সোমবার, ১৪ জুন, ২০১০

বাংলাদেশে তামাক নিয়ন্ত্রণের বর্তমান প্রেক্ষাপট ও করণীয়

বাংলাদেশে তামাক নিয়ন্ত্রণের বর্তমান প্রেক্ষাপট ও করণীয়
২৩ মে ২০১০, গোলটেবিল বৈঠক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সিনেট ভবন
বাংলাদেশ তামাক বিরোধী জোট


সম্মানিত সুধী,
বাংলাদেশ তামাক বিরোধী জোট-র পক্ষ হতে শুভেচ্ছা জানবেন। বিশ্ব তামাকমুক্ত দিবস উপলক্ষে আয়োজিত গোলটেবিল বৈঠকে আপনাদের স্বাগত। এবারের বিশ্ব তামাকমুক্ত দিবসের প্রতিপাদ্য হচ্ছে \"Gender and tobacco with an emphasis on marketing to women"। এই গোলটেবিলের আলোচনা শুরুতে প্রথমেই বাংলাদেশ তামাক বিরোধী জোট-র সংক্ষিপ্ত পরিচিতি ও এ দিবস উপলক্ষ্যে গৃহীত কার্যক্রম আপনাদের অবগতির জন্য তথ্য তুলে ধরছি।

১. বাংলাদেশ তামাক বিরোধী জোট :
বাংলাাদেশ তামাক বিরোধী জোট তামাক নিয়ন্ত্রণে কার্যরত সংগঠনগুলোর একটি সম্মিলি্লত মঞ্চ। তামাক নিয়ন্ত্রণের নীতি প্রণয়নে এডভোকেসি, নীতি বাসত্দবায়নে সহযোগিতা, সংগঠনগুলোর কার্যক্রমে সমন্বয় সাধন, দক্ষতা বৃদ্ধি, সরকারী ও আনত্দর্জাতিক সংগঠনগুলোর সাথে যোগাযোগ স্থাপন, সদস্য সংগঠনের স্বার্থরক্ষা জোটের অন্যতম কার্যক্রম।

সাংগঠনিক, সহযোগি ও নেটওয়ার্ক এই তিন প্রক্রিয়ার মাধ্যমে সারা দেশের সংগঠনগুলো এ নেটওয়ার্কর সাথে যুক্ত রয়েছে। ৩০ এপ্রিল ২০১০ অনুসারে বর্তমানে এর সাথে যুক্ত সংগঠনের সংখ্যা ৬৮৫ টি। এ সংগঠনগুলো অন্যান্য কার্যক্রমের পাশাপাশি তামাক নিয়ন্ত্রণ কার্যক্রম পরিচালনা করে। তামাক নিয়ন্ত্রণ আইন বাসত্দবায়ন ও উন্নয়ন, কর বৃদ্ধি, ইত্যাদি ইসূ্যভিত্তিক কমিটি, ৬টি বিভাগীয় ফোকাল পয়েন্ট এবং বিভিন্ন সংগঠনের একদল তরুন স্বেচ্ছাসেবীর কমিটি জোটের সচিবালয় পরিচালিনা করছে। জোট একটি স্বেচ্ছাসেবী তামাক বিরোধী আন্দোলনের মঞ্চ।

বাংলাদেশ তামাক বিরোধী জোট-র সদস্য সংগঠনগুলো তামাক নিয়ন্ত্রণ আইন মনিটরিং, আইন বাসত্দবায়নে প্রশাসনকে সহযোগিতা, ধূমপানমুক্ত স্থান সৃিষ্ট, আইন উন্নয়ন জনমত, কর বৃদ্ধির বিষয়ে সচেতনতা সৃষ্টিসহ নানাবিধ কার্যক্রম নিয়মিত পরিচালিত করছে। এ যাবত প্রাপ্ত তথ্য অনুসারে সারা দেশের ৬৪ টি জেলায় প্রায় ২০০ টি বেশি উপজেলার ২৩০ টি বেশি সংগঠন বিশ্ব তামাকমুক্ত দিবসে কার্যক্রম গ্রহণ করেছে। তবে এ নেটওয়ার্কের সাথে যুক্ত প্রতিটি সংগঠনই নিজস্ব পরিসরে কোন না কোন কাজ করে থাকে।

এ পর্যায়ে বাংলাদেশের তামাক নিয়ন্ত্রণের বর্তমান অবস্থার কিছু বিষয় তুলে ধরছি:

২. তামাক নিয়ন্ত্রণ আইন বাসত্দবায়ন:
ধূমপান ও তামাকজাত দ্রব্য ব্যবহার (নিয়ন্ত্রণ) আইন ২০০৫ বিষয়ে আলোচনার শুরুতে এ আইনের বাসত্দবায়ন হচ্ছে না বলে কেহ কেহ অভিমত ব্যক্ত করেন। কিন্তু Global Adult Tobacco Survey এবং ITC Bangladesh National Report on Evaluation of Tobacco Control Policies in Bangladesh 2009 বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় তামাক নিয়ন্ত্রণ আইন বাসত্দবায়নে অগগতি হয়েছে। মানুষের মাঝে সচেতনতা বৃদ্ধি, পাবলিক প্লেস ও পরিবহনে ধূমপান হ্রাস পেয়েছে, দেশের অনেক প্রতিষ্ঠানে ধূমপানমুক্ত সাইনসহ স্থান সংরক্ষিত হচ্ছে। প্রিণ্ট ও ইলেকট্রনিঙ্ মিডিয়ায় বিজ্ঞাপন বন্ধ হয়েছে, সিগারেটের প্যাকেটে লিখিত বানী প্রচার হচ্ছে, যা নিঃসন্দেহে আইন প্রণয়নের ফলাফল। এ অর্জন সরকার, তামাক নিয়ন্ত্রণ সংগঠন ও গণমাধ্যমের সম্মিলি্লত প্রয়াস।

তবু বলা যেতে পারে আইনের অগ্রগতি প্রত্যাশিত মাত্রায় নয়। এখনো আইন অনুসারে সকল পাবলিক প্লেস ও পরিবহন ধূমপানমুক্ত নয়। এসকল স্থানে ধূমপানমুক্ত সাইন স্থাপনও সম্ভব হয়নি। তামাক কোম্পানিগুলো আইন লঙ্গন করে পরোক্ষ বিজ্ঞাপন প্রচার করছে, কিছু কোম্পানি প্যাকেটের গায়ে আইন অনুসারে সতর্কবাণী প্রচার করছে না, তামাক চাষের বিকল্প ফসলের সুবিধা নিশ্চিত করা যায়নি, তামাক ব্যবহার ও শিল্প স্থাপনে নিরুৎসাহিত করতে নীতিমালা বা কোন ধরনের পদক্ষেপ গ্রহণ করা সম্ভব হয়নি।

৩. তামাক নিয়ন্ত্রণ আইন সংশোধন :
তামাক নিয়ন্ত্রণ আইন সংশোধন এখন সময়ের দাবি। আইনের সীমাবদ্ধতার কারণেও অনেক ক্ষেত্রে আইনটি সুফল জনগনের নিকট তুলে দেওয়া যাচ্ছে না। আশার কথা হচ্ছে সরকার তামাক নিয়ন্ত্রণ আইনটি উন্নয়নের লক্ষ্যে একটি কমিটি গঠন করেছে। উক্ত কমিটির বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের মতামতের উপর ভিত্তি করে ইতিমধ্যে মন্ত্রণালয়ের নিকট একটি খসড়া প্রসত্দাবনা পেশ করেছে। উক্ত খসড়া প্রসত্দাবনার বিষয়ে পুনরায় সকলের নিকট মতামত আহবান করা হয়েছে। আমরা আশা করি সরকার এফসিটিসি-র আলোকে আগামী Conference of the Party (COP) -র সভার পূর্বে আইনটি সংশোধন করবে।

তামাক নিয়ন্ত্রণ আইন উন্নয়ন বিষয়ে বিভিন্ন আলোচনা প্রেক্ষিতে তামাক নিয়ন্ত্রণ কর্মীরা পাবলিক প্লেস ও পরিবহনে ধূমপানের স্থান সংক্রানত্দ বিধান বাতিল করা; সকল তামাকজাত দ্রব্যকে আইনের আওতায় নিয়ে আসা; প্রত্যক্ষ, পরোক্ষ তামাকজাত দ্রব্যের বিজ্ঞাপন নিষিদ্ধ, তামাকজাত দ্রব্যের মোড়কে ৫০% শতাংশ জুড়ে ক্ষতিকর দিক তুলে ধরে সচিত্র স্বাস্থ্য সতর্কবানী প্রদান; সামাজিক দায়বদ্ধতার নামে তামাক কোম্পানির নামে লগো ব্যবহার করে প্রমোশনার কার্যক্রম নিষিদ্ধ; তামাকজাত দ্রব্যের মোড়ক বা কৌটার অনুরূপ বা সাদৃশ্যে অন্য কোন প্রকার দ্রব্যের ব্যবহার নিষিদ্ধ করা; তামাক কোম্পানিগুলোর বিরুদ্ধে যে কোন নাগরিককে মামলা করার অধিকার প্রদান; আইনভঙ্গের প্রেক্ষিতে তামাক কোম্পানিগুলোর জরিমানা ও শাসত্দির পরিমান বৃদ্ধি; তামাকের বিকল্প চাষ ও কর বৃদ্ধির জন্য নীতিমালা প্রণয়ন, তামাক কোম্পানিগুলো হতে স্বাস্থ্যকর (ঐবধষঃয ঞধী) নামে কর আদায়, কর্তৃত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা পরিধি বৃদ্ধি এবং ধূমপানমুক্ত স্থান তৈরির করতে ব্যর্থ হলে সংশ্লিষ্ট কতর্ৃপক্ষের শাসত্দির ব্যবস্থা গ্রহণের বিষয়গুলো আইনেরযুক্ত করার সুপারিশ করেন।

৪. তামাকজাত দ্রব্যের উপর কর বৃদ্ধি:
দেশীয় ও আনত্দর্জাতিক গবেষণায় দেখা যায় তামাক ব্যবহার হ্রাসে তামাকজাত দ্রব্যের উপর কর বৃদ্ধি একটি কার্যকর উপায়। তামাক নিয়ন্ত্রণ চুক্তি এফসিটিসি অনুসারে তামাকজাত দ্রব্যের উপর বৃদ্ধির লক্ষ্যে সরকার পদক্ষেপ গ্রহণ করা প্রয়োজন। অথচ বিগত কয়েক বছরে তামাকজাত দ্রব্যের উপর মুদ্রাস্ফীতি অনুসারে কর বৃদ্ধির কোন পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়নি। বরং অন্যান্য নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যের তুলনায় তামাকজাত দ্রব্যের মূল্য হ্রাস পেয়েছে। সসত্দায় তামাকজাত দ্রব্য প্রাপ্তির প্রেক্ষিতে তামাক ব্যবহার দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। বিগত বছরে সরকার তামাকজাত দ্রব্যের উপর কর বৃদ্ধি পদক্ষেপ গ্রহণ করলেও কোম্পানিগুলোর ভ্রানত্দ প্রচারণার কারণে তামাকজাত দ্রব্যের উপর কর বৃদ্ধি করা সম্ভব হয়নি।

তামাক কোম্পানিগুলো কর বৃদ্ধি হলে রাজস্ব এবং কর্মসংস্থান হ্রাস পাবে বলে কর বৃদ্ধির বিরোধীতা করে থাকে। গবেষণায় দেখা যায়, কর বৃদ্ধি হলে তামাক ব্যবহার হ্রাস পেলেও দাম বৃদ্ধির প্রেক্ষিতে সরকারের রাজস্ব বৃদ্ধি পাবে। বিশ্ব ব্যাংকের এক গবেষণায় দেখা যায়, বাংলাদেশ তামাক নিয়ন্ত্রণ হলে ১৮.৭% চাকুরি বৃদ্ধি পাবে।

তামাকজাত দ্রব্যের উপর কর বৃদ্ধির মাধ্যমে আদায়কৃত অতিরিক্ত রাজস্ব সরকার প্রয়োজনে দরিদ্র লোকদের বিকল্প কর্মসংস্থানের জন্য ব্যয় করতে পারে। প্রায়শই কোম্পানিগুলো অনেক টাকা রাজস্ব দেয়া বলে নিজেদের জাহির করতে চায়। আমাদের একটি কথা স্মরণ রাখা প্রয়োজন কোম্পানিগুলো মূলত সংগৃহীত ভ্যাট রাজস্ব খাতে জমা দেয়, ভ্যাট পুরোটা জনগনের টাকা। মাত্র ১৫% ভ্যাটের টাকা রাজস্ব খাতে দিয়ে, সরকারের উপর রোগ ও অসুস্থ্যতার বোঝা চাপিয়ে কি পরিমান অর্থ লাভ হিসেবে নিয়ে যাচ্ছে তা সহজেই অনুমেয়। আমরা আশা করি জনস্বাস্থ্য, পরিবেশ ও স্বাস্থ্য সম্মত কর্মসংস্থান ও অর্থনৈতিক উন্নয়নের কথা মাথায় রেখে এ বাজেটে সরকার সকল ধরনের তামাকজাত দ্রব্যের উপর কর বৃদ্ধির পদক্ষেপ গ্রহণ করবে।

৫.খাদ্যের জমিতে, তামাক চাষ- আমাদের শংকা:
এ বছর বাংলাদেশে তামাক চাষ আংশকাজনকভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। সমপ্রতি বাংলাদেশ ব্যাংক এক নির্দেশনায় তামাক চাষ ও তামাক উৎপাদন প্রক্রিয়ায় কোন প্রকার আর্থিক সাহায্য না করার জন্য দেশের সব সরকারি-বেসরকারি ব্যাংক-কে নির্দেশনা জারি করে । তামাক চাষ নিরুৎসাহিত করতে বাংলাদেশ ব্যাংক এর এই নির্দেশনা দেশের জনস্বাস্থ্য, পরিবেশ, অর্থনীতি উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে বলে আমাদের বিশ্বাস। তামাক কোম্পানিগুলো বিভিন্ন মিথ্যা প্রলোভনের মাধ্যমে চাষীদের তামাক চাষের জন্য উদ্বুদ্ধ করছে।

অধিক জনসংখ্যার সীমিত ভুখন্ডের এ দেশ। খাদ্যের জমিতে তামাক চাষ দেশের খাদ্য নিরাপত্তা, পরিবেশ, জনস্বাস্থ্যকে হুমকির মুখে ফেলছে। পাশাপাশি তামাক চাষ দরিদ্রতা ও অপুষ্টি ঘাটতি বৃদ্ধির জন্য দায়ী। তামাক পাতা শুকানোর জন্য প্রতিবছর দেশের বনাঞ্চল ধবংস হয়ে যাচ্ছে, বিনষ্ট হচ্ছে পরিবেশ। তামাক চাষের সময়ে স্কুলে বাচ্চাদের উপস্থিতির হার কমে যায়। তামাক চাষ অনেক শ্রমের প্রয়োজন ও কঠিন কাজ। তামাক চাষের সঙ্গে সম্পৃক্তদের হাঁপানিসহ শ্বাস ও চর্মজনিত রোগের বিসত্দার লক্ষ্য করা যায়। এছাড়া মারত্মক বার্জাজ ডিজিজ এর মত ভয়াবহ রোগও লক্ষ করা যাচ্ছে। তামাক চাষের কারণে জমির উর্বরতা শক্তি কমে যায় এবং ১০ বছর পর সে জমি সম্পূর্ণভাবে চাষ অনুপযোগী হয়ে পড়ে। এসব দিক বিবেচনায় নিয়ে তামাক চাষ নিয়ন্ত্রণে আরো কঠোর কার্যক্রম দরকার।

৬. তামাক নিয়ন্ত্রণ বিষয়ক দক্ষতা বৃদ্ধি ও সচেতনতা
তামাক নিয়ন্ত্রণের বিভিন্ন ব্যক্তি ও সংগঠনের দক্ষতা বৃদ্ধির লক্ষ্য বিভিন্ন সংগঠনের উদ্যোগ দক্ষতা বৃদ্ধির পদক্ষেপ গ্রহণ করা হচ্ছে। তামাক বিরোধী সংগঠন, স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন, এনজিও, সিবিও, সিভিল সোসাইটি ও গনমাধ্যমের কর্মীদের তামাক নিয়ন্ত্রণ বিষয়ে দক্ষতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে বিভিন্ন সংগঠন কাজ করছে। বিগত বছরে সরকারীভাবে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ও দি ইউনিয়নের সহযোগিতায় তামাক নিয়ন্ত্রণ আইন বাসত্দবায়নের সাথে জড়িত সরকারী কর্মকর্তাদের দক্ষতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে কর্মশালা আয়োজন করা হয়। তবে এ ধরনের কর্মশালা আরো বৃদ্ধি করা প্রয়োজন বলে বিভিন্ন কর্মশালা ও সেমিনারে অভিমত ব্যক্ত করা হয়।

তামাক নিয়ন্ত্রণ আইন পালণ ও তামাকজাত দ্রব্যের ক্ষতিকর দিক বিষয়ে এখনো সরকারীভাবে সীমিত সচেতনতামূলক কার্যক্রম গ্রহণ করা হয়। তবে সরকারের সহযোগি স্বেচ্ছাসেবী তামাক নিয়ন্ত্রণ সংগঠনগুলো এক্ষেত্রে সক্রিয়ভাবে তামাক বিরোধী সচেতনতামূলক কার্যক্রম পরিচালনা করে আসছে। এর মধ্যে বিলবোর্ড, সাইনবোর্ড, পোষ্টার, স্টিকার, লিফলেট, ভ্রাম্যমান গানের দল, পথ নাটক, বিভিন্ন ক্যাম্পেইন অন্যতম। তবে জনসংখ্যার অনুপাতে এ সকল কার্যক্রম খুবই অপ্রতুল। সরকারকে এক্ষেত্রে সক্রিয়ভাবে এগিয়ে আসা প্রয়োজন। তামাক নিয়ন্ত্রণ বিষয়ক দক্ষতা বৃদ্ধি ও সচেতনতা ক্ষেত্রে সরকারী ও স্বেচ্ছাসেবী তামাক নিয়ন্ত্রণ সংগঠনগুলো মাঝে আরো বেশি সমন্বয় সাধন জরুরি।

৭. তামাক নিয়ন্ত্রণে গণমাধ্যমের ভূমিকা
তামাক নিয়ন্ত্রণে বাংলাদেশের গণমাধ্যমে সক্রিয় ও অগ্রণী ভূমিকা পালণ করে আসছে। ভয়েজ অব ডিসকভারী প্রতিহত, তামাক নিয়ন্ত্রণ আইন পাস, এফসিটিসি র্যাটিফাই, স্বাস্থ্য সচেনতা, তামাক চাষের ভয়াবহতা ও তামাকজাত দ্রব্যের উপর কর বৃদ্ধি ইত্যাদি বিষয়ে জনমত সৃষ্টিতে গণমাধ্যম সক্রিয় ভূমিকা রয়েছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ও স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের উদ্যোগ বেশ কয়েকবার পত্রপত্রিকায় আইন বিষয়ে সচেতনতামূলক বিজ্ঞাপন প্রচার করা হয়। ধারাবাহিকভাবে তামাক বিরোধী সচেতনতার লক্ষ্যে সরকারী পৃষ্টপোষকতায় গণমাধ্যমে বিভিন্ন কার্যক্রম জরুরি।

তামাক নিয়ন্ত্রণ আইন বাসত্দবায়নসহ বিভিন্ন বিষয়ে সরকারের গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ থাকলেও নানা সীমাবদ্ধতার কারণে তা গণমাধ্যমে কর্মীদের নিকট পৌছে না। সরকারীভাবে তামাক নিয়ন্ত্রণে সরকার ও দেশের ইতিবাচক উদ্যোগগুলো গণমাধ্যমের নিকট পৌছে দেয়া প্রয়োজন। এ ধরনের পদক্ষেপ গণমাধ্যমকে তামাক নিয়ন্ত্রণ কার্যক্রমের সঠিক ও সময়পোযোগী তথ্য খুজে বের করতে সহযোগিতা করবে।

৮. ধূমপান ত্যাগে সহযোগিতা
তামাক ব্যবহার হ্রাসে ধূমপান ত্যাগে সহযোগিতা একটি অন্যতম উপায়। কিন্তু বাংলাদেশ এ প্রক্রিয়া এখনো জোরালোভাবে শুরু করা সম্ভব হয়নি। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সহযোগিতায় সীমিত পর্যায়ে বিআইডিসি রাজশাহী এবং এখলাসপুর সেন্টার অব হেলথ নামক তামাক বিরোধী সংস্থা কুইট কার্যক্রম সফলতার সাথে পরিচালনা করে। মানবিক নামক অপর একটি সংস্থা বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সহযোগিতা ডক্টর ফর হেলথ এবং কুইট লাইনের মাধ্যমে কিছু সময় কার্যক্রম পরিচালনা করেছে। দেশের ক্রমবর্ধমান তামাক ব্যবহারকারীর কথা বিবেচনা করে সরকারী পৃষ্টপোষকতায় এ ধরনের কার্যক্রম ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি করা প্রয়োজন।

৯. National Strategic Plan of Action for Tobacco Control
তামাক নিয়ন্ত্রণ কার্যক্রমকে গতিশীল করার লক্ষ্যে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সহযোগিতায় স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয় National Strategic Plan of Action for Tobacco Control 2007-2010 প্রণয়ন করে। দেশের তামাক নিয়ন্ত্রণ কার্যক্রমকে দিক নির্দেশনা প্রদানের এ পরিকল্পনা পত্র একটি গুরুত্বপূর্ণ দলিল। এ বছর এ দলিলের সময় সীমা শেষের প্রেক্ষিতে এ দলিল মূল্যায়ন ও পুণপ্রণয়নের উদ্যোগ গ্রহণ করা প্রয়োজন।

১০. জাতীয়, জেলা ও উপজেলা ধূমপান ও তামাকজাত দ্রব্য ব্যবহার (নিয়ন্ত্রণ) টাস্কফোর্স
তামাক আইন বাসত্দবায়নসহ বিভিন্ন কার্যক্রম পরিচালনার জন্য সরকার জাতীয়, জেলা ও উপজেলা ধূমপান ও তামাকজাত দ্রব্য ব্যবহার (নিয়ন্ত্রণ) টাস্কফোর্স গঠণ করেছে। প্রশাসন, মিডিয়া ও তামাক বিরোধী সংগঠনের প্রতিনিধিদের নিয়ে গঠিত এ কমিটি তামাক নিয়ন্ত্রণে একটি শক্তি কেন্দ্র। কিন্তু নানা সীমাবদ্ধতার কারণে জাতীয়, জেলা ও উপজেলা ধূমপান ও তামাকজাত দ্রব্য ব্যবহার (নিয়ন্ত্রণ) টাস্কফোর্স-র সভায় নিয়মিত অনুষ্ঠিত হচ্ছে না এবং কার্যক্রমও গ্রহণ করা সম্ভব হচ্ছে না।

কার্যক্রম পরিচালনার ক্ষেত্রে মনিটরিং-র অভাব, আর্থিক সীমাবদ্ধতা, প্রয়োজনীয় উপকরনের অভাবসহ নানা বিধি কারণ জেলা ও উপজেলা ধূমপান ও তামাকজাত দ্রব্য ব্যবহার (নিয়ন্ত্রণ) টাস্কফোর্স কমিটির কার্যক্রমকে বাধাগ্রসত্দ করছে। তথাপিও দেশের অনেক স্থানের টাস্কফোর্স তামাক নিয়ন্ত্রণ আইন বাসত্দবায়নে অনেক অনুকরণীয় সিদ্ধানত্দ গ্রহণ করেছে। এ সকল কমিটিরগুলোকে প্রশিক্ষন, উপকরণসহ নানা সুবিধা মনিটরিং-র মাধ্যমে নিশ্চিত করার সম্ভব হলে স্থানীয় পর্যায়ে তামাক নিয়ন্ত্রণ কার্যক্রম আরো গতিশীল হবে।

১১. আনত্দজার্তিক অঙ্গনে বাংলাদেশের তামাক নিয়ন্ত্রণ
তামাক নিয়ন্ত্রণে বাংলাদেশের অগ্রগতির প্রেক্ষিতে আনত্দর্জাতিক অঙ্গনে ভাবমূর্তি উজ্বল করেছে। মোবাইল কোর্ট, ধূমপান ও তামাকজাত দ্রব্য ব্যবহার (নিয়ন্ত্রণ) টাস্কফোর্স, সরকারী ও তামাক নিয়ন্ত্রণ সংগঠনগুলোর পারস্পরিক সহযোগিতামূলক কার্যক্রম, তামাকজাত দ্রব্যের বিজ্ঞাপন অপসারণ, ভয়েজ অব ডিভকভারীর কার্যক্রম বন্ধ, নিত্য নতুন তামাক বিরোধী আন্দোলন, জাতীয় ও স্থানীয় পর্যায়ে কার্যরত ব্যাপক সংখ্যাক তামাক নিয়ন্ত্রণ সংগঠন সম্পৃক্তকরণ ইত্যাদি বিষয়গুলো আনত্দর্জাতিক অনেক প্রতিষ্ঠানগুলোই বাংলাদেশ থেকে শিখছে। সরকারী, তামাক নিয়ন্ত্রণ সংগঠন এবং গণমাধ্যমের যৌথ কার্যক্রমের ফসল এই আনত্দর্জাতিক অর্জন ও সম্মান। বাংলাদেশের অনেক তামাক নিয়ন্ত্রণ কর্মী আনত্দর্জাতিক অনেক সংস্থার গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপে স্বেচ্ছাসেবী বা পেশাগতভাবে দায়িত্ব পালণ করে যাচ্ছে।

তবে, অনেক ক্ষেত্রেই আমাদের নিজেদেরও জ্ঞানের সীমাবদ্ধতা রয়েছে। বিভিন্ন দেশ হতে এ সকল বিষয়গুলো শেখার প্রয়োজন রয়েছে। কিন্তু পর্যাপ্ত সুযোগ সুবিধার অভারের কারণে অনেকের পক্ষেই এ জ্ঞান লাভ করা সম্ভব হয় না, এমনকি নিজেদের অভিজ্ঞতা ও অর্জনগুলো তুলে ধরা সম্ভব হচ্ছে না। এ ক্ষেত্রে সুযোগ ও সুবিধা সৃষ্টিতে সরকারকে সক্রিয়ভাবে এগিয়ে আসা প্রয়োজন, যাতে যোগ্য লোকজন তাদের অভিজ্ঞতাগুলো বিশ্ব দরবারে ছড়িয়ে দিতে পারে এবং বিশ্ব হতেও নিজের দেশের জন্য শিখতে পারে।

১২. তামাক নিয়ন্ত্রণ বিষয়ক গবেষণা:
তামাক নিয়ন্ত্রণ সংক্রানত্দ আলোচনার ক্ষেত্রে এক সময় আমাদের বিদেশী ডাটা বা তথ্য ব্যবহার করতে হতো। আমাদের জন্য আনন্দের ও আশার কথা হচ্ছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা, সিডিসিসহ বিভিন্ন আনত্দর্জাতিক সংস্থার কারিগরি সহযোগিতায় বাংলাদেশ সরকার জাতীয়ভাবে Global Adult Tobacco Survey (GATS) সার্ভে সম্পন্ন করেছে। এছাড়া ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও ওয়াটার লু বিশ্ববিদ্যালয়ে ITC Bangladesh National Report on Evaluation of Tobacco Control Policies in Bangladesh 2009 নামক অপর একটি জাতীয় পর্যায়ের গবেষণা সম্পন্ন করেছে।

ডাবি্লউবিবি ট্রাস্ট, এইচআরডিসি ট্রাস্ট, উন্নয়ন সমন্বয়, উবেনীগ, ক্যাব, মানবিক, আরটিএম ইত্যাদি সংগঠনগুলো বিড়ি ব্যবহার, তামাক নিয়ন্ত্রণ, তামাকজাত দ্রব্যের উপর কর বৃদ্ধি, তামাক চাষ, প্যাকেট ওয়ানিং ইত্যাদি সুনির্দিষ্ট বিষয়ে গবেষণা সম্পন্ন করেছে। এ সকল গবেষনাগুলো জাতীয় সম্পন, যা দেশের তামাক নিয়ন্ত্রণ কার্যক্রমকে গতিশীল করবে। তথ্যাপিও দেশে তামাক ব্যবহার ত্যাগে সমস্যা, আইন বাসত্দবায়নের প্রতিবন্ধকতা, আইন পালণে করণীয় ইত্যাদি বিষয়েও গবেষণার প্রয়োজনীতা রয়েছে।


১৪. পরিশিষ্ট
তামাক নিয়ন্ত্রণে বাংলাদেশের অর্জন অনেকখানি। কিন্তু তামাক কোম্পানিগুলো প্রতিনিয়ত দেশের এই অর্জনকে বাধাগ্রসত্দ করতে অব্যাহত প্রয়াশ চালাচ্ছে। তামাক নিয়ন্ত্রণ ও তামাক বিরোধী সংগঠনগুলো বিষয়ে নৈতিবাচক প্রচারণা তাদের এ সকল কার্যক্রমের অন্যতম হাতিয়ার। কোম্পানিগুলো তাদের ব্যবসার স্বার্থে নানাভাবেই দেশের তামাক বিরোধী কার্যক্রমকে বাধাগ্রসত্দ করতে চাচ্ছে।

তামাক কোম্পানির তাদের মুনাফার উদ্দেশ্যে মানুষকে রোগ ও মৃতু্যর দিকে ঢেলে দিচ্ছে, অপর দিকে তামাক নিয়ন্ত্রণ কর্মীদের উদ্দেশ্য মানুষের স্বাস্থ্যকে রক্ষা করা। মানুষের স্বাস্থ্য অপেক্ষা অর্থ কখনোই মুখ্য হতে পারে না। সরকার, প্রশাসন, তামাক নিয়ন্ত্রণ সংগঠন, গণমাধ্যমকর্মীদের পারস্পরিক সহযোগিতা ও পদক্ষেপ কোম্পানির অশুভ উদ্দেশ্য প্রতিহত করে জনগনের স্বাস্থ্যকে রক্ষা করবে এ আমাদের বিশ্বাস।

সুপারিশ:
* তামাক নিয়ন্ত্রণ আইন বাসত্দবায়নের মনিটরিং জোরদার, মোবাইল কোর্ট পরিচালনা, ধূমপানমুক্ত সাইন স্থাপন;
* এফসিটিসি-র আলোকে তামাক নিয়ন্ত্রণ আইন সংশোধনের দ্রুত পদক্ষেপ গ্রহণ;
* বিড়ি-সিগারেটসহ সকল তামাকজাত দ্রব্যের উপর উচ্চহারে কর বৃদ্ধি করা। কর বৃদ্ধির অর্থ দরিদ্র বিড়ি শ্রমিকদের কর্মসংস্থানের জন্য ব্যয় করা;
* পরিবেশ, অর্থ, স্বাস্থ্য রক্ষায় তামাক চাষ নিয়ন্ত্রণে দ্রুত পদক্ষেপ গ্রহণ;
* আইন বাসত্দবায়নের সাথে সম্পৃক্ত প্রশাসনের কর্মকর্তাদের দক্ষতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে পদক্ষেপ গ্রহণ;
* তামাক বিরোধী সচেতনতামূলক কার্যক্রম বৃদ্ধির লক্ষ্যে সরকারীভাবে উদ্যোগ গ্রহণ;
* সরকারীভাবে নিয়মিত গণমাধ্যমকে তামাক নিয়ন্ত্রণ বিষয়ক কার্যক্রম বিষয় তথ্য প্রদানের প্রক্রিয়া তৈরি;
* ধূমপানত্যাগে সহায়ক কর্মসূচী তৈরি করা;
* National Strategic Plan of Action for Tobacco Control 2007-2010 মূল্যায়ণ এবং পুণপ্রণয়নের উদ্যোগ গ্রহণ;
* আনত্দর্জাতিক অভিজ্ঞতা বিনিময়ের সুযোগ সৃষ্টির লক্ষ্যে পদক্ষেপ গ্রহণ;
* জেলা ও উপজেলা তামাক নিয়ন্ত্রণ টাস্কফোর্স-র প্রশিক্ষন, উপকরণসহ নানা সুবিধা ও মনিটরিং নিশ্চিত করা;
* স্থানীয় সরকার, দেশীয় দাতা গোষ্ঠীগুলোর সহযোগিতায় স্থানীয় পর্যায়ে তামাক নিয়ন্ত্রণ কার্যক্রম পরিচালনার সুযোগ সৃষ্টির জন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ;

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন