সোমবার, ১৯ জুলাই, ২০১০

সেবাখাত বিরাষ্ট্রীয়করনে প্রেক্ষাপট-জনগনের সেবা প্রাপ্তির অধিকার

উন্নয়ন যে কোন জাতি ও মানুষের পরম একটি কাঙ্গিত বিষয়। কিন' উন্নয়ন কি? আমরা কিসের উন্নয়রেন জন্য কাজ করছি? আমরা কি প্রত্যাশিত উন্নয়নের দিকে যাচ্ছি? এ বিষয়গুলো নিয়ে অনেকেরই মত বিরোধ রয়েছে। তবে প্রচলিত অর্থে অনেকেই আমরা উন্নয়ন বলতে অর্থনৈতিক উন্নয়নের কথা বুঝে থাকি। আর এখানেই প্রশ্ন অর্থনৈতিক উন্নয়ন কিসের জন্য? আমরা অর্থনৈতিক উন্নয়ন চাই, যাতে মানুষের মৌলিক চাহিদাগুলোর নিশ্চিত করা যায়। কিন' বিগত দিনে আমাদের পদক্ষেপর ফলে কি মানুষের মৌলিক চাহিদাগুলো নিশ্চিত হয়েছে? না আরো অনেক মানুষের জীবন অনিশ্চয়তা দিকে এগিয়ে যাচ্ছে? সমাজে সুখ, শানিত্ম, সম্পৃতি কি বৃদ্ধি পেয়েছে? উন্নয়ন মানে কি শুধু সুউচ্চ দালাল কোটা, দামী গাড়ী, প্রশসত্ম রাসত্মা, আধূনিক যন্ত্রপাতি, দামী রেষ্টুরেন্ট, কিছু লোকের ধনী হওয়া, অর্থনৈতিক সুচক বৃদ্ধি, বিদেশী বিনিয়োগ? উন্নয়নের সুচক হওয়া উচিত রাষ্ট্র সুবিধা বঞ্চিত মানুষের মৌলিক অধিকার নিশ্চিতে কতটুকু সক্ষমতা অর্জন করতে সামর্থ হয়েছে।

বাংলাদেশের উন্নয়ন প্রত্যেক মানুষের স্বপ্ন। আমরা সকলেই চাই এ দেশ এগিয়ে যাক সুখ ও সমৃদ্ধির দিকে। সরকার এ স্বপ্ন বাসবায়নের অন্যতম কান্ডারী। রাষ্ট্রীয় সম্পদ তথা রাষ্ট্র যন্ত্রের যথাপোযুক্ত ব্যবহার নিশ্চিত করার মাধ্যমে এই লক্ষ্য অর্জন করা সম্ভব। বাংলাদেশের সংবিধানের ১৪ নং অনুচ্ছেদ অনুসারে ’’রাষ্ট্রের অন্যতম মৌলিক দায়িত্ব হইবে মেহনতি মানুষ (কৃষক ও শ্রমিক) কে এবং অনগ্রসর জনগনের অংশ সমূহকে সকল প্রকার শোষণ হইতে মুক্তি দান করা’’ এবং অনুচ্ছেদ ০৭ অনুসারে জনগনই প্রজাতন্ত্রের সকল ক্ষমতা উৎস, অনুচ্ছেদ ৪৭ অনুসারে বাংলাদেশে রাষ্ট্রয়াত প্রতিটি প্রতিষ্ঠান এবং খনিজ সম্পদের মালিক জনগন। কিন' রাষ্ট্রীয় সেবাখাত বিরাষ্ট্রীয়করনের মাধ্যমে এ দেশের মানুষকে অধিকারকে ক্ষুন্ন করা হয়েছে। রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলো হতে নির্বিচারে শ্রমিক ছাটাই করার মাধ্যমে দেশে দারিদ্রতা ও বেকারত্ব বৃদ্ধি করা হয়েছে।

অর্থনৈতিকভাবে শক্তিশালী দেশগুলো বিশ্বব্যাংক, আই এম এফ, এডিবি-র মতো ঋণলগ্নিকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর মাধ্যমে তাদের স্বার্থে আমাদের মতো দেশের সেবাখাত বিরাষ্ট্রীয়করণের দিকে ঠেলে দেয়। আর এ দেশের মানুষের সম্পদ লুটপাট করে নেয় বহুজাতিক কোম্পানিগুলোর মাধ্যমে। অর্থনৈতিক উন্নয়নের নামে এ সকল কার্যক্রম গ্রহণ করে হলেও অর্থনৈতিক উন্নয়ন আসেনি। জনগনের সম্পদ ব্যক্তির খাতে তুলে দিয়ে জনগনকে ব্যক্তির নিকট জিম্মি করার সংবিধান সম্পন্ন নয়। রাষ্ট্রীয় সম্পদ বিরাষ্ট্রীয়করণের ফলে মানুষের অর্থনীতি, পরিবেশ, সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা বিঘ্নিত হচ্ছে। দেশ জিম্মি হয়ে পড়ে বহুজাতিক কোম্পানি ও গুটি কয়েক ব্যক্তির কাছে।

বর্তমান বিশ্বে অর্থনৈতিক মন্দার কথা আমাদের সকলের জানা। বিশ্বের অন্যতম সম্পদশালী দেশ হওয়ার পরও আমেরিকা, ইংল্যান্ড এর মতো দেশগুলো অর্থনৈতিক মন্দার প্রকোপ হতে রক্ষা পাচ্ছে না। এ সকল রাষ্ট্র ব্যাংক, রেলসহ বিভিন্ন সেবা প্রদানকারী প্রতিষ্ঠান রাষ্ট্রায়ত্ব করেছে। আইসল্যান্ড তাদের সর্ববৃহৎ ব্যাংক রাষ্ট্রায়ত্ব করেছে। এ সকল দেশের অনেক প্রতিষ্ঠান দেউলিয়া হওয়ার প্রেক্ষিতে সরকার রাষ্ট্রীয় কোষাগার হতে অর্থ প্রদাণ করে এ সকল প্রতিষ্ঠান রাষ্ট্রায়ত্ব করেছে। আর ঠিক একই সময়ে বাংলাদেশে একের পর এক রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান কোম্পানি করার নামান-রে বিরাষ্ট্রীয়করণ করার পদক্ষেপ গ্রহণ করা হচ্ছে। এ বছর সরকার আর কোন রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানকে বিরাষ্ট্রীয়করন না করার চিন-া করছেন, যা অবশ্যই সাধুবাদ পাওয়ার যোগ্য। কিন' উৎকণ্ঠা রয়েই যাচ্ছে কারণ আগামী বছর কি আবার কোম্পানির নামানত্মরে বিরাষ্ট্রীয়করণ করা হবে।

সেবাখাত বানিজিককরণ
অর্থনীতিতে সেবা খাতের অবদান অত্যেনত্ম দূ্রত হারে বেড়ে যাবার ফলে এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ খাত হিসেবে আর্বিভুত হয়েছে । এ ধরনের একটি প্রেক্ষাপটে বিশ্ব বানিজ্য সংস'ায় সেবাখাত সংক্রানত্ম চুক্তি (জেনারেল এগ্রিমেন্ট অন ট্রেড ইন সার্ভিসেস’বা গ্যাটসের ) মাধ্যমে সেবা খাতকে আনুষ্টানিক ভাবে বিশ্ব বানিজ্য ব্যবস'ার অধীনে আনা হয় । এ চুক্তিতে যেসব যেসবসেবাখাত অনত্মর্ভুক্ত হয়েছে সেগুলোকে ১২ াট ভাগে ভাগ করা হয়েছে যার মধ্যে রয়েছে ১৬০টি উপখাত । মূল খাত গুলোর মধ্যে রয়েছে ব্যবসায়িক সেবা যোগাযোগ সেবা ,নির্মাণ ও সংশ্লিষ্ট প্রকৌশল সেবা ,বিতরন সেবা,শিক্ষা সেবা,পরিবেশগত সেবা , আর্থিক সেবা ,স্বাস'্য সংক্রানত্ম ও সামাজিক সেবা ,পর্যটন ও ভ্রমন সংক্রানত্ম সেবা ,বিনোদন সেবা , এবং অন্যান্য সেব িযেগুলো অন্য কোথাও উল্লেখ্য করা হয়নি ।

১৯৯৫ সালে গ্যাটস প্রতিষ্ঠার সময়ে সিদ্বানত্ম হয় যে , প্রতিষ্টার পাচঁ বছরের মধ্যে আলোচনা শুরু করতে হবে । সে অনুযায়ী ২০০০সালের জানুয়ারি মাসের আলোচনা শুরু হয় । গ্যাটস প্রতিষ্টার সময়ে কিছু কিছু বিষয় অমীমাংসিত ছিল যে গুলো পরবর্তীতে আলোচনার সময় নিষ্পত্তি করার সিদ্ধানত্ম হয় । ২০০০থেকে ২০০১সালের মার্চ পর্যনত্ম আলোচনা চলার পর সেবাখাতে বানিজ্য উদারীকরনের একটি নীতিমালা প্রণীত হয় । এতে দ্বিপাক্ষিক, বহুপাক্ষিক , ও সার্বজনীন আলোচনার মাধ্যমে সেবাখাত উন্মুক্ত করার রূপরেখা ঠিককরা হয় । আর আলোচনার উপায় হিসাবে অনুরোধ-প্রসত্মাব পদ্ধতি নির্ধারন করা হয় । একটি দেশ অন্য একটি দেশকে সেদেশের কোন একটি সেবা খাত উন্মুক্ত করার অনুরোধ জানাবে । প্রত্যুত্তরে এই দেশটি কোন কোন খাত কি পরিমানে উন্মুক্ত করতে পারবে তার প্রসত্মাব দেবে ।


ভতুর্কী, ঋণ, সহায়তা, বিনিয়োগ এবং অনুদান
দেশের নাগরিক হিসেবে প্রতিটি নাগরিক কর প্রদান করে আসছে। সরকার কর আদায় বৃদ্ধির লক্ষ্যে বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। নাগরিক হিসেবে এ কর প্রদানের উদ্দেশ্য আমরা কিছু সেবা পাবো। কিন' যদি রাষ্ট্রীয় সকল সেবাখাতগুলো বেসরকারী করে, তবে জনগনের কর প্রদানের উদ্দেশ্য বিষয়ে প্রশ্ন জাগে, জনগণ কেন কর প্রদান করবে? একদিকে রাজস্ব বৃদ্ধির জন্য জনসাধারণকে চাপ দেওয়া এবং অপর দিকে রাষ্ট্রীয় সুবিধাসমূহ সংকুচিত করার কোনভাবেই রাষ্ট্রীয় নীতি হতে পারে না।

অর্থনীতির ভাষার পারম্যাচে অনেক ক্ষেত্রেই দেশের মানুষদের বিভ্রানত্ম করা হয়। ভতুর্কী, ঋণ, সহায়তা, বিনিয়োগ এবং অনুদান যে নামেই অভিহিত করা হোক না কেন, এর ব্যয় বহন করতে হয় জনগনকে। অথবা বলা যেতে পারে জনগনের অর্থে এ সকল খাতে খরচ করা হয়। ঋণলগ্নিকারী সংস'াগুলো জনগনের কল্যাণে সেবাখাতে ভর্তুকীকে নিরুৎসাহিত করে থাকে এবং ভতুর্কীকে আর্থিক ক্ষতি হিসেবে অবহিত করে। কিন' অপর দিকে সরকারকে একের পর এক ঋণ গ্রহনের জন্য উৎসাহী করে থাকে। ঋণ ও ভতুর্কী উভয় খাতের অর্থই জনগনকে বহন করতে হয়।

ঋণলগ্নিকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর পরামর্শে উন্নয়নে দোহাই দিয়ে সেবাখাত বিরাষ্ট্রীয়করণ করা হলেও বিগত কয়েক বছরের এ দেশের দরিদ্রতা বৃদ্ধি পেয়েছে ৩গুন, ২০০৯-১১ সালের মধ্যে ২ কোটি ৬৫ লাখ ৮০ হাজার লোক বেকার হবে এবং বৈদেশিক ঋণের পরিমান হ্রাস পেলেও, ঋণ অর্থ পরিশোধের পরিমান বৃদ্ধি পেয়েছে। বাংলাদেশের ঋণের পরিমান ১ লক্ষ ৪২ হাজার কোটি টাকা এবং দেশের প্রতিটি শিশু ১১ হাজার টাকা ঋণের বোঝা নিয়ে জন্ম গ্রহণ করছে। বাংলাদেশকে ১ ডলার বৈদেশিক ঋণের বিপরীতে সুদসহ পরিশোধ করতে হচ্ছে দেড় ডলার। আর এ সকল ঋণের একটি বড় অংশ গ্রহণ করা করা হয় বিশ্বব্যাংক, আই এম এফ, এডিবি-র মতো প্রতিষ্ঠানগুলো হতে অহেতুক খাতে। এ প্রতিষ্ঠানগুলো একদিকে ঋণ দিয়ে ব্যবসা করছে, অপর দিকে তাদের দোসর কোম্পানির হাতে এ দেশের মানুষের সম্পদ তুলে দিচ্ছে বিরাষ্ট্রীয়করণের মাধ্যমে। ২০০৭ সালের সরকার বৈদেশিক ঋণের সুদ-আসল পরিশোধ করতে রাজস্ব বাজেটে প্রায় শতকরা ২৫ ভাগ ব্যয় করেছে। অর্থনৈতিক উন্নয়ন এই আজব সুত্রে পিষ্ট হচ্ছে উন্নয়নশীল দেশের প্রতিটি জনগন।

বেসরকারী খাতে র্দুনীতি নিয়ে ঋণলগ্নিকারী গোষ্টীর মৌনতা:
রাষ্ট্রীয়খাতে ব্যক্তি পর্যায়ের দুর্নীতির কারণে রাষ্ট্রীয় বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান বিরাষ্ট্রীকরণ করার পরামর্শ প্রদান করা হচ্ছে। অথচ বেসরকারীখাতে দূনীতির বিষয়ে ঋণপ্রদানকারী সংস'া, উন্নয়ন সহযোগি এবং দূনীতি বিরোধী সংস'াগুলো নিরব ভূমিকা পালন করছে। বিভিন্ন বিদেশী মোবাইল কোম্পানিগুলোর বিরুদ্ধে হাজার কোটি হাজার ভিওআইপির সমস্যা থাকা স্বত্বেও কোন পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়নি। সমপ্রতি অবৈধ ভিওআইপি কার্যক্রম পরিচালনার জন্য বিদেশী মোবাইল কোম্পানিগুলোকে জরিমানা করা হয়। অথচ বিগত কয়েক বছর ধরে কোম্পানিগুলো নগ্নভাবে এ ধরনের অপতৎপরতার মাধ্যমে দেশের রাজস্ব ক্ষতি করলেও তাদের বিরুদ্ধে এ সকল প্রতিষ্ঠান কোন উচ্চবাচ্য করেনি বরং অনেকে এই সময় গবেষণা করে বের করেছে রাষ্ট্রীয় সেবা প্রতিষ্ঠান বিটিটিবিতে কোন ব্যক্তি কি পরিমাণ দূনীতি করেছে। যদি সরকার কর্মকর্তা ঘুষ করে করে থাকে, তবে সে বেসরকারী কোম্পানি ঘুষ প্রদান করেছে তারাও দুনীতিবাজ। রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোতে ব্যক্তি পর্যায়ে দূনীতি করা হলেও, বেসরকারীখাতে দূনীতি করা হয় কোম্পানির মাধ্যমে। কোম্পানির এ ধরনের কার্যক্রম রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে অপরাধ। বেসরকারী কোম্পানিগুলোর বিজ্ঞাপনে/উপঢৌকনে মগ্ন থাকার কারণে অনেক দূনীতি বিরোধী ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান নীরব ভূমিকা পালন করছে। কিন' একতরফা রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে প্রচারণা রাষ্ট্রীয় সেবা খাতকে দূর্বল করছে এবং বিদেশী কোম্পানী/প্রতিষ্ঠানগুলোকে অবৈধভাবে জনগণকে শোষণ করতে সহযোগিতা প্রদান করছে।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন