা নয়, অকিঞ্চিৎকর ও অভিপ্রায়মূলক ওষুধ পরীা-নিরীা ওষুধ কোম্পনিগুলোর আকাশচুম্বী মুনাফার জন্যও অত্যাবশ্যক। এ ধরনের বক্তব্যের সপে যুক্তি খুঁজে পাওয়া যাবে ই-লিলির ১৯৯৩ সালের প্রোজাক ওষুধ বিষয়ক পুস্তিকার ভাষা পড়লে। এত বলা হয়-“এমন কোন প্রেসক্রিপসন ড্রাগ নেই যা শতভাগ নিরাপদ। এমনও হতে পারে, কোন ওষুধ বহু বছর ধরে ব্যাপকভাবে ব্যবহার করলে তার পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া দৃশ্যমান হতে পারে।” যদি তাই হয় অর্থাৎ কোন বিশেষ ওষুধ কোন বিশেষ রোগীর েেত্র ভিন্নভাবে প্রতিক্রিয়া দেখালে তবে আলাদা জীবজন্তুর ওপর পরীা-নিরীা চালানোর যৌক্তিকতা থাকে কি? এ প্রসঙ্গে এক অভিজ্ঞ চিকিৎসক বলেন, জীবজন্তুর ওপর চালানো পরীার ফলাফলের ওপর ভিত্তি করে কোন ওষুধ মানবদেহে প্রয়োগ করলে তার নিরাপত্তা নিশ্চিত হবে না।’’

এ বিষয়গুলো মানুষের শরীর ও স্বাস্থ্য নিয়ে বানিজ্যিক কার্যক্রমের একটি অংশিক চিত্র। স¤পূর্ণ চিত্র তার চেয়ে ভয়ংকর। মানুষের রোগ, শরীর সর্বোপরি জীবন ও মরণ নিয়ে বানিজ্যের অবসান রাষ্ট্র ও সরকারের হাতে। রাষ্ট্রের আইন আর সরকারের পদপেই পারে মানুষকে এই অমানবিক বানিজ্যিক কার্যক্রম হতে মুক্তি দিতে।

সকলের জন্য স্বাস্থ্যসেবা ও রাষ্ট্রীয় ব্যয়
বাংলাদেশ একটি উন্নয়নশীল রাষ্ট্র। আমাদের অর্থ কম, এই শব্দগুলো দেশের সাধারণ মানুষের সুবিধাকে সংকুচিত করার হাতিয়ারে পরিণত হয়েছে। অর্থনৈতিক উন্নয়নের দোহাই দিয়ে বিভিন্ন কার্যক্রম গ্রহণ করলেও জনগণের সুবিধা মূলত সংকোচন করা হয়েছে। অথচ বৈদেশিক ঋণ, পেনশনভাতা, প্রজাতন্ত্রের কর্মীদের বেতন, বেসরকারী কোম্পানীগুলোর সুবিধার জন্য বাজেটে অর্থ বা প্রণোদনা বৃদ্ধি পাচ্ছে।

সম্প্রতি ঢাকায় প্রাইভেট কার কে প্রধান্য দিয়ে একটি বিলাস বহুল এলিভেটর একপেক্সওয়ে নিমার্ণের পরিকল্পনা করা হয়েছে। এ বাজেট প্রায় ১৮,০০০০ কোটি টাকা। যা বাংলাদেশের ১৬ কোটি মানুষের প্রায় ২ বছর ৬ মাসের স্বাস্থ্য বাজেটের সমান। অপর দিকে তেল আমদানীতে আইডিবি হতে ১৪০০০ হাজার কোটি টাকার ঋণ নেয়া হচ্ছে। এই তেলের একটি বড় অংশ ব্যবহার হয় প্রাইভেট গাড়ীর জন্য। এছাড়া হাজার হাজার কোটি টাকা ব্যয় হচ্ছে নানা অপ্রয়োজনীয় খাতে। সাধারণ মানুষের জন্য কোন বরাদ্ধ ও সুবিধার কথা আসলেই বলা হয় আমাদের অর্থ নেই। অপ্রয়োজনীয় খাতে অর্থ বরাদ্ধ হ্রাস করে জনস্বাস্থ্য উন্নয়নের মতো বিষয়ে ব্যয় করা উচিত।

নিচের টেবিলে দেশের স্বাস্থ্য বাজেটে কমে আসার একটি চিত্র তুলে ধরা হলো। ২০০২-০৩ অর্থ বছরের স্বাস্থ্যখাতে বাজেট ছিল ৬.৪৭%, ২০০৯-১০ সালে ছিল ৬.১৫% এবং ২০১০-২০১১ সালে তা কমে দাঁড়িয়েছে ৬.০। অর্থাৎ স্বাস্থ্যখাতে বরাদ্ধ দিন দিন হ্রাস পাচ্ছে। আবার এ অর্থের বড় অংশ ব্যয় হয় প্রশাসনিক ও অবকাঠামোর খাতে। জনগনের স্বাস্থ্য জন্য ব্যয় নেই বলেই চলে। বিভিন্নখাতে জনগণের সেবার জন্য অর্থ প্রদানকে ভর্তুকী হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। অনেকেই বলে থাকেন এ খাতে ভতুর্কী প্রদান করা উচিত নয়। জনগণের অর্থ জনগণের সেবায় না প্রদানের নানা টালবাহানা করা হয়। অনেকেই সেবাখাতে অর্থ প্রদানকে অহেতুক মনে করেন। বিনামূল্যে কোন কিছুই দেয়া উচিত নয় যে সকল কর্মকর্তা বা ব্যক্তি বিশ্বাস করেন তাদের নিকট প্রশ্ন এ রাষ্ট্র কেন প্রজাতন্ত্রের সেই সকল কর্মীদের পেনশন প্রদান করবে যারা কাজ হতে অবসর নিয়েছেন ? প্রজাতন্ত্রের অবসরপ্রাপ্ত কর্মীদের পেনশন যেমন যৌক্তিক, তেমনি জনগনের সেবাখাতে সরকারের আর্থিক যোগান সৃষ্টিও যৌক্তিক ও দায়বদ্ধতা।

বাজেটে স্বাস্থ্য খাতে যে অর্থ বরাদ্দ হয় তার পুরোটাই রোগ পরবর্তী সেবা প্রদানের জন্য কিন্তু রোগ প্রতিরোধের জন্য সেভাবে বাজেটে কোন অর্থ বরাদ্দ দেয়া হয়না। রোগ প্রতিরোধ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। এই বিষয়টাকে অবশ্যই গুরুত্বসহকারে দেখা উচিত। রোগ প্রতিরোধের সাথে দেশের মানুষের রোগ মুক্তিসহ দেশের অর্থনীতির জড়িত। তাই বাজেটে অবশ্যই রোগ নিরাময়ের সাথে রোগ প্রতিরোধের জন্য অর্থ বরাদ্দ দেয়া প্রয়োজন। বিগত বাজেটে অর্থমন্ত্রী মানুষের গড় আয়ু ২০২১ সালের মধ্যে ৭০ এর কোঠায় উন্নীত করার আশা ব্যাক্ত করেছেন। এর জন্য চিকিৎসা ব্যবস্থার চাইতে রোগ প্রতিরোধ ব্যাবস্থাকে গুরুত্ব দিতে হবে। মানুষকে রোগ প্রতিরোধের মাধ্যমে রোগ মুক্ত রাখা গেলে তার আয়ু বাড়ানো সম্ভব হবে। তবে এর জন্য সরকারকে বাজেটে রোগ প্রতিরোধ করার জন্য আলাদা অর্থ বরাদ্দ দেওয়া প্রয়োজন।

সাধারণত যে মাপকাঠিতে দরিদ্রতা নিরূপন করা হয়, দরিদ্রতা তার চেয়ে আরো ভয়ংকর। তথাকথিত অর্থনৈতিক মাপকাঠিতে মধ্যবিত্ত বা উচ্চমধ্যবিত্ত শ্রেণী বলে যাদের চিহ্নিত করা হয় বতর্মান চিকিৎসা বণিজ্যের নিকট তারাও দরিদ্র। দেশের অনেক পরিবার আছে যারা চিকিৎসা করাতে গিয়ে সর্বস্বান্ত হচ্ছে। পত্র-পত্রিকার পাতা খুললেই চোখে পড়ে চিকিৎসার সহযোগিতা পাবার আকুতি। অনেক মানুষ আছে লজ্জায় তাদের সমস্যা বলতে পারে না। হাসপাতালগুলোর সামনে গেলেই দেখা যায় এ মানুষগুলোর ভোগান্তি। ঘরের মুরগি, গরু, চাল বা অন্য পণ্য অথবা উপকরণ বিক্রি করে কিংবা ধার করে চিকিৎসা করাতে এসেছে মানুষ। দেশের অনেক সাধারণ মানুষ চিকিৎসকদের নিকট চিকিৎসা না করিয়ে ঝাড়-ফুঁক বা অন্য কোন ভ্রান্ত চিকিৎসা পদ্ধতি গ্রহণ করছে। যদি স্বাস্থ্য ব্যয় এভাবে বৃদ্ধি পায় তবে মানুষ উপায় না দেখে ভ্রান্ত চিকিৎসার দ্বারস্ত হবে।

আমরা সুস্থ্যভাবে বাচঁতে চাই। আমাদের রোগের জন্য চিকিৎসা চাই। অর্থনৈতিক উন্নয়নের উম্মাদনায় অপ্রয়োজনীয়খাতে অর্থ ব্যয় না করে জনস্বার্থে সরাসরি ব্যয় করা হোক। আমরা রাষ্ট্রীয় স্বাস্থ্যসেবা চাই। স্বাস্থ্যসেবার নামে আমাদের শরীরকে বানিজ্যি পন্য রূপান্তর করা হোক তা চাই না। আমরা এমন একটি দেশ গড়তে চাই, যে দেশ হবে পৃথিবীর অন্যতম দেশ হিশেবে পরিচিত হবে, যেখানে রাষ্ট্র জনগণের স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করে। স্বাস্থ্য যেখানে মানবাধিকার হিসেবে প্রতিষ্ঠিত। স্বাস্থ্য বাণিজ্য কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ করা হয়, রোগপ্রতিরোধ এ দেশের স্বাস্থ্যনীতির মূলভিত্তি। পৃথিবী আমাদের নিকট হতে শিখবে স্বাস্থ্যসেবা কিভাবে নিশ্চিত করা যায়।

তথ্যসুত্র
১. বেসরকারী খাতের চিকিৎসা ব্যবস্থা, শীর্ষক মতবিনিময় সভা, স্বাস্থ্য অধিকার আন্দোলন জাতীয় কমিটি
২. বেসরকারী হাসপাতালে কম খরচে পেতে সেবা আইন করার চিন্তা সংসদীয় কমিটির, ২৮ মার্চ ২০১০, আরটিএনএন ডটনেট,
৩. দীর্ঘমেয়াদী অসংক্রামক রোগ ও বাংলাদেশ: একটি তথ্যচিত্র, এন,সি,ডি, স্বাস্থ্য অধিদপ্তর, স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা
৪. সর্বজনীন স্বাস্থ্যসেবা রাষ্ট্রের দায়িত্ব, ১৩ জুন, ২০০৯, ডা. মুশতাক হোসেন, সাধারণ সম্পাদক, বাংলাদেশ চিকিৎসা সংসদ।
৫. একটি গণমুখী স্বাস্থ্যনীতির ল্েয, স্বাস্থ্য আন্দোলনের পর্যালোচনা, উবেনীগ
৬. স্বাস্থ্য অধিকার, বছর ১, মার্চ, ২০১০ স্বাস্থ্য আন্দোলন
৭. মাহফুজ কবীর, বাংলাদেশে স্বাস্থ্য, দারিদ্র ও সরকারী ব্যয়, বাংলাদেশ উন্নয়ন সমীা, একবিংশতিতম খন্ড বার্ষিক সংখ্যা ১৪১০
৮. তেল আমদানতে আইডিবি ১৪ হাজার কোটি টাকার ঋণ দিচ্ছে, আমাদের অর্থনীতি, ৩১ ডিসেম্বর ২০১০
৯. আজিমপুর মাতৃসদন: টাকা না দিলে নার্স আয়ারা সন্তান দিতে চায় না; বাংলাবাজার পত্রিকা, মঙ্গলবার, ১ জুলাই ২০০৮।
১০. ৮ বছরে বেসরকারি চিকিৎসালয়ের আয় বেড়েছে ৫৩৬ শতাংশ, নয়া দিগন্ত, শুক্রবার, ২৬ জুন ২০০৯।
১১. বেসরকারি চিকিৎসকদের স্বেচ্ছাচারিতা কিনিকগুলোয় প্রতারনা বাণিজ্য, ডেসটিনি, সোমবার, ২৪ মার্চ ২০০৮।
১২. উপযুক্ত কারণ ছাড়াই ৬০ ভাগ রোগীকে এন্টিবায়োটিক দেয়া হয় হাসপাতালে, আমার দেশ, শনিবার, ২১ মার্চ ২০০৯।
১৩. ভুল চিকিৎসার শিকার অনেক শিশু: নেই মনিটরিং, আমার দেশ, শনিবার, ৪ এপ্রিল, ২০০৯।
১৪. চিকিৎসা সেবায় অনুকরনীয় মিটফোর্ড হাসপাতাল, ডেসটিনি, বৃহস্পতিবার, ৯ এপ্রিল ২০০৯।
১৫. পরীার নামে রোগীদের গলা কাটছে প্রাইভেট ডায়াগনস্টিক সেন্টারগুলো, সোমবার, ১৩ এপ্রিল ২০০৯।
১৬. ল্যাবএইড হাসপাতালে আধুনিক চিকিৎসা হলেও ব্যয় বেশি, কর্তৃপরে দাবি অন্য দেশের চেয়ে অর্ধেক, ইত্তেফাক, বুধবার, ২ এপ্রিল, ২০০৮।
১৭. প্র্ইাভেট মেডিকেলে ভর্তি অনিয়ম ঠেকাতে হার্ডলাইনে সরকার, সমকাল, ৮ ডিসেম্বর ২০০৯।
১৮. ঢামেক হাসপাতালে বছরে দশ লাখ রোগীর চাপ, যুগান্তর শুক্রবার, ২৩ জানুয়ারি ২০০৯।
১৯. স্বাস্থ্য খাতে জেঁকে বসেছে বেহিসাবি অনিয়ম। সমকাল, বুধবার, ২১ জানুয়ারি ২০০৯।
২০. চিলমারী ও শাহাজাদপুরের চর এলাকার স্বাস্থ্য সেবার চিত্র, রোকেয়া বেগম, উবিনীগ।
২১. জাতীয় স্বাস্থ্যনীতি পুনগঠনে জনগণের প্রত্যাশা, শশাঙ্ক বরণ রায়, স্বাস্থ্য অধিকার আন্দোলন জাতীয় কমিটি।
২২. স্বাস্থ্য সেবা কোনদিকে ছুটছে, ফরিদা আখতার।
২৩. জাতীয় স্বাস্থ্য বাজেট: প্রোপট-স্বাস্থ্য অধিকার; ডাঃ মোঃ আব্দুল মতিন সদস্য, বাংলাদেশ স্বাস্থ্য অধিকার আন্দোলন
ও সাধারন সম্পাদক, বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা)
২৪. বিপন্ন স্বাস্থ্য ব্যবস্থা, সেবার জন্য আর কত অপো, ডা. মোরশেদ চৌধুরী, সাপ্তাহিক ২০০০।
২৫. সরকারী স্বাস্থ্য সেবার নমুনা, প্রতিবেদন, সাপ্তাহিক ২০০০
২৬. ওষুধের দাম লাগাম ছাড়া, সাপ্তাহিক ২০০০
২৭. জাতীয় বাজেট এবং বাংলাদেশের স্বাস্থ্য খাত, সশাসনের জন্য প্রচারাভিজান (সুপ্র) আয়োজিত ২০০৭-০৮ অর্থবছরের বাজেট পর্যালোচনার জন্য রচনা উপকরন।
২৮. বেসরকারি চিকিৎসা প্রতিষ্ঠানে সরকারের নিয়ত্রণ নেই। দৈনিক জনকণ্ঠ, শনিবার, ৩১ জুলাই ২০১০
২৯. স্বাস্থ্য সুযোগ নয়, অধিকার, স্বাস্থ্যসেবার বেসরকারিকরণ ও বাণিজ্যিকীকরণ বন্ধ করতে হবে। স্বাস্থ্যসেবা চিত্র এবং স্বাস্থ্যনীতি ২০০৯ শীর্ষক জাতীয় মতবিনিময় সভায় আলোচনাপত্র, ২২ ডিসেম্বর ২০০৯।
৩০. খসড়া জাতীয় স্বাস্থ্যনীতি ২০০৯, সুশাসনের জন্য প্রচারাভিযান- সুপ্র’র সুপারিশ ও মতামত।
৩১. স্বাস্থ্যসেবা প্রাপ্তির অধিকার সকলের, সুশাসনের জন্য প্রচারাভিযান- সুপ্র, ৭ এপ্রিল, ২০০৯।
৩২. বেসরকারি খাতের চিকিৎসাব্যবস্থা, স্বাস্থ্য অধিকার আন্দোলন জাতীয় কমিটি।
৩৩. রাষ্ট্রীয় হাসপাতাল বেসরকারীকরণ: জনস্বাস্থ্যের উপর প্রভাব, ২৯ মার্চ, ২০০৮, স্বাস্থ্য অধিকার জোট।
৩৪. স্বাস্থ্যনীতিতে স্বাস্থ্যকে বানিজ্য নয়, সেবা হিসেবে বিবেচনা করতে হবে, স্বাস্থ্য পন্য নয়, মানবাধিকার, সৈয়দ মাহবুবুর আলম, উন্নয়ন কর্মী।
৩৫. স্বাস্থ্য অধিকার জোট, ২৭ জুলাই ২০০৮।
৩৬. স্বাস্থ্য সেবা বেসরকারীকরণ, সমস্যা না উত্তরণ; ২৭ জুলাই ২০০৮, স্বাস্থ্য অধিকার জোট।
৩৭. উপজেলা পর্যায়ে স্বাস্থ্য ব্যবস্থা ও ভুল চিকিৎসার খতিয়ান, উবিনীগ
৩৮. আশংকাজনক হারে রোগ বিস্তারঃ রোগ প্রতিরোধে স্বাস্থ্যনীতি, সৈয়দ মাহবুবুল আলম, কামরুন্নিছা মুন্না, ডাব্লিউবিবি ট্রাস্ট।
৩৯. জাতীয় শিা ও স্বাস্থ্যনীতি এবং দারিদ্র বিমোচন কৌশলপত্রের পোপটে যাযাবর বেদে সমাজের উন্নয়ণ, এ কে এম মাকসুদ, সৌদ খান, গ্রাম বাংলা উন্নয়ন কমিটি।

মঙ্গলবার, ২২ মার্চ, ২০১১

পানির উৎস সংরন ও ব্যবহৃত পানি পুনঃব্যবহারে করণীয়


পানির উৎস সংরন ও ব্যবহৃত পানি পুনঃব্যবহারে করণীয়

বিশুদ্ধ পানি
মানুষের জীবন পানির সাথে একসূত্রে গাঁথা। এই ভূ-পৃষ্ঠের যেমন ৭০ ভাগই পানিতে ঢাকা, তেমন আমাদের শরীরেরও প্রায় ৭০ ভাগ পানি। শুধু আমাদের জীবনই নয়, পৃথিবীর সব জীব-জন্তু, কীট-পতঙ্গ, গাছপালা সবকিছুর জীবনই এই পানির ওপর নির্ভরশীল। তাছাড়া আমাদের দৈনন্দিন যাবতীয় কাজ, চাষাবাদ, শিল্প-কারখানায় উৎপাদন সবকিছুর জন্যই আমরা পানি উপর নির্ভরশীল। এক কথায় পানি হলো এমনি এক প্রাকৃতিক উপাদান, জীবনের জন্য যার কোন বিকল্প নেই।

বিশ্বের প্রায় ৮০ টি দেশে নিরাপদ পানির সমস্যা রয়েছে এবং পৃথিবীর প্রায় ৪০ ভাগ মানুষ পানির জন্য সংগ্রাম করছে। শুধু জলবায়ু পরিবর্তনের কারণেই এ শতকে বিশ্বে মিঠা পানির ঘাটতি ২০ভাগ বাড়বে বলে বিশেষজ্ঞরা আশংকা করছে। বাংলাদেশে নিরাপদ পানি সরবরাহ ও পয়ঃনিষ্কাশন একটি বিশাল সমস্যা। গবেষকদের মতে নিরাপদ পানি সরবরাহ ও পয়ঃনিষ্কাশন সুবিধা নিশ্চিত করা গেলে প্রতিবছর দেশের ৭ হাজার কোটি টাকা বাঁচবে।

বিশুদ্ধ পানি অভাবে সৃষ্ট সমস্যা ঃ
ভূ-গর্ভের চারভাগের তিনভাগই পানিতে পরিপূর্ণ কিন্তু মানুষের ব্যবহারের উপযোগী পানি মাত্র এক ভাগ। বিশ্ব ব্যাংকের হিসাব অনুসারে সুপেয় পানির অভাবে ও দূষিত পানি পানের কারণে প্রতিবছর মারা যাচ্ছে সোয়া কোটি মানুষ। সাধারণ খাওয়া, গোসল, রান্নাবান্না ও অন্যান্য মৌলিক চাহিদা মেটাতে প্রতিদিন একজন মানুষের গড়ে ৫০ লিটার পানি প্রয়োজন। অথচ বর্তমানে পৃথিবীতে ১১০ কোটি মানুষ প্রতিদিন পান করার জন্য পর্যাপ্ত বিশুদ্ধ পানি পায় না।

পানি দূষণের কারণে বাংলাদেশে ডায়ারিয়া ও অন্যান্য পানি বাহিত রোগ দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। বিলীন হচ্ছে জলজ প্রাণী এবং উদ্ভিদ। এছাড়া অনেক মাছ বিলুপ্ত হয়ে গেছে বলে গবেষকগণ মতামত প্রকাশ করেছেন। বাংলাদেশের ৮ কোটি মানুষ আর্সেনিকের ঝুঁকিতে রয়েছে এবং এভাবে চলতে থাকলে সমস্যা মহামারির আকার ধারণ করতে পারে। গত এক যুগে দেশের ৬১ জেলার ২৭০ উপজেলায় আর্সেনিক দুষণযুক্ত পানির কারণে বিভিন্ন বয়সের প্রায় ৪০ হাজার মানুষ বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হরঢছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বাংলাদেশে আর্সেনিকজনিত ক্যান্সারের কারণে ২০০,০০০-২৭০,০০০ মানুষের মৃত্যু হতে পারে বলে আশংকা করছে। গবেষণায় দেখা যায় দেশের ৩০ ভাগ নলকূপের পানি আর্সেনিক দূষণে দূষিত এবং প্রতিদিন দুষণের মাত্রা বৃদ্ধি পাচ্ছে। কৃষি কাজ ও চাষাবাদের জন্য পানি একটি বড় বিষয়। বর্তমানে চাষাবাদের জন্য ভূগর্ভস্থ পানি ব্যবহার করা হয়। শহর অঞ্চলেও পানির সংকট প্রকট হয়ে উঠছে। ফলে দেশের অধিকাংশ বিভাগীয় ও জেলা শহরেরই পানির স্তর নিচে নেমে যাচ্ছে। হ্রাস পাচ্ছে সুপেয় পানি পরিমান।

বাংলাদেশে পানির উৎসঃ
পানি সম্পদের দিক দিয়ে বাংলাদেশ অত্যন্ত সম্পদশালী। এর ভূ-পৃষ্ঠে যেমন আছে পদ্মা- মেঘনা- যমুনার মত প্রমত্তা নদী, তেমনি ভূ-গর্ভেও রয়েছে সুপেয় পানি। এদেশের বুকের ওপর দিয়ে বয়ে গেছে ছোট-বড় প্রায় সাতশ নদ-নদী এবং অসংখ্য খাল-বিল, দীঘি-পুকুর ও হাওর-বাঁওড়। বর্ষাকালে সারাদেশ পানিতে থৈ থৈ করে। বাংলাদেশে বাৎসরিক গড় বৃষ্টির পরিমান প্রায় ২০৫০ মিলিমিটার। আর বর্ষাকালে অর্থাৎ জুন থেকে অক্টোবরের মধ্যে ৮০% ভাগ বৃষ্টি হয়। কিন্তু আমাদের অবহেলা ও অপরিকল্পনার কারণে পানির উৎস আজ হুমকির সম্মুখীন।

বিশ্বব্যাপী পানির অবস্থা
জাতিসংঘ তথ্য অনুসারে আগামী ২০ বছরের কম সময়ের মধ্যে বিশুদ্ধ পানির চাহিদা ৫০% বৃদ্ধি পাবে। ২০২৫ সাল নাগাদ ২/৩ অংশের মানুষের (৪৮ টি দেশের ২.৮ বিলিয়ন মানুষ) বিশুদ্ধ পানি সমস্যার সম্মুখীন হবে। পৃথিবীর প্রায় ৯৭% পানি লবনাক্ত। ব্রাজিল, কানাডা, চায়না, কলম্বিয়া, ইন্দোনেশিয়া, রাশিয়া বিশ্বের বিশুদ্ধ পানির অর্ধেক ভান্ডার ৬টি দেশের অধীনে। যদিও বিশ্বের ৬০% মানুষ বসবাস করে এশিয়ায় এবং মধ্যপ্রাচ্যে। বিশ্বের ৭০% পানি ব্যবহার হয় কৃষি কাজে, ২২% ব্যবহার হয় শিল্প কারখানায় এবং ৮% ব্যবহার হয় মিউিনিসিপালটি ও জনগনের ব্যবহারের জন্য।
বাংলাদেশে সেচ ও মহানগরীগুলোতে পানি ব্যবহার
বর্তমানে দেশের মানুষপানি আহরণের েেত্র ভূগর্ভস্থ পানির উপর নির্ভরশীল। পানির চাহিদার একটি বড় অংশ যায় কৃষি কাজে। এ সময় ভুপৃষ্টের পানি ব্যবহার করা হলেও এখন ব্যপকভাবে ভূগর্ভের পানি ব্যবহৃত হয় এবং দিন দিন এই ব্যবহার বৃদ্ধি পাচ্ছে। নিম্নে ২০০৩ সাল হতে ২০১০ পর্যন্ত জমিতে সেচ সংক্রান্ত একটি তথ্য উপস্থাপন করা হলেও।


সেচ ছাড়াও পৌরসভা, নগর এবং মহানগরের পানি সরবরাহ ও আহরনের েেত্র অধিকাংশ সংগ্রহ করা হয় ভূগর্ভস্থ হতে। নিচে দেশের ছয়টি মহানগরীর পানি সংগ্রহের তথ্যচিত্র উপস্থাপন করা হলেও।

ঢাকা : ঢাকা ওয়াসা ৫৭৫টি গভীর নলকূপ ও চারটি পানি শোধনাগারের মাধ্যমে দিনে ২০৬ থেকে ২১০ কোটি লিটার পানি উৎপাদন করছে। এছাড়া বেশকিছু স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান ও বেসরকারি সেক্টরে ছোট-বড় অনেক পাম্প বসানো আছে। সব মিলিয়ে প্রায় ১১ হাজার পাম্প দিয়ে প্রতিদিন ভূগর্ভস্থ পানি উঠানো হচ্ছে প্রায় ১শ ৮০ থেকে ১শ ৯০ কোটি লিটার।

২০০৯ সালের পর ঢাকা শহরের পানির চাহিদা পূরণের ল্েয আরো ৬৪টি গভীর নলকূপ স্থাপন এবং ৭৫টি নলকূপ প্রতিস্থাপন করা হয়েছে। এতে করে পানির উৎপাদন ২৫ থেকে ৩০ কোটি লিটার বৃদ্ধি পেয়েছে। ভূ-গর্ভস্থ পানির নির্ভরতা কমিয়ে ভূ-উপরিস্থ উৎস থেকে পানি সংগ্রহের ল্েয সায়েদাবাদ পানি শোধনাগারের দ্বিতীয় পর্যায়ের কাজ বর্তমানে চলছে এবং আগামী বছরের মধ্যে সম্পন্ন হবে। প্রকল্পটি শেষ হলে দিনে আরো সাড়ে ২২ কোটি লিটার পানি শোধনাগার থেকে রাজধানীতে সরবরাহ করা সম্ভব হবে।

চট্টগ্রাম: চট্টগ্রাম মহানগরীতে দৈনিক পানির চাহিদা ৫০ কোটি লিটার। এর বিপরীতে ওয়াসা সরবরাহ করছে ২১ কোটি লিটার। ঘাটতির পরিমাণ ২৯ কোটি লিটার। সরবরাহকৃত পানির চার ভাগের একভাগই অপচয় হয়ে যাচ্ছে। ফলে কাগজে-কলমে ২১ কোটি লিটার পানি সরবরাহের কথা বলা হলেও কার্যত নগরবাসী পানি পাচ্ছেন ১৫-১৬ কোটি লিটার। যা দিয়ে চাহিদার খুব সামান্য একটি অংশই পূরণ হচ্ছে। পুরো পানিই উত্তোলন করা হচ্ছে ভুগর্ভস্থ হতে।

চট্টগ্রাম ওয়াসায় গত ২৫ বছরের মধ্যে একটিও পানি শোধনাগার প্রকল্প বাস্তবায়ন করা যায়নি। রাঙ্গুনিয়া থানার পোমরা এলাকায় ৩১ দশমিক ৫৫ একর জায়গায় কর্ণফুলী পানি শোধনাগার প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করা হচ্ছে। কর্ণফুলী নদী থেকে পানি নিয়ে পরিশোধন করে মহানগরীতে সরবরাহ দেয়া হবে। প্রকল্পটি থেকে দৈনিক সাড়ে ১৩ কোটি লিটার পানি সরবরাহ করা যাবে।

খুলনা: খুলনা মহানগরীতে পানির চাহিদা প্রায় ৩ কোটি লিটার। কিন্তু সেখানে ওয়াসা প্রতিদিন সরবরাহ করছে মাত্র ৯০ লাখ লিটার পানি। যখন পানি সরবরাহ ব্যবস্থা খুলনা সিটি কর্পোরেশনের অধীন ছিল, তখনো পানি সরবরাহ হতো ৯০ লাখ লিটার। খুলনা ওয়াসার নতুন ও পুরাতন মিলিয়ে বর্তমানে ৭২টি পাম্প সচল ও ৭টি পাম্প বন্ধ রয়েছে। শুষ্ক মৌসুম শুরুর আগেই খুলনা মহানগরীতে পানির জন্য হাহাকার পড়ে গেছে। ভূগর্ভস্থ পানির স্তর আশঙ্কাজনক হারে নিচে নেমে যাচ্ছে। ওয়াসার একাধিক গভীর ও অগভীর নলকূল অকেজো হয়ে পানির পাম্প বন্ধ রয়েছে। একমাত্র সারফেস ওয়াটার ট্রিটমেন্ট প্লান্টটিও আট বছর ধরে অকেজো। এ অবস্থায় ১৫ লাখ নগরবাসীর দৈনিক পানির চাহিদার অর্ধেকও পূরণ করতে পারছে না খুলনা ওয়াসা।
রাজশাহী: প্রায় ৬ লাখ অধ্যুষিত রাজশাহী নগরীতে প্রতিদিন পানির চাহিদা ১০ কোটি ৩০ লাখ লিটার। এতে বিভিন্ন পাম্প থেকে সরবরাহ করা হচ্ছে ৭ কোটি ৫১ লাখ ৯০ হাজার লিটার পানি। বৃষ্টিপাতের অভাবে রাজশাহীতে ভূ-গর্ভস্থ পানির স্তর দ্রুত নীচে নেমে যাচ্ছে। তাই ভূ-গর্ভস্থ পানির ব্যবহার কমিয়ে পদ্মার পানি শোধন করে মহানগরীতে সরবরাহের ল্েয শ্যামপুরে 'শহীদ কামারুজ্জামান পানি শোধনাগার' উদ্বোধন করা হয়েছে। শিগগির নগরীর পশ্চিমপ্রান্তে আরেকটি পানি শোধনাগার নির্মাণ করার পরিকল্পনা রয়েছে।

সিলেট : সিলেট নগরীতে বর্তমানে পানির চাহিদা প্রায় ৬০ হাজার ঘনলিটার। এর বিপরীতে সরবরাহ করা হয় সর্বোচ্চ ২০ থেকে ২২ হাজার ঘনলিটার পানি। প্রতিদিন পানির ঘাটতি প্রায় ৪০ হাজার ঘনলিটার। সিলেট নগরীতে জনসংখ্যা সময়ের সাথে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে। পাশাপাশি বাড়ছে পানির চাহিদা। নগরীতে অনেক বাসাবাড়িতে নিজস্ব গভীর-অগভীর নলকূপের মাধ্যমে পানির সংস্থান রয়েছে। অন্যরা পানির জন্য সিটি কর্পোরেশনের উপর নির্ভরশীল। কিন্তু সিটি কর্পোরেশনের পানি সরবরাহ চাহিদার তুলনায় একেবারেই অপ্রতুল।

বরিশাল: ৪৫ বর্গ কিলোমিটারের বরিশাল সিটি কর্পোরেশনে ১ কোটি গ্যালন পানির প্রয়োজন রয়েছে। ২৪টি পাম্পের মাধ্যমে ৬৫ লাখ গ্যালন পানি সরবরাহের মতা থাকলেও বর্তমানে এর ১৯টি বিকল রয়েছে। ফলে বর্তমানে বাকী পাম্পগুলোর সাহায্যে ৪০ লাখ গ্যালন পানি সরবরাহ করছে বরিশাল সিটি কর্পোরেশন। ১২ হাজার গ্রাহক এই সরবরাহের সাহায্যে তাদের চাহিদা পূরণ করছে। আপতদৃষ্টিতে ১২ হাজার গ্রাহক উপকার ভোগী হলেও মূলতঃ এর সংখ্যা আরো কম।

ভূ-গর্ভস্থ পানি হ্রাস
কৃষিপ্রধান এবং নদীমাতৃক এ দেশে বর্তমানে পানি একটি প্রধান সমস্যা। সারা দেশে ব্যবহৃত মোট পানির ৯৫% আসে ভূ-গর্ভস্থ পানি থেকে। অথচ ভ ূ-গর্ভস্থ পানির সমস্যা দিন দিন বেড়েই চলেছে। শুকনো মৌসুমে আমাদের দেশে সেচের জন্য পর্যাপ্ত পানি পাওয়া যায় না। অত্যাধিক ভুগর্ভস্থ পানি উত্তোলন, বৃষ্টিহীনতা এবং খরার মাত্রা বৃদ্ধিতে ভূ-গর্ভস্থ পানির স্থর ভয়াবহ পরিমাণে নেমে গেছে, গভীর নলকূপের দ্বারা পানি উঠানোও সম্ভব হচ্ছে না।

বিগত ১২ বছরে ঢাকা নগরীর পানির স্তর আরও ৩৫ মিটার নিচে নেমে গেছে। বর্তমানে পানির স্তর অবস্থান করছে ৬১ দশমিক ১৮ মিটার গভীরে। অথচ সত্তর দশকে মাত্র ১১ দশমিক ৩ মিটার নিচে পানি পাওয়া যেতো। ১৯৯৬ থেকে ২০০৭ এই সময়ে মধ্যে বছরে গড়ে তিন মিটার করে পানির স্তর আশঙ্কাজনকভাবে হ্রাস পেয়েছে। বিএডিসির গবেষকদের মতে, এই ঘটনার কারণ হচ্ছে অব্যাহত গতিতে দ্রুত ঢাকার জনসংখ্যা বৃদ্ধি ও ভূগর্ভস্থ পানির রিচার্জ হওয়ার প্রক্রিয়া ব্যহত হওয়া। ঢাকা শহরে ৪শ মতো গভীর নলকুপ দিয়ে পানি উত্তোলন করা হচ্ছে। অপর দিকে জলাভূমি ও খালগুলো ভরাট করায় এবং নদী তীরবর্তী এলাকা দখল হওয়ায় বর্ষা মৌসূমে ভূগর্ভস্থ পানির স্তর যেভাবে রিচার্জ হওয়ার কথা সেভাবে রিচার্জ হচ্ছে না। শহরের অধিকাংশ স্থানে ইট, বালু, সিমেন্টের আস্তর ভুগর্ভস্থ পানি প্রবাহকে বাধাগ্রস্ত করছে। বিএডিসির তথ্য অনুসারে দেশের ৪৫ শতাংশ জমিতে অগভীর নলকুপ দিয়ে পানি দেওয়া যাচ্ছে না।

বিশুদ্ধ পানি উৎস দূষণ বা হ্রাস
পানি দূষণের প্রধান উৎস হিসাবে চিহিৃত করা হয় শিল্প-কারখানার, পয়ঃবর্জ্য, বিদুৎকেন্দ্র এবং আবর্জনা প্রক্রিয়াজাতকরণ স্থাপনাগুলোকে। এসব থেকে নির্গত বর্জ্য সাধারণত পাইপের মাধ্যমে নদী, জলাশয় বা স্রোতধারায় মিশ্রিত হয়। কৃষিেেত্র কীটনাশক ও রাসায়নিকের ব্যবহার পানিদূষণের অন্যতম কারণ। এছাড়া ধূলা, কীটনাশক, সার, ধাতু, লবণ, তেল, গ্রিজ, জঞ্জাল এমনকি বায়ুবর্জ্য যা বৃষ্টির সঙ্গে বায়ুমন্ডল থেকে নিচে পতিত হয় এসবের দ্বারাও পানি দূষিত হয়। পানি দূষণের উৎসকে প্রাকৃতিক এবং মনুষ্যসৃষ্ট এই দুই শ্রেণীতে ভাগ করা হয়েছে। প্রাকৃতিক উৎসসমূহ মনুষ্যসৃষ্ট নয় তবে এগুলো মানুষের কর্মকান্ডের দ্বারা আরও তীব্র হয়ে উঠতে পারে। পানির প্রধান তিনটি উৎস হলো বৃষ্টির পানি, ভূ-পৃষ্ঠের উপরের পানি ও ভূ-গর্ভস্থ পানি। এর সবকটির েেত্রই দূষণ ঘটে। ভূপৃষ্ঠের ওপরের পানি ভূগর্ভস্থ পানির তুলনায় অধিক সংবেদনশীল বা তুলনামূলকভাবে সহজে প্রভাবিত হয়, কেননা ভূগর্ভস্থ পানি প্রাকৃতিভাবেই ভূপৃষ্ঠের ওপরের ক্রিয়াকান্ড থেকে সুরতি।

বাংলাদেশের পানি সম্পদের প্রতি নানাভাবে বিরূপ আচরন করা হচ্ছে। যথেচ্ছভাবে নদী দূষণ, দখল, নদী খনন এবং নদীখাতের যথাযত সংরণ ও নদী শাসনের প্রতি অবহেলা ইত্যাদি কারণে দেশের নদ-নদী শোচনীয় পরিস্থিতির সম্মুখীন। আমরা যদি ঢাকা মহানগরের পয়ঃবর্জ্যরে কথা চিন্তা করি তাহলে দেখতে পাই প্রতিদিন প্রায় ১০ লাখ ঘনমিটার পয়ঃবর্জ্য উৎপাদিত হচ্ছে। উৎপাদিত এই বর্জ্য ঢাকার আশেপাশের নদ-নদীতে গিয়ে পরিবেশ ও পানির দূষণ করছে। এই দূষিত পানি আবার মানুষ দৈনন্দিন কাজে ব্যবহার করে নানা রকম রোগে আক্রান্ত হচ্ছে।

নদ-নদী, খাল-বিল
অসংখ্য নদ-নদী পরিবেষ্টিত বাংলাদেশ প্রধানত একটি নিম্ন সমতলভূমি বিশিষ্ট অঞ্চল। জালের মত নদী ও খাল ঘিরে রেখেছে এ দেশকে। যুগে যুগে এই নদ-নদীর পাড়ে গড়ে উঠেছে জনপদ, শিল্পকলকারখানা ও বানিজ্যিক কেন্দ্র, সেই সাথে স্থায়ী হয়েছে বাঙালি সমাজের অগ্রগতি ও স্বাচ্ছন্দ্য। বাংলাদেশ চারটি দেশের (চীন, ভূটান, নেপাল ও ভারতের) ১.৫৫ মিলিয়ন বর্গকিলোমিটার অববাহিকার পানি নিস্কাশনের আধার। বিপুল জলরাশি, প্রায় ৬ মিলিয়ন কিউসেক পানি গঙ্গা, ব্রপুত্র, মেঘনা নদী ও তাদের শাখা প্রশাখা নদী দ্বারা প্রবাহিত হয়ে বঙ্গোপসাগরে মিশছে। যার ফলে বাংলাদেশ পরিণত হয়েছে ১,৪৪,০০০ বর্গকিলোমিটার আয়তন বিশিষ্ট বিশ্বের বৃহত্তম বদ্বীপে। প্রতি বছর প্রায় আড়াই বিলিয়ন টন পলি বহন করছে এই নদীগুলো।

বাংলাদেশ নদীমাতৃক দেশ। ৫৫,৪৯৮ বর্গমাইল আয়তন নিয়ে বাংলাদেশ। যার জলভাগের আয়তন হচ্ছে ৩,৬৬১ বর্গমাইল। আর সমগ্র দেশে নদীর দৈর্ঘ্য হচ্ছে ৮,৪৬৫ মাইল। বাংলাদেশের নদ-নদীর সংখ্যা নিয়ে নানা মত রয়েছে। অনুমান ও হিসাব কষে (খাল-বিল, ছড়াসহ) বাংলাদেশে ৭০০ নদী আছে বলে বিশেষজ্ঞরা বলেন। এক সুন্দরবনেই খাল-নদী রয়েছে ১৭০টি। কোনটি খাল আর কোনটি নদী তার সীমারেখা আঁকা সত্যিই বড় কঠিন। পঞ্চাশ বছর আগে যেখানে নদী ছিল আজ সেখানে আবাদ ভূমি, আবার একটি শাখা বা উপনদী নানাস্থানে নানা নামে অভিহিত হয়েছে।

স্বাধীনতার পর থেকে বাংলাদেশের প্রায় ১৮ হাজার কিলোমিটার নদ-নদী বিলীন হয়ে গেছে। এ বিলীন হওয়ার পেছনে যে সকল কারণ পরিলতি হয় তা শুধু পলি ভরাট হয়ে নদী ভরাট হয়েছে তা নয়, মানুষের দখলদারিত্ব তার একটা বিশেষ কারণ। ঢাকার পাশ দিয়ে বুড়িগঙ্গা, নারায়ণগঞ্জের পাশ দিয়ে শীতলা, টঙ্গীর পাশ দিয়ে প্রবাহিত তুরাগ। এ নদীগুলোর পাশে অবস্থান করছে রাজধানীর শহর বন্দর। সেই সুবাদে জনবসতি এ শহরে-বন্দরমুখী মানুষের যাত্রা, শহর বন্দরকেন্দ্রের মানুষের বসবাস, আবাসন প্রয়োজনেও নতুন নতুন শিল্প-কারখানা ও দোকানপাট গড়ে উঠছে। সেই সাথে নদীর পাড় ভরাট প্রতিযোগীতায় নেমেছে ভূমি খেকো ও ভূমি দস্যুরা। এভাবেই নদীর দৈর্ঘ্য-প্রস্থ ছোট হয়ে আসছে।

প্রতি বছরই দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে শুস্ক মৌসুমে নদ-নদীতে পানি হ্রাসের ফলে নৌচলাচলে সংকট দেখা দেয়। নদীবে জেটে ওঠে অসংখ্যা চর। নদী মাতৃক বাংলাদেশের জন্য এটি একটি গুরুতর সমস্যা। দেশের যোগাযোগ ব্যবস্থার েেত্র নৌপথ একটি প্রধান মাধ্যম। নৌপথ যেমন যাতায়াত তেমনি মালামাল পরিবহণের জন্য ব্যবহৃত হয়ে থাকে। রাজধানী ঢাকার সাথে দেশের দণিাঞ্চলের যোগাযোগের একটি বড়ো মাধ্যম হচ্ছে নৌপথ। কিন্তু এই নৌপথগুলোর নদ-নদী ভরাট হয়ে যাওয়ার ফলে নানা সমস্যার সম্মূখীন হতে হচ্ছে। শুস্ক মৌসুমে নদ-নদীর পানি কমতে থাকে এবং নদ-নদীতে চর জেগে ওঠে। নদ-নদীর নাব্যতা একদিকে যেমন নৌচলাচলের জন্য বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ তেমনি এর বহমানতা ুণ হলে বা পানি ধারণ মতা না থাকলে বন্যার আশংকা থেকে যায়। এসকল বিষয় বিবেচনা করে নদী শাসন, নদী খনন ও নদীর গতিপথ সচল রাখার ব্যাপারে সুসংগঠিত উদ্যোগ গ্রহণ করা প্রয়োজন।

হাওর বাওর বিল
আমাদের মৌলিক খাদ্য সম্পদ উৎপাদনের অন্যতম প্রধান ত্রে হচ্ছে দেশের হাওরগুলো। দেশের বহু অঞ্চলে হাওর-বিল-জলাশয় প্রভূতি ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকলেও প্রকৃত হাওর অঞ্চল বলতে যা বোঝায় তা আমাদের দেশের উত্তর পূর্বাঞ্চলের সাতটি জেলায় বিস্তৃত। এ সাতটি জেলার প্রায় ৫০টি উপজেলায় প্রধান হাওরগুলো রয়েছে। সাধারণভাবে বলা যায় নিচু সমতল ভূমি, বিল, জলাশয়, খাল প্রভৃতি জলাধারসহ বির্স্তীর্ণ এক বৈচিত্র্যময় অঞ্চল হাওর। বছরের অর্ধেক সময় হাওর ডুবে থাকে স্বচ্ছ মিঠাপানিতে। এখানে রয়েছে মৎস সম্পদ, বিভিন্ন প্রজাতির বৃ, লতা-পাতা, সমৃদ্ধ সংস্কৃতির জনপদ। প্রতিবার পানি নিয়ে আসে পলি, উর্ব্বর করে জমি। গ্রীষ্মমন্ডলীয় উষ্ণতা ও প্রাকৃতিক খাদ্য ভান্ডার প্রতি শীতে আমন্ত্রণ করে আনে ঝাঁকে ঝাঁকে ভিনদেশী শীতার্ত পাখিকে। বাংলাদেশের সাতটি জেলার ৪০ টি থানায় মোট ৪৭ টি ছোট বড় হাওর রয়েছে। হাওর এলাকায় রয়েছে অসংখ্য খাল, নদী এবং প্রায় ৬৩০০ টি বিল, যার মধ্যে ৩৫০০ টি স্থায়ী। মনুষ্য সৃষ্ঠ বিভিন্ন দূষণের ফলে দেশের সমৃদ্ধ এই অঞ্চলের প্রাকৃতি ও মানুষের জীবন আজ হুমকির সম্মুখীন।

পুকুর ও দীঘি
পুকুর ও দীঘিতে সাঁতার কেটে দিন কাটানো অনেক অভিজ্ঞতা আমাদের রয়েছে। পূর্বে দৈনন্দিন জীবনের বিভিন্ন কার্যক্রমের জন্য পানি সংগ্রহ করা হত এই পুকুর ও দীঘি হতে। শুধুমাত্র খাবার পানি নলকূপ বা কুয়া হতে সংগ্রহ করা হতো। দেশের সকল এলাকায় কম বেশী পুকুর ও দীঘি ছিল। বাড়ীতে নিজস্ব পুকুর বা দীঘি থাকা আভিজাত্যের প্রতীক ছিল। গৃহস্থালী মাছের চাহিদা পুরণ করা হতো পুকুর ও দিঘী হতে। অনেক কিংবদন্তী গল্প ও জড়িয়ে রয়েছে এই পুকুর ও দীঘি ঘিরে। কিন্তু বিগত বেশ অনেক দিন ধরে অবিবেচকের মতো পুকুর ও দিঘী ভরাট করা হচ্ছে। এগুলো ভরাট করে তৈরি করা হচ্ছে অট্টালিকা বা মার্কেট। এই পানির জলাধারগুলো ধ্বংশের ফলে শহরগুলোর ভুগর্ভস্থ পানি স্তর হ্রাস, জলাবদ্ধতা, পানি সংকটের সৃষ্টি হচ্ছে। তবে দেশের জেলা শহরগুলোতে এখনো কম বেশি পুকুর বা জলাধার রয়েছে। এই জলাধারাগুলোর পানি স্থানীয় জনগন তাদের গোছল থেকে শুরু করে দৈনন্দিন বিভিন্ন কাজে ব্যবহার করেন। এতে করে ভূগর্ভের পানির উপর চাপ কম পড়ে। কিন্তু দুঃখের বিষয় স্থানীয় প্রভাবশালীরা অবৈধভাবে পুকুর ভরাট করে তৈরি করছে বহুতল ভবন সেই সাথে আবার গৃহস্থালী বর্জ্য ফেলে দূষিত করা হচ্ছে পুকুরের পানি। পুকুরের পানি ব্যবহার উপযোগী না থাকায় চাপ পড়ছে ভূ-গর্ভের পানির উপর। দেশের পানি সংঙ্কট নিরসনে পুকুরের পানি বিশুদ্ধ পানির চাহিদা হ্রাসে কার্যকর ভূমিকা পালন করতে পারে। প্রয়োজনীয় আইন ও নীতিমালার মাধ্যমে পুকুরগুলোকে দূষণের হাত থেকে বাঁচিয়ে অবৈধ দখল থেকে রা করতে হবে।

পানির উৎস সংরন ও ব্যবহৃত পানি পুনঃব্যবহারে করণীয়:

পানির পুনব্যবহার:
পৃথিবীতে প্রায় ১০০ কোটি মানুষ নিরাপদ পানি পায় না। ঢাকা মহানগরের অনেক এলাকায় বসবাসরত মানুষ পানি না পাওয়ার কারণে তীব্র পানি সঙ্কটে পড়ছে। বর্তমানে ঢাকা শহরে প্রতিদিন গড়ে ২০০ থেকে ২২০ কোটি লিটার পানি প্রয়োজন থাকলেও ওয়াসা উৎপাদন করছে ১৭০ থেকে ১৯০ লিটার। এই পানির বেশিরভাগই পাম্পের সাহায্যে ভূ-গর্ভ থেকে উত্তোলন করে সরবরাহ হচ্ছে। এতে যেমন প্রচুর অর্থ খরচ হচ্ছে আবার প্রতিনিয়ত ভূ-গর্ভের পানির স্থর নীচে নেমে যাচ্ছে।

আমাদের ভূ-গর্ভের পানির চাহিদা কমিয়ে ভূপৃষ্ঠের পানি কিভাবে ব্যবহার করা যায় সে বিষয়টি নিয়ে পরিকল্পনা করতে হবে। ঢাকা শহরের বহুতল ভবনগুলোতে প্রচুর পরিমান পানি অপচয় হয়। ভবনগুলোতে একবার টয়লেট ব্যবহারে প্রায় ১০ থেকে ১৫ লিটার পানি অপচয় হচ্ছে। এছাড়া কাপড় ধোয়া, রান্নাবান্না, গোসলে প্রয়োজনের তুলনায় প্রচুর পানি ব্যবহৃত হচ্ছে। কাপড় ধোয়ার পানি, রান্নাবান্না এবং গোসলের পানিকে প্রক্রিয়ার মাধ্যমে পূনর্ব্যবহার করে পানির অপচয় কমাতে পারি। এছাড়া ঢাকা শহরের আশেপাশে যে সকল নদ-নদী, খাল-বিল আছে তার পানি পরিশোধনের মাধ্যমে পূর্নব্যবহার করে পানির ঘাটতি হ্রাস করা সম্ভব।

ভূপৃষ্টের পানি ব্যবহার
বাংলাদেশের একটি বড় সুবিধা হচ্ছে এদেশের এখনো প্রচুর নদ-নদী,খাল,বিল, পুকুর, দীঘি রয়েছে। কিন্তু পানি সংগ্রহের জন্য এই উৎসগুলোর কথা চিন্তা করা হয়নি। এই জলের আধারগুলোকে অবহেলা করে প্রকল্পের কারণেই ভূগর্ভস্থ পানির উপর নির্ভরত বৃদ্ধি করা হয়েছে। আর অবহেলা, অপরিকল্পিত বাধ, রাস্তা, ব্রিজ এবং দখলদারদের কারণে নদীগুলোতে নি¯প্রাণ হয়ে গেছে। যে সকল নদীতে প্রাণ আছে তা আবার শিল্প কারখানাসহ নানা কারণে দুষিত হচ্ছে। কিন্তু এসব নদীই হতে পারত ঢাকা শহরের পানির প্রধান উৎস। তবে বাস্তবে তা হচ্ছে না।

বুড়িগঙ্গা, শীতল্য, বালু, তুরাগ, এবং ধলেশ্বর নদীর পানিকে ব্যবহারের মাধ্যমেও নগরীর পানির চাহিদা মিটানো সম্ভব। পৃথিবীর অনেক দেশেই নগর পরিকল্পনার েেত্র নগরের আশেপাশের নদীনালার পানিকে ব্যবহার করা হয়ে থাকে। আমাদেরও একইভাবে পরিকল্পনা করতে হবে। আমরা নদীর পানিকে কলকারখানার বর্জ্য, সুয়ারেজ বর্জ্য দিয়ে প্রতিনিয়ত দূষিত করছি। ঢাকা শহরের সুয়ারেজ অব্যবস্থপনার কারণে নদীনালা, খাল-বিল এর পানি দূষিত হচ্ছে। শহরের ভবনগুলোর দৈনন্দিন কাজে ব্যবহুত পানি মল-মূত্রের সাথে মিশে সুয়ারেজ লাইনের মাধ্যমে নদীতে গিয়ে নদীর পানি দূষিত করছে। এতে যেমন পরিবেশ দূষিত হচ্ছে আবার মানুষ সে পানি ব্যবহার করে স্বাস্থ্য ঝুঁকিতে পড়ছে।

সুয়ারেজ এর পানি ও মল-মূত্রের আর্বজনা পৃথক পাইপের মাধ্যমে ফেলার চিন্তা করতে হবে। এেেত্র ভবনের মল-মূত্রের জন্য সেফটি ট্যাংক থাকতে হবে যাতে করে আর্বজনা নদীতে মিশে দূষণ ছড়াতে না পারে এবং দৈনন্দিন কাজের ব্যবহৃত পানি সরাসরি সুয়ারেজ লাইনের মাধ্যমে নদীনালয় গিয়ে পড়ে। নগরীতে বসবাসরত মানুষের বিশুদ্ধ পানি নিশ্চিত করতে আশেপাশের নদীনালার পানিকে দূষণের হাত থেকে বাঁচানোর পরিকল্পনা করতে হবে।

ঢাকা শহরের মোট চাহিদার মাত্র ১৩ থেকে ১৫ ভাগ পানি নদী থেকে সরবরাহ করা হচ্ছে। বুড়িগঙ্গা ও তুরাগের পানি অতিমাত্রায় দূষিত হওয়ায় তা পরিশোধনের অযোগ্য হয়ে পড়েছে। বর্তমানে শীতল্যা থেকে পানি এনে সায়েদাবাদ পানি শোধনাগারে প্রতিদিন প্রায় ২২ কোটি লিটার পরিশোধন করা হয়। রাজশাহীতে স¤প্রতি নদী পানি শোষণ করে সরবরাহ করার ব্যবস্থা করেছে। খুলনা, চট্টগ্রাম অঞ্চলে এধরনের প্রকল্প বাস্তবায়নাধীন রয়েছে। তবে চাহিদা ও উত্তোলনের তুলনায় ভুপৃষ্টের পানি ব্যবহারের পরিমান কম।


বৃষ্টির পানি সংরন ও ব্যবহার
বৃষ্টির পানিকে সংগ্রহ এবং সংরণ করে প্রক্রিয়াকরণের মাধ্যমে নগরীর পানির চাহিদা হ্রাস করা সম্ভব। এেেত্র বর্ষাকালে নগরের বহুতল ভবনে ছাদের পানি সংগ্রহ ও সংরণ করে প্রক্রিয়াকরণের মাধ্যমে ব্যবহার করে পানির চাহিদা কমানো যাবে। পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতসহ বর্তমান বিশ্বের অনেক দেশেই বৃষ্টির পানি সংগ্রহ (রেইন ওয়াটার হারভেস্টিং) সিস্টেম চালু হলেও বাংলাদেশে এর প্রচলন নেই। একমাত্র ঢাকা ওয়াসা ভবনের ছাদে এক সময় এ ব্যবস্থা চালু করা হলেও পরবর্তীকালে তা ভেঙে ফেলা হয়েছে। তবে বেসরকারী উদ্যোগে কিছু প্রতিষ্ঠান নিজস্ব ভবনে বৃষ্টির পানি ব্যবহার করে আসছে। ইমারত নির্মাণ বিধিমালায় বৃষ্টির পানির সংরন ও ব্যবহারের বিধান থাকলেও তা বলবৎযোগ্য নয়।

সুপারিশ
১. বিশুদ্ধ পানির উৎসঃ নদ-নদী, খাল-বিল ও জলাশয় রায় কঠোর আইন প্রণয়ন।
২. বৃষ্টির পানি সংরণ ও ব্যবহারে ব্যবস্থা করতে হবে।
৩. ইমারত নির্মাণ বিধিমালা সংশোধন করি প্রতিটি বাড়ীতে বৃষ্টির পানি সংরন ও ব্যবহৃত পানি পুনব্যবহারের ব্যবস্থা নিশ্চিত করা।
৪. শিল্প-কারখানার, পয়ঃবর্জ্য, বিদ্যুাৎকেন্দ্র এবং আবর্জনা প্রক্রিয়াজাতকরণ স্থাপনার বর্জ্য নদী বা জলাশয়ে ফেলা বন্ধ।
৫. পানি ব্যবহারে সংযমী হতে জনসাধারণকে উৎসাহী করা।
৬. ভুগর্ভস্থ পানির ব্যবহার হ্রাস করা এবং ভূ-পৃষ্টের পানির ব্যবহার বৃদ্ধির ল্েয প্রয়োজনী পরিকল্পনা ও নীতি প্রণয়ন।
৭. পুকুর, দীঘি, খাল-বিল-নদীসহ যে কোন জলাশয় ভরাট বন্ধে কার্যকর পদপে গ্রহণ।
৮. পানি পরিশোধনের ল্েয প্রয়োজনীয় পদপে গ্রহণ ও অবিলম্বে নদী- দূষণের প্রক্রিয়া বন্ধ করা।
৯. নদীর পানির অপসারন রোধ এবং সাগরে নদীর পানির স্বাভাবিক প্রবাহকে অুন্ন রাখতে হবে।
১০. নদী, খাল, বিলসহ যে কোন ধরনের জলাশয়কে পেছনে দিয়ে এ ধরনের স্থাপনা বা পরিকল্পনা নিষিদ্ধের ল্েয প্রয়োজনীয় পদপে গ্রহণ। যদি জলাশয় সামনে থাকে তবে মানুষ এ সকল স্থানে ময়লা আর্বজনা ফেলবে না।
১১. নদীর পানি ব্যবহার, নদীর গতিধারা পরিবর্তনে গৃহীত বিভিন্ন প্রকল্প, নদী তীরে নির্মিত বিভিন্ন শিল্প-কলকারখানা নির্মাণে বানিজ্যিক দৃষ্টিভঙ্গি পরিহার করতে হবে।
১২. বাংলাদেশ ও প্রতিবেশী দেশগুলোতে পানি প্রকল্পসমূহ যথাযথভাবে পুনরমূল্যায়ন করতে হবে এবং পানি প্রাপ্তির অধিকার নিশ্চিত করতে হবে।
১৩. নদী দূষণকারী ও দখলদারদের কাছ থেকে তিপুরণ ও জরিমানা আদায় করা।
১৪. সকল অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ করে নদীর জায়গা নদীকে ফিরিয়ে দেয়া এবং অবৈধ দখলদারীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি প্রদান করা। সি এস দাগ ধরে নদীর সীমানা নির্ধারন করে, নতুন করে আর যাতে কোন স্থাপনা না গড়ে উঠে সেদিকে ল্য রাখা।
১৫. নদী ও খালের দুইপারে মানুষের বিনোদনের জন্য হাঁটার ব্যবস্থা রাখা।

শনিবার, ২৬ ফেব্রুয়ারী, ২০১১

বানিজ্যিক স্বাস্থ্য কার্যক্রম ও মানবাধিকার

বানিজ্যিক স্বাস্থ্য কার্যক্রম ও মানবাধিকার
সৈয়দ মাহবুবুল আলম, নীতিবিশ্লেষক

ভাই রোগীটা দেখেন, টঙ্গীতে ট্রাকের সাথে ধাক্কা খেয়েছে। দয়া করে রোগীটাকে চিকিৎসা দিন। আমরা টাকা নিয়ে আসছি। একটি বেসরকারী হাসপাতালের কর্তৃপরে নিকট মোবাইলে গুরুতর আহত একজন রোগীকে চিকিৎসা দিতে এভাবে আকুতি জানাচ্ছিলাম। ছেলেটার অপরিচ্ছন্ন কাপড় আর দরিদ্র সহচরদের দেখে কর্তৃপ চিকিৎসা দিচ্ছিল না। এত আকুতির পরও চিকিৎসা পায়নি মারাত্বকভাবে আহত দরিদ্র ছেলেটি..... বেসরকারী হাসপাতাল থেকে ছেলেটিকে পাঠিয়ে দেয়া হয় ঢাকা মেডিক্যাল কলেজে। ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ এ পৌঁছানো পর্যন্ত বাঁচেনি ছেলেটা.......সারান মনে হচ্ছিল যদি সময় মতো চিকিৎসা পেতো হয়তো ছেলেটা বাচঁতো।

‘‘ভাই আমাগো বাচ্ছাডা বাঁচবে না।’’ গভীর রাত। ঢাকায় একটি শিশু বিশেষাষ্ণায়িত হাসপাতালে বসে আছি। একজন মা ডাক্তারকে অনুরোধ করছে তার সন্তানকে এনআইসিইউতে রাখতে। সিট না থাকায় ডাক্তার তাকে অন্য হাসপাতালে নিতে পরামর্শ দিচ্ছেন। কিন্তু অন্য হাসপাতালে নিতে হলে প্রতিদিন প্রায় ২০ হাজার টাকার মতো খরচ লাগবে বিধায় মা তার শিশুটিকে এ হাসপাতালেই সিট না থাকলে অন্তত মাটিতে স্থান দিতে পীড়াপীড়ি করছিলেন। এটি বর্তমান বানিজ্যিক স্বাস্থ্য কার্যক্রমের চিত্র।

সেবা বলতে একটি মহৎকর্ম প্রচেষ্টাকে বুঝায়। অর্থের বিনিময়ে পরিচালিত স্বাস্থ্য কার্যক্রমকে স্বাস্থ্যসেবা বলা অযৌক্তিক। বেসরকারী স্বাস্থ্যসেবা বলতে সে সকল দাতব্য প্রতিষ্ঠানকে চিহ্নিত করা উচিত যারা মানুষকে তাদের সাধ্য অনুসারে সেবা প্রদান করা আসছে, এতে মুনাফা অর্জনই মূল উদ্দেশ্য নয়। শুধুমাত্র অর্থ উপার্জনের ল্েয নানা প্রক্রিয়ায় মানুষকে জিম্মি করার স্বাস্থ্য বিষয়ক কার্যক্রমকে বানিজ্যিক স্বাস্থ্য কার্যক্রম বলা উচিত। স্বাস্থ্য বিষয়ে নীতিনির্ধারণ ও আলোচনার েেত্র সরকারী স্বাস্থ্যসেবা, বেসরকারী স্বাস্থ্যসেবা এবং বানিজ্যিক স্বাস্থ্য কার্যক্রম এই মৌলিক বিষয়গুলো সুপষ্টভাবে চিহ্নিত করা প্রয়োজন। বেসরকারী স্বাস্থ্য সেবা শব্দটির আড়ালে স্বাস্থ্য নিয়ে বানিজ্য করায় মূল বিষয়টি হারিয়ে যায়। সেবার কথা বলে এই বানিজ্যিক প্রতিষ্ঠানগুলো রাষ্ট্র হতে নানা সুযোগ সুবিধা গ্রহণ করে। কিন্তু তাদের মূনাফা অর্জনের ল্য মাত্রায় পিষ্ট হয় রাষ্ট্রের জনগন।

স্বাস্থ্যখাত এর ক্রমবর্ধমান বানিজ্যকরণের অপর একটি কারণ হচ্ছে, স্বাস্থ্য বলতে অনেক সচেতন মানুষ শুধুমাত্র চিকিৎসাকেই চিন্তা করে। সকল পরিকল্পনা ও কার্যক্রমে চিকিৎসার মতো বানিজ্যিক েেত্রগুলোই প্রধান্য পায়। স্বাস্থ্য সেবা বলতে সুস্থ্য থাকার উপায় বা রোগ প্রতিরোধের মতো বিষয়গুলো স্থান পায় না। পরিবেশ দূষণ রোধ, খাদ্যভাস, কায়িক পরিশ্রম, সচেতনতা সুস্বাস্থ্য বজায় রাখার এ সকল খাতে বানিজ্য করার সুযোগ খুবই কম। অপরদিকে চিকিৎসা কার্যক্রমের সাথে রয়েছে অবকাঠামো, ঔষধ, টেস্ট, অপরেশন, ভিজিটসহ নানা ধরনের অর্থসংস্থানের সুযোগ। আর নিয়মিত অর্থ উৎপাদনের এ সুযোগের কারণে মানুষকে সুস্থ্য রাখা অপো চিকিৎসা ও বানিজ্যিক স্বাস্থ্য কার্যক্রমের প্রতি মনোযোগ, প্রকল্প, নীতি ও পরিকল্পনা অনেক বেশি।

স্বাস্থ্যখাত বানিজ্যিককরণের প্রক্রিয়া
স্বাধীনতার পর সত্তর দশকের শেষের দিকে এদেশের বানিজ্যিক স্বাস্থ্যখাতের বিকাশ শুরু হলেও তখন এ সংক্রান্ত কোন বিধি বিধান বা নীতিমালা তৈরী হয়নি। তথাপিও সে সময় হাসপাতাল, নার্সিং হোম, কিনিক স্থাপনের জন্য স্বল্প সুদে ব্যাংক ঋণদানের একটি স্কীম চালু করা হয়। ১৯৮২ সালে একটা অধ্যাদেশ জারীর মাধ্যমে বেসরকারি স্বাস্থ্যসেবা খাতকে আইনী বৈধতা দেওয়া হয়। উক্ত অধ্যাদেশ বেসরকারি কিনিক, হাসপাতাল, ল্যাবরেটরি নির্মানের েেত্র যন্ত্রপাতি ও বিশেষজ্ঞ নিয়োগের শর্ত নির্দিষ্ট করা হয়। ১৯৮৪ সালে পূর্ববর্তী অধ্যাদেশের সংশোধনীসহ আরেকটি অধ্যাদেশ জারী করা হয়। সে সময় গৃহীত তৃতীয় পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা এবং পরবর্তীতে ১৯৯১-৯৬ গৃহীত চতুর্থ পঞ্চবাষির্কী পরিকল্পনায় বেসরকারি খাত বিকাশের ল্েয সরকারি পরিকল্পনা সন্নিবেশিত হয়। ১৯৯৬-২০০১ সালে পঞ্চম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনায় বেসরকারি খাতকে বিকাশের পরিকল্পনা দৃঢ়ভাবে গ্রহণ করা হয়। পরবর্তীতে ২০০১-০৬ বেসরকারি খাতকে উৎসাহিত করার ল্েয সরকারীভাবে বিভিন্ন প্রোগ্রাম ও অর্থ সুবিধার বিধান হাতে নেওয়া হয়।

বাংলাদেশে খুব দ্রুত বেড়েছে এই বেসরকারী স্বাস্থ্যখাত। ১৯৮০ সালে সরকারী পরিচালনায় রাষ্ট্রায়াত হাসপাতাল ছিল ৫১০ টি এবং বেসরকারী ছিল ৩৯ টি, ১৯৯৮ সালে সরকারী হাসপাতালের সংখ্যা বেড়ে ৬৪৭ টি এবং বেসরকারী হাসপাতালের সংখ্যা দাড়ায় ৬২৬টি। ২০০৫-০৬ সালে এক তথ্যে দেখা যায় মোট ৪ হাজার ১৫টি চিকিৎসা প্রতিষ্ঠানের মাঝে ২ হাজার ১৬৮টি একক মালিকানায় প্রতিষ্ঠিত। বর্তমানে কত পরিমান হাসপাতাল, কিনিক ও প্যাথলজি ল্যাব রয়েছে তার সঠিক পরিসংখ্যান কারো কাছেই নেই। বেসরকারী চিকিৎসা সেবার মান উন্নয়নে বেসরকারি চিকিৎসা সেবা আইন ২০০০ খসড়া প্রণয়ন করা হয়। আইনটি ২০০৩ ও ২০০৪ সালে আরো অধিকতর উন্নয়ন করে
পাসের উদ্যোগ গ্রহণ করা হলেও, এখনো পর্যন্ত আলোর মুখ দেখেনি। তবে এই উদ্যোগের অংশ হিসেবে স্বাস্থ মন্ত্রণালয় আবার “বেসরকারি স্বাস্থ্য সেবা আইন-২০১০ (খসড়া) প্রণয়ন করেছে। তবে কবে পাশ হবে এবং মানুষের স্বার্থ রা করবে তা দেখার বিষয়।

বাংলাদেশে বেসরকারীখাতে স্বাস্থ্যসেবার চিত্র পাওয়া যায় বিশ্ব ব্যাংকের ২০০৩ সালের একটি প্রতিবেদনে। সেখানে উল্লেখ করা হয়েছে “স্বাস্থ্যসেবা গ্রহণকারীদের মধ্যে শতকরা ৭০ ভাগ বেসরকারী স্বাস্থ্যখাত থেকে সেবা নিয়ে থাকেন (নিবন্ধিত নয় এমন সেবা প্রদানকারীসহ)। অর্থ ব্যয়ের নিরিখেও বেসরকারি খাতের কলেবর সরকারি খাতের দ্বিগুণের বেশি। স্বাস্থ্য বিষয়ক মুখপত্র হেলথ বুলেটিন ২০১০ এর উপাত্তের দিকে দৃষ্টি দিলে দেখা যায় ১৯৯৬-৯৭ সালে সরকারি খাতে মোট ব্যয়ের পরিমান ছিলো সর্বমোট স্বাস্থ্য ব্যয়ের ৩৬% এবং বেসরকারি খাতে ৬৪%, ১৯৯৭-৯৮ সালে ৩৪% ও ৬৬ %, ১৯৯৮-৯৯ সালে ৩১% ও ৬৯%, ২০০১-০২ সালে ৩০% ও ৭০%, ২০০২-০৩ সালে ২৮% ও ৭২%, ২০০৪-০৫ ও ২০০৫-০৬ সালে ২৬% ও ৭৪%। বেসরকারি খাতের ব্যয় বলতে ব্যাক্তিগত খাতের ব্যয়, বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের ব্যয়, এনজিও ব্যয় ও উন্নয়ন সহযোগীদের ব্যয়সমূহকে বোঝানো হয়েছে।

উপরেররর চিত্র থেকে বোঝা যায় বাংলাদেশের মানুষ আজ বেসরকারী স্বাস্থ্য খাত তথা বানিজ্যিক স্বাস্থ্য খাতের নিকট জিম্মি। তবে বিশ্বব্যাংকের এ সকল তথ্য যথেষ্ট সতর্কতার সাথে গ্রহণ করা উচিত। বিশ্বব্যাংকের এ সকল তথ্যের পরবর্তী পদপে থাকে ব্যবসার পথ তৈরি করা। রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান ও সরকারে জনস্বার্থে গৃহীত কার্যক্রমগুলোকে অযোগ্য এবং অকার্যকর প্রমাণিত করার প্রকল্পগুলো বানিজ্যিক কার্যক্রমের পথ সুগম করে দেয়। রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানের স্বাস্থ্য সেবাকে সংকুচিত করার প্রেেিত মানুষ কোন উপায় না পেয়ে সহায় সম্বল বিক্রি করে ছুটছে বানিজ্যিক স্বাস্থ্য সেবা কার্যক্রমের দিকে সেবা পেতে। বানিজ্য তার নিয়মেই পরিচালিত হচ্ছে মানুষ ও মানবাধিকার সেখানে পণ্য।

স্বাস্থ্য ও মানবাধিকার
বর্তমান প্রোপটে বানিজ্য ও স্বাস্থ্য অধিকার পারস্পরিক সাংঘর্ষিক বিষয়। যদিও বলবৎ সংবিধান, আন্তর্জাতিক চুক্তি সকল সকল বিষয়ে স্বাস্থ্যকে মানবাধিকার হিসেবে স্বীকৃতি প্রদান করেছে। বাংলাদেশ সংবিধানের রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতিতে রাষ্ট্রের অন্যতম মৌলিক দায়িত্ব হিসেবে চিকিৎসাকে চিহ্নিত করা হয়েছে। পাশাপাশি জনগণের পুষ্টির স্তর-উন্নয়ন ও জনস্বাস্থ্যের উন্নতি সাধনকে রাষ্ট্র অন্যতম প্রাথমিক কর্তব্য বলে গণ্য করার কথা সংবিধানের সুপষ্ট উল্লেখ্য করা হয়েছে। জাতীয় স্বাস্থ্য নীতি অনুসারে প্রাথমিক স্বাস্থ্য পরিচর্যার অত্যাবশ্যক সেবাগুলি রাষ্ট্রীয় ভূখন্ডের যে কোন ভৌগলিক অবস্থানে প্রত্যেক নাগরিকের কাছে পৌছে দেওয়াকে মূলনীতিতে স্থান দেওয়া হয়েছে। রাষ্ট্র পরিচালনার মূল দলিল অনুসারে জনগনের স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করা সরকারের অন্যতম দায়িত্ব ও কর্তব্য।

সার্বজনীন মানবাধিকার ঘোষণার ধারা ২৫ এ বলা আছে, স্বাস্থ্য ও কল্যাণের জন্য উপযুক্ত জীবনযাত্রার মান প্রাপ্তির অধিকার প্রত্যেকেরই আছে। খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থান, শিা, চিকিৎসাসহ প্রয়োজনীয় সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় সেবা ও সুবিধা লাভের অধিকার প্রত্যেকেরই প্রাপ্য। অর্থনৈতিক, সামাজিক এবং সাংস্কৃতিক অধিকার বিষয়ক আন্তর্জাতিক চুক্তি (ওঈঊঝঈজ)-এর ১২ অনুচ্ছেদ অনুসারে প্রত্যেকের সর্বোত্তম শারীরিক এবং মানসিক স্বাস্থ্য উপভোগ করার অধিকার রয়েছে। ১৯৭৮ সালে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার আলমা আতা ঘোষণায় স্বাস্থ্যসেবার অভিগম্যতাকে একটি অধিকার হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে এবং পৃথিবীর সকল দেশ তা গ্রহণ করেছে। ২০০০ সালের জাতিসংঘ কর্তৃক ঘোষিত সহস্রাব্দ উন্নয়ন ঘোষণায়ও এ অধিকারের বিষয়টি পূর্ণব্যক্ত করে স্বাস্থ্যকে উন্নয়নের কেন্দ্রে স্থান দেয়া হয়েছে। নীতি ও আর্দশের দিক হতে স্বাস্থ্যকে মানবাধিকার হিসেবে বিবেচনা করা হলেও, স্বাস্থ্য কার্যক্রম ছুটছে বানিজ্যকরনের দিকে।

স্বাস্থ্যকে বানিজ্যিক দিকে নিয়ে যাওয়ার প্রক্রিয়া সম্পর্কে তথ্য পাওয়া যায় ফরিদা আকতারের স্বাস্থ্য সেবা কোন দিকে ছুটছে এ লেখা হতে ‘‘ স্বাধীনতার পরের সময়ে মোহাম্মদপুর, শ্যামলী মিরপুর এলাকার গরিব মহিলারা বিশেষ করে সোহরাওর্য়াদী জেনারেল হাসপাতালের কথা উল্লেখ করলেন। এখানে ১ টাকার টিকেট কেটে চিকিৎসা করছেন এবং বিনামূল্যে চিকিৎসা সেবা নিয়েছেন। মধ্যবিত্ত মহিলারা আরো একটি তথ্য দিলেন তা হচ্ছে হঠাৎ করে আশির দশকে অস্ত্র প্রচারের বিষয়টি চোখে পড়তে শুরু করলো। সন্তান জন্ম দিতে গিয়ে সিজারিয়ান অপরেশনে বাচ্চা হওয়া যেন স্বাভাবিক বিষয় হলে উঠলো। অথচ সবার জন্য তা দরকার ছিল কি না এখন যে প্রশ্ন উঠে। খরচের ব্যাপারটাও বেড়ে গেল । ১৯৮৮ সালে একজন মহিলার প্রথম বাচ্চা সিজারিয়ান অপারেশনে হবার সময় খরচ হলো ১৩,০০০ টাকায়, ১৯৯৪ সালে দ্বিতীয় বাচ্চা হবার সময় খরচ হলো ৩০,০০০ টাকা। বর্তমানে তা আরো বেড়ে গেছে।’’ আর এখন এর বড় অংশ নিয়ন্ত্রণ করছে বানিজ্যিক খাত।

বেড়েছে বানিজ্য, বাড়ছে রোগ
স্বাস্থ্যখাত বানিজ্যিককরণের প্রেেিত আমাদের কতটুকু অগ্রগতি হয়েছে তা বিবেচ্য বিষয়। আগের তুলনায় মানুষের মাঝে রোগ অনেক বৃদ্ধি পেয়েছে এবং অনেক লোক চিকিৎসা পাচ্ছে না। উদাহরণ হিসাবে বলা যায় দেশে নীরব ঘাতক ব্যধি ডায়াবেটিসে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা বাড়ছে এবং ৭৫ শতাংশ ডায়াবেটিস রোগী রয়েছে চিকিৎসা সেবার বাইরে। ডায়াবেটিস রোগীদের জীবন রাকারী ওষুধের দাম বেড়েছে দ্বিগুন-তিনগুন এখনো নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত হয়ে বাংলাদেশে প্রতি ঘন্টায় ৭ টি শিশু মারা যায়। প্রতি বছর মারা যায় ৫০ হাজার শিশু। অপুষ্টির কারণে প্রতিদিন ৯০০ শিশু মারা যাচ্ছে। বাংলাদেশে প্রায় দেশের ৪০ ভাগ এলাকায় স্যানিটেশন সুবিধা নেই, পানিবাহিত রোগে প্রতিদিন মারা যাচ্ছে ৩৪২ শিশু। দেশে প্রায় ৮ ল ক্যান্সার রোগী আছে, তাদের মাঝে ৭ ল লোক চিকিৎসা পাচ্ছে না।

বাংলাদেশ অসংক্রামক রোগ দিন দিন বাড়ছে। আমাদের কর্মব্যস্ত জীবনে পরিকল্পিত খাদ্যাভাস গড়ে তোলার পরিবর্তে আমরা অতিরিক্ত চর্বিযুক্ত খাবার, কার্বহাইড্রেট, ফাস্ট ফুড, জাঙ্ক ফুডে অভ্যস্ত হয়ে পড়ছি। ফলে আমরা আক্রান্ত হচ্ছি ডায়াবেটিস এবং অতিরিক্ত মোটাজনিত রোগে। বাংলাদেশের ২০ বছরের উর্দ্ধ বয়সী গ্রামের মানুষের মাঝে ৭% এবং শহরাঞ্চলে ১৭ % লোক ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হচ্ছে এবং মোট মৃত্যুর ৬.২% ভাগ মৃত্যু হয় ডায়াবেটিসের কারনে। এছাড়া উন্নয়নশীল দেশগুলোতে জনগণ পরিকল্পিত খাদ্যাভাস সম্পর্কে অজ্ঞতা, সচেতনতা কম এবং অর্থনৈতিক দূর্বলতার কারনে অপুষ্টিতে ভুগছে।

আমাদের দেশে কায়িক শ্রমের অভাবে একটি বড় অংশের মানুষ আক্রান্ত হচ্ছে হৃদরোগ এবং উচ্চরক্তচাপ জনিত সমস্যায়। বাংলাদেশের গ্রামাঞ্চলের ১৮ এর উর্দ্ধ বয়সীদের শতকরা ১৩% (পুরুষ ৯.৮% ও মহিলা ১৫.৬%) উচ্চ রক্তচাপে আক্রান্ত হচ্ছে। তাছাড়া মোট মৃত্যুর শতকরা ২.৪ ভাগ হার্ট অ্যটাক. ৩.৬ ভাগ স্ট্রোক এবং ৬.৫ ভাগ অন্যান্য হৃদরোগ অর্থাৎ সর্বমোট ১২.৫ % মৃত্যুর কারণ নানাবিধ হৃদরোগ। বাংলাদেশে বায়ূ দূষনের কারণে বেড়ে যাচ্ছে শ্বাসতন্ত্রের দীর্ঘমেয়াদী রোগ। দেশের জনগনের প্রতি হাজারে যথাক্রমে পুরুষ ও মহিলাদের ৪৫ ও ২২ জনের হাপাঁনি বহির্ভূত শ্বাসতন্ত্রের দীর্ঘমেয়াদী রোগ রয়েছে। ফলে এই রোগের কারণে মৃত্যুর পরিমান মোট মৃত্যুর ৩%।

বাংলাদেশে প্রাপ্ত বয়স্ক জনগোষ্ঠীর মাঝে গ্রামাঞ্চলের ৪৩% ও শহরের ৯০% অপর্যাপ্ত কায়িক শ্রম করেন। তাছাড়া বাংলাদেশে প্রাপ্ত বয়স্ক জনগোষ্ঠীর মধ্যে গ্রামাঞ্চলে বেশীর ভাগ মানুষ প্রয়োজনীয় খাদ্য পায়না, কিন্ত শহরাঞ্চলে চাহিদার ৫৮% অধিক শর্করা ও ১৬% অধিক চর্বি গ্রহণ করেন। বাংলাদেশের গ্রামাঞ্চলের শতকরা ৩ ভাগ মহিলা ’’বিপাকীয় উপর্স’’ বা মেটাবেলিক সিনড্রোমে ভোগে। বাংলাদেশে ২০ উর্দ্ধ গ্রামের মহিলাদের ৬.৫% এবং শহরের মহিলা ও পুরুষদের যথাক্রমে ৫০% ও ৩১% ওজনাধিক্যে ভুগছে।

অসংক্রামক রোগের বিষয়ে আমাদের এখনই সচেতন হতে হবে। চিকিৎসার চেয়ে রোগ প্রতিরোধকেই প্রাধান্য দিতে হবে। এক সময় মনে করা হত, অসংক্রামক রোগ প্রতিরোধযোগ্য নয়, প্রকৃত পে শতকরা ৮০% অপরিণত হৃদরোগ, স্ট্রোক ও ডায়াবেটিস এবং ৪০ ভাগ ক্যান্সার প্রতিরোধযোগ্য। বিভিন্ন গবেষনা হতে জানা গেছে যে, কমিউনিটি ভিত্তিক পদপে দ্বারা অসংক্রামক রোগসমূহ প্রতিরোধযোগ্য এবং এই সকল রোগ চিকিৎসা করার চেয়ে প্রতিরোধ করা অর্থনৈতিকভাবে অনেক বেশী সাশ্রয়ী।

শুধু বাংলাদেশ নয়, পৃথিবীর মানুষ নতুন নতুন সংক্রামক ব্যাধির ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে। দিন দিন ঝুঁকি বাড়ছে। গবেষকরা বলছেন, মনুষ্য প্রজাতি গত ২৫ বছরে ৩৫টি নতুন সংক্রামক ব্যাধিতে আক্রান্ত হয়েছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, জনসংখ্যার এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে ছড়িছে পড়ছে। রোগ তত্ত্ববিদেরা বলছেন, পৃথিবীর মানুষ নতুন নতুন রোগে আক্রান্ত হচ্ছে। যুক্তরাজ্যের এডিনবার্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষক মার্ক উলহাউস ২৫ বছরের তথ্য বিশ্লেষণ করে করেছেন, এই সময়ে মানুষ ৩৮টি নতুন রোগে আক্রান্ত হয়েছে। এই রোগ মানুষের মধ্যে আগে ছিল না। এসব রোগের ৭৫ শতাংশ এসেছে জীবজন্তু ও পশু-পাখি থেকে।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা সংক্রামক ব্যাধির বিস্তার নিয়ে পর্যালোচনা করেছে। (গ্লোবালাইজেশন অ্যান্ড ইনফেকশাস ডিজিজেস: এ রিভিউ অব দ্য লিংকেজ) তাতে দেখা যায়, ১৯৯৫ সাল থেকে ৩০টি নতুন ও পুরোনো রোগ “নতুনভাবে আবির্ভূত হচ্ছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বলছে, বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধি, রৈখিক জলবায়ু পরিবর্তন, বড় বড় বাধ নির্মান, বন উজাড় হওয়া, বিস্তীর্ণ ভূমি ন্যাড়া হওয়া-এসব কারনে (সিলেকটিভ অ্যাডভান্টেজ) রোগের আবির্ভাব হচ্ছে। প্রতি আট মাসে একটি নতুন রোগের ঝুঁকি প্রতিরোধে দেশের প্রস্তুতি যথেষ্ট নয়।

রোগ নিয়ন্ত্রণে মনোযোগী না হয়ে মনোযোগ হচ্ছে স্বাস্থ্য বানিজ্যিক খাতে বিস্তারে। কারণ এই খাতটি অন্যতম একটি লাভজনক ব্যবসা। দরিদ্র মানুষ ব্যক্তি মালিকানাধীন স্বাস্থ্য সেবার জন্য এত টাকা দিতে পারছে না। তথাপিও বানিজ্যিক স্বাস্থ্য সেবা প্রতিষ্ঠানগুলো ছুটছে মফস্বল ও গ্রামের দিকে। সমস্যা হচ্ছে ব্যক্তি মালিকানাধীন এই স্বাস্থ্য কার্যক্রম হতে দীর্ঘমেয়াদী স্বাস্থ্যসেবা, গৃহভিত্তিক সেবা, জটিল ও দীর্ঘস্থায়ী রোগ এবং অন্যান্য গুরুতর স্বাস্থ্য সমস্যার সেবা পাওয়া যাবে না। ফলে সবার জন্য স্বাস্থ্য নীতি মূখ থুবড়ে পড়বে।

আমাদের দেহ যখন পন্য
স্বাস্থ্যখাত একটি বিশাল বানিজ্যিক খাত। ২০০৯ সালে প্রকাশিত এক তথ্যে দেখা যায় ৮ বছরে বেসরকারী চিকিৎসালয়ের আয় বেড়েছে ৫৩৬ শতাংশ, দিন দিন এর পরিমান বাড়ছে। বানিজ্যিকখাতে চিকিৎসা ব্যয় অস্বাভাবিক হারে বৃদ্ধি পাচ্ছে। উদাহরণ স্বরূপ বলা যেতে পারে, দেশের ৩৫টি সরকারী ও বেসরকরী হাসপাতালে বছরে একশ’র বেশী রোগীর দেহে কিডনি সংযোজন করা হয়ে থাকে। বেসরকারী হাসপাতালে একজন রোগীর কাছ থেকে সাড়ে ছয় লাখ টাকা আদায় করা হয়। অথচ সরকারী হাসপাতালে এ বাবদ চার্জ ৪৫ শতাংশ কম। বাংলাদেশে শুধুমাত্র চিকিৎসা েেত্র বছরে কয়েক হাজার কোটি টাকা খরচ করা হয়। অথচ সুস্থ্য থাকার জন্য পরিবেশ এবং সচেতন হলেই অনেক অসংক্রমক রোগ রয়েছে যেগুলো প্রতিরোধ করা সম্ভব ফলে এসব েেত্র ব্যায় করা অর্থ অন্য প্রয়োজনীয় খাতে ব্যবহার করা সম্ভব হবে।

বেসরকারী হাসপাতালগুলোতে স্বাস্থ্য ও চিকিৎসা একটি রমরমা বানিজ্যে পরিণত হয়েছে। আর অর্থ উৎপাদনের এই আধূনিক ব্যবস্থায় পিষ্ট হচ্ছে মানুষ। চিকিৎসার জন্য বিদেশগামী মানুষের স্রোত ঠেকাতে বিভিন্ন দেশী বিদেশী হাসপাতালকে অনুমতি প্রদান করা হলেও, বিগত সময়ের তুলনায় চিকিৎসার জন্য বিদেশ গমনের পরিমান অনেকাংশে বৃদ্ধি পেয়েছে। চিকিৎসাখাতে এই লাগামহীন বানিজ্য মানুষকে জিম্মি করে তুলছে। সংসদীয় কমিটির সুত্রে জানা যায়, বেসরকারী হাসপাতালগুলোতে ৩০ শতাংশ কম খরচে গরীব মানুষকে সেবা দেবে এই শর্তে হাসপাতালগুলোকে সরকারী অনুদান দেয়া হয়। কিন্তু হাসাপাতালগুলো নিয়ম মানে না।

রাষ্ট্রীয় মূলনীতি হিসেবে স্বাস্থ্য একটি মৌলিক অধিকার হলেও, অর্থনীতি উন্নয়নের উম্মাদনায় আমাদের বিচার বিবেচনা লোভ পাচ্ছে। বিশ্বব্যাংক ও আইএমএফর এর প্রভাবে ও চাপের কারণে সরকারী কিছূ নিয়ম কানুনের মধ্যে এটি পণ্য হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। তারই প্রেেিত স্বাস্থ্য সেবার টেষ্টসহ বিভিন্ন কার্যক্রমের উপর ভ্যাট আরোপ করা হয়। পরবর্তীতে একটি রিটের প্রেেিত সুপ্রিমকোর্টের হাইকোর্ট বিভাগ রোগীদের কাছ থেকে চিকিৎসাপত্র, প্যাথলজিক্যাল টেস্ট এবং সব ধরনের রোগ নির্ণয়, পরীা-নিরীার েেত্র প্রত্য বা পরোভাবে ভ্যাট আদায় করা বে-আইনি, সংবিধান পরিপন্থী ও অবৈধ ঘোষণা করে। পাশাপাশি ভ্যাট আদায় না করতে সরকার এবং সংশ্লিষ্টদের নির্দেশ দিয়েছে হাইকোর্ট।

অপর দিকে বিশ্বব্যাংকের ঋণ প্রকল্পের আওতায় (লোন#৪০৫২ বিডি) সরকারী পরিচালনাধীন রাষ্ট্রীয় হাসপাতালগুলো ইজারা দেওয়ার জন্য চাপ প্রয়োগ করে। পরবর্তীতে জনগনের আন্দোলনের প্রেেিত এই ইজারাদান বন্ধ হয়। তারপরও রাষ্ট্রীয় হাসপাতালগুলো কার্যক্রম বানিজ্যিকরণের ল্েয ইউজার ফি বৃদ্ধি এবং বন্টনের পরিকল্পনা গ্রহণ করে। জনগনের আন্দোলন এবং সুপ্রীম কোর্টের হাইকোর্টে ডিভিশনে রীটের প্রেেিত এ কার্যক্রম ও স্থগিত হয়। বাংলাদেশের প্রায় ৪০% মানুষ বিদ্যমান সরকারি-বেসরকারী উন্নয়ন সংস্থা পরিচালিত সামগ্রিক সুযোগ পাচ্ছে। ২৫% মুত্যু পথযাত্রী রোগী শিতি চিকিৎসকের পরামর্শ পায় না। ৭০% প্রসুতি নারী প্রসব-পূর্ব চেকআপ থেকে বঞ্চিত, ৭০% নারী রক্তশূন্যতার শিকার। এ অবস্থায় রাষ্ট্রীয় হাসপাতালগুলো সরকারী স্বাস্থ্যসেবা কার্যক্রম সংকুচিত করে মানুষের বাঁচার পথ থাকবে না।

স্বাস্থ্যখাতে অপর এক অনিয়ন্ত্রিত অবস্থার নাম ঔষধ বানিজ্য। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সাবেক মহাপরিচালক বলেছেন, বর্তমান চিকিৎসকদের ক্যাশ টাকা দিয়ে ওষুধ কোম্পানিগুলো তাদের নিজেদের ঔষধের নাম লিখিয়ে নিচ্ছে। ওষুধ প্রশাসনের হিসেব মতে দেশে এলোপ্যাথিক ২৩৭টি, হোমিওপ্যাথিক, আয়ুবের্দিক ও হারবালসহ ৮০০(আটশত) ওষুধ কোম্পানি আছে। ২২২টি কোম্পানির ওষুধ তৈরীর অনুমতি আছে। ১৬৪টি কোম্পানি ঔষুধ উৎপাদন করছে। এমন কোনো কোম্পানি আছে যার মাত্র ০৫টি ঔষধ এর উৎপাদনের অনুমতি থাকলেও উৎপাদন করছে প্রায় ২০টি ঔষুধ। এসব কোম্পানি অবৈধভাবে ঔষুধ উৎপাদন করে দেশের আইন ও প্রশাসনকে বৃদ্ধাঙ্গুলী প্রদর্শন করছে। কিছুদিন পূর্বে ভেজাল ও নিম্নমান বা নকল প্যারাসিটামল সিরাপ ব্যবহারে ২৪টি শিশুর অকাল মৃত্যু হয়। তথাপিও তা নিয়ন্ত্রণে কোন ধরনের উদ্যোগ নেই। সরকারী ঔষধ কারাখানাটিকে অকার্যকর করে রাখা হয়েছে বেসরকারী কোম্পানিগুলোর বাজার সৃষ্টির জন্য। ২০০৮ সালের এক তথ্য অনুসারে দেখা যায় বাংলাদেশে ঔষুধখাতে বানিজ্যের পরিমান আনুমানিক ৬০০০ কোটি টাকা।

ঔষধ বানিজ্যের চিত্র পাওয় যায়, ডাঃ মুনির উদ্দিন আহমদ এর লেখায় ‘‘১৯৮১ সালে বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থার সহযোগিতায় জাতিসংঘের শিল্প উন্নয়ন সংস্থা বাজারজাতকৃত ২ লাখ ওষুধ থেকে মাত্র ২৬টি ওষুধের একটি তালিকা প্রকাশ করে যেগুলোকে অপরিহর্য বলে বিবেচনা করা হয়। তাহলে অন্য অসংখ্য ওষুধের কাজ কী ? যদি সেগুলো অপরিহার্য না হয়ে থাকে। ১৯৭২ সালে চিলি এবং ১৯৭৮ সালে শ্রীলংকার মেডিকেল কমিশন বাজার জরিপ করে দেখতে পায়, মাত্র কয়েক ডজন ওষুধ জীবন ও সুস্থ্যতার জন্য প্রয়োজনীয়। মজার ব্যাপার হল- এ তথ্য প্রকাশ পাওয়ার পর দুই দেশের সরকার উৎখাত হয়ে গিয়েছিল মার্কিন সমর্থিত সরকার দ্বারা। পরবর্তী সময়ে মার্কিন সমর্থিত সরকারদ্বয় তাদের দেশে আমেরিকান কেমিক্যালস ও ফার্মাসিউটিক্যাল প্রোডাক্টস আমদানি ও ব্যবসার সুযোগ করে দিয়েছিল।

একটু খোলামন নিয়ে উপলব্ধি করতে চেষ্টা করলে বুঝতে কারও অসুবিধা হওয়ার কথা নয়, অকিঞ্চিৎকর ও অভিপ্রায়মূলক ওষুধ পরীা-নিরীা ওষুধ কোম্পনিগুলোর আকাশচুম্বী মুনাফার জন্যও অত্যাবশ্যক। এ ধরনের বক্তব্যের সপে যুক্তি খুঁজে পাওয়া যাবে ই-লিলির ১৯৯৩ সালের প্রোজাক ওষুধ বিষয়ক পুস্তিকার ভাষা পড়লে। এত বলা হয়-“এমন কোন প্রেসক্রিপসন ড্রাগ নেই যা শতভাগ নিরাপদ। এমনও হতে পারে, কোন ওষুধ বহু বছর ধরে ব্যাপকভাবে ব্যবহার করলে তার পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া দৃশ্যমান হতে পারে।” যদি তাই হয় অর্থাৎ কোন বিশেষ ওষুধ কোন বিশেষ রোগীর েেত্র ভিন্নভাবে প্রতিক্রিয়া দেখালে তবে আলাদা জীবজন্তুর ওপর পরীা-নিরীা চালানোর যৌক্তিকতা থাকে কি? এ প্রসঙ্গে এক অভিজ্ঞ চিকিৎসক বলেন, জীবজন্তুর ওপর চালানো পরীার ফলাফলের ওপর ভিত্তি করে কোন ওষুধ মানবদেহে প্রয়োগ করলে তার নিরাপত্তা নিশ্চিত হবে না।’’

এ বিষয়গুলো মানুষের শরীর ও স্বাস্থ্য নিয়ে বানিজ্যিক কার্যক্রমের একটি অংশিক চিত্র। স¤পূর্ণ চিত্র তার চেয়ে ভয়ংকর। মানুষের রোগ, শরীর সর্বোপরি জীবন ও মরণ নিয়ে বানিজ্যের অবসান রাষ্ট্র ও সরকারের হাতে। রাষ্ট্রের আইন আর সরকারের পদপেই পারে মানুষকে এই অমানবিক বানিজ্যিক কার্যক্রম হতে মুক্তি দিতে।




সকলের জন্য স্বাস্থ্যসেবা ও রাষ্ট্রীয় ব্যয়
বাংলাদেশ একটি উন্নয়নশীল রাষ্ট্র। আমাদের অর্থ কম, এই শব্দগুলো দেশের সাধারণ মানুষের সুবিধাকে সংকুচিত করার হাতিয়ারে পরিণত হয়েছে। অর্থনৈতিক উন্নয়নের দোহাই দিয়ে বিভিন্ন কার্যক্রম গ্রহণ করলেও জনগণের সুবিধা মূলত সংকোচন করা হয়েছে। অথচ বৈদেশিক ঋণ, পেনশনভাতা, প্রজাতন্ত্রের কর্মীদের বেতন, বেসরকারী কোম্পানীগুলোর সুবিধার জন্য বাজেটে অর্থ বা প্রণোদনা বৃদ্ধি পাচ্ছে।

সম্প্রতি ঢাকায় প্রাইভেট কার কে প্রধান্য দিয়ে একটি বিলাস বহুল এলিভেটর একপেক্সওয়ে নিমার্ণের পরিকল্পনা করা হয়েছে। এ বাজেট প্রায় ১৮,০০০০ কোটি টাকা। যা বাংলাদেশের ১৬ কোটি মানুষের প্রায় ২ বছর ৬ মাসের স্বাস্থ্য বাজেটের সমান। অপর দিকে তেল আমদানীতে আইডিবি হতে ১৪০০০ হাজার কোটি টাকার ঋণ নেয়া হচ্ছে। এই তেলের একটি বড় অংশ ব্যবহার হয় প্রাইভেট গাড়ীর জন্য। এছাড়া হাজার হাজার কোটি টাকা ব্যয় হচ্ছে নানা অপ্রয়োজনীয় খাতে। সাধারণ মানুষের জন্য কোন বরাদ্ধ ও সুবিধার কথা আসলেই বলা হয় আমাদের অর্থ নেই। অপ্রয়োজনীয় খাতে অর্থ বরাদ্ধ হ্রাস করে জনস্বাস্থ্য উন্নয়নের মতো বিষয়ে ব্যয় করা উচিত।

নিচের টেবিলে দেশের স্বাস্থ্য বাজেটে কমে আসার একটি চিত্র তুলে ধরা হলো। ২০০২-০৩ অর্থ বছরের স্বাস্থ্যখাতে বাজেট ছিল ৬.৪৭%, ২০০৯-১০ সালে ছিল ৬.১৫% এবং ২০১০-২০১১ সালে তা কমে দাঁড়িয়েছে ৬.০। অর্থাৎ স্বাস্থ্যখাতে বরাদ্ধ দিন দিন হ্রাস পাচ্ছে। আবার এ অর্থের বড় অংশ ব্যয় হয় প্রশাসনিক ও অবকাঠামোর খাতে। জনগনের স্বাস্থ্য জন্য ব্যয় নেই বলেই চলে। বিভিন্নখাতে জনগণের সেবার জন্য অর্থ প্রদানকে ভর্তুকী হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। অনেকেই বলে থাকেন এ খাতে ভতুর্কী প্রদান করা উচিত নয়। জনগণের অর্থ জনগণের সেবায় না প্রদানের নানা টালবাহানা করা হয়। অনেকেই সেবাখাতে অর্থ প্রদানকে অহেতুক মনে করেন। বিনামূল্যে কোন কিছুই দেয়া উচিত নয় যে সকল কর্মকর্তা বা ব্যক্তি বিশ্বাস করেন তাদের নিকট প্রশ্ন এ রাষ্ট্র কেন প্রজাতন্ত্রের সেই সকল কর্মীদের পেনশন প্রদান করবে যারা কাজ হতে অবসর নিয়েছেন ? প্রজাতন্ত্রের অবসরপ্রাপ্ত কর্মীদের পেনশন যেমন যৌক্তিক, তেমনি জনগনের সেবাখাতে সরকারের আর্থিক যোগান সৃষ্টিও যৌক্তিক ও দায়বদ্ধতা।


বাজেটে স্বাস্থ্য খাতে যে অর্থ বরাদ্দ হয় তার পুরোটাই রোগ পরবর্তী সেবা প্রদানের জন্য কিন্তু রোগ প্রতিরোধের জন্য সেভাবে বাজেটে কোন অর্থ বরাদ্দ দেয়া হয়না। রোগ প্রতিরোধ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। এই বিষয়টাকে অবশ্যই গুরুত্বসহকারে দেখা উচিত। রোগ প্রতিরোধের সাথে দেশের মানুষের রোগ মুক্তিসহ দেশের অর্থনীতির জড়িত। তাই বাজেটে অবশ্যই রোগ নিরাময়ের সাথে রোগ প্রতিরোধের জন্য অর্থ বরাদ্দ দেয়া প্রয়োজন। বিগত বাজেটে অর্থমন্ত্রী মানুষের গড় আয়ু ২০২১ সালের মধ্যে ৭০ এর কোঠায় উন্নীত করার আশা ব্যাক্ত করেছেন। এর জন্য চিকিৎসা ব্যবস্থার চাইতে রোগ প্রতিরোধ ব্যাবস্থাকে গুরুত্ব দিতে হবে। মানুষকে রোগ প্রতিরোধের মাধ্যমে রোগ মুক্ত রাখা গেলে তার আয়ু বাড়ানো সম্ভব হবে। তবে এর জন্য সরকারকে বাজেটে রোগ প্রতিরোধ করার জন্য আলাদা অর্থ বরাদ্দ দেওয়া প্রয়োজন।

সাধারণত যে মাপকাঠিতে দরিদ্রতা নিরূপন করা হয়, দরিদ্রতা তার চেয়ে আরো ভয়ংকর। তথাকথিত অর্থনৈতিক মাপকাঠিতে মধ্যবিত্ত বা উচ্চমধ্যবিত্ত শ্রেণী বলে যাদের চিহ্নিত করা হয় বতর্মান চিকিৎসা বণিজ্যের নিকট তারাও দরিদ্র। দেশের অনেক পরিবার আছে যারা চিকিৎসা করাতে গিয়ে সর্বস্বান্ত হচ্ছে। পত্র-পত্রিকার পাতা খুললেই চোখে পড়ে চিকিৎসার সহযোগিতা পাবার আকুতি। অনেক মানুষ আছে লজ্জায় তাদের সমস্যা বলতে পারে না। হাসপাতালগুলোর সামনে গেলেই দেখা যায় এ মানুষগুলোর ভোগান্তি। ঘরের মুরগি, গরু, চাল বা অন্য পণ্য অথবা উপকরণ বিক্রি করে কিংবা ধার করে চিকিৎসা করাতে এসেছে মানুষ। দেশের অনেক সাধারণ মানুষ চিকিৎসকদের নিকট চিকিৎসা না করিয়ে ঝাড়-ফুঁক বা অন্য কোন ভ্রান্ত চিকিৎসা পদ্ধতি গ্রহণ করছে। যদি স্বাস্থ্য ব্যয় এভাবে বৃদ্ধি পায় তবে মানুষ উপায় না দেখে ভ্রান্ত চিকিৎসার দ্বারস্ত হবে।

আমরা সুস্থ্যভাবে বাচঁতে চাই। আমাদের রোগের জন্য চিকিৎসা চাই। অর্থনৈতিক উন্নয়নের উম্মাদনায় অপ্রয়োজনীয়খাতে অর্থ ব্যয় না করে জনস্বার্থে সরাসরি ব্যয় করা হোক। আমরা রাষ্ট্রীয় স্বাস্থ্যসেবা চাই। স্বাস্থ্যসেবার নামে আমাদের শরীরকে বানিজ্যি পন্য রূপান্তর করা হোক তা চাই না। আমরা এমন একটি দেশ গড়তে চাই, যে দেশ হবে পৃথিবীর অন্যতম দেশ হিশেবে পরিচিত হবে, যেখানে রাষ্ট্র জনগণের স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করে। স্বাস্থ্য যেখানে মানবাধিকার হিসেবে প্রতিষ্ঠিত। স্বাস্থ্য বাণিজ্য কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ করা হয়, রোগপ্রতিরোধ এ দেশের স্বাস্থ্যনীতির মূলভিত্তি। পৃথিবী আমাদের নিকট হতে শিখবে স্বাস্থ্যসেবা কিভাবে নিশ্চিত করা যায়।

তথ্যসুত্র
১. বেসরকারী খাতের চিকিৎসা ব্যবস্থা, শীর্ষক মতবিনিময় সভা, স্বাস্থ্য অধিকার আন্দোলন জাতীয় কমিটি
২. বেসরকারী হাসপাতালে কম খরচে পেতে সেবা আইন করার চিন্তা সংসদীয় কমিটির, ২৮ মার্চ ২০১০, আরটিএনএন ডটনেট,
৩. দীর্ঘমেয়াদী অসংক্রামক রোগ ও বাংলাদেশ: একটি তথ্যচিত্র, এন,সি,ডি, স্বাস্থ্য অধিদপ্তর, স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা
৪. সর্বজনীন স্বাস্থ্যসেবা রাষ্ট্রের দায়িত্ব, ১৩ জুন, ২০০৯, ডা. মুশতাক হোসেন, সাধারণ সম্পাদক, বাংলাদেশ চিকিৎসা সংসদ।
৫. একটি গণমুখী স্বাস্থ্যনীতির ল্েয, স্বাস্থ্য আন্দোলনের পর্যালোচনা, উবেনীগ
৬. স্বাস্থ্য অধিকার, বছর ১, মার্চ, ২০১০ স্বাস্থ্য আন্দোলন
৭. মাহফুজ কবীর, বাংলাদেশে স্বাস্থ্য, দারিদ্র ও সরকারী ব্যয়, বাংলাদেশ উন্নয়ন সমীা, একবিংশতিতম খন্ড বার্ষিক সংখ্যা ১৪১০
৮. তেল আমদানতে আইডিবি ১৪ হাজার কোটি টাকার ঋণ দিচ্ছে, আমাদের অর্থনীতি, ৩১ ডিসেম্বর ২০১০
৯. আজিমপুর মাতৃসদন: টাকা না দিলে নার্স আয়ারা সন্তান দিতে চায় না; বাংলাবাজার পত্রিকা, মঙ্গলবার, ১ জুলাই ২০০৮।
১০. ৮ বছরে বেসরকারি চিকিৎসালয়ের আয় বেড়েছে ৫৩৬ শতাংশ, নয়া দিগন্ত, শুক্রবার, ২৬ জুন ২০০৯।
১১. বেসরকারি চিকিৎসকদের স্বেচ্ছাচারিতা কিনিকগুলোয় প্রতারনা বাণিজ্য, ডেসটিনি, সোমবার, ২৪ মার্চ ২০০৮।
১২. উপযুক্ত কারণ ছাড়াই ৬০ ভাগ রোগীকে এন্টিবায়োটিক দেয়া হয় হাসপাতালে, আমার দেশ, শনিবার, ২১ মার্চ ২০০৯।
১৩. ভুল চিকিৎসার শিকার অনেক শিশু: নেই মনিটরিং, আমার দেশ, শনিবার, ৪ এপ্রিল, ২০০৯।
১৪. চিকিৎসা সেবায় অনুকরনীয় মিটফোর্ড হাসপাতাল, ডেসটিনি, বৃহস্পতিবার, ৯ এপ্রিল ২০০৯।
১৫. পরীার নামে রোগীদের গলা কাটছে প্রাইভেট ডায়াগনস্টিক সেন্টারগুলো, সোমবার, ১৩ এপ্রিল ২০০৯।
১৬. ল্যাবএইড হাসপাতালে আধুনিক চিকিৎসা হলেও ব্যয় বেশি, কর্তৃপরে দাবি অন্য দেশের চেয়ে অর্ধেক, ইত্তেফাক, বুধবার, ২ এপ্রিল, ২০০৮।
১৭. প্র্ইাভেট মেডিকেলে ভর্তি অনিয়ম ঠেকাতে হার্ডলাইনে সরকার, সমকাল, ৮ ডিসেম্বর ২০০৯।
১৮. ঢামেক হাসপাতালে বছরে দশ লাখ রোগীর চাপ, যুগান্তর শুক্রবার, ২৩ জানুয়ারি ২০০৯।
১৯. স্বাস্থ্য খাতে জেঁকে বসেছে বেহিসাবি অনিয়ম। সমকাল, বুধবার, ২১ জানুয়ারি ২০০৯।
২০. চিলমারী ও শাহাজাদপুরের চর এলাকার স্বাস্থ্য সেবার চিত্র, রোকেয়া বেগম, উবিনীগ।
২১. জাতীয় স্বাস্থ্যনীতি পুনগঠনে জনগণের প্রত্যাশা, শশাঙ্ক বরণ রায়, স্বাস্থ্য অধিকার আন্দোলন জাতীয় কমিটি।
২২. স্বাস্থ্য সেবা কোনদিকে ছুটছে, ফরিদা আখতার।
২৩. জাতীয় স্বাস্থ্য বাজেট: প্রোপট-স্বাস্থ্য অধিকার; ডাঃ মোঃ আব্দুল মতিন সদস্য, বাংলাদেশ স্বাস্থ্য অধিকার আন্দোলন
ও সাধারন সম্পাদক, বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা)
২৪. বিপন্ন স্বাস্থ্য ব্যবস্থা, সেবার জন্য আর কত অপো, ডা. মোরশেদ চৌধুরী, সাপ্তাহিক ২০০০।
২৫. সরকারী স্বাস্থ্য সেবার নমুনা, প্রতিবেদন, সাপ্তাহিক ২০০০
২৬. ওষুধের দাম লাগাম ছাড়া, সাপ্তাহিক ২০০০
২৭. জাতীয় বাজেট এবং বাংলাদেশের স্বাস্থ্য খাত, সশাসনের জন্য প্রচারাভিজান (সুপ্র) আয়োজিত ২০০৭-০৮ অর্থবছরের বাজেট পর্যালোচনার জন্য রচনা উপকরন।
২৮. বেসরকারি চিকিৎসা প্রতিষ্ঠানে সরকারের নিয়ত্রণ নেই। দৈনিক জনকণ্ঠ, শনিবার, ৩১ জুলাই ২০১০
২৯. স্বাস্থ্য সুযোগ নয়, অধিকার, স্বাস্থ্যসেবার বেসরকারিকরণ ও বাণিজ্যিকীকরণ বন্ধ করতে হবে। স্বাস্থ্যসেবা চিত্র এবং স্বাস্থ্যনীতি ২০০৯ শীর্ষক জাতীয় মতবিনিময় সভায় আলোচনাপত্র, ২২ ডিসেম্বর ২০০৯।
৩০. খসড়া জাতীয় স্বাস্থ্যনীতি ২০০৯, সুশাসনের জন্য প্রচারাভিযান- সুপ্র’র সুপারিশ ও মতামত।
৩১. স্বাস্থ্যসেবা প্রাপ্তির অধিকার সকলের, সুশাসনের জন্য প্রচারাভিযান- সুপ্র, ৭ এপ্রিল, ২০০৯।
৩২. বেসরকারি খাতের চিকিৎসাব্যবস্থা, স্বাস্থ্য অধিকার আন্দোলন জাতীয় কমিটি।
৩৩. রাষ্ট্রীয় হাসপাতাল বেসরকারীকরণ: জনস্বাস্থ্যের উপর প্রভাব, ২৯ মার্চ, ২০০৮, স্বাস্থ্য অধিকার জোট।
৩৪. স্বাস্থ্যনীতিতে স্বাস্থ্যকে বানিজ্য নয়, সেবা হিসেবে বিবেচনা করতে হবে, স্বাস্থ্য পন্য নয়, মানবাধিকার, সৈয়দ মাহবুবুর আলম, উন্নয়ন কর্মী।
৩৫. স্বাস্থ্য অধিকার জোট, ২৭ জুলাই ২০০৮।
৩৬. স্বাস্থ্য সেবা বেসরকারীকরণ, সমস্যা না উত্তরণ; ২৭ জুলাই ২০০৮, স্বাস্থ্য অধিকার জোট।
৩৭. উপজেলা পর্যায়ে স্বাস্থ্য ব্যবস্থা ও ভুল চিকিৎসার খতিয়ান, উবিনীগ
৩৮. আশংকাজনক হারে রোগ বিস্তারঃ রোগ প্রতিরোধে স্বাস্থ্যনীতি, সৈয়দ মাহবুবুল আলম, কামরুন্নিছা মুন্না, ডাব্লিউবিবি ট্রাস্ট।
৩৯. জাতীয় শিা ও স্বাস্থ্যনীতি এবং দারিদ্র বিমোচন কৌশলপত্রের পোপটে যাযাবর বেদে সমাজের উন্নয়ণ, এ কে এম মাকসুদ, সৌদ খান, গ্রাম বাংলা উন্নয়ন কমিটি।

শনিবার, ১ জানুয়ারী, ২০১১

ধূমপানমুক্তকরণ কর্মসূচীর উদ্বোধন



বিশ্ব তামাকমুক্ত দিবস ৩১ মে ২০১০ উপলে
ধূমপানমুক্তকরণ কর্মসূচীর উদ্বোধন, রমনা মডেল থানা
বাংলাদেশ তামাক বিরোধী জোট

তামাকজাত দ্রব্য বিশ্বে প্রতিরোধযোগ্য মৃত্যুর অন্যতম প্রধান কারণ। তামাকের কারণে প্রতিবছর বাংলাদেশে ৫৭ হাজার মানুষ মারা যায়, ৩ ল ৮২ হাজার মানুষ পঙ্গুত্ব বরণ করে। তামাকের ভয়াবহ তিকর দিক সম্পর্কে সচেতন করতে প্রতিবছর পালন করা হয় বিশ্ব তামাকমুক্ত দিবস। ১৯৮৭ সাল থেকে বিশ্বব্যাপী এ দিবসটি পালন করা হচ্ছে।

প্রতিবছরের মতো এ বছরও বিশ্ব তামাকমুক্ত দিবস উদযাপন হতে যাচ্ছে। এ বছরের বিশ্ব তামাকমুক্ত দিবসের প্রতিপাদ্য হচ্ছে "এবহফবৎ ধহফ ঃড়নধপপড় রিঃয ধহ বসঢ়যধংরং ড়হ সধৎশবঃরহম ঃড় ড়িসবহ". বাংলায় ’’তামাকের আগ্রাসী বিজ্ঞাপন মহিলা ও শিশু জন্য হুমকি’’। ’’প্রতিদিনই হোক তামাকমুক্ত দিন’’। তামাকজাত দ্রব্যের তিকর দিক বিবেচনায় বাংলাদেশ সরকার ধূমপান ও তামাকজাত দ্রব্য ব্যবহার (নিয়ন্ত্রণ) আইন প্রণয়ন করেছে। এ আইনে পাবলিক প্লেস ও পরিবহনে ধূমপান নিষিদ্ধ করা হয়েছে। বিড়ি-সিগােেটর ধোঁয়া অধূমপায়ীদের জন্য তিকর। পরো তি হতে জনসাধারণকে রায় এ আইনের কার্যকর বাস্তবায়ন জরুরি।

আইনের বাস্তবায়ন হচ্ছে না বলে অনেকেই অভিমত ব্যক্ত করেন। আইনের প্রকাশ্যে ধূমপান নিষিদ্ধ এ ধরনের বিভ্রান্তির কারণেও অনেকে আইন বাস্তবায়নের বিষয়ে নেতিবাচক ধারণা পোষণ করে থাকেন। আইনের কোথাও প্রকাশ্যে ধূমপান নিষিদ্ধ করা হয়নি, বরং সুনির্দিষ্ট পাবলিক প্লেস ও পরিবহনে ধূমপান নিষিদ্ধ করা হয়েছে। জনসচেতনতা বৃদ্ধির ল্েয পাবলিক প্লেস ও পরিবহনে ধূমপান নিষিদ্ধ সংক্রান্ত বিষয়ে সচেতনতা বৃদ্ধি করা প্রয়োজন।

এষড়নধষ অফঁষঃ ঞড়নধপপড় ঝঁৎাবু (এঅঞঝ) এবং ওঞঈ ইধহমষধফবংয ঘধঃরড়হধষ জবঢ়ড়ৎঃ ড়হ ঊাধষঁধঃরড়হ ড়ভ ঞড়নধপপড় ঈড়হঃৎড়ষ চড়ষরপরবং রহ ইধহমষধফবংয ২০০৯ বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় তামাক নিয়ন্ত্রণ আইন বাস্তবায়নে অগগতি হয়েছে। তামাক নিয়ন্ত্রণ আইন সম্পর্কে মানুষের মাঝে সচেতনতা বৃদ্ধি পেয়েছে। পাবলিক প্লেস ও পরিবহনে ধূমপান হ্রাস পেয়েছে, দেশের অনেক প্রতিষ্ঠানে ধূমপানমুক্ত সাইন স্থাপন হচ্ছে। প্রিণ্ট ও ইলেকট্রনিক্স মিডিয়ায় বিজ্ঞাপন বন্ধ হয়েছে, সিগারেটের প্যাকেটে লিখিত বানী প্রচার হচ্ছে, যা নিঃসন্দেহে আইন প্রণয়নের ফলাফল। এ অর্জন সরকার, তামাক নিয়ন্ত্রণ সংগঠন ও গণমাধ্যমের সম্মিল্লিত প্রয়াস।

দেশের থানাগুলো প্রতিটি এলাকায় একটি গুরুত্বপূর্ণ পাবলিক প্লেস। প্রতিদিন এখানে প্রচুর জনসাধারণ বিভিন্ন কার্যক্রমের জন্য এসে থাকে। এছাড়া পুলিশ বাহিনীর সদস্যগণকে সাধারন মানুষ আইন বাস্তবায়নের প্রতীক হিসেবে মনে করে থাকেন। পাবলিক প্লেস হিসেবে থানা ধূমপানমুক্তকরণ উদ্যোগ একটি গুরুত্বপূর্ণ পদপে। দেশের থানাগুলো ধূমপানমুক্ত করার মাধ্যমে আইন বাস্তবায়ন এবং ধূমপানমুক্ত স্থান বিষয়ে জনমনে ইতিবাচক প্রভাব ফেলবে। থানা ধূমপানমুক্ত করার মাধ্যমে তামাক নিয়ন্ত্রণ আইন বাস্তবায়নের যে উদ্যোগ গ্রহণ করলেন মাননীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী এডভোকেট সাহারা খাতুন এমপি, তা বাংলাদেশের তামাক নিয়ন্ত্রণে ইতিহাস হয়ে থাকবে। বাংলাদেশ পুলিশ বাহিনী, ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ এবং বাংলাদেশ তামাক বিরোধী জোট এ ইতিহাস এর গর্বিত অংশীদার।

বাংলাদেশ পুলিশ বাহিনী দেশের আইন শৃঙ্খলা রার্থে অকান্ত পরিশ্রম করে যাচ্ছে। এর মাঝেও পুলিশ বাহিনীর অনেক ইতিবাচক দিক রয়েছে। তামাক নিয়ন্ত্রণ আইন বাস্তবায়নে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও বাংলাদেশ পুলিশ ইতোপূর্বে অনেক ইতিবাচক উদ্যোগ গ্রহণ করেছিল। গত ১৪ এপ্রিল অর্থাৎ পহেলা বৈশাখ উপলে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ জনস্বার্থে নববর্ষের জনসমাগমস্থলকে ধূমপানমুক্ত ঘোষণা করেন। ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের উদ্যোগ দেশের জন্য একটি ইতিবাচক পদপে। এ পদেেপর পর দেশের বিভিন্ন জেলা, উপজেলাও নববর্ষের মেলা/ অনুষ্ঠান ধূমপানমুক্ত করার উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়। আজকে রমনা মডেল থানা ধূমপানমুক্ত করনের মাধ্যমে যে উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে। আমরা আশা করি তা দেশের অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের জন্য অনুকরণীয় ও দৃষ্টান্ত হবে।

তামাক নিয়ন্ত্রণ আইন বাস্তবায়নে পুলিশের মতা প্রদান করার কথা বলা হলেও আইনটি বাস্তবায়নের ল্েয পুলিশের মতা খুবই সীমিত। আইনের ধারা ১৪ (ক) অনুসারে যেহেতু একটি আমলযোগ্য অপরাধ যে জন্য পুলিশ কর্মকর্তা কোন ব্যক্তিকে আইনের আওতায় আটক বা ধূমপানমুক্ত স্থান হতে বহিষ্কার করতে পারে। কিন্তু জরিমানা আদায় বা আরোপের মতা পুলিশের নেই। শুধুমাত্র মোবাইল কোর্টের মাধ্যমেই এ আইন বাস্তবায়নে জরিমানা আদায় করা হয়। অপরদিকে বিদ্যমান মেট্রোপলিটন পুলিশ আইনগুলোতে ধূমপানমুক্ত এলাকা সাইন থাকা স্বত্বেও, এ সংক্রান্ত ধারাভঙ্গের প্রেেিত ১০০-৩০০ টাকা জরিমানা বিধান রয়েছে। কিন্তু এই ধারা অনুসারেও সরাসরি পুলিশ কর্মকর্তা জরিমানা আদায় করতে পারেন না।

পাবলিক প্লেস বা পরিবহনে ধূমপানের কারণে কোন ব্যক্তিকে আটক করে ম্যাজিট্রেট এর নিকট প্রেরণ এবং জরিমানা করা একটি দীর্ঘ প্রক্রিয়া। আমাদের একটি বিষয় বিবেচনা করা প্রয়োজন ধূমপায়ীরা অপরাধী নয়, বরং তারা আসক্তির শিকার। আমাদের ল্য তাদের এ আসক্তি হতে মুক্ত করা। সামাজিক ও মানবিক কারণে পাবলিক প্লেস বা পরিবহনের ধূমপানের কারণে এ দীর্ঘ প্রক্রিয়ায় একজনকে আটক করে বিচারের সম্মুখীন করার অনেকের নিকটই গ্রহণ যোগ্য নয় এবং সাী উপস্থাপনসহ নানাবিধ কারণে এটি একটি জটিল প্রক্রিয়া।

পাবলিক প্লেস এ ধূমপান যখনই সংঘটিত হয়, ঠিক তৎনাৎ আইনটি প্রয়োগ তথা জরিমানা করা প্রয়োজন। আর এ েেত্র আইন প্রয়োগ বা জরিমানা আদায়ের মতাপ্রাপ্ত কর্মকর্তার পরিধি সংখ্যা আরো বৃদ্ধি করা প্রয়োজন। পুলিশ সদস্যগণ নিরাপত্তা নিশ্চিতসহ দায়িত্ব পালনের বিভিন্ন কারণে দেশের প্রায় সকল পাবলিক প্লেস ও পরিবহনের অবস্থান অপোকৃত বেশি। এেেত্র পুলিশ কর্মকর্তাদের পাবলিক প্লেস ও পরিবহনের ধূমপানের প্রেেিত জরিমানা আদায়ের মতা আইন মতা প্রদান করা হলে আইনের বাস্তবায়ন অনেক সহজতর হবে। ভারতে বাস চালক, স্কুল শিককে পাবলিক প্লেস ও পরিবহনে ধূমপানমুক্ত সংক্রান্ত ধারাভঙ্গের প্রেেিত জরিমানা আদায়ের মতা প্রদান করা হয়েছে। পৃথিবীর অনেক দেশেই পুলিশকে এধরনের আইন বাস্তবায়নে সরাসরি মতা প্রদান করা হয়েছে।

সিগারেটের ধোঁয়া অধূমপায়ীদের জন্যও তিকর। অধূমপায়ী বিশেষ করে মহিলা ও শিশুদের ধূমপানের ধোঁয়া হতে রায় পাবলিক প্লেস ও পরিবহনের ধূমপান নিষিদ্ধ সংক্রান্ত ধারা কার্যকর বাস্তবায়ন করা প্রয়োজন। এ ধারাটি বাস্তবায়নের করার সম্ভব হলে দেশে ধুমপায়ীর মাত্রাও কাঙ্খিত মাত্রা হ্রাস করা সম্ভব।

আমাদের সুপারিশ
১. রমনা মডেল থানার মতো দেশের সকল থানা ও পুলিশের অন্যান্য অফিসগুলোতে ধূমপানমুক্ত সাইন স্থাপন।

২. পুলিশ বাহিনীর সকল সদস্যদের তামাক নিয়ন্ত্রণ আইন প্রশিন কারিকুলামে সম্পৃক্তকরণ ।

৩. পাবলিক প্লেস ও পরিবহনে ধূমপানমুক্ত সংক্রান্ত ধারাটি বাস্তবায়নের ল্েয মেট্রোপলিটন আইন ও তামাক নিয়ন্ত্রণ আইনে পুলিশসহ সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের জরিমানা আরোপোর মতা প্রদান করা।

৪. জরিমানা আরোপের জন্য স্ট্যাম্প ব্যবস্থা প্রর্বতন করা, যাতে সহজেই পুলিশ কর্মকর্তারা জরিমানা আরোপ করতে পারে। এ ব্যবস্থার মাধ্যমে জবাবদিহিতা ও আইনের বাস্তবায়ন সহজ হবে।

৫. পুলিশ সদস্যগণ জনগনের নিকট আইন প্রয়োগের প্রতীক। তাই পোষাক পরিহিত ও কর্তব্যরত অবস্থায় পাবলিক প্লেসগুলোতে পুলিশ সদস্যদের ধূমপান হতে বিরত রাখতে প্রয়োজনীয় পদপে গ্রহণ করা দরকার।

পরিশেষে আমি আজকের মহতী এ অনুষ্ঠানের সম্মানিত প্রধান অতিথি, মাননীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী এডভোকেট সাহারা খাতুন এমপি, মাননীয় সংসদ সদস্য জনাব আসাদ্জ্জুামান খান, মাননীয় সংসদ সদস্য জনাব আসমা জেরীন ঝুমু, সম্মানিত আইজিপি জনাব নূর মোহাম্মদ, ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ এর কমিশনার জনাব এ কে এম শহীদুল হক, উপ-পুলিশ কমিশনার কৃষ্ণ পদ রায় এবং বাংলাদেশ পুলিশ, গণমাধ্যম কর্মী ও সুধীবৃন্দÑআপনাদের সকলকে বাংলাদেশ তামাক বিরোধী জোটের প থেকে শুভেচ্ছা জানাই।

মূল প্রবন্ধ উপস্থাপনকারী-
সৈয়দ মাহবুবুল আলম, এল এল বি
সম্পাদক, বাংলাদেশ তামাক বিরোধী জোট

বিশ্ব তামাকমুক্ত দিবস ৩১ মে ২০১০ “প্রতিদিনই হোক তামাকমুক্ত দিন’’

বিশ্ব তামাকমুক্ত দিবস ৩১ মে ২০১০
“প্রতিদিনই হোক তামাকমুক্ত দিন’’

প্রতিবছরের মতো এ বছরও উদযাপিত হতে যাচ্ছে বিশ্ব তামাকমুক্ত দিবস। এ বছর বিশ্ব তামাকমুক্ত দিবসের প্রতিপাদ্য "এবহফবৎ ধহফ ঃড়নধপপড় রিঃয ধহ বসঢ়যধংরং ড়হ সধৎশবঃরহম ঃড় ড়িসবহ". বাংলায় “তামাকের আগ্রাসী বিপনন মহিলা ও শিশু স্বাস্থ্যের জন্য হুমকি’’। ’’প্রতিদিনই হোক তামাকমুক্ত দিন’’।

বাংলাদেশে ৪৩.৩ % প্রাপ্ত বয়স্ক মানুষ কোন না কোনভাবে তামাক ব্যবহার করে। ধোঁয়াবিহীন তামাক ব্যবহার নারীদের মাঝে বেশি। নারীদের মাঝে ২৮% এবং পুরুষদের মাঝে ২৬% ধোয়াবিহীন তামাক ব্যবহার করেন। এছাড়া ৪৫% পুরুষ এবং ১.৫% নারী সিগারেটের মাধ্যমে এবং ২১% পুরুষ ও ১.১% নারী বিড়ির মাধ্যমে ধূমপান করেন। বাংলাদেশে ৪৯০০০ হেক্টর জমিতে তামাক চাষ হচ্ছে। তামাকজাত দ্রব্যের ব্যবহারের কারণে বাংলাদেশে প্রতিবছর ৫৭,০০০ লোক মারা যায় এবং ৩৮২০০০ লোক পঙ্গুত্ব বরণ করছে। তামাকের ফলে বাংলাদেশের অর্থনীতিতে তির পরিমান ৫০০০ কোটি টাকা।

উপরের তথ্যগুলো বিশ্লেষণ করলে সহজেই অনুমান করা যায় তামাক ব্যবহার আমাদের মানুষের স্বাস্থ্য, অর্থনীতি ও পরিবেশের জন্য তিকর। জনস্বাস্থ্যের উন্নয়নের ল্েয তামাক নিয়ন্ত্রণ প্রয়োজন। তামাক নিয়ন্ত্রণের জন্য বাংলাদেশ সরকার কতিপয় পদপে গ্রহণ করেছে। এ সকল কার্যক্রমের মধ্যে ধূমপান ও তামাকজাত দ্রব্য ব্যবহার (নিয়ন্ত্রণ) আইন ২০০৫ প্রণয়ন অন্যতম।

তামাকজাত দ্রব্যের ব্যবহার হ্রাস একটি জটিল প্রক্রিয়া। তামাক কোম্পানির মতো স্বার্থনেষী ব্যবসায়িক গোষ্ঠীকে নিয়ন্ত্রণের পাশাপাশি, ধূমপায়ীদের অভ্যাসের পরিবর্তন এবং অধূমপায়ীদের রা করার একটি কঠিন ও সময় সাপে কাজ। এ কাজের জন্য একটি নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত অপো করার পাশাপাশি ক্রমাগতভাবে তামাক নিয়ন্ত্রণের কার্যক্রম পরিচালনা করতে হবে।

কিছু নীতি বিষয়ক কাজ আছে, যার মাধ্যমে তামাক নিয়ন্ত্রণ কার্যক্রম গতিশীল করা হয়। যেমন তামাক নিয়ন্ত্রণ আইনের ধূমপানমুক্ত স্থানের উদ্দেশ্য হচ্ছে পরো ধূমপানের তি হতে অধূমপায়ীকে রা এবং ধূমপায়ীকে যতবেশী সময় ধূমপান হতে বিরত রাখা । বিজ্ঞাপন নিষিদ্ধ সংক্রান্ত ধারার উদ্দেশ্য হচ্ছে নতুন তরুনদের ধূমপানে উদ্বুদ্ধ হতে বিরত রাখা এবং বিদ্যমান ধূমপায়ীদের সাথে কোম্পানির উদ্বুদ্ধকরণ কার্যক্রমে যোগাযোগ বিঘিœত করা। মোড়কে ছবিসহ সতর্কবানীর উদ্দেশ্য হচ্ছে ধূমপায়ীদের তামাকের তিকর দিক সম্পর্কে সরাসরি সচেতন করা। সর্বোপরি তামাকজাত দ্রব্যের উপর কর বৃদ্ধির উদ্দেশ্য হচ্ছে দাম বৃদ্ধির মাধ্যমে ধূমপায়ীদের ধূমপান ত্যাগে সহযোগিতা করা।

তামাক নিয়ন্ত্রণ আইন বাস্তবায়ন:
ধূমপান ও তামাকজাত দ্রব্য ব্যবহার (নিয়ন্ত্রণ) আইন ২০০৫ বিষয়ে আলোচনার শুরুতে এ আইনের বাস্তবায়ন হচ্ছে না বলে কেহ কেহ অভিমত ব্যক্ত করেন। কিন্তু এষড়নধষ অফঁষঃ ঞড়নধপপড় ঝঁৎাবু এবং ওঞঈ ইধহমষধফবংয ঘধঃরড়হধষ জবঢ়ড়ৎঃ ড়হ ঊাধষঁধঃরড়হ ড়ভ ঞড়নধপপড় ঈড়হঃৎড়ষ চড়ষরপরবং রহ ইধহমষধফবংয ২০০৯ বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় তামাক নিয়ন্ত্রণ আইন বাস্তবায়নে অগ্রগতি হয়েছে। মানুষের মাঝে সচেতনতা বৃদ্ধি, পাবলিক প্লেস ও পরিবহনে ধূমপান হ্রাস পেয়েছে, দেশের অনেক প্রতিষ্ঠানে ধূমপানমুক্ত সাইন স্থাপনসহ ধূমপানমুক্ত স্থান সংরতি হচ্ছে। প্রিণ্ট ও ইলেকট্রনিক্স মিডিয়ায় বিজ্ঞাপন বন্ধ হয়েছে, সিগারেটের প্যাকেটে লিখিত সর্তক বানী প্রচার হচ্ছে, যা নিঃসন্দেহে আইন প্রণয়নের ফলাফল। এ অর্জন সরকার, তামাক নিয়ন্ত্রণ সংগঠন ও গণমাধ্যমের সম্মিল্লিত প্রয়াস।

তবু বলা যেতে পারে আইনের অগ্রগতি প্রত্যাশিত মাত্রায় নয়। এখনো আইন অনুসারে সকল পাবলিক প্লেস ও পরিবহন ধূমপানমুক্ত নয়। এসকল স্থানে ধূমপানমুক্ত সাইন স্থাপনও সম্ভব হয়নি। তামাক কোম্পানিগুলো আইন লঙ্ঘন করে পরো বিজ্ঞাপন প্রচার করছে, কিছু কোম্পানি প্যাকেটের গায়ে আইন অনুসারে সতর্কবাণী প্রচার করছে না, তামাক চাষের বিকল্প ফসলের সুবিধা নিশ্চিত করা যায়নি এবং তামাক ব্যবহার ও শিল্প স্থাপনে নিরুৎসাহিত করতে নীতিমালা বা কোন ধরনের পদপে গ্রহণ করা সম্ভব হয়নি।



তামাক নিয়ন্ত্রণ আইন সংশোধন :
তামাক নিয়ন্ত্রণ আইন সংশোধন এখন সময়ের দাবি। আইনের সীমাবদ্ধতার কারণেও অনেক েেত্র আইনটি সুফল জনগনের নিকট তুলে দেওয়া যাচ্ছে না। আশার কথা হচ্ছে সরকার তামাক নিয়ন্ত্রণ আইনটি উন্নয়নের ল্েয একটি কমিটি গঠন করেছে। উক্ত কমিটি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের মতামতের উপর ভিত্তি করে ইতিমধ্যে মন্ত্রণালয়ে একটি খসড়া প্রস্তাবনা পেশ করেছে। উক্ত খসড়া প্রস্তাবনার বিষয়ে পুনরায় সকলের নিকট মতামত আহবান করা হয়েছে। আমরা আশা করি সরকার এফসিটিসি-র আলোকে আগামী ঈড়হভবৎবহপব ড়ভ ঃযব চধৎঃু (ঈঙচ) -র সভার পূর্বে আইনটি সংশোধন করবে।

তামাক নিয়ন্ত্রণ আইন উন্নয়ন বিষয়ে বিভিন্ন আলোচনার প্রেেিত তামাক নিয়ন্ত্রণ কর্মীরা পাবলিক প্লেস ও পরিবহনে ধূমপানের স্থান সংক্রান্ত বিধান বাতিল করা; সকল তামাকজাত দ্রব্যকে আইনের আওতায় নিয়ে আসা; প্রত্য ও পরো তামাকজাত দ্রব্যের বিজ্ঞাপন নিষিদ্ধ, তামাকজাত দ্রব্যের মোড়কে ৫০ শতাংশ জায়গা জুড়ে তিকর দিক তুলে ধরে সচিত্র স্বাস্থ্য সতর্কবানী প্রদান; সামাজিক দায়বদ্ধতার নামে তামাক কোম্পানির লগো ব্যবহার করে প্রমোশনাল কার্যক্রম নিষিদ্ধ; তামাকজাত দ্রব্যের মোড়ক বা কৌটার অনুরূপ বা সাদৃশ্যে অন্য কোন প্রকার দ্রব্যের ব্যবহার নিষিদ্ধ করা; তামাক কোম্পানিগুলোর বিরুদ্ধে যে কোন নাগরিককে মামলা করার অধিকার প্রদান; আইনভঙ্গের প্রেেিত তামাক কোম্পানিগুলোর জরিমানা ও শাস্তির পরিমান বৃদ্ধি; তামাকের বিকল্প চাষ ও কর বৃদ্ধির জন্য নীতিমালা প্রণয়ন, তামাক কোম্পানিগুলো হতে স্বাস্থ্যকর (ঐবধষঃয ঞধী) নামে কর আদায়, কর্তৃত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা পরিধি বৃদ্ধি এবং ধূমপানমুক্ত স্থান তৈরির করতে ব্যর্থ হলে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপরে শাস্তির ব্যবস্থা গ্রহণের বিষয়গুলো আইনে যুক্ত করার সুপারিশ করেন।

তামাকজাত দ্রব্যের উপর কর বৃদ্ধি:
দেশীয় ও আন্তর্জাতিক গবেষণায় দেখা যায় তামাক ব্যবহার হ্রাসে তামাকজাত দ্রব্যের উপর কর বৃদ্ধি একটি কার্যকর উপায়। তামাক নিয়ন্ত্রণ চুক্তি এফসিটিসি অনুসারে তামাকজাত দ্রব্যের উপর বৃদ্ধির ল্েয সরকারী পর্যায়ে পদপে গ্রহণ করা প্রয়োজন। অথচ বিগত কয়েক বছরে তামাকজাত দ্রব্যের উপর মুদ্রাস্ফীতি অনুসারে কর বৃদ্ধির কোন পদপে গ্রহণ করা হয়নি। বরং অন্যান্য নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যের তুলনায় তামাকজাত দ্রব্যের মূল্য হ্রাস পেয়েছে। সস্তায় তামাকজাত দ্রব্য প্রাপ্তির প্রেেিত তামাকের ব্যবহার দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। বিগত বছরে সরকার তামাকজাত দ্রব্যের উপর কর বৃদ্ধির পদপে গ্রহণ করলেও কোম্পানিগুলোর ভ্রান্ত প্রচারণার কারণে তামাকজাত দ্রব্যের উপর কর বৃদ্ধি করা সম্ভব হয়নি।

তামাক কোম্পানিগুলো কর বৃদ্ধি হলে রাজস্ব এবং কর্মসংস্থান হ্রাস পাবে বলে কর বৃদ্ধির বিরোধীতা করে থাকে। গবেষণায় দেখা যায়, কর বৃদ্ধি হলে তামাক ব্যবহার হ্রাস পেলেও দাম বৃদ্ধির প্রেেিত সরকারের রাজস্ব বৃদ্ধি পাবে। বিশ্ব ব্যাংকের এক গবেষণায় দেখা যায়, বাংলাদেশ তামাক নিয়ন্ত্রণ হলে ১৮.৭% চাকুরি বৃদ্ধি পাবে।

তামাকজাত দ্রব্যের উপর কর বৃদ্ধির মাধ্যমে আদায়কৃত অতিরিক্ত রাজস্ব সরকার প্রয়োজনে দরিদ্র লোকদের বিকল্প কর্মসংস্থানের জন্য ব্যয় করতে পারে। তামাককের উপর কর বৃদ্ধির ফলে সরকার তিনভাবে লাভবান হবে, প্রথমত রাজস্ব বৃদ্ধি পাবে, দ্বিতীয়ত জনস্বাস্থ্য উন্নয়ন হবে, তৃতীয় তামাক হতে আদায়কৃত রাজস্ব তামাক শ্রমিকদের বিকল্প কর্মসংস্থানে ব্যয় করা সম্ভব হবে।

প্রায়ইশ কোম্পানিগুলো অনেক টাকা রাজস্ব দেয় বলে নিজেদের জাহির করতে চায়। আমাদের একটি কথা স্মরণ রাখা প্রয়োজন কোম্পানিগুলো মূলত জনগণের কাছ থেকে সংগৃহীত ভ্যাট রাজস্ব খাতে জমা দেয়, ভ্যাট পুরোটাই জনগনের টাকা। মাত্র ১৫% ভ্যাটের টাকা রাজস্ব খাতে দিয়ে, জনগন ও সরকারের উপর রোগ ও অসুস্থ্যতার বোঝা চাপিয়ে কি পরিমান অর্থ লাভ হিসেবে নিয়ে যাচ্ছে তা সহজেই অনুমেয়। আমরা আশা করি জনস্বাস্থ্য, পরিবেশ ও স্বাস্থ্য সম্মত কর্মসংস্থান ও অর্থনৈতিক উন্নয়নের কথা মাথায় রেখে এ বাজেটে সরকার সকল ধরনের তামাকজাত দ্রব্যের উপর কর বৃদ্ধির প্রয়োজনীয় পদপে গ্রহণ করবে।

খাদ্যের জমিতে, তামাক চাষ- আমাদের শংকা:
এ বছর বাংলাদেশে তামাক চাষ আংশকাজনকভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। সম্প্রতি বাংলাদেশ ব্যাংক এক নির্দেশনায় তামাক চাষ ও তামাক উৎপাদন প্রক্রিয়ায় কোন প্রকার আর্থিক সাহায্য না করার জন্য দেশের সব সরকারি-বেসরকারি ব্যাংক-কে নির্দেশনা জারি করে । তামাক চাষ নিরুৎসাহিত করতে বাংলাদেশ ব্যাংক এর এই নির্দেশনা দেশের জনস্বাস্থ্য, পরিবেশ, অর্থনীতি উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে বলে আমাদের বিশ্বাস। তামাক কোম্পানিগুলো বিভিন্ন মিথ্যা প্রলোভনের মাধ্যমে চাষীদের তামাক চাষের জন্য উদ্বুদ্ধ করছে।

অধিক জনসংখ্যার সীমিত ভুখন্ডের এ দেশ। খাদ্যের জমিতে তামাক চাষ দেশের খাদ্য নিরাপত্তা, পরিবেশ, জনস্বাস্থ্যকে হুমকির মুখে ফেলছে। পাশাপাশি তামাক চাষ দরিদ্রতা ও পুষ্টি ঘাটতি বৃদ্ধির জন্য দায়ী। তামাক পাতা শুকানোর জন্য প্রতিবছর দেশের বনাঞ্চল ধবংস হয়ে যাচ্ছে, বিনষ্ট হচ্ছে পরিবেশ। গবেষনায় দেখা যায় তামাক চাষের সময়ে স্কুলে বাচ্চাদের উপস্থিতির হার কমে যায়।

তামাক চাষে অনেক শ্রমের প্রয়োজন এবং প্রক্রিয়াটি অনেক কঠিন। তামাক চাষের সঙ্গে সম্পৃক্তদের হাঁপানিসহ শ্বাস ও চর্মজনিত রোগের বিস্তার ল্য করা যায়। এছাড়া মারত্মক বার্জাজ ডিজিজ এর মত ভয়াবহ রোগও ল্য করা যাচ্ছে। তামাক চাষের কারণে জমির উর্বরতা শক্তি কমে যায় এবং ১০ বছর পর সে জমি সম্পূর্ণভাবে চাষ অনুপযোগী হয়ে পড়ে। এসব দিক বিবেচনায় নিয়ে তামাক চাষ নিয়ন্ত্রণে আরো কঠোর কার্যক্রম দরকার।

জাতীয়, জেলা ও উপজেলা ধূমপান ও তামাকজাত দ্রব্য ব্যবহার (নিয়ন্ত্রণ) টাস্কফোর্স
তামাক আইন বাস্তবায়নসহ বিভিন্ন কার্যক্রম পরিচালনার জন্য সরকার জাতীয়, জেলা ও উপজেলা ধূমপান ও তামাকজাত দ্রব্য ব্যবহার (নিয়ন্ত্রণ) টাস্কফোর্স গঠণ করেছে। প্রশাসন, মিডিয়া ও তামাক বিরোধী সংগঠনের প্রতিনিধিদের নিয়ে গঠিত এ কমিটি তামাক নিয়ন্ত্রণে একটি শক্তি কেন্দ্র। কিন্তু নানা সীমাবদ্ধতার কারণে জাতীয়, জেলা ও উপজেলা ধূমপান ও তামাকজাত দ্রব্য ব্যবহার (নিয়ন্ত্রণ) টাস্কফোর্স-র সভায় নিয়মিত অনুষ্ঠিত হচ্ছে না এবং কার্যক্রমও গ্রহণ করা সম্ভব হচ্ছে না।

তথাপিও দেশের অনেক স্থানের টাস্কফোর্স তামাক নিয়ন্ত্রণ আইন বাস্তবায়নে অনেক অনুকরণীয় সিদ্ধান্ত ও পদপে গ্রহণ করেছে। তামাক নিয়ন্ত্রণ টাস্কফোর্সকে প্রশিন, উপকরণসহ নানা সুবিধা প্রদাণ এবং এর মাধ্যমে মনিটরিং-র কার্যক্রম নিশ্চিত করা সম্ভব হলে স্থানীয় পর্যায়ে তামাক নিয়ন্ত্রণ কার্যক্রম আরো গতিশীল হবে।

অভিজ্ঞতায় দেখা যায় টাস্কফোর্স সদস্যদের কার্যালয় ও অধিনস্ত্য প্রতিষ্ঠান ধূমপানমুক্তকরণ, সদস্যদের উদ্যোগে মোবাইল কোর্ট পরিচালনা, তামাক বিরোধী সচেতনতামূলক কার্যক্রম, টাস্কফোর্সের সভা তামাক নিয়ন্ত্রণ আইন বাস্তবায়ন কার্যক্রমকে গতিশীল করার পাশাপাশি টাস্কফোর্সের কার্যক্রম সম্পর্কে জনগণের মধ্যে ইতিবাচক প্রভাব ফেলে।

৬. তামাক নিয়ন্ত্রণ বিষয়ক দতা বৃদ্ধি ও সচেতনতা
তামাক নিয়ন্ত্রণের বিভিন্ন ব্যক্তি ও সংগঠনের দতা বৃদ্ধির ল্েয বিভিন্ন সংগঠনের উদ্যোগ দতা বৃদ্ধির পদপে গ্রহণ করা হচ্ছে। তামাক বিরোধী সংগঠন, স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন, এনজিও, সিবিও, সিভিল সোসাইটি ও গনমাধ্যমের কর্মীদের তামাক নিয়ন্ত্রণ বিষয়ে দতা বৃদ্ধির ল্েয বিভিন্ন সংগঠন কাজ করছে। বিগত বছরে সরকারীভাবে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ও দি ইউনিয়নের সহযোগিতায় তামাক নিয়ন্ত্রণ আইন বাস্তবায়নের সাথে জড়িত সরকারী কর্মকর্তাদের দতা বৃদ্ধির ল্েয কর্মশালা আয়োজন করা হয়। তবে এ ধরনের কর্মশালা আরো বৃদ্ধি করা প্রয়োজন বলে বিভিন্ন কর্মশালা ও সেমিনারে অভিমত ব্যক্ত করা হয়।

তামাক নিয়ন্ত্রণ আইন পালণ ও তামাকজাত দ্রব্যের তিকর দিক বিষয়ে সরকারীভাবেও সচেতনতামূলক কার্যক্রম গ্রহণ করা হয়। সরকারের সহযোগি স্বেচ্ছাসেবী তামাক নিয়ন্ত্রণ সংগঠনগুলো এেেত্র সক্রিয়ভাবে তামাক বিরোধী সচেতনতামূলক কার্যক্রম পরিচালনা করে আসছে। এর মধ্যে বিলবোর্ড, সাইনবোর্ড, পোষ্টার, স্টিকার, লিফলেট, ভ্রাম্যমান গানের দল, পথ নাটক, বিভিন্ন ক্যাম্পেইন অন্যতম। তবে জনসংখ্যার অনুপাতে এ সকল কার্যক্রম খুবই অপ্রতুল। সরকাররের এেেত্র সক্রিয়ভাবে এগিয়ে আসা প্রয়োজন। তামাক নিয়ন্ত্রণ বিষয়ক দতা ও সচেতনতা বৃদ্ধির েেত্র সরকারী ও স্বেচ্ছাসেবী তামাক নিয়ন্ত্রণ সংগঠনগুলো মাঝে আরো বেশি সমন্বয় সাধন জরুরি।

পরিশিষ্ট: তামাক নিয়ন্ত্রণে বাংলাদেশের অর্জন অনেকখানি। কিন্তু তামাক কোম্পানিগুলো প্রতিনিয়ত দেশের এই অর্জনকে বাধাগ্রস্ত করতে অব্যাহত প্রয়াশ চালাচ্ছে। তামাক নিয়ন্ত্রণ ও তামাক বিরোধী সংগঠনগুলো বিষয়ে নেতিবাচক প্রচারণা তাদের এ সকল কার্যক্রমের অন্যতম হাতিয়ার। কোম্পানিগুলো ব্যবসার স্বার্থে নানাভাবেই দেশের তামাক বিরোধী কার্যক্রমকে বাধাগ্রস্ত করতে চাচ্ছে।

তামাক কোম্পানি তাদের মুনাফার উদ্দেশ্যে মানুষকে রোগ ও মৃত্যুর দিকে ঢেলে দিচ্ছে, অপর দিকে তামাক নিয়ন্ত্রণ কর্মীদের উদ্দেশ্য মানুষের স্বাস্থ্যকে রা করা। মানুষের স্বাস্থ্য অপো অর্থ কখনোই মুখ্য হতে পারে না। সরকার, প্রশাসন, তামাক নিয়ন্ত্রণ সংগঠন, গণমাধ্যমকর্মীদের পারস্পরিক সহযোগিতা ও সম্মিলিত পদপে কোম্পানির অশুভ উদ্দেশ্য প্রতিহত করে জনগনের স্বাস্থ্যকে রা করবে এ আমাদের বিশ্বাস।

বিশ্ব তামাকমুক্ত দিবসে তামাক নিয়ন্ত্রণ কার্যক্রম গতিশীল করতে সুপারিশ:
১. তামাক নিয়ন্ত্রণ আইন বাস্তবায়নের মনিটরিং জোরদার, মোবাইল কোর্ট পরিচালনা, ধূমপানমুক্ত সাইন স্থাপন;
২. টাস্কফোর্স সদস্যদের কার্যালয় ও অধিনস্ত্য প্রতিষ্ঠান ধূমপানমুক্তকরণ,
৩. এফসিটিসি-র আলোকে তামাক নিয়ন্ত্রণ আইন সংশোধনের দ্রুত পদপে গ্রহণ, স্থানীয় পর্যায়ে জনমত সৃষ্টি করা;
৪. বিড়ি-সিগারেটসহ সকল তামাকজাত দ্রব্যের উপর উচ্চহারে কর বৃদ্ধি করা। কর বৃদ্ধির অর্থে দরিদ্র বিড়ি শ্রমিকদের কর্মসংস্থানের এবং তামাকজনিতর রোগের চিকিৎসায় ব্যয় করা;
৫. পরিবেশ, অর্থ, স্বাস্থ্য রায় তামাক চাষ নিয়ন্ত্রণে দ্রুত পদপে গ্রহণ;
৬. আইন বাস্তবায়নের সাথে সম্পৃক্ত প্রশাসনের কর্মকর্তাদের দতা বৃদ্ধির ল্েয পদপে গ্রহণ;
৭. তামাক বিরোধী সচেতনতামূলক কার্যক্রম বৃদ্ধির ল্েয সরকারীভাবে উদ্যোগ গ্রহণ;
৮. সরকারীভাবে নিয়মিত গণমাধ্যমকে তামাক নিয়ন্ত্রণ বিষয়ক কার্যক্রম বিষয় তথ্য প্রদানের প্রক্রিয়া তৈরি;
৯. জেলা ও উপজেলা তামাক নিয়ন্ত্রণ টাস্কফোর্স-র প্রশিন, উপকরণসহ নানা সুবিধা ও মনিটরিং নিশ্চিত করা;
১০. সরকার, স্থানীয় সরকার, দেশীয় দাতা গোষ্ঠীগুলোর সহযোগিতায় স্থানীয় পর্যায়ে তামাক নিয়ন্ত্রণ কার্যক্রম পরিচালনার সুযোগ সৃষ্টির জন্য প্রয়োজনীয় পদপে গ্রহণ;

পরিবেশের উপর তামাকের তিকর প্রভাব

পরিবেশের উপর তামাকের তিকর প্রভাব

তামাকের তিকর প্রভাবের কথা আসলেই আমারা স্বাস্থ, অর্থনৈতিক তি নিয়ে বলি কিন্তু এর কৃষি, পরিবেশগত দিক তেমন গুরুত্ব পায় না। তামাক শুধুমাত্র স্বাস্থ, অর্থনৈতিক তিই করছে না এর পরিবেশগত তিও মারাত্বক। যা মানবজাতি, জীব বৈচিত্র্যের অস্তিত্বকে ধ্বংসের দিকে নিয়ে যাচ্ছে। আমাদের নিজেদের অস্তিত্বের স্বার্থেই পরিবেশগত তি বিবেচনা করে তা সমাধানে তামাক নিয়ন্ত্রণে এগিয়ে আসতে হবে।

মানুষের বেঁচে থাকার অন্যতম প্রয়োজন খাদ্য। অথচ তামাক চাষের জন্য বেছে নেয়া হচ্ছে খাদ্য উৎপাদনের জমি এবং উৎপাদিত তামাক শুকানোর জন্য বন ধবংস করে গাছ কেটে জ্বালানী হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে। এক সমীায় দেখা যায়, প্রতিবছর তামাক উৎপাদনের কারনে ২ ল হেক্টর বন ধবংস হচ্ছে। তামাক শুকানোর জন্য গাছ কাটার ফলে চট্টগ্রামের পাহড়ী এলাকায় বনাঞ্চল ধবংশ হচ্ছে। এক একর জমিতে যে পরিমান তামাক উৎপন্ন হয় এটি শুকানোর জন্য প্রয়োজন প্রায় ৬ টন কাঠ। এভাবে তামাক শুকানোর কাজে বন ধবংশ করার কারইে এবং এর থেকে উৎপন্ন ধোয়ার ফলে বিলীন হয়ে পড়ছে জীববৈচিত্র্য। বন কেটে উজাড় করার কারনে নষ্ট হয়ে যাচ্ছে মাটি ধারন মতা ফলে আমাদের ভূমি ধসের সম্মুখীন হতে হচ্ছে। প্রতিনিয়ত বদলে যাচ্ছে প্রকৃতি তথা জলবায়ু এবং আমরা সম্মুখীন হচ্ছি প্রাকৃতিক দূর্যোগের।

তামাক চাষে শুধু গাছ কেটেই পরিবেশ ধ্বংশ করা হচ্ছে না। এর বিরূপ প্রভাব পড়ছে পানির উপরও। তামাক চাষে প্রচুর পানির প্রয়োজন হয়। তাই পার্বত্য এলাকায় তামাক কোম্পানীগুলো চাষের ল্েয নদীর ঢালকে বেছে নেয়। পাহাড়ী এলাকায় নদীগুলো ঐ এলাকার মানুষের অন্যতম পানির উৎস। তামাক চাষে প্রচুর পরিমাণে কীটনাশক এবং রাসায়নিক পদার্থ ব্যবহারের ফলে তা স্থানীয় পানির প্রবাহকে দূষিত করে। গৃহস্থালীর কাজে দূষিত পানি ব্যবহার করার ফলে তারা বিভিন্ন জটিল স্বাস্থ্য সমস্যার সম্মুখীন হচ্ছে এবং দেখা দিচ্ছে সুপেয় পানির অভাব। দূষিত পানির ফলে শুধুমাত্র মানব জাতিই নয় পানির নিচে বসবাসরত জীব বৈচিত্রও হুমকীর সম্মুখীন হচ্ছে।

তাছাড়া উর্বরতা বৃদ্ধির এবং পোকামাকড়ের আক্রমন থেকে রা করার ল্েয ব্যবহূত প্রচুর পরিমাণ সার ও কীটনাশক জমি থেকে গড়িয়ে নদীর পানিতে গিয়ে মেশে। আবার তামাক শুকানোর পর গাছ, খড় বা কুড়া পোড়ানোর ছাই নদী, পুকুরে ফেলে দেয়। ফলে পুকুরের জলজ প্রাণী বিশেষ করে মাছ তিগ্রস্থ হচ্ছে। তিগ্রস্থ হচেছ এদের প্রজনন মতার। বর্তমানে আমাদের অনেক প্রজাতীর দেশীয় মাছ, জলজ প্রাণী বিপন্ন হয়ে গেছে এবং আরো কিছু মাছ এবং জলজ প্রাণী বিপন্ন হওয়ার পথে।

তামাক গাছ মাটির পুষ্টি দ্রুত শেষ করে ফেলে। ফলে েেত প্রতিবার চাষের জমিতে দামী রাসায়নিক সার ব্যবহার করতে হয়। এক হিসাবে দেখা গেছে প্রতি একর জমিতে তামাক চাষের জন্য ৩০০ কিঃ গ্রাঃ সার ব্যবহার করা হয়। এতে সাময়ীকভাবে মাটির উর্বরতা বৃদ্ধি পেলেও ধীরে ধীরে মাটির উর্বরতার জন্য প্রয়োজনীয় উপাদান যেমন পটাসিয়াম, ফসফরাস, নাইট্রোজেন ইত্যাদির পরিমাণ কমে যায় এবং মাটির উর্বরতা নষ্ট হয়ে যায়। তাছাড়া যেসব দেশে পাহাড়ী অঞ্চলে তামাক চাষ করা হয়, সেসব এলাকাতে মাটির রাসায়নিক পদর্থগুলো কমে যাবার কারণে ভূমি ধবংস দেখা দেয়। তাছাড়া সিগারেটের পিছনের অংশ, প্যাকেট এবং কার্টুন নষ্ট করতে গিয়ে বিভিন্ন বর্জ্য তৈরি হচ্ছে। শুধু তাই নয় তামাক ব্যবহারের কারনে প্রচুর অগ্লিকান্ড সংগঠিত হয়। যা আমাদের অর্থনৈতিক তি ছাড়াও প্রাণ হানীর কারণ যা অপূরনীয়।

আমাদের অস্তিত্ব রার স্বার্থে এখনই তামাকের ব্যবহার নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। খাদ্য উৎপাদনের যে জমি তামাক চাষের জন্য ব্যবহার করা হচ্ছে তা বন্ধ করতে তামাক চাষের তিকর প্রভাব সম্পর্কে কৃষকদের সচেতনতার পাশাপাশি বিকল্প ফসল উৎপাদনে সহযোগিতা প্রদান করতে হবে। পরিবেশ রার সার্থে তামাক শুকানোর জন্য বন ও গাছ কাটা বন্ধ করতে হবে। কোন একক ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের পে এত বড় কাজ সম্পন্ন করা সম্ভব নয়, প্রয়োজন সকলের সম্মিলিত উদ্যোগ।