শনিবার, ২৬ ফেব্রুয়ারী, ২০১১

বানিজ্যিক স্বাস্থ্য কার্যক্রম ও মানবাধিকার

বানিজ্যিক স্বাস্থ্য কার্যক্রম ও মানবাধিকার
সৈয়দ মাহবুবুল আলম, নীতিবিশ্লেষক

ভাই রোগীটা দেখেন, টঙ্গীতে ট্রাকের সাথে ধাক্কা খেয়েছে। দয়া করে রোগীটাকে চিকিৎসা দিন। আমরা টাকা নিয়ে আসছি। একটি বেসরকারী হাসপাতালের কর্তৃপরে নিকট মোবাইলে গুরুতর আহত একজন রোগীকে চিকিৎসা দিতে এভাবে আকুতি জানাচ্ছিলাম। ছেলেটার অপরিচ্ছন্ন কাপড় আর দরিদ্র সহচরদের দেখে কর্তৃপ চিকিৎসা দিচ্ছিল না। এত আকুতির পরও চিকিৎসা পায়নি মারাত্বকভাবে আহত দরিদ্র ছেলেটি..... বেসরকারী হাসপাতাল থেকে ছেলেটিকে পাঠিয়ে দেয়া হয় ঢাকা মেডিক্যাল কলেজে। ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ এ পৌঁছানো পর্যন্ত বাঁচেনি ছেলেটা.......সারান মনে হচ্ছিল যদি সময় মতো চিকিৎসা পেতো হয়তো ছেলেটা বাচঁতো।

‘‘ভাই আমাগো বাচ্ছাডা বাঁচবে না।’’ গভীর রাত। ঢাকায় একটি শিশু বিশেষাষ্ণায়িত হাসপাতালে বসে আছি। একজন মা ডাক্তারকে অনুরোধ করছে তার সন্তানকে এনআইসিইউতে রাখতে। সিট না থাকায় ডাক্তার তাকে অন্য হাসপাতালে নিতে পরামর্শ দিচ্ছেন। কিন্তু অন্য হাসপাতালে নিতে হলে প্রতিদিন প্রায় ২০ হাজার টাকার মতো খরচ লাগবে বিধায় মা তার শিশুটিকে এ হাসপাতালেই সিট না থাকলে অন্তত মাটিতে স্থান দিতে পীড়াপীড়ি করছিলেন। এটি বর্তমান বানিজ্যিক স্বাস্থ্য কার্যক্রমের চিত্র।

সেবা বলতে একটি মহৎকর্ম প্রচেষ্টাকে বুঝায়। অর্থের বিনিময়ে পরিচালিত স্বাস্থ্য কার্যক্রমকে স্বাস্থ্যসেবা বলা অযৌক্তিক। বেসরকারী স্বাস্থ্যসেবা বলতে সে সকল দাতব্য প্রতিষ্ঠানকে চিহ্নিত করা উচিত যারা মানুষকে তাদের সাধ্য অনুসারে সেবা প্রদান করা আসছে, এতে মুনাফা অর্জনই মূল উদ্দেশ্য নয়। শুধুমাত্র অর্থ উপার্জনের ল্েয নানা প্রক্রিয়ায় মানুষকে জিম্মি করার স্বাস্থ্য বিষয়ক কার্যক্রমকে বানিজ্যিক স্বাস্থ্য কার্যক্রম বলা উচিত। স্বাস্থ্য বিষয়ে নীতিনির্ধারণ ও আলোচনার েেত্র সরকারী স্বাস্থ্যসেবা, বেসরকারী স্বাস্থ্যসেবা এবং বানিজ্যিক স্বাস্থ্য কার্যক্রম এই মৌলিক বিষয়গুলো সুপষ্টভাবে চিহ্নিত করা প্রয়োজন। বেসরকারী স্বাস্থ্য সেবা শব্দটির আড়ালে স্বাস্থ্য নিয়ে বানিজ্য করায় মূল বিষয়টি হারিয়ে যায়। সেবার কথা বলে এই বানিজ্যিক প্রতিষ্ঠানগুলো রাষ্ট্র হতে নানা সুযোগ সুবিধা গ্রহণ করে। কিন্তু তাদের মূনাফা অর্জনের ল্য মাত্রায় পিষ্ট হয় রাষ্ট্রের জনগন।

স্বাস্থ্যখাত এর ক্রমবর্ধমান বানিজ্যকরণের অপর একটি কারণ হচ্ছে, স্বাস্থ্য বলতে অনেক সচেতন মানুষ শুধুমাত্র চিকিৎসাকেই চিন্তা করে। সকল পরিকল্পনা ও কার্যক্রমে চিকিৎসার মতো বানিজ্যিক েেত্রগুলোই প্রধান্য পায়। স্বাস্থ্য সেবা বলতে সুস্থ্য থাকার উপায় বা রোগ প্রতিরোধের মতো বিষয়গুলো স্থান পায় না। পরিবেশ দূষণ রোধ, খাদ্যভাস, কায়িক পরিশ্রম, সচেতনতা সুস্বাস্থ্য বজায় রাখার এ সকল খাতে বানিজ্য করার সুযোগ খুবই কম। অপরদিকে চিকিৎসা কার্যক্রমের সাথে রয়েছে অবকাঠামো, ঔষধ, টেস্ট, অপরেশন, ভিজিটসহ নানা ধরনের অর্থসংস্থানের সুযোগ। আর নিয়মিত অর্থ উৎপাদনের এ সুযোগের কারণে মানুষকে সুস্থ্য রাখা অপো চিকিৎসা ও বানিজ্যিক স্বাস্থ্য কার্যক্রমের প্রতি মনোযোগ, প্রকল্প, নীতি ও পরিকল্পনা অনেক বেশি।

স্বাস্থ্যখাত বানিজ্যিককরণের প্রক্রিয়া
স্বাধীনতার পর সত্তর দশকের শেষের দিকে এদেশের বানিজ্যিক স্বাস্থ্যখাতের বিকাশ শুরু হলেও তখন এ সংক্রান্ত কোন বিধি বিধান বা নীতিমালা তৈরী হয়নি। তথাপিও সে সময় হাসপাতাল, নার্সিং হোম, কিনিক স্থাপনের জন্য স্বল্প সুদে ব্যাংক ঋণদানের একটি স্কীম চালু করা হয়। ১৯৮২ সালে একটা অধ্যাদেশ জারীর মাধ্যমে বেসরকারি স্বাস্থ্যসেবা খাতকে আইনী বৈধতা দেওয়া হয়। উক্ত অধ্যাদেশ বেসরকারি কিনিক, হাসপাতাল, ল্যাবরেটরি নির্মানের েেত্র যন্ত্রপাতি ও বিশেষজ্ঞ নিয়োগের শর্ত নির্দিষ্ট করা হয়। ১৯৮৪ সালে পূর্ববর্তী অধ্যাদেশের সংশোধনীসহ আরেকটি অধ্যাদেশ জারী করা হয়। সে সময় গৃহীত তৃতীয় পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা এবং পরবর্তীতে ১৯৯১-৯৬ গৃহীত চতুর্থ পঞ্চবাষির্কী পরিকল্পনায় বেসরকারি খাত বিকাশের ল্েয সরকারি পরিকল্পনা সন্নিবেশিত হয়। ১৯৯৬-২০০১ সালে পঞ্চম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনায় বেসরকারি খাতকে বিকাশের পরিকল্পনা দৃঢ়ভাবে গ্রহণ করা হয়। পরবর্তীতে ২০০১-০৬ বেসরকারি খাতকে উৎসাহিত করার ল্েয সরকারীভাবে বিভিন্ন প্রোগ্রাম ও অর্থ সুবিধার বিধান হাতে নেওয়া হয়।

বাংলাদেশে খুব দ্রুত বেড়েছে এই বেসরকারী স্বাস্থ্যখাত। ১৯৮০ সালে সরকারী পরিচালনায় রাষ্ট্রায়াত হাসপাতাল ছিল ৫১০ টি এবং বেসরকারী ছিল ৩৯ টি, ১৯৯৮ সালে সরকারী হাসপাতালের সংখ্যা বেড়ে ৬৪৭ টি এবং বেসরকারী হাসপাতালের সংখ্যা দাড়ায় ৬২৬টি। ২০০৫-০৬ সালে এক তথ্যে দেখা যায় মোট ৪ হাজার ১৫টি চিকিৎসা প্রতিষ্ঠানের মাঝে ২ হাজার ১৬৮টি একক মালিকানায় প্রতিষ্ঠিত। বর্তমানে কত পরিমান হাসপাতাল, কিনিক ও প্যাথলজি ল্যাব রয়েছে তার সঠিক পরিসংখ্যান কারো কাছেই নেই। বেসরকারী চিকিৎসা সেবার মান উন্নয়নে বেসরকারি চিকিৎসা সেবা আইন ২০০০ খসড়া প্রণয়ন করা হয়। আইনটি ২০০৩ ও ২০০৪ সালে আরো অধিকতর উন্নয়ন করে
পাসের উদ্যোগ গ্রহণ করা হলেও, এখনো পর্যন্ত আলোর মুখ দেখেনি। তবে এই উদ্যোগের অংশ হিসেবে স্বাস্থ মন্ত্রণালয় আবার “বেসরকারি স্বাস্থ্য সেবা আইন-২০১০ (খসড়া) প্রণয়ন করেছে। তবে কবে পাশ হবে এবং মানুষের স্বার্থ রা করবে তা দেখার বিষয়।

বাংলাদেশে বেসরকারীখাতে স্বাস্থ্যসেবার চিত্র পাওয়া যায় বিশ্ব ব্যাংকের ২০০৩ সালের একটি প্রতিবেদনে। সেখানে উল্লেখ করা হয়েছে “স্বাস্থ্যসেবা গ্রহণকারীদের মধ্যে শতকরা ৭০ ভাগ বেসরকারী স্বাস্থ্যখাত থেকে সেবা নিয়ে থাকেন (নিবন্ধিত নয় এমন সেবা প্রদানকারীসহ)। অর্থ ব্যয়ের নিরিখেও বেসরকারি খাতের কলেবর সরকারি খাতের দ্বিগুণের বেশি। স্বাস্থ্য বিষয়ক মুখপত্র হেলথ বুলেটিন ২০১০ এর উপাত্তের দিকে দৃষ্টি দিলে দেখা যায় ১৯৯৬-৯৭ সালে সরকারি খাতে মোট ব্যয়ের পরিমান ছিলো সর্বমোট স্বাস্থ্য ব্যয়ের ৩৬% এবং বেসরকারি খাতে ৬৪%, ১৯৯৭-৯৮ সালে ৩৪% ও ৬৬ %, ১৯৯৮-৯৯ সালে ৩১% ও ৬৯%, ২০০১-০২ সালে ৩০% ও ৭০%, ২০০২-০৩ সালে ২৮% ও ৭২%, ২০০৪-০৫ ও ২০০৫-০৬ সালে ২৬% ও ৭৪%। বেসরকারি খাতের ব্যয় বলতে ব্যাক্তিগত খাতের ব্যয়, বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের ব্যয়, এনজিও ব্যয় ও উন্নয়ন সহযোগীদের ব্যয়সমূহকে বোঝানো হয়েছে।

উপরেররর চিত্র থেকে বোঝা যায় বাংলাদেশের মানুষ আজ বেসরকারী স্বাস্থ্য খাত তথা বানিজ্যিক স্বাস্থ্য খাতের নিকট জিম্মি। তবে বিশ্বব্যাংকের এ সকল তথ্য যথেষ্ট সতর্কতার সাথে গ্রহণ করা উচিত। বিশ্বব্যাংকের এ সকল তথ্যের পরবর্তী পদপে থাকে ব্যবসার পথ তৈরি করা। রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান ও সরকারে জনস্বার্থে গৃহীত কার্যক্রমগুলোকে অযোগ্য এবং অকার্যকর প্রমাণিত করার প্রকল্পগুলো বানিজ্যিক কার্যক্রমের পথ সুগম করে দেয়। রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানের স্বাস্থ্য সেবাকে সংকুচিত করার প্রেেিত মানুষ কোন উপায় না পেয়ে সহায় সম্বল বিক্রি করে ছুটছে বানিজ্যিক স্বাস্থ্য সেবা কার্যক্রমের দিকে সেবা পেতে। বানিজ্য তার নিয়মেই পরিচালিত হচ্ছে মানুষ ও মানবাধিকার সেখানে পণ্য।

স্বাস্থ্য ও মানবাধিকার
বর্তমান প্রোপটে বানিজ্য ও স্বাস্থ্য অধিকার পারস্পরিক সাংঘর্ষিক বিষয়। যদিও বলবৎ সংবিধান, আন্তর্জাতিক চুক্তি সকল সকল বিষয়ে স্বাস্থ্যকে মানবাধিকার হিসেবে স্বীকৃতি প্রদান করেছে। বাংলাদেশ সংবিধানের রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতিতে রাষ্ট্রের অন্যতম মৌলিক দায়িত্ব হিসেবে চিকিৎসাকে চিহ্নিত করা হয়েছে। পাশাপাশি জনগণের পুষ্টির স্তর-উন্নয়ন ও জনস্বাস্থ্যের উন্নতি সাধনকে রাষ্ট্র অন্যতম প্রাথমিক কর্তব্য বলে গণ্য করার কথা সংবিধানের সুপষ্ট উল্লেখ্য করা হয়েছে। জাতীয় স্বাস্থ্য নীতি অনুসারে প্রাথমিক স্বাস্থ্য পরিচর্যার অত্যাবশ্যক সেবাগুলি রাষ্ট্রীয় ভূখন্ডের যে কোন ভৌগলিক অবস্থানে প্রত্যেক নাগরিকের কাছে পৌছে দেওয়াকে মূলনীতিতে স্থান দেওয়া হয়েছে। রাষ্ট্র পরিচালনার মূল দলিল অনুসারে জনগনের স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করা সরকারের অন্যতম দায়িত্ব ও কর্তব্য।

সার্বজনীন মানবাধিকার ঘোষণার ধারা ২৫ এ বলা আছে, স্বাস্থ্য ও কল্যাণের জন্য উপযুক্ত জীবনযাত্রার মান প্রাপ্তির অধিকার প্রত্যেকেরই আছে। খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থান, শিা, চিকিৎসাসহ প্রয়োজনীয় সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় সেবা ও সুবিধা লাভের অধিকার প্রত্যেকেরই প্রাপ্য। অর্থনৈতিক, সামাজিক এবং সাংস্কৃতিক অধিকার বিষয়ক আন্তর্জাতিক চুক্তি (ওঈঊঝঈজ)-এর ১২ অনুচ্ছেদ অনুসারে প্রত্যেকের সর্বোত্তম শারীরিক এবং মানসিক স্বাস্থ্য উপভোগ করার অধিকার রয়েছে। ১৯৭৮ সালে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার আলমা আতা ঘোষণায় স্বাস্থ্যসেবার অভিগম্যতাকে একটি অধিকার হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে এবং পৃথিবীর সকল দেশ তা গ্রহণ করেছে। ২০০০ সালের জাতিসংঘ কর্তৃক ঘোষিত সহস্রাব্দ উন্নয়ন ঘোষণায়ও এ অধিকারের বিষয়টি পূর্ণব্যক্ত করে স্বাস্থ্যকে উন্নয়নের কেন্দ্রে স্থান দেয়া হয়েছে। নীতি ও আর্দশের দিক হতে স্বাস্থ্যকে মানবাধিকার হিসেবে বিবেচনা করা হলেও, স্বাস্থ্য কার্যক্রম ছুটছে বানিজ্যকরনের দিকে।

স্বাস্থ্যকে বানিজ্যিক দিকে নিয়ে যাওয়ার প্রক্রিয়া সম্পর্কে তথ্য পাওয়া যায় ফরিদা আকতারের স্বাস্থ্য সেবা কোন দিকে ছুটছে এ লেখা হতে ‘‘ স্বাধীনতার পরের সময়ে মোহাম্মদপুর, শ্যামলী মিরপুর এলাকার গরিব মহিলারা বিশেষ করে সোহরাওর্য়াদী জেনারেল হাসপাতালের কথা উল্লেখ করলেন। এখানে ১ টাকার টিকেট কেটে চিকিৎসা করছেন এবং বিনামূল্যে চিকিৎসা সেবা নিয়েছেন। মধ্যবিত্ত মহিলারা আরো একটি তথ্য দিলেন তা হচ্ছে হঠাৎ করে আশির দশকে অস্ত্র প্রচারের বিষয়টি চোখে পড়তে শুরু করলো। সন্তান জন্ম দিতে গিয়ে সিজারিয়ান অপরেশনে বাচ্চা হওয়া যেন স্বাভাবিক বিষয় হলে উঠলো। অথচ সবার জন্য তা দরকার ছিল কি না এখন যে প্রশ্ন উঠে। খরচের ব্যাপারটাও বেড়ে গেল । ১৯৮৮ সালে একজন মহিলার প্রথম বাচ্চা সিজারিয়ান অপারেশনে হবার সময় খরচ হলো ১৩,০০০ টাকায়, ১৯৯৪ সালে দ্বিতীয় বাচ্চা হবার সময় খরচ হলো ৩০,০০০ টাকা। বর্তমানে তা আরো বেড়ে গেছে।’’ আর এখন এর বড় অংশ নিয়ন্ত্রণ করছে বানিজ্যিক খাত।

বেড়েছে বানিজ্য, বাড়ছে রোগ
স্বাস্থ্যখাত বানিজ্যিককরণের প্রেেিত আমাদের কতটুকু অগ্রগতি হয়েছে তা বিবেচ্য বিষয়। আগের তুলনায় মানুষের মাঝে রোগ অনেক বৃদ্ধি পেয়েছে এবং অনেক লোক চিকিৎসা পাচ্ছে না। উদাহরণ হিসাবে বলা যায় দেশে নীরব ঘাতক ব্যধি ডায়াবেটিসে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা বাড়ছে এবং ৭৫ শতাংশ ডায়াবেটিস রোগী রয়েছে চিকিৎসা সেবার বাইরে। ডায়াবেটিস রোগীদের জীবন রাকারী ওষুধের দাম বেড়েছে দ্বিগুন-তিনগুন এখনো নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত হয়ে বাংলাদেশে প্রতি ঘন্টায় ৭ টি শিশু মারা যায়। প্রতি বছর মারা যায় ৫০ হাজার শিশু। অপুষ্টির কারণে প্রতিদিন ৯০০ শিশু মারা যাচ্ছে। বাংলাদেশে প্রায় দেশের ৪০ ভাগ এলাকায় স্যানিটেশন সুবিধা নেই, পানিবাহিত রোগে প্রতিদিন মারা যাচ্ছে ৩৪২ শিশু। দেশে প্রায় ৮ ল ক্যান্সার রোগী আছে, তাদের মাঝে ৭ ল লোক চিকিৎসা পাচ্ছে না।

বাংলাদেশ অসংক্রামক রোগ দিন দিন বাড়ছে। আমাদের কর্মব্যস্ত জীবনে পরিকল্পিত খাদ্যাভাস গড়ে তোলার পরিবর্তে আমরা অতিরিক্ত চর্বিযুক্ত খাবার, কার্বহাইড্রেট, ফাস্ট ফুড, জাঙ্ক ফুডে অভ্যস্ত হয়ে পড়ছি। ফলে আমরা আক্রান্ত হচ্ছি ডায়াবেটিস এবং অতিরিক্ত মোটাজনিত রোগে। বাংলাদেশের ২০ বছরের উর্দ্ধ বয়সী গ্রামের মানুষের মাঝে ৭% এবং শহরাঞ্চলে ১৭ % লোক ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হচ্ছে এবং মোট মৃত্যুর ৬.২% ভাগ মৃত্যু হয় ডায়াবেটিসের কারনে। এছাড়া উন্নয়নশীল দেশগুলোতে জনগণ পরিকল্পিত খাদ্যাভাস সম্পর্কে অজ্ঞতা, সচেতনতা কম এবং অর্থনৈতিক দূর্বলতার কারনে অপুষ্টিতে ভুগছে।

আমাদের দেশে কায়িক শ্রমের অভাবে একটি বড় অংশের মানুষ আক্রান্ত হচ্ছে হৃদরোগ এবং উচ্চরক্তচাপ জনিত সমস্যায়। বাংলাদেশের গ্রামাঞ্চলের ১৮ এর উর্দ্ধ বয়সীদের শতকরা ১৩% (পুরুষ ৯.৮% ও মহিলা ১৫.৬%) উচ্চ রক্তচাপে আক্রান্ত হচ্ছে। তাছাড়া মোট মৃত্যুর শতকরা ২.৪ ভাগ হার্ট অ্যটাক. ৩.৬ ভাগ স্ট্রোক এবং ৬.৫ ভাগ অন্যান্য হৃদরোগ অর্থাৎ সর্বমোট ১২.৫ % মৃত্যুর কারণ নানাবিধ হৃদরোগ। বাংলাদেশে বায়ূ দূষনের কারণে বেড়ে যাচ্ছে শ্বাসতন্ত্রের দীর্ঘমেয়াদী রোগ। দেশের জনগনের প্রতি হাজারে যথাক্রমে পুরুষ ও মহিলাদের ৪৫ ও ২২ জনের হাপাঁনি বহির্ভূত শ্বাসতন্ত্রের দীর্ঘমেয়াদী রোগ রয়েছে। ফলে এই রোগের কারণে মৃত্যুর পরিমান মোট মৃত্যুর ৩%।

বাংলাদেশে প্রাপ্ত বয়স্ক জনগোষ্ঠীর মাঝে গ্রামাঞ্চলের ৪৩% ও শহরের ৯০% অপর্যাপ্ত কায়িক শ্রম করেন। তাছাড়া বাংলাদেশে প্রাপ্ত বয়স্ক জনগোষ্ঠীর মধ্যে গ্রামাঞ্চলে বেশীর ভাগ মানুষ প্রয়োজনীয় খাদ্য পায়না, কিন্ত শহরাঞ্চলে চাহিদার ৫৮% অধিক শর্করা ও ১৬% অধিক চর্বি গ্রহণ করেন। বাংলাদেশের গ্রামাঞ্চলের শতকরা ৩ ভাগ মহিলা ’’বিপাকীয় উপর্স’’ বা মেটাবেলিক সিনড্রোমে ভোগে। বাংলাদেশে ২০ উর্দ্ধ গ্রামের মহিলাদের ৬.৫% এবং শহরের মহিলা ও পুরুষদের যথাক্রমে ৫০% ও ৩১% ওজনাধিক্যে ভুগছে।

অসংক্রামক রোগের বিষয়ে আমাদের এখনই সচেতন হতে হবে। চিকিৎসার চেয়ে রোগ প্রতিরোধকেই প্রাধান্য দিতে হবে। এক সময় মনে করা হত, অসংক্রামক রোগ প্রতিরোধযোগ্য নয়, প্রকৃত পে শতকরা ৮০% অপরিণত হৃদরোগ, স্ট্রোক ও ডায়াবেটিস এবং ৪০ ভাগ ক্যান্সার প্রতিরোধযোগ্য। বিভিন্ন গবেষনা হতে জানা গেছে যে, কমিউনিটি ভিত্তিক পদপে দ্বারা অসংক্রামক রোগসমূহ প্রতিরোধযোগ্য এবং এই সকল রোগ চিকিৎসা করার চেয়ে প্রতিরোধ করা অর্থনৈতিকভাবে অনেক বেশী সাশ্রয়ী।

শুধু বাংলাদেশ নয়, পৃথিবীর মানুষ নতুন নতুন সংক্রামক ব্যাধির ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে। দিন দিন ঝুঁকি বাড়ছে। গবেষকরা বলছেন, মনুষ্য প্রজাতি গত ২৫ বছরে ৩৫টি নতুন সংক্রামক ব্যাধিতে আক্রান্ত হয়েছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, জনসংখ্যার এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে ছড়িছে পড়ছে। রোগ তত্ত্ববিদেরা বলছেন, পৃথিবীর মানুষ নতুন নতুন রোগে আক্রান্ত হচ্ছে। যুক্তরাজ্যের এডিনবার্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষক মার্ক উলহাউস ২৫ বছরের তথ্য বিশ্লেষণ করে করেছেন, এই সময়ে মানুষ ৩৮টি নতুন রোগে আক্রান্ত হয়েছে। এই রোগ মানুষের মধ্যে আগে ছিল না। এসব রোগের ৭৫ শতাংশ এসেছে জীবজন্তু ও পশু-পাখি থেকে।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা সংক্রামক ব্যাধির বিস্তার নিয়ে পর্যালোচনা করেছে। (গ্লোবালাইজেশন অ্যান্ড ইনফেকশাস ডিজিজেস: এ রিভিউ অব দ্য লিংকেজ) তাতে দেখা যায়, ১৯৯৫ সাল থেকে ৩০টি নতুন ও পুরোনো রোগ “নতুনভাবে আবির্ভূত হচ্ছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বলছে, বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধি, রৈখিক জলবায়ু পরিবর্তন, বড় বড় বাধ নির্মান, বন উজাড় হওয়া, বিস্তীর্ণ ভূমি ন্যাড়া হওয়া-এসব কারনে (সিলেকটিভ অ্যাডভান্টেজ) রোগের আবির্ভাব হচ্ছে। প্রতি আট মাসে একটি নতুন রোগের ঝুঁকি প্রতিরোধে দেশের প্রস্তুতি যথেষ্ট নয়।

রোগ নিয়ন্ত্রণে মনোযোগী না হয়ে মনোযোগ হচ্ছে স্বাস্থ্য বানিজ্যিক খাতে বিস্তারে। কারণ এই খাতটি অন্যতম একটি লাভজনক ব্যবসা। দরিদ্র মানুষ ব্যক্তি মালিকানাধীন স্বাস্থ্য সেবার জন্য এত টাকা দিতে পারছে না। তথাপিও বানিজ্যিক স্বাস্থ্য সেবা প্রতিষ্ঠানগুলো ছুটছে মফস্বল ও গ্রামের দিকে। সমস্যা হচ্ছে ব্যক্তি মালিকানাধীন এই স্বাস্থ্য কার্যক্রম হতে দীর্ঘমেয়াদী স্বাস্থ্যসেবা, গৃহভিত্তিক সেবা, জটিল ও দীর্ঘস্থায়ী রোগ এবং অন্যান্য গুরুতর স্বাস্থ্য সমস্যার সেবা পাওয়া যাবে না। ফলে সবার জন্য স্বাস্থ্য নীতি মূখ থুবড়ে পড়বে।

আমাদের দেহ যখন পন্য
স্বাস্থ্যখাত একটি বিশাল বানিজ্যিক খাত। ২০০৯ সালে প্রকাশিত এক তথ্যে দেখা যায় ৮ বছরে বেসরকারী চিকিৎসালয়ের আয় বেড়েছে ৫৩৬ শতাংশ, দিন দিন এর পরিমান বাড়ছে। বানিজ্যিকখাতে চিকিৎসা ব্যয় অস্বাভাবিক হারে বৃদ্ধি পাচ্ছে। উদাহরণ স্বরূপ বলা যেতে পারে, দেশের ৩৫টি সরকারী ও বেসরকরী হাসপাতালে বছরে একশ’র বেশী রোগীর দেহে কিডনি সংযোজন করা হয়ে থাকে। বেসরকারী হাসপাতালে একজন রোগীর কাছ থেকে সাড়ে ছয় লাখ টাকা আদায় করা হয়। অথচ সরকারী হাসপাতালে এ বাবদ চার্জ ৪৫ শতাংশ কম। বাংলাদেশে শুধুমাত্র চিকিৎসা েেত্র বছরে কয়েক হাজার কোটি টাকা খরচ করা হয়। অথচ সুস্থ্য থাকার জন্য পরিবেশ এবং সচেতন হলেই অনেক অসংক্রমক রোগ রয়েছে যেগুলো প্রতিরোধ করা সম্ভব ফলে এসব েেত্র ব্যায় করা অর্থ অন্য প্রয়োজনীয় খাতে ব্যবহার করা সম্ভব হবে।

বেসরকারী হাসপাতালগুলোতে স্বাস্থ্য ও চিকিৎসা একটি রমরমা বানিজ্যে পরিণত হয়েছে। আর অর্থ উৎপাদনের এই আধূনিক ব্যবস্থায় পিষ্ট হচ্ছে মানুষ। চিকিৎসার জন্য বিদেশগামী মানুষের স্রোত ঠেকাতে বিভিন্ন দেশী বিদেশী হাসপাতালকে অনুমতি প্রদান করা হলেও, বিগত সময়ের তুলনায় চিকিৎসার জন্য বিদেশ গমনের পরিমান অনেকাংশে বৃদ্ধি পেয়েছে। চিকিৎসাখাতে এই লাগামহীন বানিজ্য মানুষকে জিম্মি করে তুলছে। সংসদীয় কমিটির সুত্রে জানা যায়, বেসরকারী হাসপাতালগুলোতে ৩০ শতাংশ কম খরচে গরীব মানুষকে সেবা দেবে এই শর্তে হাসপাতালগুলোকে সরকারী অনুদান দেয়া হয়। কিন্তু হাসাপাতালগুলো নিয়ম মানে না।

রাষ্ট্রীয় মূলনীতি হিসেবে স্বাস্থ্য একটি মৌলিক অধিকার হলেও, অর্থনীতি উন্নয়নের উম্মাদনায় আমাদের বিচার বিবেচনা লোভ পাচ্ছে। বিশ্বব্যাংক ও আইএমএফর এর প্রভাবে ও চাপের কারণে সরকারী কিছূ নিয়ম কানুনের মধ্যে এটি পণ্য হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। তারই প্রেেিত স্বাস্থ্য সেবার টেষ্টসহ বিভিন্ন কার্যক্রমের উপর ভ্যাট আরোপ করা হয়। পরবর্তীতে একটি রিটের প্রেেিত সুপ্রিমকোর্টের হাইকোর্ট বিভাগ রোগীদের কাছ থেকে চিকিৎসাপত্র, প্যাথলজিক্যাল টেস্ট এবং সব ধরনের রোগ নির্ণয়, পরীা-নিরীার েেত্র প্রত্য বা পরোভাবে ভ্যাট আদায় করা বে-আইনি, সংবিধান পরিপন্থী ও অবৈধ ঘোষণা করে। পাশাপাশি ভ্যাট আদায় না করতে সরকার এবং সংশ্লিষ্টদের নির্দেশ দিয়েছে হাইকোর্ট।

অপর দিকে বিশ্বব্যাংকের ঋণ প্রকল্পের আওতায় (লোন#৪০৫২ বিডি) সরকারী পরিচালনাধীন রাষ্ট্রীয় হাসপাতালগুলো ইজারা দেওয়ার জন্য চাপ প্রয়োগ করে। পরবর্তীতে জনগনের আন্দোলনের প্রেেিত এই ইজারাদান বন্ধ হয়। তারপরও রাষ্ট্রীয় হাসপাতালগুলো কার্যক্রম বানিজ্যিকরণের ল্েয ইউজার ফি বৃদ্ধি এবং বন্টনের পরিকল্পনা গ্রহণ করে। জনগনের আন্দোলন এবং সুপ্রীম কোর্টের হাইকোর্টে ডিভিশনে রীটের প্রেেিত এ কার্যক্রম ও স্থগিত হয়। বাংলাদেশের প্রায় ৪০% মানুষ বিদ্যমান সরকারি-বেসরকারী উন্নয়ন সংস্থা পরিচালিত সামগ্রিক সুযোগ পাচ্ছে। ২৫% মুত্যু পথযাত্রী রোগী শিতি চিকিৎসকের পরামর্শ পায় না। ৭০% প্রসুতি নারী প্রসব-পূর্ব চেকআপ থেকে বঞ্চিত, ৭০% নারী রক্তশূন্যতার শিকার। এ অবস্থায় রাষ্ট্রীয় হাসপাতালগুলো সরকারী স্বাস্থ্যসেবা কার্যক্রম সংকুচিত করে মানুষের বাঁচার পথ থাকবে না।

স্বাস্থ্যখাতে অপর এক অনিয়ন্ত্রিত অবস্থার নাম ঔষধ বানিজ্য। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সাবেক মহাপরিচালক বলেছেন, বর্তমান চিকিৎসকদের ক্যাশ টাকা দিয়ে ওষুধ কোম্পানিগুলো তাদের নিজেদের ঔষধের নাম লিখিয়ে নিচ্ছে। ওষুধ প্রশাসনের হিসেব মতে দেশে এলোপ্যাথিক ২৩৭টি, হোমিওপ্যাথিক, আয়ুবের্দিক ও হারবালসহ ৮০০(আটশত) ওষুধ কোম্পানি আছে। ২২২টি কোম্পানির ওষুধ তৈরীর অনুমতি আছে। ১৬৪টি কোম্পানি ঔষুধ উৎপাদন করছে। এমন কোনো কোম্পানি আছে যার মাত্র ০৫টি ঔষধ এর উৎপাদনের অনুমতি থাকলেও উৎপাদন করছে প্রায় ২০টি ঔষুধ। এসব কোম্পানি অবৈধভাবে ঔষুধ উৎপাদন করে দেশের আইন ও প্রশাসনকে বৃদ্ধাঙ্গুলী প্রদর্শন করছে। কিছুদিন পূর্বে ভেজাল ও নিম্নমান বা নকল প্যারাসিটামল সিরাপ ব্যবহারে ২৪টি শিশুর অকাল মৃত্যু হয়। তথাপিও তা নিয়ন্ত্রণে কোন ধরনের উদ্যোগ নেই। সরকারী ঔষধ কারাখানাটিকে অকার্যকর করে রাখা হয়েছে বেসরকারী কোম্পানিগুলোর বাজার সৃষ্টির জন্য। ২০০৮ সালের এক তথ্য অনুসারে দেখা যায় বাংলাদেশে ঔষুধখাতে বানিজ্যের পরিমান আনুমানিক ৬০০০ কোটি টাকা।

ঔষধ বানিজ্যের চিত্র পাওয় যায়, ডাঃ মুনির উদ্দিন আহমদ এর লেখায় ‘‘১৯৮১ সালে বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থার সহযোগিতায় জাতিসংঘের শিল্প উন্নয়ন সংস্থা বাজারজাতকৃত ২ লাখ ওষুধ থেকে মাত্র ২৬টি ওষুধের একটি তালিকা প্রকাশ করে যেগুলোকে অপরিহর্য বলে বিবেচনা করা হয়। তাহলে অন্য অসংখ্য ওষুধের কাজ কী ? যদি সেগুলো অপরিহার্য না হয়ে থাকে। ১৯৭২ সালে চিলি এবং ১৯৭৮ সালে শ্রীলংকার মেডিকেল কমিশন বাজার জরিপ করে দেখতে পায়, মাত্র কয়েক ডজন ওষুধ জীবন ও সুস্থ্যতার জন্য প্রয়োজনীয়। মজার ব্যাপার হল- এ তথ্য প্রকাশ পাওয়ার পর দুই দেশের সরকার উৎখাত হয়ে গিয়েছিল মার্কিন সমর্থিত সরকার দ্বারা। পরবর্তী সময়ে মার্কিন সমর্থিত সরকারদ্বয় তাদের দেশে আমেরিকান কেমিক্যালস ও ফার্মাসিউটিক্যাল প্রোডাক্টস আমদানি ও ব্যবসার সুযোগ করে দিয়েছিল।

একটু খোলামন নিয়ে উপলব্ধি করতে চেষ্টা করলে বুঝতে কারও অসুবিধা হওয়ার কথা নয়, অকিঞ্চিৎকর ও অভিপ্রায়মূলক ওষুধ পরীা-নিরীা ওষুধ কোম্পনিগুলোর আকাশচুম্বী মুনাফার জন্যও অত্যাবশ্যক। এ ধরনের বক্তব্যের সপে যুক্তি খুঁজে পাওয়া যাবে ই-লিলির ১৯৯৩ সালের প্রোজাক ওষুধ বিষয়ক পুস্তিকার ভাষা পড়লে। এত বলা হয়-“এমন কোন প্রেসক্রিপসন ড্রাগ নেই যা শতভাগ নিরাপদ। এমনও হতে পারে, কোন ওষুধ বহু বছর ধরে ব্যাপকভাবে ব্যবহার করলে তার পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া দৃশ্যমান হতে পারে।” যদি তাই হয় অর্থাৎ কোন বিশেষ ওষুধ কোন বিশেষ রোগীর েেত্র ভিন্নভাবে প্রতিক্রিয়া দেখালে তবে আলাদা জীবজন্তুর ওপর পরীা-নিরীা চালানোর যৌক্তিকতা থাকে কি? এ প্রসঙ্গে এক অভিজ্ঞ চিকিৎসক বলেন, জীবজন্তুর ওপর চালানো পরীার ফলাফলের ওপর ভিত্তি করে কোন ওষুধ মানবদেহে প্রয়োগ করলে তার নিরাপত্তা নিশ্চিত হবে না।’’

এ বিষয়গুলো মানুষের শরীর ও স্বাস্থ্য নিয়ে বানিজ্যিক কার্যক্রমের একটি অংশিক চিত্র। স¤পূর্ণ চিত্র তার চেয়ে ভয়ংকর। মানুষের রোগ, শরীর সর্বোপরি জীবন ও মরণ নিয়ে বানিজ্যের অবসান রাষ্ট্র ও সরকারের হাতে। রাষ্ট্রের আইন আর সরকারের পদপেই পারে মানুষকে এই অমানবিক বানিজ্যিক কার্যক্রম হতে মুক্তি দিতে।




সকলের জন্য স্বাস্থ্যসেবা ও রাষ্ট্রীয় ব্যয়
বাংলাদেশ একটি উন্নয়নশীল রাষ্ট্র। আমাদের অর্থ কম, এই শব্দগুলো দেশের সাধারণ মানুষের সুবিধাকে সংকুচিত করার হাতিয়ারে পরিণত হয়েছে। অর্থনৈতিক উন্নয়নের দোহাই দিয়ে বিভিন্ন কার্যক্রম গ্রহণ করলেও জনগণের সুবিধা মূলত সংকোচন করা হয়েছে। অথচ বৈদেশিক ঋণ, পেনশনভাতা, প্রজাতন্ত্রের কর্মীদের বেতন, বেসরকারী কোম্পানীগুলোর সুবিধার জন্য বাজেটে অর্থ বা প্রণোদনা বৃদ্ধি পাচ্ছে।

সম্প্রতি ঢাকায় প্রাইভেট কার কে প্রধান্য দিয়ে একটি বিলাস বহুল এলিভেটর একপেক্সওয়ে নিমার্ণের পরিকল্পনা করা হয়েছে। এ বাজেট প্রায় ১৮,০০০০ কোটি টাকা। যা বাংলাদেশের ১৬ কোটি মানুষের প্রায় ২ বছর ৬ মাসের স্বাস্থ্য বাজেটের সমান। অপর দিকে তেল আমদানীতে আইডিবি হতে ১৪০০০ হাজার কোটি টাকার ঋণ নেয়া হচ্ছে। এই তেলের একটি বড় অংশ ব্যবহার হয় প্রাইভেট গাড়ীর জন্য। এছাড়া হাজার হাজার কোটি টাকা ব্যয় হচ্ছে নানা অপ্রয়োজনীয় খাতে। সাধারণ মানুষের জন্য কোন বরাদ্ধ ও সুবিধার কথা আসলেই বলা হয় আমাদের অর্থ নেই। অপ্রয়োজনীয় খাতে অর্থ বরাদ্ধ হ্রাস করে জনস্বাস্থ্য উন্নয়নের মতো বিষয়ে ব্যয় করা উচিত।

নিচের টেবিলে দেশের স্বাস্থ্য বাজেটে কমে আসার একটি চিত্র তুলে ধরা হলো। ২০০২-০৩ অর্থ বছরের স্বাস্থ্যখাতে বাজেট ছিল ৬.৪৭%, ২০০৯-১০ সালে ছিল ৬.১৫% এবং ২০১০-২০১১ সালে তা কমে দাঁড়িয়েছে ৬.০। অর্থাৎ স্বাস্থ্যখাতে বরাদ্ধ দিন দিন হ্রাস পাচ্ছে। আবার এ অর্থের বড় অংশ ব্যয় হয় প্রশাসনিক ও অবকাঠামোর খাতে। জনগনের স্বাস্থ্য জন্য ব্যয় নেই বলেই চলে। বিভিন্নখাতে জনগণের সেবার জন্য অর্থ প্রদানকে ভর্তুকী হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। অনেকেই বলে থাকেন এ খাতে ভতুর্কী প্রদান করা উচিত নয়। জনগণের অর্থ জনগণের সেবায় না প্রদানের নানা টালবাহানা করা হয়। অনেকেই সেবাখাতে অর্থ প্রদানকে অহেতুক মনে করেন। বিনামূল্যে কোন কিছুই দেয়া উচিত নয় যে সকল কর্মকর্তা বা ব্যক্তি বিশ্বাস করেন তাদের নিকট প্রশ্ন এ রাষ্ট্র কেন প্রজাতন্ত্রের সেই সকল কর্মীদের পেনশন প্রদান করবে যারা কাজ হতে অবসর নিয়েছেন ? প্রজাতন্ত্রের অবসরপ্রাপ্ত কর্মীদের পেনশন যেমন যৌক্তিক, তেমনি জনগনের সেবাখাতে সরকারের আর্থিক যোগান সৃষ্টিও যৌক্তিক ও দায়বদ্ধতা।


বাজেটে স্বাস্থ্য খাতে যে অর্থ বরাদ্দ হয় তার পুরোটাই রোগ পরবর্তী সেবা প্রদানের জন্য কিন্তু রোগ প্রতিরোধের জন্য সেভাবে বাজেটে কোন অর্থ বরাদ্দ দেয়া হয়না। রোগ প্রতিরোধ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। এই বিষয়টাকে অবশ্যই গুরুত্বসহকারে দেখা উচিত। রোগ প্রতিরোধের সাথে দেশের মানুষের রোগ মুক্তিসহ দেশের অর্থনীতির জড়িত। তাই বাজেটে অবশ্যই রোগ নিরাময়ের সাথে রোগ প্রতিরোধের জন্য অর্থ বরাদ্দ দেয়া প্রয়োজন। বিগত বাজেটে অর্থমন্ত্রী মানুষের গড় আয়ু ২০২১ সালের মধ্যে ৭০ এর কোঠায় উন্নীত করার আশা ব্যাক্ত করেছেন। এর জন্য চিকিৎসা ব্যবস্থার চাইতে রোগ প্রতিরোধ ব্যাবস্থাকে গুরুত্ব দিতে হবে। মানুষকে রোগ প্রতিরোধের মাধ্যমে রোগ মুক্ত রাখা গেলে তার আয়ু বাড়ানো সম্ভব হবে। তবে এর জন্য সরকারকে বাজেটে রোগ প্রতিরোধ করার জন্য আলাদা অর্থ বরাদ্দ দেওয়া প্রয়োজন।

সাধারণত যে মাপকাঠিতে দরিদ্রতা নিরূপন করা হয়, দরিদ্রতা তার চেয়ে আরো ভয়ংকর। তথাকথিত অর্থনৈতিক মাপকাঠিতে মধ্যবিত্ত বা উচ্চমধ্যবিত্ত শ্রেণী বলে যাদের চিহ্নিত করা হয় বতর্মান চিকিৎসা বণিজ্যের নিকট তারাও দরিদ্র। দেশের অনেক পরিবার আছে যারা চিকিৎসা করাতে গিয়ে সর্বস্বান্ত হচ্ছে। পত্র-পত্রিকার পাতা খুললেই চোখে পড়ে চিকিৎসার সহযোগিতা পাবার আকুতি। অনেক মানুষ আছে লজ্জায় তাদের সমস্যা বলতে পারে না। হাসপাতালগুলোর সামনে গেলেই দেখা যায় এ মানুষগুলোর ভোগান্তি। ঘরের মুরগি, গরু, চাল বা অন্য পণ্য অথবা উপকরণ বিক্রি করে কিংবা ধার করে চিকিৎসা করাতে এসেছে মানুষ। দেশের অনেক সাধারণ মানুষ চিকিৎসকদের নিকট চিকিৎসা না করিয়ে ঝাড়-ফুঁক বা অন্য কোন ভ্রান্ত চিকিৎসা পদ্ধতি গ্রহণ করছে। যদি স্বাস্থ্য ব্যয় এভাবে বৃদ্ধি পায় তবে মানুষ উপায় না দেখে ভ্রান্ত চিকিৎসার দ্বারস্ত হবে।

আমরা সুস্থ্যভাবে বাচঁতে চাই। আমাদের রোগের জন্য চিকিৎসা চাই। অর্থনৈতিক উন্নয়নের উম্মাদনায় অপ্রয়োজনীয়খাতে অর্থ ব্যয় না করে জনস্বার্থে সরাসরি ব্যয় করা হোক। আমরা রাষ্ট্রীয় স্বাস্থ্যসেবা চাই। স্বাস্থ্যসেবার নামে আমাদের শরীরকে বানিজ্যি পন্য রূপান্তর করা হোক তা চাই না। আমরা এমন একটি দেশ গড়তে চাই, যে দেশ হবে পৃথিবীর অন্যতম দেশ হিশেবে পরিচিত হবে, যেখানে রাষ্ট্র জনগণের স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করে। স্বাস্থ্য যেখানে মানবাধিকার হিসেবে প্রতিষ্ঠিত। স্বাস্থ্য বাণিজ্য কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ করা হয়, রোগপ্রতিরোধ এ দেশের স্বাস্থ্যনীতির মূলভিত্তি। পৃথিবী আমাদের নিকট হতে শিখবে স্বাস্থ্যসেবা কিভাবে নিশ্চিত করা যায়।

তথ্যসুত্র
১. বেসরকারী খাতের চিকিৎসা ব্যবস্থা, শীর্ষক মতবিনিময় সভা, স্বাস্থ্য অধিকার আন্দোলন জাতীয় কমিটি
২. বেসরকারী হাসপাতালে কম খরচে পেতে সেবা আইন করার চিন্তা সংসদীয় কমিটির, ২৮ মার্চ ২০১০, আরটিএনএন ডটনেট,
৩. দীর্ঘমেয়াদী অসংক্রামক রোগ ও বাংলাদেশ: একটি তথ্যচিত্র, এন,সি,ডি, স্বাস্থ্য অধিদপ্তর, স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা
৪. সর্বজনীন স্বাস্থ্যসেবা রাষ্ট্রের দায়িত্ব, ১৩ জুন, ২০০৯, ডা. মুশতাক হোসেন, সাধারণ সম্পাদক, বাংলাদেশ চিকিৎসা সংসদ।
৫. একটি গণমুখী স্বাস্থ্যনীতির ল্েয, স্বাস্থ্য আন্দোলনের পর্যালোচনা, উবেনীগ
৬. স্বাস্থ্য অধিকার, বছর ১, মার্চ, ২০১০ স্বাস্থ্য আন্দোলন
৭. মাহফুজ কবীর, বাংলাদেশে স্বাস্থ্য, দারিদ্র ও সরকারী ব্যয়, বাংলাদেশ উন্নয়ন সমীা, একবিংশতিতম খন্ড বার্ষিক সংখ্যা ১৪১০
৮. তেল আমদানতে আইডিবি ১৪ হাজার কোটি টাকার ঋণ দিচ্ছে, আমাদের অর্থনীতি, ৩১ ডিসেম্বর ২০১০
৯. আজিমপুর মাতৃসদন: টাকা না দিলে নার্স আয়ারা সন্তান দিতে চায় না; বাংলাবাজার পত্রিকা, মঙ্গলবার, ১ জুলাই ২০০৮।
১০. ৮ বছরে বেসরকারি চিকিৎসালয়ের আয় বেড়েছে ৫৩৬ শতাংশ, নয়া দিগন্ত, শুক্রবার, ২৬ জুন ২০০৯।
১১. বেসরকারি চিকিৎসকদের স্বেচ্ছাচারিতা কিনিকগুলোয় প্রতারনা বাণিজ্য, ডেসটিনি, সোমবার, ২৪ মার্চ ২০০৮।
১২. উপযুক্ত কারণ ছাড়াই ৬০ ভাগ রোগীকে এন্টিবায়োটিক দেয়া হয় হাসপাতালে, আমার দেশ, শনিবার, ২১ মার্চ ২০০৯।
১৩. ভুল চিকিৎসার শিকার অনেক শিশু: নেই মনিটরিং, আমার দেশ, শনিবার, ৪ এপ্রিল, ২০০৯।
১৪. চিকিৎসা সেবায় অনুকরনীয় মিটফোর্ড হাসপাতাল, ডেসটিনি, বৃহস্পতিবার, ৯ এপ্রিল ২০০৯।
১৫. পরীার নামে রোগীদের গলা কাটছে প্রাইভেট ডায়াগনস্টিক সেন্টারগুলো, সোমবার, ১৩ এপ্রিল ২০০৯।
১৬. ল্যাবএইড হাসপাতালে আধুনিক চিকিৎসা হলেও ব্যয় বেশি, কর্তৃপরে দাবি অন্য দেশের চেয়ে অর্ধেক, ইত্তেফাক, বুধবার, ২ এপ্রিল, ২০০৮।
১৭. প্র্ইাভেট মেডিকেলে ভর্তি অনিয়ম ঠেকাতে হার্ডলাইনে সরকার, সমকাল, ৮ ডিসেম্বর ২০০৯।
১৮. ঢামেক হাসপাতালে বছরে দশ লাখ রোগীর চাপ, যুগান্তর শুক্রবার, ২৩ জানুয়ারি ২০০৯।
১৯. স্বাস্থ্য খাতে জেঁকে বসেছে বেহিসাবি অনিয়ম। সমকাল, বুধবার, ২১ জানুয়ারি ২০০৯।
২০. চিলমারী ও শাহাজাদপুরের চর এলাকার স্বাস্থ্য সেবার চিত্র, রোকেয়া বেগম, উবিনীগ।
২১. জাতীয় স্বাস্থ্যনীতি পুনগঠনে জনগণের প্রত্যাশা, শশাঙ্ক বরণ রায়, স্বাস্থ্য অধিকার আন্দোলন জাতীয় কমিটি।
২২. স্বাস্থ্য সেবা কোনদিকে ছুটছে, ফরিদা আখতার।
২৩. জাতীয় স্বাস্থ্য বাজেট: প্রোপট-স্বাস্থ্য অধিকার; ডাঃ মোঃ আব্দুল মতিন সদস্য, বাংলাদেশ স্বাস্থ্য অধিকার আন্দোলন
ও সাধারন সম্পাদক, বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা)
২৪. বিপন্ন স্বাস্থ্য ব্যবস্থা, সেবার জন্য আর কত অপো, ডা. মোরশেদ চৌধুরী, সাপ্তাহিক ২০০০।
২৫. সরকারী স্বাস্থ্য সেবার নমুনা, প্রতিবেদন, সাপ্তাহিক ২০০০
২৬. ওষুধের দাম লাগাম ছাড়া, সাপ্তাহিক ২০০০
২৭. জাতীয় বাজেট এবং বাংলাদেশের স্বাস্থ্য খাত, সশাসনের জন্য প্রচারাভিজান (সুপ্র) আয়োজিত ২০০৭-০৮ অর্থবছরের বাজেট পর্যালোচনার জন্য রচনা উপকরন।
২৮. বেসরকারি চিকিৎসা প্রতিষ্ঠানে সরকারের নিয়ত্রণ নেই। দৈনিক জনকণ্ঠ, শনিবার, ৩১ জুলাই ২০১০
২৯. স্বাস্থ্য সুযোগ নয়, অধিকার, স্বাস্থ্যসেবার বেসরকারিকরণ ও বাণিজ্যিকীকরণ বন্ধ করতে হবে। স্বাস্থ্যসেবা চিত্র এবং স্বাস্থ্যনীতি ২০০৯ শীর্ষক জাতীয় মতবিনিময় সভায় আলোচনাপত্র, ২২ ডিসেম্বর ২০০৯।
৩০. খসড়া জাতীয় স্বাস্থ্যনীতি ২০০৯, সুশাসনের জন্য প্রচারাভিযান- সুপ্র’র সুপারিশ ও মতামত।
৩১. স্বাস্থ্যসেবা প্রাপ্তির অধিকার সকলের, সুশাসনের জন্য প্রচারাভিযান- সুপ্র, ৭ এপ্রিল, ২০০৯।
৩২. বেসরকারি খাতের চিকিৎসাব্যবস্থা, স্বাস্থ্য অধিকার আন্দোলন জাতীয় কমিটি।
৩৩. রাষ্ট্রীয় হাসপাতাল বেসরকারীকরণ: জনস্বাস্থ্যের উপর প্রভাব, ২৯ মার্চ, ২০০৮, স্বাস্থ্য অধিকার জোট।
৩৪. স্বাস্থ্যনীতিতে স্বাস্থ্যকে বানিজ্য নয়, সেবা হিসেবে বিবেচনা করতে হবে, স্বাস্থ্য পন্য নয়, মানবাধিকার, সৈয়দ মাহবুবুর আলম, উন্নয়ন কর্মী।
৩৫. স্বাস্থ্য অধিকার জোট, ২৭ জুলাই ২০০৮।
৩৬. স্বাস্থ্য সেবা বেসরকারীকরণ, সমস্যা না উত্তরণ; ২৭ জুলাই ২০০৮, স্বাস্থ্য অধিকার জোট।
৩৭. উপজেলা পর্যায়ে স্বাস্থ্য ব্যবস্থা ও ভুল চিকিৎসার খতিয়ান, উবিনীগ
৩৮. আশংকাজনক হারে রোগ বিস্তারঃ রোগ প্রতিরোধে স্বাস্থ্যনীতি, সৈয়দ মাহবুবুল আলম, কামরুন্নিছা মুন্না, ডাব্লিউবিবি ট্রাস্ট।
৩৯. জাতীয় শিা ও স্বাস্থ্যনীতি এবং দারিদ্র বিমোচন কৌশলপত্রের পোপটে যাযাবর বেদে সমাজের উন্নয়ণ, এ কে এম মাকসুদ, সৌদ খান, গ্রাম বাংলা উন্নয়ন কমিটি।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন