বুধবার, ৮ সেপ্টেম্বর, ২০১০

ইকো নগরায়ন: কিছু মৌলিক বিষয়

পরিবেশ দূষণ বর্তমানে মানুষের স্বাস্থ্য সমস্যার একটি বড় কারণ। পরিবেশ দুষণের কারণে প্রাকৃতিক বিপর্যয়সহ নানা ধরনের প্রতিবন্ধকতার সম্মুখীন হচ্ছে মানব সভ্যতা। ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে অর্থনীতি, উন্নয়ন, মানুষের বিকাশ। নগরায়ন ও শিল্পায়ন পরিবেশ দূষণের অন্যতম প্রদান কারণ। কিন্তু এ সত্য জানার পরও থেমে নেই পরিবেশ দূষণের মাত্র। দিন দিন তা বৃদ্ধি পাচ্ছে। অর্থনৈতিক উন্নয়নের অজব লক্ষে জিডিপি বৃদ্ধির উম্মদনায় ধ্বংশ করা হচ্ছে পরিবেশ, মানবতা, স্বাস্থ্য, সংস্কৃতি। জিডিপির অংক বৃদ্ধি পেলে অন্যান্য সমস্যাগুলোর সাথে বাড়ছে দারিদ্র মানুষের ভোগান্তি আর বিনষ্ট হচ্ছে সামাজিক স¤প্রতি। ধনী আরো ধনী হচ্ছে, গরীব আরো গবীর হচ্ছে। নগরগুলো হচ্ছে শোষনের আবাসস্থল। অধিকাংশ মানুষের সুবিধাকে ছিনিয়ে উন্নয়নে নামে করা হচ্ছে নগরায়ন।

শত বছরের পুরাতন এই ঢাকা নগরীতে হাজার হাজার কোটি টাকা খচর করার পরও বিজ্ঞজনের আশংকা এই নগরী মানুষের বসবাসের অযোগ্য হয়ে পড়ছে। এই নগরীর পরিবেশ দূষণ, যানজট, স্বাস্থ্য, পানি, শিক্ষা, যোগাযোগ কোন বিষয়েই পরিবেশ বান্ধব হয়নি। বরং দিন দিন খারাপ হচ্ছে। অথচ একদিন এই শহরই ছিল একটি আর্দশ নগরী। কিভাবে ধ্বংশ করা হলো সেই পরিবেশ বান্ধব নগরীকে, কেন করা হলো? কেন সমস্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে? আমাদের পরিকল্পনা মৌলিকতা কি কোন ভূল আছে? না এ প্রশ্ন খোজার চেষ্টা হয়নি। বরং একটি ভুলকে ঢাকতে আরো একটি ভূল করা হচ্ছে। সবচেয়ে ভয়কর বিষয় হচ্ছে ঢাকা নগরীর পরিকল্পনাগুলো দেশের অন্য এলাকাগুলোতেও করার চেষ্টা করা হচ্ছে। বিগত দিনের ভুলগুলো হতে শিক্ষা নিয়ে পরিবেশ, অর্থনীতি ও মানুষের স্বাস্থ্য রক্ষায় একটি পরিবেশ বান্ধব নগরী গড়ার কোন বিকল্প নেই।

উন্নত জীবনের সন্ধানে এই নগরে ছুটে আসলেও, এ নগর মানুষের উন্নত জীবনের অন্তরায়। জীবন ধারনের অন্যতম প্রধান উৎপাদন বায়ু, শব্দ, পানি দূষণ কারণের মানুষ বিভিন্ন প্রানঘাতী রোগে আক্রান্ত হচ্ছে। নগরের যাতায়াত ও অবকাঠামোর প্রতিবন্ধকতার কারণে হ্রদরোগ, স্ট্রোক, ডায়বেটিক অতিরিক্ত মোটা হওয়াসহ নানা ধরনের অসংক্রামক রোগ বৃদ্ধি পাচ্ছে। খেলাধুলা ও পর্যাপ্ত বিনোদনের অভাবের কারণে শিশু-কিশোরদের মানসিক ও শারিরীক বিকাশ বাধাগ্রস্ত হচ্ছে।

একটি শহরের পরিকল্পনা নাগরিকদের দৈনন্দিন জীবন এবং কার্যক্রমকে নানাভাবে প্রভাবিত করে। নগর পরিকল্পনা হওয়া প্রয়োজন মানুষের কথা মাথায় রেখে। একটি সুষ্ঠু সুন্দর পরিবেশবান্ধব পরিকল্পিত নগরী দক্ষ মানবগোষ্ঠী গড়ে তুলতে সহায়ক। গণমুখী টেকসই সমন্বিত নগর পলিল্পনা প্রণয়নের মাধ্যমে মানুষের জীবনযাত্রার মান যেমন উন্নত হবে, তেমনি একটি আন্তরিক, পরিবেশবান্ধব বসবাস উপযোগী শহর গড়ে তোলা সম্ভব।

আমাদের শহরগুলো হওয়া উচিত এইরূপÑযেখানে বাসস্থানের পাশাপশি প্রচুর গাছপালা থাকবে, প্রাকৃতিক পরিবেশ ক্ষতিগ্রস্থ হবে না, শিশুরা ঘরের বাইরে নিরাপদে খেলাধূলার পরিবেশ পাবে, নগরবাসী পাবে একটি সুস্থ বিনোদনের পরিবেশ, প্রতিবেশীদের মধ্যে থাকবে আন্তরিক সম্পর্ক, প্রয়োজনীয় খাদ্যের যোগানের জন্য বাসস্থানের কাছাকাছি পর্যাপ্ত কৃষি জমি থাকবে। যেখানে নগরের গতানুগতিক যান্ত্রিকতা এড়িয়ে আন্তরিকতাপূর্ণ সুন্দর জীবন উপভোগ করা সম্ভব হবে। বর্তমানে সারা বিশ্বব্যপী জলবায়ু পরিবর্তনের ব্যপক প্রভাব পড়ছে। জলবায়ু পরিবর্তন রোধে ইকো নগরায়ন অত্যন্ত কার্যকরী ভূমিকা পালন করতে পারে।

একটি পরিবেশ বান্ধব নগরের জন্য অনেকগুলো বিষয়ে মধ্যে বিনোদন, উম্মুক্ত স্থান, আবাসন, যাতায়াত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। এ পর্যায়ের আলোচনায় একটি শহরের এ বিষয়গুলো কিভাবে নিশ্চিত করা যায় তা সম্পর্কে নিম্নে সংক্ষিপ্ত আলোচনা করা হলো।

বিনোদন ও উম্মুক্ত স্থান
একে অন্যকে সাহায্য, আতিথেয়তা, বন্ধুপরাণয়তা, সুখ-দুখে এগিয়ে আসা এ দেশের সামাজিক রীতিনীতি অংশ। এ কারণে পুরো গ্রাম, মহল্লাকে আবদ্ধ হয় একটি পরিবারের অটুট বন্ধনে। উঠোন, খোলা মাঠ, বাড়ীর সামনে খোলা জায়গা, বৈঠক ঘরগুলো এদেশের মানুষকে মনের ভাব আদান প্রদান ও বিনোদনের সুযোগ করে দিত।

আমাদের অনেকেই সেই ছেলেবেলার স্মৃতিতে ভেসে উঠে সেই সুখের দিনগুলো। কিন্তু কালের আর্বতে হারিয়ে যাচ্ছে সেই সুযোগগুলো। শহর ও নগরগুলোতেও একই সমস্যা। নেই খেলাধূলা, হাঁটা, বাস, মেলামেশার জন্য পর্যাপ্ত জায়গা। ঘরে বন্দী মানুষগুলো সীমিত হচ্ছে মেলামেশার সুযোগগুলো, বাড়ছে দুরুত্ব। এ দুরুত্ব বৃদ্ধি করছে হাতাশা, একাকীত্ব, অপসংস্কৃতি, নিরাপত্তাহীনতা, অপরাধ বিনষ্ট করছে সামাজিক সম্পৃতি। মানুষের পরিপূর্ণ মানসিক বিকাশ, বিনোদন, খেলাধূলা এবং শরীরচর্চা, সামাজিক নিরাপত্তা বৃদ্ধিতে পার্ক ও পাবলিক স্পেস এর গুরুত্ব অনেক বেশি।

বিনোদন মানুষের অধিকার। মানুষের পরিপূর্ণ মানসিক বিকাশের জন্য বিনোদন, খেলাধূলা এবং শরীরচর্চার গুরুত্ব অপরিসীম। শুধুমাত্র অবকাশযাপন নয়, বিনোদনকেন্দ্রগুলো সামাজিকীকরণের জন্য আদর্শ স্থান। সর্ব সাধারনের জন্য উন্মুক্ত এসব বিনোদনকেন্দ্রগুলোতে বিভিন্ন শ্রেনীপেশার মানুষ সমবেত হয়, এর মাধ্যমে একে অন্যের সাথে পরিচিত হবার সুযোগ থাকে। ফলে বিভিন্ন মানুষের মধ্যে একটি যোগসূত্র স্থাপিত হয়। সমাজে একটি সুন্দর আদর্শ সামাজিক পরিবেশ বিরাজ করে।

শিশু-কিশোরদের খেলাধুলার সুবিধা প্রদান এবং নগরবাসীর সুস্থ সুন্দর বিনোদনের জন্য শহরগুলোতে পর্যাপ্ত বিনোদনকেন্দ্র, পার্ক, খেলার মাঠ প্রয়োজন। দিনে দিনে ঢাকা সহ ঢাকার বাইরে বিভিন্ন স্থানে মানুষের বাইরে উন্মুক্তস্থানে বিনোদন বা সামাজিক কার্যক্রমগুলোর পরিধি ক্রমশই সংকুচিত হচ্ছে। পরিকল্পনায় ঘাটতি কিংবা সীমাবদ্ধতার কারণে প্রতিনিয়তই মানুষকে এর উন্নয়ন কিংবা সুবিধা বৃদ্ধির জন্য সংগ্রাম করতে হচ্ছে। পরিকল্পনার দৈন্যতার কারণে মানুষ তার এই মৌলিক সুবিধাগুলো থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। খেলার মাঠ, পার্ক কিংবা উদ্যানের সল্পতা কিংবা আবাসিক এলাকায় প্রকৃতির অনুপস্থিতি ক্রমশই মানুষকে গৃহকেন্দ্রিক কিংবা টেলিভিশন নির্ভর করে তুলছে। ফুটপাতে হাঁটার পরিবেশের অভাব কিংবা মাঠে খেলাধুলার পরিবেশের অভাবও প্রকট আকারে পরিলক্ষিত হয়। শিশু, প্রাপ্তবয়স্ক কিংবা বৃদ্ধ বিবেচনায় উন্মুক্তস্থানের পরিকল্পনা প্রণয়ন এবং প্রয়োজনীয় সুযোগ সুবিধা নিশ্চিত করা আবশ্যক। নগর পরিকল্পনা পুরো অবকাঠামোর সাথে সমন্বয় রেখে, পরিকল্পিতভাবে জনসাধারনের জন্য গুনগতমান সম্পন্ন পর্যাপ্ত বিনোদনকেন্দ্র গড়ে তোলা প্রয়োজন।

একটি বিষয় মনে রাখতে হবে বিনোদনকেন্দ্র বলতে শুধুমাত্র বাণিজ্যিকভাবে তৈরী কিছু রাইড সম্মিলিত স্থানগুলো নির্দেশ করে না। বর্তমানে কিছু বিনোদনকেন্দ্র গড়ে উঠছে ব্যক্তিমালিকানাধীনভাবে, ফলে সর্বস্তরের জনগণের জন্য তা উন্মুক্ত হয় না। ফলে মুষ্টিমেয় কিছু মানুষ তা ব্যবহার করতে পারে, সাধারণ মানুষ বিনোদনের সুযোগ পায় না। নিরাপত্তা এবং পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতার বিষয়গুলোর প্রতি দৃষ্টি রেখে পাকর্, খেলার মাঠ এবং উন্মুক্তস্থানগুলো যেন সর্ব সাধারণের ব্যবহার জন্য উন্মুক্ত হয় সে বিষয়টি গুরুত্বের সাথে বিবেচনা করতে হবে।

উন্মুক্তস্থানের বিশেষত্ব হচ্ছে যেখানে সহজেই লোক সমাগম ঘটে এবং সেই জায়গাগুলোতে সামাজিক, সাংস্কৃতিক, বিনোদনমূলক কর্মকান্ড সংগঠিত হয়। যেখানে প্রকৃতি বর্তমান। মানুষে মানুষে যোগাযোগের সুবিধা, আড্ডা কিংবা খেলাধুলার সুবিধা বিদ্যমান। যদি উন্মুক্ত স্থানের পরিবেশে এর ঘাটতি দেখা দেয় তাহলে সেখানে মানুষের আগমন কিংবা প্রাণচাঞ্চল্য হারিয়ে যায়। মানুষের উন্মুক্তস্থানের কর্মকান্ডগুলো আকর্ষনীয় এবং অর্থবহ করে তুলতে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণের পাশাপাশি উন্মুক্ত স্থানের বরাদ্দ এবং পরিকল্পনায় পূর্বেই নজর দেয়া জরুরী।

পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে নগরবাসীর সুস্থ সুন্দর মানসিক ও শারীরিক বিকাশের কথা চিন্তা করে বিনোদন ও খেলাধূলার জন্য বিভিন্ন উদ্যোগ গৃহীত হলেও বাংলাদেশে এ ধরনের উদ্যোগ উপেক্ষিত। বাংলাদেশের বিভিন্ন শহরে বিশেষ করে ঢাকায় বিনোদনের সুযোগ খুবই সীমিত। ঢাকায় হাতে গোনা যে পার্ক ও খেলার মাঠ রয়েছে তা প্রয়োজনের তুলনায় খুবই অপ্রতুল। তবে যে কয়টি পার্ক, মাঠ রয়েছে, প্রয়োজনীয় রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে বর্তমানে এই পার্ক ও খেলার মাঠগুলোর খুবই বেহাল দশা। বর্তমানে এর সাথে যুক্ত হয়েছে অন্য এক নতুন সমস্যা, প্রতি মাসেই নগীরর কোন না কোন মাঠে মেলা বসে। এছাড়া সৌন্দর্যবর্ধনসহ বিভিন্ন অযুহাতে পার্ক, খেলার মাঠগুলো অবৈধভাবে দখল করার প্রচেষ্টা চলে। এভাবেই আরো সংকুচিত হয়ে পড়ছে নাগরিকদের বিনোদনের সুযোগ সুবিধা।

বর্তমানে সীমিত সংখ্যক পার্ক, খেলার মাঠের কারণে শিশু-কিশোররা বঞ্চিত হচ্ছে বাইরে খেলাধূলার এবং বিনোদনের সুযোগ থেকে। তাদের অবসর সময় কাটছে টিভি দেখে বা কম্পিউটারে গেমস্ খেলে, যা তাদের পরিপূর্ণ শারীরিক ও মানসিক বিকাশে বাধা সৃষ্টি করছে। এছাড়া বিনোদনের অপ্রতুল সুযোগ নাগরিকদের দৈনন্দিন কর্মব্যস্ত জীবনকে একঘেয়ে করে তুলছে। শিশু-কিশোরদের খেলাধূলার সুবিধা প্রদান, নগরবাসীর বিনোদনের জন্য শহরগুলোতে পর্যাপ্ত বিনোদনকেন্দ্র হিসেবে পার্ক, খেলার মাঠ গড়ে তোলা এবং পুরোনোগুলোর সংস্কার অত্যাবশ্যকীয়। একই সাথে নগরবাসীর শারীরিক ও মানসিক সুস্থতার কথা চিন্তা করে পায়ে হেঁটে চলাচল ও শরীরচর্চার জন্য উপযুক্ত পরিবেশ তৈরী খুবই গুরুত্বপূর্ণ।

পরিবেশ বান্ধব নগরীর আবাসন ব্যবস্থা
নগর পরিকল্পনায় সর্বপ্রথম আমাদের মনে রাখতে হবে নগর তৈরীর উদ্দেশ্য। একটি শহর গড়ে ওঠে মানুষকে উন্নত কর্মসংস্থান, শিক্ষা ও স্বাস্থ্য সেবা প্রদান, বিনোদনের সুযোগ প্রদান এবং মানুষের পাস্পরিক সম্পর্ক বৃদ্ধির মিলনকেন্দ্র হিসাবে। এই সমস্ত সুবিধাগুলো মানুষের হাতের নাগালের মধ্যেই থাকা উচিত। এই সুবিধাগুলো প্রদানের মাধ্যমেই নগরগুলোকে ধ্বংসের হাত থেকে রক্ষা করা সম্ভব।

নগরের আবাসন সংস্থান করতে গিয়েও আমরা মানুষের কল্যাণের দিকটি চরমভাবে উপেক্ষা করছি। নগরের মধ্যে এবং শহরের নিকটবর্তী স্থানে বিভিন্ন আবাসিক এলাকা গড়ে তোলার ক্ষেত্রে প্লট ভিত্তিক উন্নয়ন করায় মানুষের মধ্যে পারষ্পরিক যোগাযোগের সুযোগ কমে যাচ্ছে। এ ধরনের আবাসিক এলাকায় কাছাকাছি বাজার, শিক্ষা ও স্বাস্থ্য সেবা প্রতিষ্ঠান, অফিস না থাকায় দূরে যাওয়ার প্রয়োজন পড়ে এছাড়া বিনোদনের সুবিধা ও মানুষের মেলামেশার জন্য উন্মূক্তস্থান না থাকায় পারস্পরিক যোগাযোগ ব্যহত হয় । একইভাবে এপার্টমেন্ট ভিত্তিক যে আবাসন ব্যবস্থা গড়ে উঠছে তাতেও মানুষের সাথে মানুষের সামাজিক যোগাযোগের সুযোগ রাখা হচ্ছে না। ফলে আগে আমাদের এলাকা ভিত্তিক যে আন্তরিক পরিবেশ ছিল তা ক্রমেই নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। মানুষের সাথে মানুষের দূরত্ব বেড়ে যাচ্ছে যা সমাজের সার্বিক নিরাপত্তার জন্য হুমকি স্বরূপ।

সুষ্ঠু পরিবহণ ব্যবস্থা গড়ে তুলতে নগর ও পরিবহণ পরিকল্পনার মধ্যে সমন্বয় থাকা প্রযোজন। নগর পরিচালনার সুবিধার্থে এলাকা ভাগ করা হয়ে থাকে। সেক্ষেত্রে মিশ্র এলাকা অথবা পৃথক এলাকা কোনটি হবে তার উপর নির্ভর করে পরিবহণ ব্যবস্থা কেমন হবে। এলাকায় বাসা, স্কুল, বাজার, কর্মস্থল, হাসপাতাল ও বিনোদন অল্প দূরত্বের মধ্যে থাকায় যাতায়াতের চাহিদা হ্রাস করে। মিশ্র এলাকা নির্মাণে কিছু বিষয়ের প্রতি নজর দেওয়া প্রয়োজন। সেটি হচ্ছে মিশ্র এলাকায় কি কি থাকবে এবং কি কি থাকবে না। এছাড়া মিশ্র উন্নয়নের জন্য নির্ধারিত এলাকায় কাঙ্খিত জনসংখ্যা অনুপাতে প্রতিষ্ঠান ও সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করতে হবে। যেন কম বা বেশি কোনটিই না হয় সেদিকে লক্ষ্য রাখতে হবে। এভাবে প্রতিটি এলাকায় প্রয়োজন অনুসারে উন্নয়নের মাধ্যমে এক এলাকা থেকে অন্য এলাকায় যাতায়াতের চাহিদা বেশিরভাগই কমিয়ে আনা সম্ভব হবে ।

ঢাকা’র বেশিরভাগ এলাকার উন্নয়ন মিশ্রভাবে হয়েছে। যার জন্য বেশিরভাগ যাতায়াত অল্প দূরত্বে। গবেষণায় দেখা যায়, ঢাকার ছিয়াত্তর ভাগ যাতায়াত পাঁচ কিমি এর মধ্যে যার অর্ধেক আবার দুই কিমি এর মধ্যে। তবে ঢাকায় এই ধরণের উন্নয়ন সুপরিকল্পিত ও সুষমভাবে না হওয়ায় যানজটসহ বেশ কিছু সমস্যা দেখা দিচ্ছে। এখানে কোন এলাকায় জনসংখ্যা অনুপাতে অধিক প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছে, আবার কোন কোন এলাকায় প্রয়োজনীয় সুযোগ-সুবিধা নেই। এর জন্য বিশেষ কিছু এলাকার দিকে মানুষের বেশি বেশি যাওয়ার প্রয়োজন পড়ছে, সৃষ্টি হচ্ছে যানজট। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, সব এলাকায় ভালো স্কুল না থাকায় শিশুদের স্কুলে আনা-নেওয়ার জন্য দূরে দূরে যাতায়াত করা যানজট সৃষ্টির অন্যতম কারণ। শুধুমাত্র স্কুলে যাওয়া-আসার জন্য ব্যবহার হচ্ছে প্রচুর পরিমাণে গাড়ি। অথচ বাসা থেকে দেড়/দুই কিমি এর মধ্যে স্কুল থাকলে শিশুদের হেঁটেই নিয়ে যাওয়া সম্ভব। এতে সময় বাঁচবে, সাস্থ্য ভালো থাকবে, যাতায়াত খরচ লাগবে না। তবে ক্ষতিকর শিল্প-কারখানা মিশ্র এলাকার বাইরে রাখতে হবে।

ঢাকা মেট্রোপলিটন ডেভেলপমেন্ট প্লান (১৯৯৫-২০১৫) এর অধীনে স্ট্রাকচার প্লান এ মিশ্র এলাকা নির্মাণের দিক-নির্দেশনা রয়েছে। সেই আলোকেই ডিটেইল এরিয়া (ডিএপি) প্লান তৈরি করার নিয়ম। কিন্তু খসড়া ডিএপি-এ কার্যক্রমের ভিত্তিতে পৃথক এলাকা নির্মাণের প্রস্তাব করা হয়েছে। স্ট্রাকচার প্লান অনুসারে ডিএপি প্রণীত হলে ঢাকা শহরকে বাসযোগ্য রাখতে সহায়ক হবে। আশা করি সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ নিয়মানুসারে স্ট্রাকচার প্লান মেনে এবং যাতায়াত চাহিদা হ্রাস করতে ডিএপি-তে মিশ্র গড়ে তোলার প্রতি মনযোগী হবেন।

নগরীর পরিবহন ব্যবস্থা
যানজট শুধু ঢাকা নয়, বিশ্বের অনেক শহরেরই দীর্ঘদিনের একটি সমস্যা। ঢাকা মহানগরীর যানজট নিরসনে ইতিপূর্বে অনেক পদক্ষেপই গ্রহণ করা হয়েছে, যার কোনটির সঙ্গে কোনটির সমন্বয় করা হয় নি। ফলে কাঙ্খিত সমাধান আসেনি। যানজট নিয়ন্ত্রণ ও একটি সুষ্ঠু পরিবহণ ব্যবস্থা গড়ে তুলতে একটি সমন্বিত পরিকল্পনা জরুরী। বর্তমানে পরিবহণ ব্যবস্থার উন্নয়নে বেশ কিছু উদ্যোগ লক্ষ্যণীয়। তবে সেগুলি বাস্তবায়নের পূর্বে দেশীয় এবং বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে আরো ভালোভাবে যাচাই বাছাই করা প্রয়োজন। ঢাকা’র চলমান পদক্ষেপসমূহ বাস্তবায়নের আগে ইতিপূর্বে বাস্তবায়িত কার্যক্রমের ফলাফল বিশ্লেষন করা প্রয়োজন। এসবের সঙ্গে প্রায়োগিক ক্ষেত্রে বাস্তবমূখী ভাবনা যানজট নিয়ন্ত্রণ তথা পরিবহণ ব্যবস্থার উন্নয়নে কার্যকর ভূমিকা রাখবে।

মানুষ বনাম গাড়িকেন্দ্রিক পরিবহণ পরিকল্পনা:
ঢাকায় এ পর্যন্ত গাড়িকে কেন্দ্র করেই পরিবহণ নীতিমালা ও পরিকল্পনাসমূহ তৈরি হয়েছে। সাধারণত এ ধরনের পরিকল্পনা প্রণয়নের ক্ষেত্রে দেখা হয় একটি সড়কে কি পরিমাণ গাড়ি ধারণ করতে পারে অথবা সড়কটি দিয়ে কতগুলি গাড়ি অতিক্রম করতে পারবে। এর উপর ভিত্তি করেই কত বিনিয়োগ এবং কি ধরনের অবকাঠামো নির্মাণ করা হবে সে বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। মানুষের যাতায়াতের প্রয়োজনে গাড়ির প্রয়োজন রয়েছে। এখানে গাড়িই মূখ্য নয়।

পরিবহণ পরিকল্পনার কেন্দ্রবিন্দু হচ্ছে মানুষ। মানুষের যাতায়াতের প্রয়োজনে কোন ধরনের বাহন কি পরিমাণ ব্যবহার করা হবে সেটি পরের বিষয়। প্রথমে দেখতে কি পরিমাণ মানুষের যাতায়াতের প্রয়োজন রয়েছে। যাতায়াতের দূরত্ব কতটুকু এবং কোন মাধ্যমটি সবচেয়ে উপযোগী। উপযোগীতা নিরূপণে যাতায়াত খরচ, সময়, নিরাপত্তা, দূষণ ও জ্বালানী ব্যবহারের মতো বিষয়গুলি বিবেচনায় নিতে হবে। গাড়িকেন্দ্রিক পরিকল্পনায় হেঁটে ও জ্বালানীমুক্ত যানে চলাচলকারীরা অবহেলিত থেকে যায় এবং নানা প্রতিবন্ধকতার সম্মূখীন হয়।

ঢাকা’র পরিবহণ ব্যবস্থার উন্নয়নে চলমান পরিকল্পনা ও পদক্ষেপসমূহ পর্যালোচনা করলে দেখা যায় প্রতিনিয়ত প্রাইভেট কারকে সর্বোচ্চ প্রাধান্য দেওয়া হচ্ছে। এরপর ক্রমানুসারে বাস, রিকশা ও সাইকেল এবং হেঁটে চলাচলকারীরা সকল দিক থেকেই অবহেলা ও নানা প্রতিবন্ধকতার শিকার । অথচ এই ধরনের ব্যবস্থা থেকে সাময়িক সুবিধা পাচ্ছে দুই শতাংশ মানুষ যাদের প্রাইভেট কারের মালিকানা রয়েছে। এখানে সাময়িক সুবিধা এই অর্থে বলা হচ্ছে এই কারণে যে, আর অল্প কিছু সংখ্যক প্রাইভেট কার বৃদ্ধি পেলে বর্তমানকার সুবিধাও থাকবে না। যে সুবিধা তৈরি করা হয়েছে জ্বালানীমুক্ত যান চলাচল নিষিদ্ধ করে এবং হেঁটে ও পাবলিক পরিবহণকে উপেক্ষা করে। ফলশ্রতিতে আটানব্বই শতাংশ মানুষ যাতায়াতের ক্ষেত্রে অধিকার বঞ্চিত থেকে যাচ্ছে।

পরিবহণ পরিকল্পনায় দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন আনতে হবে। বিশ্বব্যাপী নগর পরিবহণ ব্যবস্থায় হেঁটে চলাচলকারীদের প্রাধান্য সর্বাগ্রে । ঢাকায় বেশিরভাগ পায়ে হেঁটে যাতায়াত হয়ে থাকে। আরো বেশি মানুষকে হেঁটে চলাচলে উৎসাহী করতে উপযোগী পরিবেশ সৃষ্টিতে সঠিক পরিকল্পনা, বিনিয়োগ এবং অতিদ্রুত তা বাস্তবায়নে পদক্ষেপ নেয়া প্রয়োজন। এরপর ক্রমানুসারে জ্বালানীমুক্ত যান ও পাবলিক পরিবহণের সুবিধা বৃদ্ধি এবং প্রাইভেট কারের অবস্থান থাকবে সবার শেষে। বর্তমানে ঢাকার বেলায়ও একই কথা বলা হচ্ছে। তবে তা এখন পর্যন্ত কথাবার্তার মধ্যেই সীমাবদ্ধ। এ ক্রমটি বিনিয়োগ ও পরিকল্পনার ক্ষেত্রে নিশ্চিত করা হলে গণমূখী পরিবহণ ব্যবস্থা চালুর পথটি সুগম হবে।

গণমুখী সমন্বিত পরিবহন পরিকল্পনা
আমাদের নগর পরিকল্পনায় পরিবহন ব্যবস্থা এবং তার সাথে সম্পৃক্ত আন্যান্য বিষয়গুলোকে বিবেচনা করা প্রয়োজন। আমাদের মনে রাখতে হবে মানুষের মূল উদ্দেশ্য যাতায়াত নয় বরং দ্রব্য এবং সেবা প্রাপ্তি। আমাদের পরিবহন পরিকল্পনার মূল সমস্যা এখানেই যে যাতায়াত উদ্দেশ্য বিবেচনা না করেই পরিকল্পনা করা হয়। মানুষ যদি তার প্রয়োজনীয় জিনিষগুলো হাতের কাছেই পেয়ে যায় তাহলে তার দূরে যাবার প্রয়োজন হয়না। শহরের অবকাঠমো এমনভাবে তৈরী করা প্রয়োজন যার ফলে মানুষের দূরে যাবার প্রয়োজনীয়তা অনেকাংশে হ্রাস পায়।

এখন পর্যন্ত আমাদের শহরগুলোতে কাছাকাছি বাজার, শিক্ষা ও স্বাস্থ্য সেবা প্রতিষ্ঠান, কর্মসংস্থান, বিনোদনের সুবিধা অধিকাংশ যাতায়াতই হয়ে থাকে স্বল্প দূরত্বে। আর এর জন্য হেঁটে চলা বা অযান্ত্রিক যানের ব্যবহার হয়ে থাকে সবচেয়ে বেশী । কিন্তু আমাদের নগরের পরিবহন পরিকল্পনাগুলো কখনই এই সকল গুরুত্বপূর্ণ যোগাযোগ মাধ্যমকে যথাযথ গুরুত্ব পায়নি। একই সাথে নগরের ভূমি ব্যবহার পরিকল্পনা এবং পরিবহন পরিকল্পনার মধ্যে যে ওতোপ্রোত সম্পর্ক বিদ্যমান তাও কখনও তেমন ভাবে অনুধাবন করা হয়নি।

কাছে যাতায়াতের থেকে যখন দূরের যাতায়াত বেশী সুবিধাজনক হবে মানুষ তখন দূরে যাতায়াত করতে আগ্রহী হবে। মানুষের বাসস্থান থেকে তার কর্মক্ষেত্র, বাচ্চাদের স্কুল ইত্যাদি দূরে দূরে থাকবে। উদাহরনস্বরূপ বলা যায় আজিমপুর থেকে ধানমন্ডি যাওয়ার থেকে আজিমপুর থেকে উত্তরা যাওয়া বেশী সুবিধাজনক হলে মানুষ উত্তরা থেকে আজিমপুর যেতে আগ্রহী হবে। মানুষের দূরে যাতায়াতের প্রবণতা বৃদ্ধি পেলে, যতবেশী রাস্তাঘাটই নির্মাণ করা হোক না কেন শহরের যানযট বৃদ্ধি পায়। অপরদিকে মানুষ সহজে কাছকাছি দুরত্বে যাতায়াত করার সুযোগ পেলে তার বাসস্থানের কাছাকাছি সবকিছু পেতে চেষ্টা করবে, এবং এর ফলে যানযট কমবে। ফলে একদিকে যেমন সময়ের অপচয় কম হবে অন্যদিকে মানুষের জীবন যাত্রার মান বৃদ্ধি পাবে এবং পাশাপাশি স্বল্প দূরত্বে যাতায়াতের ফলে জ্বালানীর অপচয় কম হবে এবং শব্দ ও বায়ু দূষনের হারও কমবে। একস্থান থেকে অন্যস্থানে দ্রুত এবং কমখরচে যাওয়া যাবে। যানবাহনের তুলনায় মানুষের জন্য বেশী জায়গা প্রদান করা হলে মানুষের বিনোদনের সুযোগ বৃদ্ধি পাবে।

সড়ক অবকাঠামো ও অনিয়ন্ত্রিতভাবে প্রাইভেট কারের বৃদ্ধি এবং তার প্রভাব:
ঢাকা শহরে সুষ্ঠু পরিবহণ ব্যবস্থা গড়ে তোলার জন্য কিছু সংযোগ সড়কের প্রয়োজন রয়েছে। তবে আগে দেখতে বিদ্যমান সড়ক অবকাঠামোর সর্বোচ্চ ব্যবহারের মাধ্যমে সমস্যা নিরসন করা যায় কি না। এসটিপি’র সুপারিশে সংযোগ সড়ক নির্মাণের দিক নির্দেশনা রয়েছে। যা বাস্তবায়নের পূর্বে এর প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে ভালোভাবে সমীক্ষার প্রয়োজন রয়েছে। কেউ কেউ বলে থাকেন একটি শহরে সড়কের জন্য ২৫ % জায়গা প্রয়োজন। ঢাকা শহরে সড়কের পরিমাণ ৮% হওয়ায় যানজট সৃষ্টি হচ্ছে। এই কথার যথার্থতা কতটুকু? মূলত প্রাইভেট কার নির্ভর পরিবহণ ব্যবস্থায় বেশি বেশি সড়কের প্রয়োজন পড়ে। উন্নয়নশীল এশিয়ান দেশগুলির তুলনায় আমেরিকান শহরগুলিতে প্রাইভেট গাড়ি নির্ভর যাতায়াত ব্যবস্থা হওয়ায় সড়কের পরিমাণ মাথাপিছু ১০ গুন বেশি হলেও যানজট অনেক বেশি । ৩৩% সড়ক হওয়ার পরও লসএঞ্জেলস বিশ্বের মধ্যে অন্যতম যানজটপূর্ণ শহর।

ইউরোপিয়ান অনেক শহরেই ৫-৬% সড়ক নিয়েই সুষ্ঠু পরিবহণ ব্যবস্থা গড়ে তোলা সম্ভব হয়েছে। সড়কের পরিমাণ নির্ভর করে কোন ধরনের মাধ্যমকে পরিবহণ ব্যবস্থায় প্রাধান্য দেওয়া হচ্ছে তার উপর। পাবলিক পরিবহণের উন্নয়ন ও প্রাইভেট কারের ব্যবহার নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হলে কম পরিমাণ সড়ক নিয়েও পরিবহণ ব্যবস্থার উন্নয়ন সম্ভব। ঢাকা শহরে বর্তমানে অনিয়নন্ত্রিতভাবে প্রাইভেট কারের ব্যবহার বৃদ্ধি পাচ্ছে। ফলে সড়কে সংকুলান না হওয়ায় লাগছে যানজট। কেউ কেউ বলছেন ঢাকা শহরে সড়কের পরিমাণ কম, কিন্তু প্রকৃতার্থে প্রাইভেট কারের সংখ্যা বেড়ে যাচ্ছে। শুধুমাত্র গত বছর ঢাকা শহরে ৪৮,০০০ প্রাইভেট কার যোগ হয়েছে। যানজট নিয়ন্ত্রণ ও বিদ্যমান সড়ক অবকাঠমো কাজে লাগিয়ে সুষ্ঠু পরিবহণ ব্যবস্থা গড়ে তুলতে পাবলিক বাসের মানোয়ন্নের মাধ্যমে প্রাইভেট কার নিয়ন্ত্রণ করা প্রয়োজন। পাশাপাশি রেল, নৌ-পরিবহণ, হেঁটে, সাইকেলে ও রিকশায় চলাচলের উপযোগী পরিবেশ সৃষ্টি করতে দ্রুত পদক্ষেপ নিতে হবে।

এশিয়ান শহরগুলির তুলনায় আমেরিকান শহরগুলিতে পরিবহণ খাতে জ্বালনী ব্যবহারের পরিমাণ মাথাপিছু ৮ গুণের বেশি। এছাড়া পরিবহণ থেকে কার্বণ উৎপাদনের পরিমাণ মাথাপিছু প্রায় সাড়ে ৫ গুন । আমেরিকান শহরগুলিই বিশ্বে যানজটপূর্ণ শহরগুলির শীর্ষে অবস্থান করছে। ২০০৯ সালে টেক্সাস ট্রান্সপোর্টেশন ইন্সটিটিউট এর আরবান মবিলিটি রিপোর্টে দেখা যায়, লস এঞ্জেলসে যানজটের কারণে ৪৮,৫০,২২,০০০ কর্মঘন্টা নষ্ট হয়, অতিরিক্ত জ্বালানী ব্যয় হয় ৩৬,৬৯,৬৯,০০০ গ্যালন। এর জন্য সর্বমোট প্রায় ১০,৩২৮ মিলিয়ন ডলার অপচয় হয় ।

ঢাকায় যানজটের কারণে বছরে সর্বমোট প্রায় ৭৭১ মিলিয়ন ডলার অপচয় হয়। আমরা অবশ্যই এই সমস্যা থেকে উত্তরণ চাই। তবে সমাধান হিসেবে বেশি বেশি সড়ক ও এলিভেটেড এক্সপ্রেসেওয়ের মতো অবকাঠামো নির্মান করলে উল্টো খেসারত দিতে হবে। যা আমেরিকান শহরগুলির দিকে তাকালে পরিলক্ষিত হয়। ঢাকায় ভূমির পরিমাণ খুবই সীমিত জনসংখ্যা অনেক বেশি। এখানে পরিবহণ ব্যবস্থায় প্রাইভেট কার নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। পাশাপাশি পাবলিক পরিবহণ, পথচারী, সাইকেল ও রিকশাকে প্রাধান্য প্রয়োজন। যা যানজট নিয়ন্ত্রণের সাথে সাথে দূষণ, জ্বালানীর ব্যবহার, দূর্ঘটনা, অবকাঠামো নির্মাণ ব্যয় ও যাতায়াত খরচ কমানোর ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে।

সড়কের পরিমাণ বাড়ালেই যে যানজট সমস্যার সমাধান করা যাবে না এ বিষয়টি স্পষ্ট। আমেরিকার তুলনায় এশিয়ান শহরগুলিতে জনঘনত্ব প্রায় ১২ গুন। এছাড়া পাবলিক পরিবহণ ও অযান্ত্রিক যান ব্যবহারের পরিমাণ প্রায় ৪ গুন। যে কারণে জ্বালানী ব্যবহার ও দূষণের পরিমাণ তুলনামূলকভাবে খুবই কম।

পাবলিক বাস এর সঙ্গে পথচারী ও জ্বালানীমুক্ত যানের সমন্বয় :
পরিবহণ ব্যবস্থায় মাধ্যমগুলির ক্রমনির্ধারণ করার পাশাপাশি এর মধ্যে সঠিকভাবে সমন্বয় করা প্রয়োজন। যেমন-মানুষকে বাসে চলাচলে উৎসাহী করতে সেবামান বাড়ানো এবং এর সঙ্গে অন্যান্য মাধ্যমের সমন্বিত ব্যবস্থাপনা গড়ে তুলতে হবে। বাসা থেকে বাস স্টপেজে যাওয়ার জন্য সুবিধাজনকভাবে হেঁটে, সাইকেল ও রিকশায় চলাচলে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করা প্রয়োজন। একইভাবে বাসস্টপেজ থেকে নেমে কর্মস্থলে পৌঁছানোর জন্য ব্যবহৃত মাধ্যমের উপযোগী পরিবেশ সৃষ্টি করতে হবে।

ঢাকা শহরে বাস র‌্যাপিড ট্রানজিট (বিআরটি) চালুর প্রস্তাব রয়েছে। কারো কারো মতে ঢাকায় বিআরটি চালুর জন্য সড়কের পরিমাণ অপ্রতুল। বিআরটি হচ্ছে বিশেষ বাস সার্ভিস। এই ব্যবস্থায় বাসের জন্য পৃথক লেন থাকবে। এর একটি হচ্ছে একেবারে ডিভাইডার দিয়ে লেন আলাদা করা থাকবে। অন্য কোন বাহন এই লেনে ঢুকে বাস চলাচলে প্রতিবন্ধকতা তৈরি করতে পারবে না। যেখানে শুধুমাত্র জরুরী বাহন যেমন-এ্যাম্বুলেন্স, ফায়ার সার্ভিস এর গাড়ি এবং পুলিশ ভ্যান ঢুকতে পারবে। বিআরটি লেন ডিভাইডার ছাড়াও হয়। শুধুমাত্র দাগ দিয়ে বাসের জন্য লেন বরাদ্দ দেওয়া হয়। তবে বিআরটি এর সর্বোচ্চ সুবিধা পেতে ডিভাইডার দিয়ে পৃথক লেন তৈরি করা প্রয়োজন। এসটিপি গবেষণায় দেখানো হয়েছে কিভাবে ঢাকা শহরে আট মিটার থেকে শুরু করে চল্লিশ মিটার প্রস্থের সড়কে বিআরটি করা যাবে। কত মিটার সড়কে বাসের সঙ্গে কোন কোন মাধ্যমের সমন্বয় করা হবে তা সুনির্দ্দিষ্টভাবে উল্লেখ রয়েছে। বিআরটি সঠিকভাবে করা না হলে হীতে বিপরীত হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। এই ব্যবস্থায় বাসের সঙ্গে পথচারী সাইকেল এবং রিকশার সমন্বয় এর উপর গুরুত্ব দিতে হবে। পাশাপাশি প্রাইভেট কারকে যতটা সম্ভব নিরুৎসাহিত করতে হবে। ঢাকার প্রেক্ষাপটে খুব সহজেই এই কাজটি সম্পন্ন করা সম্ভব।

আমেরিকার শহরগুলির তুলনায় উন্নয়নশীল এশিয়ান শহরগুলিতে পাবলিক পরিবহণ, হেঁটে ও জ্বালানীমুক্ত যানে অনেক বেশি চলাচল হয়ে থাকে। যে কারণে জ্বালানীর ব্যবহার এবং দূষণ তুলনামূলক অনেক কম। ঢাকায় একই অবস্থা বিদ্যমান। তবে এই সকল মাধ্যমের সমন্বয়ে সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনা গড়ে তুলতে পদক্ষেপ গ্রহণ জরুরী।

বিকেন্দ্রীকরণ
রাজধানী শহর হিসেবে ঢাকা মহানগরীর গুরুত্ব অবশ্যই অনেক বেশি। দেশের সার্বিক উন্নয়ন ও তার সুফল সর্বত্র সুষম বন্টনের লক্ষ্যে অন্যান্য শহরগুলির উন্নয়ন জরুরী। কিন্তু দেশে সব কিছুই ঢাকার মধ্যে পুঞ্জীভূত করা হচ্ছে। প্রশাসনিক-নিরাপত্তা কর্মকান্ড থেকে ব্যাবসা-বাণিজ্য, কল-কারখানা, শিক্ষা-স্বাস্থ্যসেবা, অফিস আদালত সব কিছুই ঢাকাকে কেন্দ্র করে। তাই চাকরি, ব্যবসা, ছেলেমেয়েদের পড়ালেখা, পরিবারের সুচিকিৎসা, বিনোদন এসব কিছুর আশায় মানুষ আজ ঢাকামূখী। তাছাড়া দেশে যে কোন দূর্যোগে সর্বহারা মানুষ দু-মুঠো ভাত পাবার আশায় কাজের জন্য ছুটে আসছে ঢাকা শহরে । এই অতিরিক্ত মানুষের চাপে ঢাকার জনজীবনে নানা সঙ্কট বৃদ্ধি পাচ্ছে। ধীরে ধীরে লোপ পেতে বসেছে মানুষের সকল সুযোগ-সুবিধা। কোন কোন ক্ষেত্রে পোহাতে হচ্ছে অবর্ণনীয় দূর্ভোগ। যার মধ্যে যানজট সমস্যা অন্যতম। ঢাকা শহরের উদ্ভূত যানজট পরিস্থিতি মোকাবিলায় ঢাকা শহরের সঙ্গে সঙ্গে দেশের অন্যান্য শহরগুলির উন্নয়নে জরুরী পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে।

পরিশিষ্ট
নগর পরিকল্পনায় পুরো অবকাঠামোর সাথে সমন্বয় রেখে, পরিকল্পিতভাবে বিনোদনস্থান, নাগরিক বিনোদন কেন্দ্র গড়ে তোলা জরুরী। নগর মানেই শুধু ইট, কাঠ, পাথরের বসতি বা যান্ত্রিকতা নয়। বহুমানুষের মিলনকেন্দ্রই হচ্ছে নগর। একটি নগরীর গড়ে ওঠা নগরবাসীর শারীরিক ও মানসিক বিকাশকে নানাভাবে প্রভাবিত করে। একটি সুষ্ঠু সুন্দর পরিকল্পিত নগরী, দক্ষ মানবগোষ্ঠী গড়ে তুলতে সহায়ক। পরিকল্পিত নগরী গড়ে তোলার ক্ষেত্রে বিষয়টি প্রাধান্য দেয়া হোক এটি আমাদের সকলেরই কাম্য।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন