বুধবার, ৮ সেপ্টেম্বর, ২০১০

যাতায়ত পরিকল্পনায় পথচারীদের স্থান নেই


যাতায়ত পরিকল্পনায় পথচারীদের স্থান নেই

রাস্তা পথচারীদের জন্য চলাচলের জন্য। অধিকাংশ মানুষ যে মাধ্যমে চলাচল করে যে মাধ্যমকেই অগ্রাধিকার প্রধান করা উচিত। কিন্তু আমাদের দেশের অধিকাংশ মানুষের সুবিধাকে উপক্ষো করে প্রধান্য দেওয়া হয় ধনীদের যানবাহন চলাচলকে। গুটি কয়েক মানুষের সুবিধা নিশ্চিত করে গিয়ে এক দিকে যেমন সৃষ্টি হচ্ছে যানজট, অপর দিক অধিকাংশ মানুষ স্বীকার হচ্ছে দুর্ভোর্গের। গবেষনায় দেখা যায় ঢাকা শহরের ৭৬% শতাংশ মানুষ ৫ কিলোমিটারে মধ্যে চলাচল করে, তার অর্ধেক হেটে চলাচল করে। কিন্তু ঢাকা শহরের মানুষের হাঁটার অবস্থা কি তা সকলের জানা। পেডিট্রাইন ফার্ট পলিসি বলা হলেও আসলে বাস্তবিক পলিসি হচ্ছে ব্যবসা ও ধনীদের জন্য। আর তাই কোটি কোটি টাকার খচরের পরও যানজট অস্বাভাবিক বৃদ্ধি পাচ্ছে। নতুন নতুন প্রকল্প আসছে, সমস্যার সমাধান না হলেও ঋণ প্রদানগোষ্টীর অব্যাহত ঋণের ব্যবসাও কিছু লোকের ব্যবসা হবে তা সুনিশ্চিত। প্রতিটি মানুষকে যাতায়াতের জন্য কিছুটা হাঁটতে হয়। নিম্নবিত্ত বা দরিদ্র মানুষের জন্য হাঁটাই একমাত্র প্রধান মাধ্যম। হাঁটার ক্ষেত্রে অনেকগুলো প্রতিবন্ধকতা থাকলেও, আজকের হাঁটার ক্ষেত্রে ফুটওভার ব্রিজের ভূমিকা কতটুকু তা তুলে ধরছি।

ঢাকা শহরের পথচারীদের জন্য উন্নতব্যবস্থার কথা বললেই, একটি বিষয় বেশ জোরশোরে উচ্চারিত হয় তা হল ফুটওভার ব্রিজ। নগর পরিকল্পনাবিদ ও আইন প্রয়োগকারী সংস্থাসহ বিভিন্ন মহলের অভিযোগ রয়েছে, পথচারীরা ফুটওভার ব্রিজ ব্যবহার করে না। ঋণ প্রদানকারীসংস্থাগুলো ঋণ নিয়ে ঢাকা শহরে অনেক ফুটওভার ব্রিজ তৈরি হয়েছে। পথচারীরা পথপারপারের জন্য ব্যবহার করেনি, ব্যবহার হয়েছে অসামাজিক কাজ ও মলমুত্র ত্যাগের জন্য। আবার টাকা খরচ করে এগুলো তুলে নেয়া হয়েছে। জনগনের টাকা খরচ করে এ ভাঙ্গা গড়ার খেলা একটি উদ্দেশ্য তা হলো ব্যবসা। আর অপর উদ্দেশ্য বুঝতে বেশ সময় লেগেছে তা হলো গাড়ীকে নির্ভিগ্নে চলাচলের সুযোগ করে দেওয়া।

তবে বিস্ময়ের বিষয় হচ্ছে মানুষ এগুলো ব্যবহার না করলেও পরিকল্পনাবিদরা এগুলো গড়ার জন্য কেন অব্যাহত পরামর্শ প্রদান করে আসছে। এগুলো কেন পথচারীরা ব্যবহার করে না তা একবারও ভেবে দেখা হয় না। সম্প্রতি আরো ফুটওভার ব্রিজ করার পরিকল্পনা করা হয়েছে। বিগত সময়ে ঢাকা শহরের উপর নিচে অনেক ধরনের যাতায়াতের ব্যবস্থা হয়েছে। কিন্তু কাজে আসেনি কোনটি। মানুষ উপর দিয়েই চলাচল করে। কিছু স্থানে পুলিশের মাধ্যমে মানুষকে ফুটওভার ব্রিজে উঠানো হচ্ছে, তারপরও মানুষ সুযোগ পেলেই উঠে না। কর্তৃপক্ষ ও পরিকল্পনকারীদের অব্যাহত অভিযোগ মানুষ ফুটওভার ব্রিজে উঠে না? আমরা প্রশ্ন কেন উঠবে? যারা পরিকল্পনা করেন তা কি এগুলো নিয়মিত ব্যবহার করেছেন? পরীক্ষা করে দেখেছেন এগুলো ব্যবহারে প্রতিবন্ধকতা কোথায়? এগুলো ব্যবহারের কত পরিমান কষ্ট হয়? দেখেনি বলেই আপনারা এ ধরনের একটি অমানবিক বিষয়কে চাপিয়ে দিতে চান। অপর দিকে যেহেতু ফুটওভার ব্রিজ মানুষের সহজাত বৈশিষ্ট্য এর সাথে সঙ্গতিপূর্ণ নয়, তাই মানুষ ফুটওভার ব্রিজ ব্যবহারে করে না। একবার কি ভেবে দেখেছেন একজন বৃদ্ধ মানুষ, হৃদরোগী, শিশু, গর্ভবতী মহিলার পক্ষে কি সক্ষম এ পর্বত অতিক্রম করা? একজন অসুস্থ্য রোগে কি পারবে এই পর্বত অতিক্রম করতে? হুইল চেয়ারে বাস একজন ব্যক্তি কিভাবে এই পর্বত অতিক্রম করবে?

যখন ফুটওভার ব্রিজ দিয়ে পথচারীদের পারাপারের পরিকল্পনা করা হয়, তখন নিশ্চিতই এই বিষয়গুলো চিন্তা করা হয় না। যদি চিন্তা করা হতো, তবে প্যাডিট্রাইন ফার্ষ্ট পলিসির নামে মানুষকে পর্বত অতিক্রমের জন্য চাপ প্রদানের কথা আসতো না। ধরুন একজন মানুষকে ঢাকা সিটি কলেজ হতে নীলক্ষেত এবং নিউমার্কেট হয়ে আবার ঢাকা কলেজ আসতে হবে। এই পথ অত্রিক্রম করতে তাঁকে দুটি ওভারব্রিজে উঠতে হবে। যদি তার হতে মালামাল থাকে, তবে তার শারীরিক অবস্থা কি হবে তা কি ভেবে দেখেছেন। একজন মানুষ যখন হাটে তখন এমনিতেই তাকে অনেক পরিশ্রম করতে হয়, তার উপর যদি তাকে এ ধরনের পর্বত অতিক্রম করতে হয়, তবে এ মানুষ আর অন্য কোন কাজ করতে পারবে না। যারা ফুটওভার ব্রিজ তৈরির পরিকল্পনাও সমর্থন করেন তাদের জন্য একটি অনুরোধ, ঘরে বা গাড়ীতে বসে পরিকল্পনা না করে, নূন্যতম ১৫ দিন এই রাস্তায় একজন সাধারণ মানুষের মতো হেটে পরীক্ষা করে দেখুন, আপনি নিজে পারেন কি না? যদি পরীক্ষা পাস করতে পারেন তাহলেই পরিকল্পনার জন্য সুপারিশ করুন। তবে যদি অধিকাংশ সাধারণ মানুষ আপনাদের পরিকল্পনা বিষয়বস্তু না হয়ে থাকে এবং ধনীদের বাহন গাড়ীর যাতায়াত নিশ্চিত করতে চান, তবে আমার বক্তব্য প্রাসঙ্গিক নয়।

বাংলাদেশে অনেক লোক আর্থেপেটিক্স এ ভোগে। অনেকেই লোক হৃদরোগে আক্রান্ত। অনেক লোক শারিরীক প্রতিন্ধী। অনেক লোক আছে হাঁটা যাদের যাতায়াতের অন্যতম মাধ্যম। বলুন তো এ লোকগুলো কিভাবে এই পর্বত অতিক্রম করবে। আসলে যারা এই ফুটওভার ব্রিজের পরিকল্পনা করেন তারা হয়তো শৌখিন পথচারী। ঘরে বসে ও গাড়ীতে চড়ে পরিকল্পনা করতে করতে তারা সাধারণ মানুষের হাঁটতে কি কষ্ট হয় তা ভুলে গেছেন। সাধারণ মানুষের যাতায়াত সুবিধা নিশ্চিত করা করা তাদের মাথাব্যাথা নয়। নিশ্চিত করতে হবে গাড়ীর চলাচল। কারণ হয়তো তাদের চিন্তা হচ্ছে মানুষ হচ্ছে গাড়ীর সেবা দাস।

প্যাডিট্রাইন ফার্ষ্ট পলিসি হিসেবে, পথচারীরা অগ্রাধিকার পাবে। সে ক্ষেত্রে মানুষের হাঁটার জন্য বিভিন্ন সুবিধা নিশ্চিত করা হবে। উন্নত দেশের অভিজ্ঞতা আলোকে বলা যায়, রাস্তায় মানুষের বসার জন্য একটু বসার ব্যবস্থা থাকবে, জ্রেবা ক্রসিং থাকবে, ক্রসিং হেটে চলাচলকারী মানুষ অগ্রাধিকার পাবে। কিন্তু একি অদ্বুত নিয়ম মানুষকে পর্বত সমান ফুটওভার ব্রিজ অতিক্রম করার জন্য পরিকল্পনা করা হচ্ছে। আমি যে ব্যবস্থার কথা বলছি তা কোন অলৌকিক কিছু নয়, এগুলো বাস্তব। আমাদের ঢাকা শহরেরও অনেকগুলো জেব্র“ ক্রসিং ছিল। কিন্তু অলৌকিকভাবে যেগুলো হরিয়ে গেছে। পথচারীদের এখন খাচায় বন্ধী পশুর মতো চলাচল করতে হয়। যে সকল দেশের উদাহরণ ও উপদেশ নিয়ে আমাদের দেশের পরিকল্পনা আর মানবাধিকার নিশ্চিতের কথা বলা হয়, যে সকল দেশের পথচারীদের অবস্থা অনেক উন্নত। এশিয়ার অন্যতম গাড়ী উৎপাদনকারী দেশ জাপানেও পথচারীদের হাঁটতে নানাভাবে উৎসাহিত করা হয়।

হৃদরোগ, ডায়বেটিস, ওবেসিটিসহ বিভিন্ন অসংক্রাম রোগ প্রতিরোধে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের সরকার মানুষকে হাঁটাতে উৎসাহিত করার লক্ষ্যে নানা পদক্ষেপ গ্রহণ করছে। অথচ আমাদের দেশে মানুষকে হাঁটাতে নিরুৎসাহিত করা হচ্ছে। ২ শতাংশ মানুষের পরিবহন প্রাইভেট গাড়ীর পাকিং এবং যাতায়াতের জন্য ফ্লাইওভার ব্রিজ তৈরি করতে কর্তৃপক্ষ যতটুকু চিন্তিত ও সচেতন। ততটুকু পথচারীদের জন্য নয়। কারণ হয়তো পথচারীদের জন্য সুবিধা তৈরি করতে যে ব্যয় হবে তা খুব বেশি নয় এবং দীর্ঘস্থায়ী। প্রতিনিয়ত ব্যবসায়িক ও বিভিন্ন সুবিধা না থাকায় এ ধরনের পরিকল্পনা বর্জন করাই শ্রেয়। অথবা অধিকাংশ সাধারণ মানুষের চলাচলে সুবিধা ও দুভোর্গ লাঘবের জন্য কর্তৃপক্ষ এবং পরিকল্পনাকারীদের বাস্তবিক জ্ঞান যথেষ্ট নয়।

সংবিধান অনুসারে অগ্রসর জনগোষ্টীকে অগ্রাধিকার প্রদান এবং জনস্বাস্থ্যের উন্নয়নে রাষ্ট্রের অন্যতম দায়িত্ব। কিন্তু সরকারী সংস্থাগুলো সাধারণ মানুষের হাঁটার অধিকারকে দুরহ করে সংবিধান লঙ্গন করছে। গুটি কয়েক মানুষের সুবিধার জন্য রাস্তাকে ব্যবহার করা অসংবিধানিক ও অন্যায়। মানুষের সাভাবিক চলাচলকে ব্যহত করে কেন পরিকল্পনার বাস্তবায়ন করা সম্ভব নয়। নূন্যতম হাঁটার পর স্বাভাবিক ভাবেই কোন মানুষ এই পর্বত সমান ফুটওভার ব্রিজ অতিক্রম করতে পারে না। মানুষের শরীর ও মন এই পর্বত অতিক্রম করতে সায় দেয় না। আর এ পর্বত অতিক্রম করার পর অন্য কোন কাজ করা কঠিন। বৃদ্ধ, শিশু, গর্ভবর্তী মহিলা, অর্থোপেটিক্স রোগী, হুইল চেয়ার ব্যবহারকারী, মলামাল বহনকারী, হৃদরোগী ইত্যাদি শ্রেণীর ব্যক্তির জন্য এই পর্বত অতিক্রম শুধু কঠিনই নয় ঝুকিপূর্নও।

মানুষকে হেঁটে চলাচলের উৎসাহী করার মাধ্যমে স্বাস্থ্য, পরিবেশ, অর্থনীতিক উন্নয়ন এবং যানজট হ্রাস করা সম্ভব। তাই দাতা তথা ঋণপ্রদানকারীদের পরামর্শে এধরনের জনস্বার্থ বিরোধী কর্মকান্ড বন্ধ করে। সাধারণ মানুষের যাতায়ত ব্যবস্থার উন্নয়নে সকলকে এগিয়ে আসার আহবান জানাই। অন্যথায় যানবাহন পরিকল্পনা ঋণের অর্থদিয়ে বিগত দিনের যানজট বৃদ্ধিকারী প্রকল্প হিসেবেই এগিয়ে যাবে।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন