সোমবার, ১৯ জুলাই, ২০১০

জনগনের হাসপাতালে ইউজার ফি,রাষ্ট্রীয় স্বাস্থ্য সেবার দায়িত্ব বিঘ্নিত

জনগনের হাসপাতালে ইউজার ফি
রাষ্ট্রীয় স্বাস্থ্য সেবার দায়িত্ব বিঘ্নিত

স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয় এক সিদ্ধান্তের মাধ্যমে সরকার পরিচালিত রাষ্ট্রায়াত জনগণের হাসপাতালগুলোতে ইউজার ফি বৃদ্ধি এবং এ সকল অর্থ চিকিৎসক, নার্স, টেকিনিশিয়ান এবং হাসপাতালের অন্যান্য কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের মাঝে বিতরণের উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে। অর্থনৈতিক মন্দা ও দারিদ্রতা ক্রমাগত বৃদ্ধি এবং জনগণের স্বাস্থ্যসেবা প্রদানের লক্ষ্যে কমিউনিটি ক্লিনিকের মতো সরকারের অব্যাহত উদ্যোগের প্রেক্ষিতে জনগণের অর্থে পরিচালিত রাষ্ট্রীয় হাসপাতালগুলোতে ইউজার ফি বৃদ্ধি অযৌক্তিক এবং অসাংবিধানিক। দেশের স্বাস্থ্য অধিকার রক্ষায় কার্যরত প্রতিটি ব্যক্তি, সংগঠন আমরা অনতিনবিলম্বে এ কার্যক্রম বন্ধে সরকারকে আহবান জানাই। জনগনের হাসপাতালে ইউজার ফি গ্রহণের প্রেক্ষিতে স্বাস্থ্য অধিকার লংঙ্ঘনসহ নানা সমস্যা সৃষ্টি হবে। ইউজার ফি বন্ধের প্রয়োজনীয়তা বিষয়ে আমাদের অবস্থান তুলে ধরছি।

ইউজার ফি ও বন্টন ব্যবস্থা
সিটি কর্পোরেশনে অবস্থিত বিশেষায়িত হাসপাতালগুলোতে ইউজার ফির সমুদয় টাকার শতকরা ৪০ ভাগ পরিচালক, অধ্যাপক বা সমপর্যায়ের কর্মকর্তারা, উপপরিচালক, সহযোগী অধ্যাপক, সহকারী পরিচালক, সহকারী অধ্যাপক বা সমমানের কর্মকর্তারা, মেডিক্যাল অফিসার বা সমমানের কর্মকর্তারা, ৩য় ও ৪র্থ শ্রেণীর কর্মচারীর মধ্যে সমভাবে বন্টন করা হবে। সরকারী কোষাগারে জমা হবে শতকরা ৩০ ভাগ। আর অবশিষ্ট ৩০ ভাগ রক্ষণাবেক্ষণে খরচ করা হবে। মেডিক্যাল হাসপাতালগুলোতে শতকরা ৫০ ভাগ টাকা উপরিল্লেখিত কর্মকর্তা-কর্মচারীর মধ্যে সমভাবে খরচ করা হবে। আর সরকারী কোষাগারে শতকরা ২৫ ভাগ এবং অবশিষ্ট ২৫ ভাগ রক্ষণাবেক্ষণ বাবদ খরচ করা হবে।

জেলা সদর হাসপাতাল ও জেনারেল হাসপাতালে শতকরা ৫০ ভাগ টাকার মধ্যে উপপরিচালক, সহযোগী অধ্যাপক, সহকারী পরিচালক, সহকারী অধ্যাপক বা সমমানের কর্মকর্তারা সমভাবে ভাগ পাবেন। আর সিভিল সার্জন/তত্ত্বা‌বধায়ক, সিনিয়র কনসালটেন্ট, জুনিয়র কনসালটেন্ট, আরএস/আরপি, আরএমএ বা সমপর্যায়ের কর্মকর্তারা সমভাবে শতকরা ১৫ ভাগ, মেডিক্যাল অফিসার বা সমমানের কর্মকর্তারা ১০ ভাগ, তৃতীয় শ্রেণীর কর্মচারীরা সমভাবে শতকরা ১৫ ভাগ ও চতুর্থ শ্রেণীর কর্মচারীরা সমভাবে শতকরা ১০ভাগ পাবে। অবশিষ্ট ২৫ ভাগ সরকারী কোষাগারে এবং শতকরা ২৫ ভাগ রক্ষণাবেক্ষনে সমভাবে ব্যায় করা হবে। উপজেলা হাসপাতালগুলোতে উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা/জুনিয়র কনসালটেন্ট বা সমপর্যায়ের কর্মকর্তারা শতকরা ১৫ ভাগ, মেডিক্যাল অফিসার ও সমমানের কর্মকর্তরা সমভাবে শতকরা ১০ ভাগ ও চতুর্থ শ্রেণীর কর্মচারীরা সমভাবে ১০ ভাগ পাবে। উপজেলা হাসপাতালে শতকরা ২০ ভাগ টাকা সরকারী কোষাগারে এবং শতকরা ২০ ভাগ রক্ষণাবেক্ষণে ব্যায় করা হবে।

জনগনের স্বাস্থ্য উন্নয়ন একটি দেশের সার্বিক উন্নতির অন্যতম প্রধান শর্ত। রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থা, পুষ্টিস্তর উন্নয়ন এবং চিকিৎসা সেবা ইত্যাদি দেশের মানুষের স্বাস্থ্য সেবা উন্নয়নের অন্যতম কার্যক্রম। রোগপ্রতিরোধের মতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে দেশে কার্যক্রম খুবই নূন্যতম হলেও, চিকিৎসা বিষয়ক সরকারী ও বেসরকারী কার্যক্রম ব্যাপক। তবে প্রশ্ন হচ্ছে কতটুকু সাধারণ মানুষের সুবিধার জন্য ব্যয় হচ্ছে। সরকারের চিকিৎসা বাজেটের একটি বড় অংশ ব্যয় বেতনভাতা ও অবকাঠামো খাতে। সীমিত সম্পদ ও লোকবল এবং অধিক রোগীর চাপে রাষ্ট্রয়াত্ব হাসপাতাগুলোতে চিকিৎসা সেবা খুবই নাজুক।


অপর দিকে অধিকাংশ বেসরকারী হাসপাতাল ও ক্লিনিকগুলোতে চিকিৎসা একটি রমরমা বাণিজ্য হিসেবে দেখা হয়। চিকিৎসার মাধ্যমে জনগণকে সেবা প্রদান অপেক্ষা, চিকিৎসা কেন্দ্রে আসা জনগণ হতে নানা উপায়ে অর্থ বের করে নিয়ে আসাই হচ্ছে বেসরকারী চিকিৎসা সেবার বর্তমান অবস্থা। আর এ অবস্থার প্রেক্ষিতে যদি রাষ্ট্রায়াত্ত্ব তথা জনগণের হাসপাতালেও চিকিৎসা বাণিজ্য শুরু হয় তবে এ দেশের মানুষের বাঁচার পথ থাকবে না।

রাষ্ট্রায়াত্ত্ব প্রতিষ্ঠানের অর্থ ইউজার ফি-র নামে বন্টন ব্যবস্থা কতটুকু সাংবিধানিক?
বাংলাদেশের সংবিধান অনুযায়ী এ রাষ্ট্রের প্রতিটি সম্পদের মালিক জনগণ। প্রচলিত অর্থে সরকারী হাসপাতালগুলোর মালিকও জনগণ। জনগণ তাঁর সেবা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে প্রজাতন্ত্রের কর্মচারী বা সেবক নিয়োগ করেন। যাদের জনগণের প্রদত্ত্ব কর হতে রাষ্ট্রীয় আইন ও নিয়মানুসারে বেতনভাতা ও অন্যান্য সুবিধ প্রদান করা হয়। তারপরও যদি রাষ্ট্রয়াত্ত্ব প্রতিষ্ঠানে আয়কৃত অর্থ কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের মাঝে বিতরণ করা হয় তবে বিষয়টি জনগনের সেবক না, মুনাফাভোগী এ দুইয়ের মাঝে সাংঘষির্ক হয়ে দাড়ায়। রাষ্ট্র জনসেবকদের বেতন ও অন্যান্য সুবিধা দিচ্ছে জনগনের সেবা প্রদানের জন্য। তাদের কেন আবার রাষ্ট্রায়াত্ত্ব প্রতিষ্ঠানের আয়ের ভাগ প্রদান করা হবে। যদি আয়ের এ ধরনের ভাগ আইন, বিচার, শিক্ষা, পরিবেশ, অর্থ, প্রশাসন, পুলিশ সকল বিভাগে চালু হয় তবে দেশের অবস্থা কি হব? আমরা অবশ্যই চাই একজন চিকিৎসক মানসম্মত বেতন পান। তার মানসম্মত বেতনের জন্য আইনের মাধ্যমে বেতনের কাঠামোর পরিবর্তন ও অন্যান্য সুবিধা নিশ্চিত করা যেতে পারে। কিন্তু রাষ্ট্রয়াত্ত্ব প্রতিষ্ঠানে ব্যবহার করে জনগণের কর হতে অর্থ গ্রহণ করে, রাষ্ট্রায়াত্ত্ব প্রতিষ্ঠানের আয় ভাগ করা কোনভাবেই উচিত নয়।

প্রজাতন্ত্রের কমর্চারীর পদকে একটি লাভজনক মুনাফালোভী পদে রূপান্তরের প্রেক্ষিতে জনগণের সেবা ও সাংবিধানিক অধিকার লংঙ্ঘিত হবে। জনগণের জন্য নির্মিত স্বাস্থ্য সেবা প্রতিষ্ঠান বা হাসপাতালগুলো রূপান্তর হবে জনগণের নির্যাতনের হাতিয়ার রূপে। কেননা হাসপাতালের চিকিৎসক, নার্স, টেকনিশিয়ান ও অন্যান্য কর্মচারীরা তাদের লাভ বৃদ্ধির জন্য সরকারকে সেবামূল্য বৃদ্ধির জন্য চাপ প্রয়োগ করতে পারে। যত সেবামূল্য বাড়বে, ততই বাড়বে তাদের লাভ। এখানে সেবা প্রদানের মান বাড়ানোর চেয়ে সেবাপ্রদানকারীর লাভ বৃদ্বিই মুখ্য হয়ে দাঁড়াবে।

ইউজার ফি প্রচলনের অন্তরালের ঋণপ্রদানকারী সংস্থার অভিপ্রায়
সেবাখাত বিরাষ্ট্রীয়করণের লক্ষ্যে দাতাসংস্থা নামক এডিবি, আইএমএফ, বিশ্বব্যাংকের মতো ঋণপ্রদানকারী সংস্থাগুলো নানাভাবে সরকারকে চাপ প্রদান করে আসছে। বিশ্বব্যাংকের একটি ঋণের প্রকল্পের আওতায় ইউজার ফি প্রচলনের প্রক্রিয়া শুরু হয়। বিগত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে জনগণের হাসপাতালগুলোতে ইউজার ফি প্রচলনের পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়। কিন্তু প্রচন্ড বিরোধীতার কারণে এ প্রক্রিয়া বন্ধ হয়। পরবর্তীতে আবার এ কার্যক্রম চালু করা হয়েছে।

ঋণপ্রদানকারী সংস্থাগুলো ডিভাইড এন্ড রুল নীতি প্রয়োগ করে সরকারকে অকার্যকর বা অদক্ষ প্রমাণের মাধ্যমে রাষ্ট্রায়াত্ত্ব খাতগুলো বিরাষ্ট্রীয় করার পদক্ষেপ গ্রহণ করে থাকে। যদি আমরা বিগত দিনে তাকালে দেখবো টেলিযোগাযোগ, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, খাদ্য বা পাটশিল্পের মতো অন্যান্য প্রতিষ্ঠানগুলোতে তারা প্রথমে ঋণের টাকায় পরামর্শ প্রদান করেছে। পরবর্তীতে তাদের পরামর্শে রাষ্ট্রায়াত্ত্ব খাতের ব্যবস্থাপনাগুলো ধ্বংশ এবং অনিয়মের প্রেক্ষিতে প্রতিষ্ঠানগুলোতে দুনীতি ও ক্ষতি ব্যাপক বৃদ্ধি পায়। পরবর্তীতে ক্ষতি ও অদক্ষতা দেখিয়ে এ সকল প্রতিষ্ঠানগুলোকে বেসরকারীখাতে ছেড়ে দেওয়ার জন্য চাপ প্রয়োগ করে। তাদের পরামর্শের কারণে দুনীতি ও অব্যবস্থাপনা বৃদ্ধি পেলেও তারা দোষ চাপায় সরকারের উপর। সবচেয়ে দুঃখজনক ঘটনা হচ্ছে। আমরা এগুলো জানার পরও একই ভুল করছি।

স্বাস্থ্যখাতকে পুরোপুরি বাণিজ্যিকীকরণ করার অভিপ্রায়ের উদ্দেশ্যে ঋণপ্রদানকারী সংস্থাগুলো ইউজার ফি চালুর প্রস্তাব করেছে। চিকিৎসক, নার্স, টেকনিশিয়ান ও কর্মচারীদের ইউজার ফি-র একটি অংশ দেয়ার কথা বলে প্রথমেই একটি স্বার্থন্বেষী গ্রুপ তৈরি করা হচ্ছে, যারা নিজেদের স্বার্থে এ সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নের জন্য কাজ করবে। এটি তাদের ডিভাইড এন্ড রুল নীতির একটি অংশ।

পরবর্তীতে সংগত কারণেই বিগত অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের মতোই এ অর্থের ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে নানা অনিয়ম ও অব্যবস্থাপনার জন্ম নেবে। ফলে ঋনপ্রদানকারী সংস্থাগুলো একসময় হাসপাতাল ব্যবস্থাপনা নিয়ে প্রশ্ন তুলবে এবং ব্যবস্থাপনা বেসরকারীখাতে ছেড়ে দেয়ার জন্য চাপ প্রয়োগ করবে। বতর্মানে রাষ্ট্রায়াত্ত্ব হাসপাতালগুলোতে নুন্যতম অর্থ থাকার পর যে পরিমান দুনীতি বা অব্যবস্থাপনা রয়েছ, ইউজার ফি বন্টনের ব্যবস্থার পর তা আরো বৃদ্ধি পাবে। প্রশাসনের অনিয়ম, অব্যবস্থাপনা ও অন্যান্য সমস্যা আরো বৃদ্ধি পাবে।

জনগনের স্বাস্থ্য খরচ বাড়বে ও স্বাস্থ্য সমস্যা বৃদ্ধি করবে
দেশের জনগণকে স্বাস্থ্য সেবা প্রদানের লক্ষ্যে সরকার কমিউনিটি ক্লিনিকসহ নানা ধরণের কার্যক্রম গ্রহণ করেছে। সরকার স্বাস্থ্যসেবাকে মানুষের দোরগোরায় পৌছে দেয়ার সিদ্বান্ত নিয়েছে। আর এ অবস্থায় ইউজার ফি বৃদ্ধির মতো কার্যক্রম সরকারের ইচ্ছাকে বাধাগ্রস্ত করবে।

সাধারণত যে মাপকাঠিতে দরিদ্রতা নিরূপন করা হয়, দরিদ্রতা তার চেয়ে আরো ভয়ংকর। তথাকথিত অর্থনৈতিক মাপকাঠিতে মধ্যবিত্ত বা উচ্চ ও মধ্যবিত্ত শ্রেণী বলে যাদের চিহ্নিত করা হয় বতর্মান চিকিৎসা বণিজ্যের নিকট তারাও দরিদ্র। দেশের অনেক পরিবার আছে যারা চিকিৎসা করাতে গিয়ে সর্বস্বান্ত হচ্ছে। পত্র-পত্রিকার পাতা খুললেই চোখে পড়ে চিকিৎসার সহযোগিতা পাবার আকুতি। অনেক মানুষ আছে লজ্জায় তাদের সমস্যা বলতে পারে না। হাসপাতালগুলোর সামনে গেলেই দেখা যায় মানুষগুলোর ভোগান্তি। ঘরের মুরগি, গরু, চাল বা অন্য পণ্য অথবা উপকরণ বিক্রি করে কিংবা ধার করে চিকিৎসা করাতে এসেছে মানুষ। তাদের উপর ইউজার ফি বোঝা চাপিয়ে সেই টাকা আবার বন্টনের ব্যবস্থা। সাধারণ মানুষের অর্থ শোষণ করে এ ধরনের অর্থের ভাগ ও ব্যবস্থাপনা সত্যিই লজ্জার এবং অপমানের।

দেশের অনেক সাধারণ মানুষ চিকিৎসকদের নিকট চিকিৎসা না করিয়ে ঝাড়-ফুক বা অন্য কোন ভ্রান্ত চিকিৎসা পদ্ধতি গ্রহণ করছে। যদি ইউজার ফি এভাবে বৃদ্ধি হয় তবে সরকারের স্বাস্থ্য কার্যক্রম বাস্তবায়ন কোনভাবেই সম্ভব হবে না। কারণ সরকার পরিচালিত রাষ্ট্রায়াত্ত্ব হাসপাতালগুলো হয়ে অর্থশোষনের যন্ত্রে পরিণত হবে। মানুষ উপায় দেখে ভ্রান্ত চিকিৎসার দ্বারস্ত হবে।

স্বাস্থ্য বাজেট, সেবাখাত ও জনগন
বাংলাদেশর জনগণ তাদের কষ্টার্জিত অর্থ ভ্যাট ও ট্যাক্সের মাধ্যমে অর্থ প্রদান করে থাকে। এ অর্থ প্রদান করে সে আশা করে কিছু সুবিধা পাবে। কিন্তু দিন দিন অর্থনৈতিক উন্নয়নের উম্মাদানায় বেসরকারী বা ব্যক্তি মালিকানা খাত বৃদ্ধি পেলেও হ্রাস পাচ্ছে রাষ্ট্রীয় সেবাখাত। অর্থনৈতিক উন্নয়নের দোহাই দিয়ে বেসরকারী প্রতিষ্ঠানগুলো পরিণত হয়েছে জনগণের শোষণের যন্ত্রে। সরকার পরিচালিত রাষ্ট্রায়াত্ত্ব খাতগুলো দিনদিন ধ্বংশ করা হচ্ছে বেসরকারী প্রতিষ্ঠানের স্বার্থে। স্বাস্থ্য এমনি একটি খাত। অনেকেই বলে থাকেন আমাদের অর্থ কম। অর্থ না থাকার কারণে চিকিৎসা দেওয়া সম্ভব হচ্ছে না। তবে প্রশ্ন করা উচিত অর্থনৈতিক উন্নয়নের উম্মাদনায় আমরা যে পরিবেশ ধ্বংশ করছি এবং রাষ্ট্রয়াত্ত্ব প্রতিষ্ঠানগুলো বন্ধ করছি তাতে জনগণের কি লাভ হয়েছে?



অর্থনৈতিক উন্নয়নের দোহাই দিয়ে বিভিন্ন কার্যক্রম গ্রহণ করলেও জনগণের সুবিধা মূলত সংকোচন করা হয়েছে। ২০০২-০৩ অর্থ বছরের স্বাস্থ্যখাতে বাজেট ছিল ৬.৪৭%, ২০০৯-১০ সালে ছিল ৬.১৫% এবং ২০১০-২০১১ সালে তা কমে দাঁড়িয়েছে ৬.০। অর্থাৎ বরাদ্ধ দিন দিন হ্রাস পাচ্ছে। অথচ বৈদেশিক ঋণ, পেনশনভাতা, প্রজাতন্ত্রের কর্মীদের বেতন, বেসরকারী কোম্পানীগুলোর সুবিধার জন্য বাজেটে অর্থ বা প্রণোদনা বৃদ্ধি পাচ্ছে। বিভিন্নখাতে জনগণের সেবার জন্য অর্থ প্রদানকে ভর্তুকী হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। অনেকেই বলেন থাকেন ভতুর্কী প্রদান করা উচিত নয়। জনগণের অর্থ জনগণের সেবায় না প্রদানের নানা টালবাহান করা হয়। অনেকেই সেবাখাতে অর্থপ্রদানকে অহেতুক মনে করেন। বিনামূল্যে কোন কিছুই দেয়া উচিত নয় সে সকল কর্মকর্তা বা ব্যক্তি বিশ্বাস করেন তাদের নিকট প্রশ্ন এ রাষ্ট্র কেন প্রজাতন্ত্রের সেই সকল কর্মীদের পেনশন প্রদান করবে যারা কাজ হতে অবসর নিয়েছেন। প্রজাতন্ত্রের অবসর প্রাপ্ত কর্মীদের পেনশন যেমন যৌক্তিক, তেমনি জনগনের সেবাখাতে সরকারের আর্থিক যোগান সৃষ্টি যৌক্তিক ও দায়বদ্ধতা।

আমাদের সুপারিশ
এডিবি, আইএমএফ, বিশ্বব্যাংকের মতো ঋণপ্রদানকারী সংস্থাগুলো তাদের ঋণের ব্যবস্থার জন্য অনেক পরামর্শই দেবে। কিন্তু অনেক কিছু মানা না মানা আমাদের নিজস্ব বিষয়। যেমন দুনীতি দমন আইন এবং টেলিযোগাযোগ আইন সংশোধনের ক্ষেত্রে তাদের মতামতকে অগ্রাহ্য করা হয়েছে। আমরা আশা করি জনগণের স্বার্থ বিবেচনা করে সরকার, জনসেবক ও প্রজাতন্ত্রের কর্মীগণ রাষ্ট্রায়াত্ত্ব স্বাস্থ্য সেবা বৃদ্ধিতে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করবেন। বর্তমান ইউজার ফি ব্যবস্থা দেশের সরকার পরিচালিত রাষ্ট্রয়াত্ত্ব স্বাস্থ্য ব্যবস্থাকে ধ্বংশ, দুনীতি, অব্যবস্থাপনা বৃদ্ধি এবং জনগণের দুর্ভোগ সৃষ্টি করবে।

আমরা এমন একটি দেশ গড়তে চাই, যে দেশ হবে পৃথিবীর অন্যতম দেশ হিশেবে পরিচিত হবে যেখানে রাষ্ট্র জনগণের স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করে। স্বাস্থ্য যেখানে মানবাধিকার হিসেবে প্রতিষ্ঠিত। স্বাস্থ্য বাণিজ্য কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ করা হয়, রোগপ্রতিরোধ এ দেশের স্বাস্থ্যনীতির মূলভিত্তি। পৃথিবী আমাদের নিকট হতে শিখবে স্বাস্থ্যসেবা কিভাবে নিশ্চিত করা যায়।

সুপারিশ
• ইউজার ফি গ্রহণ ও বন্টন পদ্ধতি অবিলম্বে বাতিল করা।
• স্বাস্থ্যখাতের হতে আয়ের অর্থ আলাদা তহবিলে সংরক্ষন করা হবে ।
• পরিবেশ দুষণকারী প্রতিষ্ঠান, স্বাস্থ্যক্ষতিকারী পণ্য যেমন কোমল পানীয়, তামাকজাত পন্য, ফাস্টফুড বা জান্কফুড হতে অতিরিক্ত কর আদায় করে তা স্বাস্থ্যখাতে ব্যয় করা।
• স্বাস্থ্যখাতে এডিবি, আইএমএফ, বিশ্বব্যাংকের মতো ঋণপ্রদানকারী সংস্থাগুলোর পরামর্শের প্রভাব ও ফলাফল মূল্যায়ণ করা।
• জনগণের স্বাস্থ্য সেবা প্রদানের বিষয়টি প্রাধান্য দিয়ে একটি গনমুখী জাতীয় স্বাস্থ্য নীতি প্রণীত হবে।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন