বুধবার, ৮ সেপ্টেম্বর, ২০১০

বহুতল ভবনে অগ্নিকান্ড: প্রাসঙ্গিক ভাবনা

বহুতল ভবনে অগ্নিকান্ড: প্রাসঙ্গিক ভাবনা
বহুতল ভবনের প্রচলন এদেশে খুব বেশি দিনের না হলেও এরই মধ্যে ঢাকা শহরে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক বহুতল ভবন বিদ্যমান। প্রচলিত বিধি বিধান অনুসারে বহুতল ভবন সম্পর্কে অনেকগুলি দিক নির্দেশনা রয়েছে। বিশেষ করে অগ্নি প্রতিরোধ এবং নির্বাপণ সম্পর্কে রয়েছে মোটামুটি সুস্পষ্ট দিক নির্দেশনা। এগুলির যথাযথ বাস্তবায়ন এবং তদারকির অভাবে ঝুঁকির আশঙ্কা বেড়ে চলেছে। যার প্রমাণ মিলতে শুরু করেছে বড় বড় খেসারত দেওয়ার মধ্য দিয়ে।

গত ১৩ মার্চ রাজধানী ঢাকার বসুন্ধরা সিটি ভবনে সংঘটিত হলো ভয়াবহ অগ্নিকান্ড। সেখানে ৭ জন নিহত এবং প্রায় ৫০ জন আহত হয়েছেন। বিনষ্ট হয়েছে কোটি কোটি টাকার সম্পদ। এই আগুন নেভাতে ও সামগ্রিক পরিস্থিতি সামাল দিতে নিয়োজিত করা হয়েছিল সংশ্লিষ্ট সামরিক ও বেসামরিক সকল সংস্থাকে। কয়েক ঘন্টার জন্য এই ঘটনাকে কেন্দ্র করে ঢাকার জীবন স্থবির হয়ে পড়েছিল। আগুনের কারণে ঐদিনের সব ক্ষতিই পুষিয়ে নেওয়া সম্ভব হবে। কিন্তু প্রাণের ক্ষতিগুলো অপূরণীয়। ২০০৭ সালে বসুন্ধরা সিটি ভবনের অদূরেই বিএসইসি ভবনে সংঘটিত হয়েছিল আরেকটি ভয়াবহ অগ্নিকান্ড। আমরা এ ধরনের ঘটনার পুনরাবৃত্তি আর দেখতে চাই না।

এর জন্য বহুতল ভবনের অগ্নি নির্বাপণের জন্য ইমারত নির্মাণ বিধিমালা ও অগ্নি প্রতিরোধ ও নির্বাপণ আইন অনুযায়ী যে সকল ব্যবস্থা থাকার কথা সেগুলি নিশ্চিত করা প্রয়োজন। এছাড়া সেসব যেন যথাসময়ে ব্যবহার করা যায় তার জন্য প্রশিক্ষিত দল থাকাটাও আবশ্যক। থাকতে হবে নিয়মিত অগ্নি নির্বাপণ মহড়ার ব্যবস্থাও। কারণ সর্বশেষ অগ্নিকান্ড ঘটে যাওয়া বসুন্ধরা সিটিতে বিদ্যমান বিধি বিধান অনুসারে প্রায় সকল ব্যবস্থা থাকা সত্ত্বেও ব্যবহারিক ক্ষেত্রে দূর্বলতার জন্য মূলত কাঙ্খিত সময়ে আগুন নিয়ন্ত্রণে আনা সম্ভব হয় নি।

নতুন করে ভবন নির্মাণের ক্ষেত্রে উপরোক্ত বিষয়গুলো অবশ্যই যথাযথভাবে প্রয়োগ হওয়া প্রয়োজন। এছাড়া পুরোনো যে সকল বহুতল ভবন রয়েছে সেগুলিতে প্রয়োজনমাফিক ব্যবস্থা নেওয়া জরুরী। বহুতল ভবনে অগ্নিকান্ডের ক্ষয়ক্ষতি শুধুমাত্র এর মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকে না ছড়িয়ে পড়ে আশে পাশে। যেমনটি দেখেছি বসুন্ধরা সিটি ভবনে আগুন লাগার পর আশে-পাশের কিছু দোকান ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে।

বহুতল ভবনে অগ্নিকান্ড ছাড়াও ভূমিকম্পের ঝুঁকি প্রতিরোধ কিভাবে হবে সেটিও আমলে নিয়ে এখনই পদক্ষেপ নেওয়া প্রয়োজন। বহুতল ভবন নির্মাণের জন্য কোথায় অনুমোদন দেওয়া হচ্ছে তা সঠিকভাবে নির্ধারণ করার প্রতিও খেয়াল করতে হবে। সেক্ষেত্রে আশ পাশে জলাশয় ও যথেষ্ট পরিমাণে ফাঁকা স্থান আছে কিনা দেখতে হবে। বহুতল ভবনের অন্যান্য প্রভাব যেমন-যানজট, বিদ্যূৎ ব্যবস্থাপনা সম্পর্কেও যাচাই বাছাই করা জরুরী।

রাজধানী ঢাকায় অগ্নিঝুঁকি বাড়ছে। শুধুমাত্র বহুতল ভবনের অগ্নিকান্ড নয়, বস্তি থেকে শুরু করে বানিজ্যিক ও আবাসিক এলাকাসহ সর্বত্রই এ ধরনের দূর্ঘটনা প্রতিরোধে যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।

১.১ বহুতল ভবন ও যানজট:
ঢাকায় যানজট অন্যতম একটি সমস্যা। যত্রতত্র স্থাপনা গড়ে ওঠার কারণে এই সমস্যা আরো প্রকট আকার ধারণ করছে। একটি বহুতল নির্মাণের পূর্বে চিন্তা করা হয় না এখানে কি পরিমান যাতায়াত সংঘটিত হবে। যাচাই বাছাই করা হয় না পুরো ট্রাফিক সিস্টেমে তার প্রভাব সম্পর্কে। এ ধরনের কর্মকান্ডের দরুন নগরবাসীকে পোহাতে হয় এক নিদারুন বিড়ম্বনা। এ ধরনের পরিস্থিতি যেন মোকাবিলা করতে না হয় সে বিষয়ে পূর্বেই সতর্কতার সঙ্গে পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। এ বিষয়ে জাপান গার্ডেন সিটি ভবনের কথা বলা যেতে পােের। যে সকল বহুতল ভবন বা বৃহৎ প্রকল্প বাস্তবায়নাধীন সেগুলি থেকে সৃষ্ট যানজট সমস্যা কিভাবে মোকাবিলা করা যায় সে সম্পর্কে এবং নতুন করে প্রকল্প অনুমোদনের পূর্বে সঠিক দিক নির্দেশনা থাকা জরুরী।

১.২ বহুতল ভবন ও বিদ্যুৎ সঙ্কট:
দেশে বিদ্যুৎ ঘাটতি একটি স্থায়ী সমম্যা হিসেবে দেখা দিয়েছে। লোডশেডিংয়ের কারণে শিল্প কলকারখানায় উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে, সেচের কাজে বিঘœ ঘটছে খাদ্য ঘাটতি থাকার পরও, এখন পর্যন্ত সারাদেশে প্রতিটি বাড়িতে অন্তত একটি বাল্ব জ্বালানোর ব্যবস্থা করার কথা ভাবাও যায় না, যাতে শিশুদের পড়ালেখা সহজ হয়। অথচ বহুতল ভবনগুলিতে নিরবিচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ প্রবাহ নিশ্চিত করা হচ্ছে। যেখানে লিফট, এসকেলেটর ও এসি পরিচালনার জন্য প্রচুর বিদ্যুৎ ব্যবহার করা হয়ে থাকে। এখানেও দেখতে হবে সমতা বিধান করা যায় কিভাবে। দেশের প্রতিটি মানুষ কর প্রদান করে থাকে রাষ্ট্রীয় কিছু সুবিধা পেতে। অথচ যারা বড় বড় শপিং মল গড়ে নিজেদের প্রতিষ্ঠানের ব্যপ্তি বাড়াচ্ছে তাদের জন্য আপামর জনসাধারণ দূর্ভোগ পোহাবে কেন। তারাতো নিজেরাই এক্ষেত্রে বিনিয়োগের জন্য এগিয়ে আসতে পারেন। সেক্ষেত্রে রাষ্ট্রীয়ভাবে নীতিমালা প্রণয়ন করা প্রয়োজন। যেন বহুতল ভবনসহ এ ধরনের বৃহৎ প্রকল্পে নিজস্ব বিদ্যুৎ উৎপাদনের ব্যবস্থা করা হয়। আশা করি এ বিষয়ে প্রকল্প কর্তৃপক্ষের উদ্যেগ থাকবে।

উপরোক্ত বিষয়গুলো বিবেচনায় নিয়ে সমন্বিত পরিকল্পনার মাধ্যমে নগর উন্নয়ন করা হলে অগ্নিকান্ড থেকে শুরু করে অন্যান্য ঝুঁকি হ্রাস করা সম্ভব হবে। সেক্ষেত্রে নগরের কোন কোন এলাকায় বহুতল ভবন নির্মাণ করা হবে তার সুস্পষ্ট উল্লেখ থাকা প্রয়োজন। আশা করি বর্তমানে প্রণয়নের প্রক্রিয়াধীন ডিটেইলড এরিয়া প্লান-এ বিষয়গুলো সংযোজন করা হবে।

বহুতল ভবনের অন্যান্য ঝুঁকি হ্রাসে করষীয় :
ক্স সমন্বিত নীতিমালার ভিত্তিতে বহুতল ভবনের অনুমোদন দেয়া।
ক্স বহুতল ভবনের নকশা সংশ্লিষ্ট বিভাগ কর্তৃক ছাড় করনের পর নির্মাণ ও অনুমতি সাপেক্ষে ব্যবহারের জন্য চালু করা।
ক্স বহুতল ভবনের পাশে যথেষ্ট পরিমানে ফাঁকা স্থান রাখা।
ক্স বহুতল ভবনের পাশে জলাশয় রাখা।
ক্স সড়কে ট্রাফিক ব্যবস্থা স্বাভাবিক থাকবে কিনা যাচাই সাপেক্ষে বহুতল ভবন নির্মাণের অনুমোদন করা।
ক্স বহুতল ভবনের অভ্যন্তরে অগ্নি নির্বাপনের সকল ব্যবস্থা রাখা ও নিয়মিত মহড়ার ব্যবস্থা করা।
ক্স বস্তি এলাকার পাশে পানির ব্যবস্থা রাখা ও বস্তিবাসীকে নিয়ে নিয়মিত মহড়া করা
ক্স ফায়ার সাভির্সের উন্নয়ন করা।
ক্স স্কুল-কলেজসহ সকল সরকারী বেসরকারী প্রতিষ্ঠানে নিয়মিত অগ্নি নির্বাপণ মহড়া করা।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন