মঙ্গলবার, ৩১ আগস্ট, ২০১০

বাসযোগ্য নগরী : জলাশয় ও উন্মূক্ত স্থানের অপরিহার্যতা এবং করণীয়

বিশ্বে এখন প্রায় অর্র্ধেক জনগোষ্ঠী নগরে বাস করছে। দ্রুত নগরায়নের এই ধাক্কা লেগেছে বাংলাদেশেও। দেশের ২৬ শতাংশ মানুষ আজ নগরের বাসিন্দা, যার মধ্যে ৪০ শতাংশই রাজধানী ঢাকার অধিবাসী। কিন্তু অতিরিক্ত জনসংখ্যা ও সঠিক পরিকল্পনার অভাবে ঢাকায় নাগরিক সুয়োগ-সুবিধা প্রতিনিয়ত সংকুচিত হচ্ছে। আবাসন, যাতায়াত, পানি, বিদ্যুত, বিনোদনসহ নানা সঙ্কটে ঢাকাবাসীর দৈনন্দিন জীবনে দম বেরুনোর জোগাড় হয়েছে। এখনই পরিকল্পনা মাফিক এ সকল সঙ্কট নিরসন করার উদ্যোগ না নিলে, আমাদের প্রিয় ঢাকা নগরী পরিত্যক্ত হিসেবে পরিগণিত হতে পারে বলে আশঙ্কা রযেছে। আর সে জন্যই ঢাকায় বসবাসযোগ্য করে তোলতে জলাধার এবং উন্মূক্ত স্থানের অপরিহার্যতা সম্পর্কে বিশেষভাবে অবগত ও সমর্থন প্রদান প্রয়োজন।

নগর মানেই ইট-কাঠ-পাথর আর যন্ত্রের সমাহার নয়। নগর যেখানে থাকবে এক সুষম কাঠমো বিন্যাস, যা মানুষকে ব্যস্ত জীবনে একটু প্রাণের ছোয়া পেতে খোরাক জোগাবে। জলাধার ও উন্মুক্ত স্থান সেই কাঙ্খিত জীবনের বাস্তব রূপ দিতে অত্যাবশ্যকীয় উপাদান। কিন্তু তথাকথিত উন্নয়নের নামে শুধু ভবনের পর ভবনের সারি আর রাস্তাঘাট, জলাধার ও উন্মূক্ত স্থানের জন্য হুমকি হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। যার খেসারত দিতে হচ্ছে মানুষকে। এই ব্যবস্থার অবসান করতে হবে, গড়ে তুলতে হবে একটি মানবিক, বৈষম্যহীন নাগরিক সুবিধা সম্বলিত নগরী। সেই লক্ষ্যকে সামনে রেখে জলাধার ও উন্মূক্ত স্থান সংরক্ষন ও তা মানুষের সর্বাঙ্গীন মঙ্গলের জন্য কাজে লাগাতে হবে। এই ঢাকা নগরী আমাদের সকলের, একে বসবাসযোগ্য করার জন্য প্রত্যেকের অবস্থান থেকে কাজ করতে হবে।

জলাধারের প্রয়োজনীয়তা:
মানুষের জীবন জন্য পানির কোন বিকল্প নেই। ঢাকা শহরের পানি সমস্যা নিয়ে নতুন করে বক্তব্য দেয়ার কোন প্রয়োজন নেই, কারণ ভোক্তভোগী আমরা সবাই। ঢাকা শহরের বর্তমানে পানির ঘাটতির পরিমান ৫০ কোটি লিটার। পানির চাহিদা ২২০ কোটি লিটার হলেও উত্তোলন হয় ১৭০ কোটি লিটার। ঢাকা ওয়াসা সরবারহকৃত পানির ১৩% নদীর এবং বাড়ী ৮৭% পানি নলকুপের। কিন্তু আশংকার বিষয় হচ্ছে, প্রতিনিয়ত পানির স্তর নিমে নেমে যাচ্ছে। আগামী ৫ বছর পর ঢাকার পানি সংকট আরো প্রচন্ড হবে।

ঢাকায় অতিরিক্ত ভুগর্ভস্থ পানি উত্তোলন ভূমিধ্বস এর ঝুঁকিসহ পরিবেশকে নানা হুমকির সম্মুখীন করছে। খুব অচিরেই ভুগর্ভস্তস্তর হতে পানি উত্তোলন করা আমাদের জন্য কঠিন হয়ে পড়বে। বর্তমানে বাংলাদেশের শহরের ৭০% দরিদ্র মানুষের জন্য বিশুদ্ধ পানির ব্যবস্থা নেই। অপরদিকে নিরাপদ পানির অভাবে দেশ লক্ষাধিক লোক মারা যাচ্ছে। নিরাপদ পানি নিশ্চিত করা সম্ভব হলে ৭ হাজার কোটি টাকা বাঁচাবে। আমাদের পানির উৎস জলাধারগুলো রক্ষা না করা হলে, এই বিপুর জনগোষ্ঠীর পানির সমস্যা কিভাবে মোকাবেলা করা সম্ভব নয়। তাই পানি সংকট রোধে যে কোন মূল্যে আমাদের জলাধারগুলো রক্ষা করতে হবে।

জলাধারগুলো ধ্বংস করার প্রেক্ষিতে একদিকে আমরা যখন পানি সংকট ভোগছি। অপর দিকে বর্ষা মৌসুমে বৃষ্টির পানি নিষ্কাশনের অভাবে সৃষ্টি হচ্ছে জলাবদ্ধতা। ২০০৯ সালে ৯ ঘন্টার ৩৩৩ মিলিমিটার বৃষ্টিতে তলিয়ে যায় এই নগর। প্রতিবছর ভরা বর্ষায় ৬ ঘন্টায় ১৫০ মিলিমিটার বা তারও বেশি বৃষ্টি হয়। তখন যে পরিমান পানি নিষ্কাশণ করা বর্তমান ড্রেনেজ ব্যবস্থায় অসম্ভব। জলাবদ্ধতার কারণে মানুষ চলাচলসহ নানা সমস্যা মোকাবেলা করছে। পানির সমস্যা ও জলাবদ্ধতা এই দুটি আমাদের দৃশ্যমান সমস্যা। জলাধারগুলো আমাদের মৎস সম্পদের একটি বড় আধার। কিন্তু ঢাকার মতো এই বৃহৎ শহরের জলাধারা না থাকায় আজ এ শহরের নিজস্ব মৎস সম্পদের ভান্ডার শূন্য। নূন্যতম নিজেদের চাহিদের মেটানোর ব্যবস্থাও নেই আমাদের এই নগরে।


জলাধারগুলো না থাকলে আমাদের পরিবেশ উত্তপ্ত হয়ে উঠবে। ধ্বংশ হবে আমাদের জীববৈচিত্র। কেননা জলাধারগুলো শুধু মাছ আর পানির ক্ষেত্রেই নয়। জলাধারগুলোতে থাকে নানা প্রজাতির জীব। জলাধারগুলো ভরাটের প্রেক্ষিতে আমরা ধ্বংশ করে ফেলছি আমাদের সেই জীববৈচিত্রের আধার। এগুলো সংরক্ষন করা হলে, হতে পারে আমাদের বিনোদনের অন্যতম ক্ষেত্রে। ধানমন্ডি লেক এ ক্ষেত্র একটি উল্লেখযোগ্য উদাহরণ। আর ঢাকা শহরের খালগুলো উদ্বার করা হলে, এ নগরে একটি আর্দশ নৌযোগাযোগ ব্যবস্থা করে তোলা সম্ভব।

দখল হয়ে যাওয়া জলাধার:
ভৌগলিক কারণেই ঢাকা নগরী জলাধারের জন্য অত্যন্ত সমৃদ্ধ। ঢাকা চারপাশ বুড়িগঙ্গা, শীতলক্ষা, বালু ও তুরাগ এই চারটি নদী দ্বারা বেষ্টিত। এছাড়াও ঢাকার অভ্যন্তরেও রয়েছে ছোট বড় অসংখ্য খাল, পুকুর। ঢাকা ওয়াসার হিসেবমতে একসময় ঢাকায় ৪৭টি খাল ছিল। কিন্তু সংরক্ষণের অভাবে আজ মাত্র ২৬টি খালের হিসেব পাওয়া যায়। সরকারী এবং বেসরকারী উদ্যোগে খালগুলিকে হত্যা করা হয়েছে।

জলাবদ্ধতা নিরসনের মূল দায়িত্ব ঢাকা সিটি কর্পোরেশনের। অথচ ডিসিসি খালগুলো সংরক্ষনের পরিবর্তে দখল করে ১৯ টি রাস্তা নির্মাণ করেছে। ড্রেনেজ ব্যবস্থা উন্নয়নের নামে অনেক রাস্তার উপর বক্স কালভার্ট নির্মাণ করা হয়েছে। তার নিচের যে সকল খাল রয়েছে, সেগুনবাগিচা খাল অন্যতম। অপর দিকে বর্তমানে খালগুলো উদ্ধারের নামে যে, কার্যক্রম হাতে নেয়া হয়েছে তাও শুভকর নয়। সুরক্ষার নাম খালগুলো দুই পাশ বাধাই করা হচ্ছে। খালের দুই ধার বাধাই করে খালকে রক্ষা করা নামান্তরে খাল ড্রেনে পরিণত হচ্ছে। খালের জীববৈচিত্র ও পরিবেশ ধ্বংশ হচ্ছে। কল্যাণপুর লেক তার একটি প্রকৃত উদাহরণ।

ঢাকায় ১৯৮৪ ও ১৯৮৫ সালে পুকুরের সংখ্যা ছিল ২ হাজার এবং ১৯৮৮ ও ১৯৮৯ সালে তা কমে দাড়ায় ১ হাজার ২ শতে। ডিসিসি সুত্র অনুসারে তাদের ১০ টি অঞ্চলে মোট পুকুর ও ঝিলের পরিমাণ ৫ হাজার ১শ ৪২ বিঘা। বর্তমানে ঢাকার পুকুর হতে গোনা এবং যে কয়েকটি পুকুর আছে তার অস্তিত্বও সংকটে। পুরাতন ঢাকার সিক্কাটুলিতে একটি পুকুর রয়েছে যা উক্ত এলাকার একমাত্র পুকুর। কিন্তু এ পুকুরটি দখলের পায়তারা চলছে। এলাকাবাসী আর পরিবেশবিদরা অব্যাহত আন্দোলন বজায় রেখেছে। জলাধার রক্ষায় এত আলোড়নের পরও পুকুরটি রক্ষায় সরকারী সংস্থার উদ্যোগ হতাশা ব্যঞ্চক।

বর্তমানে এত আলোড়নের পরও নদী ও জলাধার রক্ষা থেমে নেই। বিভিন্ন ভাবে জলাধারগুলো দখল ও ধ্বংশ করা হচ্ছে। প্রায় সাত হাজার দখলদারের কব্জায় ঢাকার নদীপাড়ের বিপুর অংশ। জলাধারগুলো দখলের জন্য শুধু দখল দায়ী নয়, বর্জ্য ফেলার মাধ্যমেও ভারট করা হচ্ছে নদী। বুড়িগঙ্গায় যে পরিমান বর্জ্য ফেলা হয়েছে তার ১ কিলোমিটারের বর্জ রাখতে ২১ একর জমি লাগবে। অপর দিকে পরিকল্পিতভাবে ব্রিজ বা কলাভার্ট নির্মাণ করে জলাধারগুলোর পানি প্রবাহ ও নৌপথ রোধ করা হচ্ছে। তার প্রকৃত উদাহরণ রাজধানী চারপাশে বৃত্তাকার নৌপথের বড় বাধা ১৪ টি সেতু। স¤প্রতিক সময়েই খাল ভরাট করে নির্মাণ করা হচ্ছে পুর্বাচলগামী তিনশ ফুট রাস্তা। এ রাস্তার কারণে ৩০ ফুট ডুমুরি খারের অস্তিত্ব আজ সংকটে।

নদীগুলিও নির্মম অবহেলা আর যতেচ্ছা ব্যবহারের শিকার। আশার কথা হচ্ছে বর্তমান সরকারও এ ব্যাপারে ভীষণ আন্তরিক। এমনকি বিচার বিভাগ থেকেও বেশকিছু যুগান্তকারী দিক-নির্দেশনামূলক সিদ্ধান্ত এসেছে। যা জনমনে আশার সঞ্চার করেছে। কিন্তু তারপরও একটি অশুভ চক্রের অপতৎপরতা রোধ করা রীতিমত চ্যালেঞ্জ হয়ে দাড়িয়েছে। এদের মোকাবিলার মধ্য দিয়ে অবশিষ্ট সুবিধাটুকু জনসাধারণের নিকট পৌঁছে দিতে সরকারের সকল শুভ উদ্যোগকে আমরা সাধুবাদ জানাই এবং সেই সঙ্গে আমাদের সহযোগিতা অব্যাহত রাখার প্রয়াস ব্যক্ত করছি। এরই সঙ্গে ঢাকার বুকে রমনা, সোহরাওয়ার্দী, ধানমন্ডি লেকসহ ছোট বড় অসংখ্য উন্মুক্ত স্থান রয়েছে। সেগুলি রক্ষাকল্পে সরকারের সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনা ও তার যথাযথ বাস্তবায়ন প্রত্যাশা করছি।

উন্মুক্তস্থান এবং বিনোদন ব্যবস্থা:
মানুষে মানুষে যোগাযোগ, সামাজিক সম্পৃত্তি জন্য প্রয়োজন উম্মুক্ত স্থান, পার্ক, খেলার মাঠ। কিন্তু এ নগরে দিন দিন তা ধ্বংশ করা হচ্ছে। ঢাকা একটি নগর বলা হলেও, নগরে সুবিধা হতাশা ব্যঞ্জক। সুস্থ্য বিনোদনের সুযোগ নেই বললেই চলে। বিনোদনের পর্যাপ্ত স্থানের অভাবে এক শ্রেণীর শিশুরা বড় হচ্ছে কম্পিউটার আর ভিডিও গেমসের খেলে, চার দেয়ালে বন্দী তাদের জীবন। অপর দিকে একটি অংশের শিশুরা বিনোদনের অভাবে জড়িয়ে পড়ছে নানা সামাজিক অপরাধে। খেলাধূলার অভাবে শিশুদের পূর্ণাঙ্গ মানসিক ও শারিরীক বিকাশ ঘটছে না। অতিরিক্ত মোটা হওয়া, মানসিক সমস্যা ও সামাজিক অপরাধমূলক কার্যক্রম অব্যাহত বৃদ্ধি পাচ্ছে।

শিশু-কিশোরদের খেলাধুলার সুবিধা প্রদান এবং নগরবাসীর সুস্থ সুন্দর বিনোদনের জন্য শহরগুলোতে পর্যাপ্ত বিনোদনকেন্দ্র, পার্ক, খেলার মাঠ প্রয়োজন। দিনে দিনে ঢাকাসহ বাইরের বিভিন্ন স্থানে মানুষের বাইরে উন্মুক্তস্থানে বিনোদন বা সামাজিক কার্যক্রমগুলোর পরিধি ক্রমশই সংকুচিত হচ্ছে। পরিকল্পনায় ঘাটতি কিংবা সীমাবদ্ধতার কারণে প্রতিনিয়তই মানুষকে এর উন্নয়ন কিংবা সুবিধা বৃদ্ধির জন্য সংগ্রাম করতে হচ্ছে। খেলার মাঠ, পার্ক কিংবা উদ্যানের সল্পতা কিংবা আবাসিক এলাকায় প্রকৃতির অনুপস্থিতি ক্রমশই মানুষকে গৃহকেন্দ্রিক কিংবা টেলিভিশন নির্ভর করে তুলছে। ফুটপাতে হাঁটার পরিবেশের অভাব কিংবা মাঠে খেলাধুলার পরিবেশের অভাবও প্রকট আকারে পরিলক্ষিত হয়। শিশু, প্রাপ্তবয়স্ক কিংবা বৃদ্ধ বিবেচনায় উন্মুক্তস্থানের পরিকল্পনা প্রণয়ন এবং প্রয়োজনীয় সুযোগ সুবিধা নিশ্চিত করা আবশ্যক।

উম্মুক্ত স্থান, পার্ক, খেলার মাঠের বিষয়ে আমাদের নগর পরিকল্পনাকারী সংস্থাগুলো এখনো ঘুমন্ত। ঢাকা সিটি কর্পোরেশনের হিসেবে ৪৭ টি পার্ক রয়েছে। কিন্তু বাস্তবে কয়েকটি পার্ক কোন রকমে নিজের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখলেও বাকীগুলো হদিস নেই। ঢাকা পার্কগুলো দখল হয়েছে পানির পাম্প, প্রাইভেট গাড়ীর পার্কিং, মার্কেট, গ্যারেজসহ নানা কর্মকান্ড। খেলার মাঠগুলো রক্ষণাবেক্ষনের কোন উদ্যোগ নেই। বরং খেলার মাঠগুলো বানিজিক নানা কর্মকান্ডে ব্যবহার করে খেলার পরিবেশ ব্যহত করা হচ্ছে।

সিটি কর্পোরেশনের পর আসা যাক রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (রাজউক)-র নিকট। রাজউক নগর পরিকল্পনার প্রাণ হিসেবে কাজ করে, কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য মানুষের বিনোদন, সামাজিকতা, মানসিক ও শারিরীক বিকাশে নগর পরিকল্পনায় এগুলো নিশ্চিত করার সীমাবদ্ধতা এখনো রয়েছে। উদাহরণ স্বরূপ বলা যেতে পারে ঢাকা শহরের মাত্র ২% লোক প্রাইভেট গাড়ী ব্যবহার করে, বাকী ৯৮% মানুষের গাড়ী নেই। ইমারত নির্মাণ বিধিমালায় প্রতিটি বাড়ী ও মার্কেটে সুনির্দিষ্ট ও সুপষ্টভাবে প্রাইভেট গাড়ীর রাখার জন্য নির্দেশনা প্রদান করা হয়েছে। শুধু তাই নয় স¤প্রতি রাজউক নিজ উদ্যোগে গাড়ীর জন্য পার্কিং তৈরি করার পরিকল্পনা গ্রহণ করেছে। অথচ প্রতিটি বাড়ীতে শিশু থাকা স্বত্বেও শিশুদের শারিরীক ও মানসিক বিকাশে এপার্টমেন্টগুলো তৈরিতে এমন কোন নির্দেশনা নেই। প্রাইভেট গাড়ী অপেক্ষা মানুষের শিশু কম গুরুত্ব পাচ্ছে নগর পরিকল্পনাকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর কাছে।

শহরের সামগ্রিক পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষায় পার্ক এবং উন্মূক্ত স্থানের গুরুত্ব অপরিসীম। শিশুদের খেলাধূলা, বয়স্কদের আড্ডাসহ সব মানুষের সামাজিক আদান প্রদানের জন্য পার্ক এবং উন্মূক্ত স্থান সঠিকভাবে রাখার ব্যবস্থা করতে হবে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, প্রতি এক হাজার জনের জন্য ৪.২৩ একর জায়গা পার্ক এবং উন্মূক্ত স্থান এর জন্য থাকা প্রয়োজন। এমনকি সবচাইতে জনবহুল হংকং শহরেও প্রতি এক হাজার জনের জন্য ০.৭১ একর জায়গা রয়েছে, যা প্রস্তাবানুযায়ী ঢাকার চেয়ে ৫ গুন বেশি। ডিটেইল এরিয়া প্লান এ প্রতি এক হাজার জনের জন্য ০.১৩ একর জায়গা পার্ক এবং উন্মূক্ত রাখার কথা বলা হয়েছে। সেটিও সুস্পষ্টভাবে কোথায় হবে তা নির্দ্দিষ্ট করে বলা হয়নি। অথচ বানিজ্যিক কাজে ব্যবহারের জন্য সকল কিছুর জন্য সুনির্দ্দিষ্টভাবে জায়গা রাখা হয়েছে। ডিটেইল এরিয়া প্লান বাস্তবায়নের পূর্বে অবশ্যই এ বিষয়টি সংশোধন সাপেক্ষে পর্যাপ্ত পরিমাণ জায়গা পার্ক এবং উন্মুক্ত স্থানের জন্য রাখা হবে।

একটি বিষয় মনে রাখতে হবে বিনোদনকেন্দ্র বলতে শুধুমাত্র বাণিজ্যিকভাবে তৈরী কিছু রাইড সম্মিলিত স্থানগুলো নির্দেশ করে না। বর্তমানে কিছু বিনোদনকেন্দ্র গড়ে উঠছে ব্যক্তিমালিকানাধীনভাবে, ফলে সর্বস্তরের জনগণের জন্য তা উন্মুক্ত হয় না। ফলে মুষ্টিমেয় কিছু মানুষ তা ব্যবহার করতে পারে, সাধারণ মানুষ বিনোদনের সুযোগ পায় না। নিরাপত্তা এবং পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতার বিষয়গুলোর প্রতি দৃষ্টি রেখে পাকর্, খেলার মাঠ এবং উন্মুক্তস্থানগুলো যেন সর্ব সাধারণের ব্যবহার জন্য উন্মুক্ত হয় সে বিষয়টি গুরুত্বের সাথে বিবেচনা করতে হবে।


উন্মুক্তস্থানের বিশেষত্ব হচ্ছে যেখানে সহজেই লোক সমাগম ঘটে এবং সেই জায়গাগুলোতে সামাজিক, সাংস্কৃতিক, বিনোদনমূলক কর্মকান্ড সংগঠিত হয়। যেখানে প্রকৃতি বর্তমান। মানুষে মানুষে যোগাযোগের সুবিধা, আড্ডা কিংবা খেলাধুলার সুবিধা বিদ্যমান। যদি উন্মুক্ত স্থানের পরিবেশে এর ঘাটতি দেখা দেয় তাহলে সেখানে মানুষের আগমন কিংবা প্রাণচাঞ্চল্য হারিয়ে যায়। মানুষের উন্মুক্তস্থানের কর্মকান্ডগুলো আকর্ষনীয় এবং অর্থবহ করে তুলতে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণের পাশাপাশি উন্মুক্ত স্থানের বরাদ্দ এবং পরিকল্পনায় পূর্বেই নজর দেয়া জরুরী।

নগর পরিকল্পনা মানুষের জীবনযাত্রাকে নানাভাবে প্রভাবিত করে। জীবনমানের উন্নয়ন শহরের পরিকল্পনার উপর নির্ভরশীল। শহরের পরিকল্পনা প্রণয়নে যদি বিনোদন অথবা প্রাকৃতিক বিষয়ের উপর গুরুত্ব আরোপ করা হয়, সেই সাথে মানুষের মৌলিক প্রয়োজনের বিষয়গুলোকেও স্থান দেয়া হয় তাহলে সেটি একটি প্রাণবন্ত শহরের অবয়ব পেতে পারে। অন্যদিকে নগর পরিকল্পনায় এই বিষয়গুলোর ঘাটতি থাকলে কিংবা বিবেচনায় নেয়া না হলে শহরটি প্রাণহীন শহরে পরিণত হতে বাধ্য। নগর মানেই শুধু ইট, কাঠ, পাথরের বসতি বা যান্ত্রিকতা নয়। বহুমানুষের মিলনকেন্দ্রই হচ্ছে নগর। একটি সুষ্ঠু সুন্দর পরিকল্পিত নগরী দক্ষ মানবগোষ্ঠী গড়ে তুলতে সহায়ক। শিশু-কিশোরদের খেলাধুলার সুবিধা প্রদান এবং নগরবাসীর সুস্থ সুন্দর বিনোদনের জন্য শহরগুলোতে পর্যাপ্ত বিনোদনকেন্দ্র, পার্ক, খেলার মাঠ প্রয়োজন। এ কারণে একটি পরিকল্পিত নগরী গড়ে তোলার ক্ষেত্রে নগরবাসীর জন্য এসব সুযোগ সুবিধা প্রদানের বিষয়টি প্রাধান্য দেয়া আমাদের সকলেরই কাম্য।

জলাধার ও উন্মুক্ত স্থান সংরক্ষণে সুপারিশ:
১. ঢাকার জলাধার ও উন্মুক্ত স্থান চিহ্নিতকরণ নিদিষ্ট করে দেয়া।
২. জলাধার ও উম্মুক্ত স্থান দখলকারীদের বিরুদ্ধে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি ব্যবস্থা করা।
৩. বিশুদ্ধ পানির উৎসঃ নদ-নদী, খাল-বিল ও জলাশয় রক্ষায় বিদ্যমান আইন প্রয়োগ প্রয়োজনে সংশোধন করা।
৪. সরকারী প্রতিষ্ঠান কর্তৃক কোন ধরনের স্থাপনা নির্মাণের পূর্বে পরিবেশ ছাড়পত্র বাধ্যতামূলক করা এবং প্রচলিত আইন লঙ্ঘনকারীদের শাস্তির আওতায় নিয়ে আসা।
৫. পুকুর, দীঘি, খাল-বিল-নদীসহ যে কোন জলাশয় ভরাট বন্ধে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ।
৬. নদী, খাল, বিলসহ যে কোন ধরনের জলাশয়কে পেছনে দিয়ে এ ধরনের স্থাপনা বা পরিকল্পনা নিষিদ্ধের লক্ষ্যে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ। যদি জলাশয় সামনে থাকে তবে মানুষ এ সকল স্থানে ময়লা আর্বজনা ফেলবে না।
৭. নদী ও খালের দুইপারে মানুষের বিনোদনের জন্য হাঁটার ব্যবস্থা রাখা।
৮. খালগুলো উদ্ধার ও সংস্কার করে নৌ-পথগুলো চালু ও স¤প্রসারণ করা ।
৯. ইমারত নির্মাণ বিধিমালা সংশোধন করে পার্কিং এর পরিবর্তে শিশুদের খেলাধূলার জায়গা রাখার বিধান করা।
১০. প্রতিটি এলাকায় মাঠ, পার্ক ও উম্মুক্ত স্থানগুলো সংরক্ষন ও ব্যবহার উপযোগী করা।
১১. ডিটেল এরিয়া চুড়ান্ত বাস্তবায়নের পূর্বে, জলাধার সংরক্ষন ও উম্মুক্ত স্থান নিশ্চিত করাসহ সুপষ্ট দিকনির্দেশনা প্রদান করা।

সৈয়দ মাহবুবুল আলম, নীতিবিশ্লেষক
০১৫৫০৬০০২০৬

তথ্যসুত্র
১. জীবন ও স্থাপত্য, ডাব্লিউবিবি ট্রাস্ট
২. টেলিভিশনের নেতিবাচক প্রভাব ও আমাদের শিশু, ডাব্লিউবিবি ট্রাস্ট
৩. িি.িবসহনফ.হবঃ
৪. আমাদের অর্থনীতি, ৯ মার্চ ২০১০
৫. প্রথম আলো, ২২ মার্চ ২০১০
৬. দৈনিক জনকণ্ঠ, ২৮ জুন ২০০৯
৭. মানবজনিম, ২৯ জুন ২০০৯
৮. বাংলাদেশ সময়, ২৯ জুন ২০০৯
৯. দৈনিক ইত্তেফাক, ০৩ আগষ্ট ২০০৯
১০. দৈনিক ডেসটিনি, ২০ জুলাই ২০০৯
১১. সমকাল, ২৭ জুন ২০০৯
১২. নয়াদিগন্ত, ১৫ ফেব্র“য়ারি ২০১০
১৩. আমাদের সময়, ৭ জানুয়ারি ২০১০
১৪. প্রথম আলো ১২ জানুয়ারি ২০১০
১৫. নয়াদিগন্ত, ১ ফেব্র“য়ারি ২০১০
http://www.somewhereinblog.net/blog/tahin2000/29232958