মঙ্গলবার, ২৭ এপ্রিল, ২০১০

ইকো নগরায়ন: কিছু মৌলিক বিষয়

ইকো নগরায়ন: কিছু মৌলিক বিষয়

পরিবেশ দূষণ বর্তমানে মানুষের রোগ ও স্বাস'্য সমস্যার একটি বড় কারণ। পরিবেশ দুষণের কারণে প্রাকৃতিক বিপর্যয়সহ নানা ধরনের প্রতিবন্ধকতার সম্মুখীন হচ্ছে মানব সভ্যতা। ক্ষতিগ্রসৱ হচ্ছে অর্থনীতি, উন্নয়ন, মানুষের বিকাশ। নগরায়ন ও শিল্পায়ন পরিবেশ দূষণের অন্যতম প্রদান করা। কিন' এ সত্য জানার পরও থেমে নেই পরিবেশ দূষণের মাত্র। দিন দিন তা বৃদ্ধি পাচ্ছে। অর্থনৈতিক উন্নয়নের অজব লক্ষে জিডিপি বৃদ্ধির উম্মদনায় ধ্বংশ করা হচ্ছে পরিবেশ, মানবতা, স্বাস'্য, সংস্কৃতি। জিডিপির অংক বৃদ্ধি পেলে অন্যান্য সমস্যাগুলোর সাথে বাড়ছে দারিদ্র মানুষের ভোগানিৱ আর বিনষ্ট হচ্ছে সামাজিক সমপ্রতি। ধনী আরো ধনী হচ্ছে, গরীব আরো গবীর হচ্ছে। নগরগুলো হচ্ছে শোষনের আবাসস'ল। অধিকাংশ মানুষের সুবিধাকে ছিনিয়ে উন্নয়নে নামে করা হচ্ছে নগরায়ন।

শত বছরের পুরাতন এই ঢাকা নগরীতে হাজার হাজার কোটি টাকা খচর করার পরও বিজ্ঞজনের আশংকা এই নগরী মানুষের বসবাসের অযোগ্য হয়ে পড়বে। এই নগরীর পরিবেশ দূষণ, যানজট, স্বাস'্য, পানি, শিক্ষা, যোগাযোগ কোন বিষয়েই পরিবেশ বান্ধব হয়নি। বরং দিন দিন খারাপ হচ্ছে। অথচ একদিন এই শহরই ছিল একটি আর্দশ নগরী। কিভাবে ধ্বংশ করা হলো সেই পরিবেশ বান্ধব নগরীকে, কেন করা হলো? কেন সমস্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে? আমাদের পরিকল্পনা মৌলিকতা কি কোন ভূল আছে? না এ প্রশ্ন খোজার চেষ্টা হয়নি। বরং একটি ভুলকে ঢাকতে আরো একটি ভূল করা হচ্ছে। সবচেয়ে ভয়কর বিষয় হচ্ছে এ নগরীর পরিকল্পনাগুলো দেশের অন্য এলাকাগুলোতেও করার চেষ্টা করা হচ্ছে। বিগত দিনের ভুলগুলো হতে শিক্ষা নিয়ে পরিবেশ, অর্থনীতি ও মানুষের স্বাস'্য রক্ষায় একটি পরিবেশ বান্ধব নগরী গড়ার কোন বিকল্প নেই।

নগরের পরিবেশ ও স্বাস'্য ঃ
উন্নত জীবনের সন্ধানে এই নগরে ছুটে আসলেও, এ নগর মানুষের উন্নত জীবনের অনৱরায়। জীবন ধারনের অন্যতম প্রধান উৎপাদন বায়ু দূষণ, শব্দদূষণ, পানি দূষণ কারণের মানুষ বিভিন্ন প্রানঘাতী রোগে আক্রানৱ হচ্ছে। নগরের যাতায়াত ও অবকাঠামোর প্রতিবন্ধকতার কারণে হ্রদরোগ, স্ট্রোক, ডায়বেটিক অতিরিক্ত মোটা হওয়াসহ নানা ধরনের অসংক্রামক রোগ বৃদ্ধি পাচ্ছে। খেলাধুলা ও পর্যাপ্ত বিনোদনের অভাবের কারণে শিশু-কিশোরদের মানসিক ও শারিরীক বিকাশ বাধাগ্রসৱ হচ্ছে।

মানুষের সার্বিক কল্যাণের কথা চিন-া করে একটি টেকসই নগর গড়ে তোলার জন্য গণমুখী ইকো নগরায়নের প্রতি গুরুত্ব দেয়া প্রয়োজন। গণমুখী ইকো নগর পরিকল্পনায় নগরকে কিভাবে সর্বস-রের মানুষের জন্য বাসযোগ্য এবং আন-রিক হিসেবে গড়ে তোলা যায় সেদিকে নজর দেয়া হয় । নগরের যে কোন অবকাঠামো বা উন্নয়ন কর্মকান্ড কিভাবে পরিবেশবান্ধব এবং সকল শ্রেণীর মানুষের জন্য সহজগম্য করা যায় সেটিই গণমুখী নগর পরিকল্পনার মূল লক্ষ্য।

একটি শহরের পরিকল্পনা নাগরিকদের দৈনন্দিন জীবন এবং কার্যক্রমকে নানাভাবে প্রভাবিত করে। নগর পরিকল্পনা হওয়া প্রয়োজন মানুষের কথা মাথায় রেখে। একটি সুষ্ঠু সুন্দর পরিবেশবান্ধব পরিকল্পিত নগরী দক্ষ মানবগোষ্ঠী গড়ে তুলতে সহায়ক। গণমুখী টেকসই সমন্বিত নগর পলিল্পনা প্রণয়নের মাধ্যমে মানুষের জীবনযাত্রার মান যেমন উন্নত হবে, তেমনি একটি আনৱরিক, পরিবেশবান্ধব বসবাস উপযোগী শহর গড়ে তোলা সম্ভব।

আমাদের শহরগুলো হওয়া উচিত এইরূপ-যেখানে বাসস'ানের পাশাপশি প্রচুর গাছপালা থাকবে, প্রাকৃতিক পরিবেশ ক্ষতিগ্রস' হবে না, শিশুরা ঘরের বাইরে নিরাপদে খেলাধূলার পরিবেশ পাবে, নগরবাসী পাবে একটি সুস' বিনোদনের পরিবেশ, প্রতিবেশীদের মধ্যে থাকবে আন-রিক সম্পর্ক, প্রয়োজনীয় খাদ্যের যোগানের জন্য বাসস'ানের কাছাকাছি পর্যাপ্ত কৃষি জমি থাকবে। যেখানে নগরের গতানুগতিক যান্ত্রিকতা এড়িয়ে আনৱরিকতাপূর্ণ সুন্দর জীবন উপভোগ করা সম্ভব হবে।

বর্তমানে সারা বিশ্বব্যপী জলবায়ু পরিবর্তনের ব্যপক প্রভাব পড়ছে। জলবায়ু পরিবর্তন রোধে ইকো নগরায়ন অত্যনৱ কার্যকরী ভূমিকা পালন করতে পারে। বর্তমানে বেশীরভাগ শহর পরিবেশ দূষণের অন্যতম প্রধান উৎস হিসাবে আবর্তিত হচ্ছে। কিন' শহরগুলো হতে পারে। শহরের বিভিন্ন সমস্যার প্রধান কারণ পরিকল্পনাবিহীন শহর গঠন নয় বরং আমাদের নির্ধারণ করতে হবে আমরা কোন কোন বিষয়কে অধিক প্রাধান্য প্রদান করব। ইউরোপের বিভিন্ন শহরের সবচেয়ে আকর্ষণীয় অংশগুলো দেখা যায় অনেক পুরানো এবং এগুলো গড়ে উঠেছিলো কোন রকম পরিকল্পনা ছাড়া শহরে বসবাসকারীদের বিভিন্ন প্রয়োজনের ধারাবাহিকতায়।

অপরদিকে দেখা যাচ্ছে যে আধুনিক পরিকল্পিত নগরী নগরজীবনে বিভিন্ন সমস্যা তৈরি করেছে। পরিকল্পনার মাধ্যমে একটি কংক্রীটে ঘেরা নগরী আমারা তৈরী করতে পারব কিন' সেটা অবশ্যই আদর্শ বসবাস উপযোগী নগরী হবে না। বর্তমানে নগর পরিকল্পনায় যেটি প্রধান সমস্যা আমরা নগরীর অন্যান্য সবরকম চিন-া বাদ দিয়ে সবচেয়ে বেশী প্রাধান্য দিচ্ছি নগরীর যাতায়াত ব্যবস'্যকে এবং যাতায়াত ব্যবস'ায় সবচেয়ে বেশী প্রাধান্য দিচ্ছি প্রাইভেট গাড়ীকে।

নগর পরিকল্পনায় সর্বপ্রথম আমাদের মনে রাখতে হবে নগর তৈরীর উদ্দেশ্য। একটি শহর গড়ে ওঠে মানুষকে উন্নত কর্মসংস'ান, শিক্ষা ও স্বাস'্য সেবা প্রদান, বিনোদনের সুযোগ প্রদান এবং মানুষের পাস্পরিক সম্পর্ক বৃদ্ধির মিলনকেন্দ্র হিসাবে। এই সমস- সুবিধাগুলো মানুষের হাতের নাগালের মধ্যেই থাকা উচিত। এই সুবিধাগুলো প্রদানের মাধ্যমেই নগরগুলোকে ধ্বংসের হাত থেকে রক্ষা করা সম্ভব।

নগরের আবাসন সংস'ান করতে গিয়েও আমরা মানুষের কল্যাণের দিকটি চরমভাবে উপেক্ষা করছি। নগরের মধ্যে এবং শহরের নিকটবর্তী স'ানে বিভিন্ন আবাসিক এলাকা গড়ে তোলার ক্ষেত্রে প্লট ভিত্তিক উন্নয়ন করায় মানুষের মধ্যে পারষ্পরিক যোগাযোগের সুযোগ কমে যাচ্ছে। এ ধরনের আবাসিক এলাকায় কাছাকাছি বাজার, শিক্ষা ও স্বাস'্য সেবা প্রতিষ্ঠান, অফিস না থাকায় দূরে যাওয়ার প্রয়োজন পড়ে এছাড়া বিনোদনের সুবিধা ও মানুষের মেলামেশার জন্য উন্মূক্তস'ান না থাকায় পারস্পরিক যোগাযোগ ব্যহত হয় । একইভাবে এপার্টমেন্ট ভিত্তিক যে আবাসন ব্যবস'া গড়ে উঠছে তাতেও মানুষের সাথে মানুষের সামাজিক যোগাযোগের সুযোগ রাখা হচ্ছে না। ফলে আগে আমাদের এলাকা ভিত্তিক যে আন-রিক পরিবেশ ছিল তা ক্রমেই নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। মানুষের সাথে মানুষের দূরত্ব বেড়ে যাচ্ছে যা সমাজের সার্বিক নিরাপত্তার জন্য হুমকি স্বরূপ।

একটি বসবাস উৎযোগী নগরী গড়ে তোলার ক্ষেত্রে নগর পরিকল্পনায় যে বিষয়গুলো প্রাধান্য দেয়া প্রয়োজন:-

মিশ্র এলাকা
মিশ্র এলাকা একটি শহরের জন্য উত্তম। আমাদের মনে রাখতে হবে মানুষের মূল উদ্দেশ্য যাতায়াত নয় বরং দ্রব্য এবং সেবা প্রাপ্তি। এই সকল সুবিধা বাসস'ানের খুব কাছাকাছি পাওয়া গেলে আমাদের যাতায়াতের প্রয়োজনীয়তা হ্রাস পায়, এর ফলে অবকাঠামো গঠনের সময় আমরা রাস-াঘাট নির্মাণের থেকে অনা্যন্য প্রয়োজনীয় বিষয়ে অধিক গুরুত্ব প্রদান করতে পারি। উপোরক্ত সুবিধাগুলো নগর পলিল্পনায় সমন্বিত করার মাধ্যমে মানুষের জীবনযাত্রার মান যেমন উন্নত হবে, তেমনি একটি আনৱরিক, পরিবেশবান্ধব বসবাস উপযোগী শহর গড়ে তোলা সম্ভব। আমাদের দেশের নগরগুলোর অধিকাংশ এলাকা মিশ্র ব্যবহার ভিত্তিক। এখানে খুব অল্প দূরত্বেই প্রায় সব নাগরিক সুবিধাদি পাওয়া যায়। কিন' আমাদের বর্তমান নগর পরিকল্পনা বা পরিবহন পরিকল্পনা বিশেষ করে ঢাকায় ক্রমেই এই সুবিধাটুকু নষ্ট করে দিচ্ছে। মানুষ ক্রমেই বেশী দূরত্বে যাতায়াত করতে বাধ্য হচ্ছে, যা বাড়িয়ে দিচ্ছে যানজট।

ঢাকা শহরের কর্মকান্ডকে সুষ্ঠুভাবে পরিচালনার লক্ষ্যে ১৩ টি জোনে বিভক্ত করা হয়েছে। কোন জোন কি কাজে ব্যবহৃত হবে সেটিও নির্ধারণ করার চেষ্টা করা হয়েছে। কোনটি আবাসিক কোনটি আবার বাণিজ্যিক। শহরেরে কর্মকান্ড সুষ্ঠুভাবে পরিচালনার জন্য জোন ভাগ করার প্রয়োজন রয়েছে। তবে প্রতিটি জোন এর জন্য কি কি সুবিধা থাকা প্রয়োজন তা নির্ধারণ করা কঠিন। তারপরও কিছু বিষয় বা উপাদান রয়েছে যেগুলি মানুষের বসবাসের ক্ষেত্রে অত্যাবশ্যকীয়। যেমন-শিক্ষা, স্বাস'্য, বাজার, বিনোদন, আবাসন, কর্মসংস'ান ইত্যাদি। প্রতিটি জোনে অল্প দূরত্বে এ সকল সুবিধা থাকলে যাতায়াতের চাহিদা কমানো যাবে। এদিক থেকে ঢাকা শহরের কাঠামোটি ইতিবাচক। তবে সমস্যা হলো ঢাকার বিভিন্ন অঞ্চলে মধ্যে বৈষম্য বৃদ্ধি পাচ্ছে। শহরে কোন একটি এলাকায় গড়ে উঠছে ভালো ভালো শিক্ষা-স্বাস'্য সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠান, বাজার, অফিস, বিনোদন কেন্দ্র। শহরের প্রতিটি জোনে প্রয়োজনের ভিত্তিতে এ সকল সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করতে হবে। যা যানজট নিয়ন্ত্রণ করবে এবং যাতায়াতের চাহিদা হ্রাস পাওয়ায় মানুষ অতিরিক্ত খরচের হাত থেকে মুক্তি পাবে।

গণমুখী সমন্বিত পরিবহন পরিকল্পনা
আমাদের নগর পরিকল্পনায় পরিবহন ব্যবস'া এবং তার সাথে সম্পৃক্ত আন্যান্য বিষয়গুলোকে বিবেচনা করা প্রয়োজন। আমাদের মনে রাখতে হবে মানুষের মূল উদ্দেশ্য যাতায়াত নয় বরং দ্রব্য এবং সেবা প্রাপ্তি। আমাদের পরিবহন পরিকল্পনার মূল সমস্যা এখানেই যে যাতায়াত উদ্দেশ্য বিবেচনা না করেই পরিকল্পনা করা হয়। মানুষ যদি তার প্রয়োজনীয় জিনিষগুলো হাতের কাছেই পেয়ে যায় তাহলে তার দূরে যাবার প্রয়োজন হয়না। শহরের অবকাঠমো এমনভাবে তৈরী করা প্রয়োজন যার ফলে মানুষের দূরে যাবার প্রয়োজনীয়তা অনেকাংশে হ্রাস পায়।

এখন পর্যনৱ আমাদের শহরগুলোতে কাছাকাছি বাজার, শিক্ষা ও স্বাস'্য সেবা প্রতিষ্ঠান, কর্মসংস'ান, বিনোদনের সুবিধা অধিকাংশ যাতায়াতই হয়ে থাকে স্বল্প দূরত্বে। আর এর জন্য হেঁটে চলা বা অযান্ত্রিক যানের ব্যবহার হয়ে থাকে সবচেয়ে বেশী । কিন' আমাদের নগরের পরিবহন পরিকল্পনাগুলো কখনই এই সকল গুরুত্বপূর্ণ যোগাযোগ মাধ্যমকে যথাযথ গুরুত্ব পায়নি। একই সাথে নগরের ভূমি ব্যবহার পরিকল্পনা এবং পরিবহন পরিকল্পনার মধ্যে যে ওতোপ্রোত সম্পর্ক বিদ্যমান তাও কখনও তেমন ভাবে অনুধাবন করা হয়নি।

কাছে যাতায়াতের থেকে যখন দূরের যাতায়াত বেশী সুবিধাজনক হবে মানুষ তখন দূরে যাতায়াত করতে আগ্রহী হবে। মানুষের বাসস'ান থেকে তার কর্মক্ষেত্র, বাচ্চাদের স্কুল ইত্যাদি দূরে দূরে থাকবে। উদাহরনস্বরূপ বলা যায় আজিমপুর থেকে ধানমন্ডি যাওয়ার থেকে আজিমপুর থেকে উত্তরা যাওয়া বেশী সুবিধাজনক হলে মানুষ উত্তরা থেকে আজিমপুর যেতে আগ্রহী হবে। মানুষের দূরে যাতায়াতের প্রবণতা বৃদ্ধি পেলে, যতবেশী রাস-াঘাটই নির্মাণ করা হোক না কেন শহরের যানযট বৃদ্ধি পায়। অপরদিকে মানুষ সহজে কাছকাছি দুরত্বে যাতায়াত করার সুযোগ পেলে তার বাসস'ানের কাছাকাছি সবকিছু পেতে চেষ্টা করবে, এবং এর ফলে যানযট কমবে। ফলে একদিকে যেমন সময়ের অপচয় কম হবে অন্যদিকে মানুষের জীবন যাত্রার মান বৃদ্ধি পাবে এবং পাশাপাশি স্বল্প দূরত্বে যাতায়াতের ফলে জ্বালানীর অপচয় কম হবে এবং শব্দ ও বায়ু দূষনের হারও কমবে। একস'ান থেকে অন্যস'ানে দ্রুত এবং কমখরচে যাওয়া যাবে। যানবাহনের তুলনায় মানুষের জন্য বেশী জায়গা প্রদান করা হলে মানুষের বিনোদনের সুযোগ বৃদ্ধি পাবে।

বিকেন্দ্রীকরণ
রাজধানী শহর হিসেবে ঢাকা মহানগরীর গুরুত্ব অবশ্যই অনেক বেশি। দেশের সার্বিক উন্নয়ন ও তার সুফল সর্বত্র সুষম বন্টনের লক্ষ্যে অন্যান্য শহরগুলির উন্নয়ন জরুরী। কিন' দেশে সব কিছুই ঢাকার মধ্যে পুঞ্জীভূত করা হচ্ছে। প্রশাসনিক-নিরাপত্তা কর্মকান্ড থেকে ব্যাবসা-বাণিজ্য, কল-কারখানা, শিক্ষা-স্বাস'্যসেবা, অফিস আদালত সব কিছুই ঢাকাকে কেন্দ্র করে। তাই চাকরি, ব্যবসা, ছেলেমেয়েদের পড়ালেখা, পরিবারের সুচিকিৎসা, বিনোদন এসব কিছুর আশায় মানুষ আজ ঢাকামূখী। তাছাড়া দেশে যে কোন দূর্যোগে সর্বহারা মানুষ দু-মুঠো ভাত পাবার আশায় কাজের জন্য ছুটে আসছে ঢাকা শহরে । এই অতিরিক্ত মানুষের চাপে ঢাকার জনজীবনে নানা সঙ্কট বৃদ্ধি পাচ্ছে। ধীরে ধীরে লোপ পেতে বসেছে মানুষের সকল সুযোগ-সুবিধা। কোন কোন ক্ষেত্রে পোহাতে হচ্ছে অবর্ণনীয় দূর্ভোগ। যার মধ্যে যানজট সমস্যা অন্যতম। ঢাকা শহরের উদ্ভূত যানজট পরিসি'তি মোকাবিলায় ঢাকা শহরের সঙ্গে সঙ্গে দেশের অন্যান্য শহরগুলির উন্নয়নে জরুরী পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে।

বিনোদন সুবিধা
বিনোদন মানুষের অধিকার। মানুষের পরিপূর্ণ মানসিক বিকাশের জন্য বিনোদন, খেলাধূলা এবং শরীরচর্চার গুরুত্ব অপরিসীম। শুধুমাত্র অবকাশযাপন নয়, বিনোদনকেন্দ্রগুলো সামাজিকীকরণের জন্য আদর্শ স'ান। সর্ব সাধারনের জন্য উন্মুক্ত এসব বিনোদনকেন্দ্রগুলোতে বিভিন্ন শ্রেনীপেশার মানুষ সমবেত হয়, এর মাধ্যমে একে অন্যের সাথে পরিচিত হবার সুযোগ থাকে। ফলে বিভিন্ন মানুষের মধ্যে একটি যোগসূত্র স'াপিত হয়। সমাজে একটি সুন্দর আদর্শ সামাজিক পরিবেশ বিরাজ করে।

পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে নগরবাসীর সুস' সুন্দর মানসিক ও শারীরিক বিকাশের কথা চিনৱা করে বিনোদন ও খেলাধূলার জন্য বিভিন্ন উদ্যোগ গৃহীত হলেও বাংলাদেশে এ ধরনের উদ্যোগ উপেক্ষিত। বাংলাদেশের বিভিন্ন শহরে বিশেষ করে ঢাকায় বিনোদনের সুযোগ খুবই সীমিত। ঢাকায় হাতে গোনা যে পার্ক ও খেলার মাঠ রয়েছে তা প্রয়োজনের তুলনায় খুবই অপ্রতুল। তবে যে কয়টি পার্ক, মাঠ রয়েছে, প্রয়োজনীয় রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে বর্তমানে এই পার্ক ও খেলার মাঠগুলোর খুবই বেহাল দশা। বর্তমানে এর সাথে যুক্ত হয়েছে অন্য এক নতুন সমস্যা, প্রতি মাসেই নগীরর কোন না কোন মাঠে মেলা বসে। এছাড়া সৌন্দর্যবর্ধনসহ বিভিন্ন অযুহাতে পার্ক, খেলার মাঠগুলো অবৈধভাবে দখল করার প্রচেষ্টা চলে। এভাবেই আরো সংকুচিত হয়ে পড়ছে নাগরিকদের বিনোদনের সুযোগ সুবিধা।

বর্তমানে ঢাকায় মোট পার্ক , উদ্যান, খেলার মাঠের সংখ্যা প্রায় ৮০ - ১২০ টি । এর মধ্যে ঢাকা সিটি কর্পোরেশনের অধীনে রয়েছে ৪৭টি পার্ক এবং ১০ টি খেলার মাঠ। পি. ডাব্লিউ.ডি এর অধীনে রয়েছে রমনা পার্ক, সোহরাওয়ার্র্দী উদ্যান, চন্দ্রিমা উদ্যান সহ আরো কয়েকটি পার্ক এবং মাঠ। অন্যান্য সরকারী প্রতিষ্ঠানের আওতাধীন রয়েছে ঢাকা চিড়িয়াখানা, বোটানিক্যাল গার্ডেন, বলধা গার্ডেন সহ ছোট বড় প্রায় ২৭ টি পার্ক এবং খেলারমাঠ। এছাড়া পাবলিক স্পেস হিসাবে ব্যবহৃত হয়ে থাকে ধানমন্ডি লেক, টি.এস.সি ইত্যাদি কয়েকটি স'ান। এসব মিলিয়ে ঢাকার উন্মুক্ত স'ান রয়েছে প্রায় ৫০৩.৬৪ একর। এর মধ্যে আহসান মজ্ঞিল, লালবাগ দূর্গ রয়েছে। বর্তমানে ঢাকার জনসংখ্যা প্রায় ১ কোটি ২০ লক্ষ। পরিসংখ্যান অনুযায়ী ঢাকায় প্রতি ১,০০০ জনে উন্মুক্তস'ান রয়েছে প্রায় ৪ শতাংশ । ব্রিটেনের জাতীয় ক্রীড়াক্ষেত্র সমিতির মতে প্রতি ১,০০০ জনপিছু ৬ একর পরিমিত উন্মুক্তস'ান, খেলারমাঠ থাকা উচিত, যার ৪ একর সার্বজনীন আর ২ একর ব্যক্তিগত। এছাড়া প্রতি ১,০০০ জনে ১ একর থাকবে বাগ এবং ৩ একর থাকবে বিদ্যালয় ক্রীড়াক্ষেত্র। এভাবে সর্বমোট ১০ একর খোলা জায়গা থাকতে হবে প্রতি ১,০০০ লোকের জন্য। এই পরিসংখ্যান অনুযাযী দেখা যাচ্ছে ঢাকায় পার্ক, খেলার মাঠ, বিনোদনকেন্দ্রের পরিমান নিতান-ই অপর্যাপ্ত।

বর্তমানে সীমিত সংখ্যক পার্ক, খেলার মাঠের কারণে শিশু-কিশোররা বঞ্চিত হচ্ছে বাইরে খেলাধূলার এবং বিনোদনের সুযোগ থেকে। তাদের অবসর সময় কাটছে টিভি দেখে বা কম্পিউটারে গেমস্‌ খেলে, যা তাদের পরিপূর্ণ শারীরিক ও মানসিক বিকাশে বাধা সৃষ্টি করছে। এছাড়া বিনোদনের অপ্রতুল সুযোগ নাগরিকদের দৈনন্দিন কর্মব্যসৱ জীবনকে একঘেয়ে করে তুলছে। শিশু-কিশোরদের খেলাধূলার সুবিধা প্রদান, নগরবাসীর বিনোদনের জন্য শহরগুলোতে পর্যাপ্ত বিনোদনকেন্দ্র হিসেবে পার্ক, খেলার মাঠ গড়ে তোলা এবং পুরোনোগুলোর সংস্কার অত্যাবশ্যকীয়। একই সাথে নগরবাসীর শারীরিক ও মানসিক সুস'তার কথা চিন-া করে পায়ে হেঁটে চলাচল ও শরীরচর্চার জন্য উপযুক্ত পরিবেশ তৈরী খুবই গুরুত্বপূর্ণ।

নগর পরিকল্পনায় পুরো অবকাঠামোর সাথে সমন্বয় রেখে, পরিকল্পিতভাবে বিনোদনস'ান, নাগরিক বিনোদন কেন্দ্র গড়ে তোলা জরুরী। নগর মানেই শুধু ইট, কাঠ, পাথরের বসতি বা যান্ত্রিকতা নয়। বহুমানুষের মিলনকেন্দ্রই হচ্ছে নগর। একটি নগরীর গড়ে ওঠা নগরবাসীর শারীরিক ও মানসিক বিকাশকে নানাভাবে প্রভাবিত করে। একটি সুষ্ঠু সুন্দর পরিকল্পিত নগরী, দক্ষ মানবগোষ্ঠী গড়ে তুলতে সহায়ক। পরিকল্পিত নগরী গড়ে তোলার ক্ষেত্রে বিষয়টি প্রাধান্য দেয়া হোক এটি আমাদের সকলেরই কাম্য।

গণমুখী নগর পরিকল্পনার স্বার্থে কিছু সুপারিশমালা:
ক্স নগর পরিকল্পনায় মিশ্র এলাকা গড়ে তোলার উপর মনযোগ দিতে হবে। যেমন-আবাসন, শিক্ষা ও স্বাস'্যসেবা প্রতিষ্ঠান, বাজার, কর্মস'ল, বিনোদন ইত্যাদি সুযোগ সুবিধা কাছাকাছি দূরত্বে থাকে।
ক্স ঢাকার জলাধারগুলো সংরক্ষণে প্রয়োজনীয় ব্যবস'া গ্রহণ করতে হবে।
ক্স জলাবদ্ধতা নিরসনে রিটেনসন পন্ড রাখার ব্যবস'া করতে হবে।
ক্স সুয়্যারেজ বর্জ্য অপসরেেণর বা ট্রিটমেন্ট প্ল্যন্ট তৈরী করার পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে
ক্স নাগরিকদের বিনোদনের জন্য পর্যাপ্ত পরিমান উন্মুক্তস'ানের ব্যবস'া করতে হবে।
ক্স নগরের পরিবহন পরিকল্পনায় পায়ে হাঁটাকে সবচেয়ে গুরুত্ব দিতে হবে এবং পথচারীদের সুবিধার কথা চিন-া করেই সকর অবকাঠামো নির্মাণ/সংস্কার করতে হবে।
ক্স ঢাকা শহরের সঙ্গে সঙ্গে দেশের অন্যান্য শহরগুলির উন্নয়নে জরুরী পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন