মঙ্গলবার, ২৭ এপ্রিল, ২০১০

সুস্থ্য বাঁচাতে চাই হাঁটা, সংকুচিত হচ্চে পথ !

সুস্থ্য বাঁচাতে চাই হাঁটা, সংকুচিত হচ্চে পথ !

সকাল বেলা ঢাকা শহরের কিছু রাসৱায় দাড়ালে দেখা যায়, হেঁটে চলা মানুষের জনস্রোত। এ সকল রাসৱায় দাড়ালে হাটতে হবে না এমনিতেই মানুষের স্রোতে এক স'ান হতে অন্য স'ানে চলে যেতে হয়। এ অবস'া অধিকাংশ স্বল্প আয়ের মানুষের যাতায়াতের। অপর দিকে সকাল-বিকাল শহরের বিভিন্ন শ্রেণীর পেশার মানুষ হৃদরোগ, অতিরিক্ত মোটা হওয়া, স্ট্রোকসহ নানা সমস্যা হতে মুক্তি পেতে মাঠ পার্কগুলোতে হেঁটে থাকেন। তার বাইরে কিছু মানুষ অনেক যাদের হাঁটা প্রয়োজন হলেও হাটতে পারেন না প্রতিবন্ধকতার কারণে। এ সকল শ্রেণীর মধ্যে প্রতিবন্ধী, বৃদ্ধি, মহিলা শিশু অন্যতম। এ অবস'া থেকেই অনুমান করা যায় হাঁটার অবস'া ভাল নয়। দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে প্রাইভেট গাড়ী, ফলে বৃদ্ধি পাচ্ছে যানজট, পরিবেশ দুষণ, জ্বালানি সংকটসহ নানা সমস্যাগুলো। অধিকাংশ মানুষ হেঁটে চলাচল করলেও অগ্রাধিকার পাচ্ছে না হাঁটার ব্যবস'া।

এক সময় ঢাকা শহরের প্রতিটি রাসৱায় হেটে পারাপারের জন্য জ্রেবা ক্রসিং ছিল। কিন' পথচারী অগ্রাধিকার দেওয়ার নামে মাত্র কযেক বছরের এ সকল জেব্রা ক্রসিংগুলো তুলে দিয়ে স'াপন করা হয়েছে ফুটওভার ব্রিজ। তিনতলা এই ফুটওভার ব্রিজগুলো কিভাবে পথচারী সহায়ক কার্যক্রম হয় তা বোধগম্য নয়। কারণ এ সকল ব্রিজ দিয়ে বৃদ্ধি, প্রতিবন্ধী, মহিলা, শিশু এবং মালামাল বহনকারী ব্যক্তিদের চলাচল কোনভাবেই সম্ভব নয়। তাছাড়া একটি সুস'্য সবল মানুষ যদি কিছু দূর হাটেন তার শরীর ও মনের পক্ষেও এ পর্বত সমান ফুটওভার ব্রিজ অতিক্রম করা সম্ভব নয়।

এ শহরে যেখানে অধিকাংশ মানুষ হেটে চলাচল করে তাদের জন্য জ্রেব্রা ক্রসিং বৃদ্ধি না করে কেনই বা পর্বত সমান ফুটওভার ব্রিজ তৈরি করা হচ্ছে না সত্যিই বিস্ময়ের বিষয়। সবচেয়ে অবাক বিষয় হচ্ছে বিগত কয়েক বছরের এ ধরনের অনেকগুলো ব্রিজ তৈরি করার পর ভেঙ্গে ফেলা হয়েছে মানুষ ব্যবহার না করার জন্য। তথাপিও নতুন নতুন তৈরি হচ্ছে ফুটওভার ব্রিজ। কিছু স'ানে আইনপ্রয়োগকারী সংস'ার লোকদের দিয়ে বাধ্য করানো হচ্ছে ব্রিজে উঠতে। ফুটওভার ব্রিজের স'ানে ব্যারিকেট তৈরি করা হচ্ছে যাতে মানুষ যত্রতত্র দিয়ে পারাপার না হতে পারে। যদি প্রশ্ন করার হয় একজন বৃদ্ধি, প্রতিবন্ধী, মহিলা, শিশু এবং মালামাল বহনকারী ব্যক্তি কিভাবে এ পর্বত অতিক্রম করবে। তার উত্তর কেনই দিতে পারবে না। বিগত দিনে ফুটওভার ব্রিজগুলো ভাঙ্গা এবং বল প্রয়োগ করেও ব্রিজ ব্যবহারে জনগনকে উৎসাহীত না করার ফলাফল হচ্ছে। এ প্রক্রিয়া জনগনের জন্য আরাম দায়াক ও সুবিধাজনক নয়। অর্থাৎ পরিকল্পনাবিদগন মানুষের সুবিধা ও মতামত বিবেচনা না করে এ সকল কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছেন। যা হাঁটার মানুষের প্রতি উপহাস বা অবহেলা হিসেবে প্রতীয়মান হয়। রাষ্ট্রীয় কোষাগারের অর্থে সরকারী প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে অধিকাংশ মানুষের সুবিধার প্রতি অবহেলা অসংবিধানিক ও গণতান্ত্রিক।

এবার আসা যাক হেটে চলাচল কেন আমাদের জন্য জরুরি। কেনই বা এ বিষয় এত বক্তব্য ও তর্কের অবতারণা। আমাদের দৈনন্দিন জীবনে যাতায়াত একটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। সুস'্য-স্বাভাবিকভাবে যাতায়াত করার জন্য সুষ্ঠু পরিবহন ব্যবস'া থাকা প্রয়োজন। ক্ষেত্রবিশেষে পাবলিক পরিবহন, অটোরিকশা, রিকশা, সাইকেল, হাঁটাকে প্রাধান্য দিতে হবে। তুলনামূলক বেশী দূরত্বের যাতায়াতের ক্ষেত্রে যেমন পাবলিক পরিবহন ব্যবহার করতে হবে, তেমনি স্বল্প দুরত্বের যাতায়াতের ক্ষেত্রে হাঁটাকে প্রাধান্য দিতে হবে। শুধুমাত্র স্বল্প দুরত্বের যাতায়াতের ক্ষেত্রেই নয় হাঁটার সাথে আমাদের শারীরীর সুস'্যতার সম্পর্ক রয়েছে।

আমাদের শারীরীক সুস'তা নিশ্চিত করার জন্য শুধুমাত্র পুষ্টিকর খাবারই নয় তার সাথে দরকার আমাদের নিয়মিত হাঁটাচলা বা ব্যায়াম করা। আমাদের শারীরীক সুস'্যতা নিশ্চিত করার জন্য প্রয়োজন নিয়মিত ব্যায়াম করা। কিন' আমাদের কর্মব্যসৱ জীবনে ব্যসৱতার কারনে নিয়মিত ব্যয়াম করা সম্ভব হয় না। তাছাড়া ব্যয়ামের জন্য যে সমসৱ জিম রয়েছে তাও ব্যায় সাপেক্ষ। অথচ আমরা যদি একটু সচেতন হয়ে স্বল্প দুরত্বের যাতায়াতের ক্ষেত্রে হেঁটে চলাচল করি তাহলে ব্যয়ামের জন্য আলাদা করে সময় এবং অর্থ ব্যয় করার প্রয়োজন হবে না। তাছাড়া রোগ প্রতিরোধের জন্য নিয়মিত হাঁটা কার্যকরী ভূমিকা পালন করে। বিশ্বস্বাস'্য সংস'ার মতে সুস'্য থাকার জন্য প্রতিদিন কমপক্ষ্যে ৩০ মি হাঁটা ও ওজন বৃদ্ধি হ্রাসের জন্য প্রতিদিন কমপক্ষে ১ ঘন্টা হাঁটা উচিত।

নিয়মিত হাঁটার ফলে হৃদরোগ, ডায়াবেটিস, মোটজনিত সমস্যাসহ নানা জটিল রোগসহ অনেক অসংক্রমক রোগ প্রতিরোধ করা সম্ভব। ২০০৫ সালের এপ্রিল মাসে প্রকাশিত তিনটা গবেষনায় দেখা গেছে নিয়মিত ৩০ মিনিট হাঁটলে হৃদরোগে আক্রানৱ হয়ে মৃত্যুর ঝুঁকি ৩৯% থেকে ৪৮% ভাগ পর্যনৱ কমায়। এবং ২০০৪ সালের সেপ্টেম্বর মাসের ৮ তারিখে "ঔড়ঁৎহধষ ড়ভ ঃযব অসবৎরপধহ গবফরপধষ অংংড়পরধঃরড়হ," একটা গবেষনা প্রকাশ করে যা ৯০৬ জন মহিলাকে নিয়ে করা হয়। গবেষনায় দেখা যায় নিয়মিত হাঁটাচলা না করা বা কায়িক শ্রমের অভাবে ৭৬% মহিলা ওজন জনিত সমস্যায় ভুগছে এবং ৪১% মহিলা অতিরিক্ত ওজন জনিত সমস্যায় ভুগছে, যা ভবিষতে হৃদরোগের ঝুঁকি বাড়ায়। তাছাড়া এমন অনেক অসংক্রমিক অনেক রোগ আছে যা হেঁটে চলাচলের মাধ্যমে প্রতিরোধ সম্ভব। তাছাড়া নিয়মিত হাঁটার ফলে শারীরীক সুস'্যতার সাথে সাথে মানসিক স্বাস'্য ঠিক রাখা সম্ভব।

সুস'্যভাবে বেঁচে থাকাই নয়, হাঁটার মাঝে রয়েছে এক ধরনের আনন্দ। কারণ হাঁটতে গিয়েই পরিচিতজন এবং নতুন মানুষের সাথে খুব সহজে সু-সম্পর্ক গড়ে তোলা সম্ভব। এর মাধ্যমে সামাজিক সম্পর্ক উন্নয়ন সম্ভব। নিয়মিত হেঁটে চলাচল করলে আশপাশের সকলের সাথে সখ্যতা সৃষ্টি হয়, যাতে সামাজিক নিরাপত্তা ও সম্পৃতি বৃদ্ধি পায়। ফলে আনন্দের সাথে অবসর সময় কাটানোর সুযোগ সৃষ্টি হয়। এতে শারীরীক সুস'্যতার সাথে সাথে মানসিক স্বাস'্য ভাল থাকে। তাছাড়া ধনি গরিব নির্বিশেষে হেঁটে চলাচল করলে সামাজে সমতা সৃষ্টি হয়।

শুধুমাত্র বড়দের জন্যই নয় শিশুদেরও সুস'্যভাবে বেড়ে ওঠার জন্য হাঁটা গুরুত্বপূর্ণ। এখনকার শিশুরা আগামী দিনের ভবিষ্যত। তাদের ওপর নির্ভর করে আগামী দিনের দেশের ভবিষ্যত। অতএব তাদের সুস'্যভাবে বেড়ে ওঠা নিশ্চিত করা প্রয়োজন। অথচ বর্তমানে আমাদের শিশুরা বড় হচ্ছে ইট-কাঠের তৈরী আবদ্ধ ঘরে। তাদের সময় কাটানো মাধ্যম হচ্ছে টিভি, কম্পিউটার, ভিডিও গেমস ইত্যাদি। উপযুক্ত খেলাধুলা ও হাঁটার পরিবেশ না থাকার কারনে আশে পাশে কারো সাথে মেলামেশার সুযোগ পাচ্ছে না। যা তাদের সুষ্ঠু বিকাশের ক্ষেত্রে অনৱরায়। এমনকি স্কুলে বা অন্য কোথাও যাতায়াতের জন্য বেশীরভাগ ক্ষেত্রে ব্যবহার করছে প্রাইভেট গাড়ী। স্কুলগুলোতেও পর্যাপ্ত খেলা ধুলার পরিবেশ নাই। ফলে শিশুদের প্রয়োজনীয় শারীরীক ব্যায়াম হচ্ছে না। অথচ শিশুদের যদি হেঁটে স্কুলে যাতায়াতের ব্যবস'া করি একদিকে যেমন শারীরীক ব্যয়াম হবে তেমনি আশে পাশে মানুষের সাথে মেলামেশার সুযোগ সৃষ্টি হবে। যা তাদের সুষ্ঠু ভাবে বেড়ে ওঠার জন্য প্রয়োজনীয়।

হাঁটার অনেক সুফল থাকলেও প্রয়োজনীয় অবকাঠামো না থাকার কারনে মানুষ অনেক ক্ষেত্রে হাঁটতে নিরুৎসাহীত হচেছ। ঢাকায় যেখানে যাতায়াতের ৮৪% যাতায়াত হচ্ছে হেঁটে ও জ্বালানীমুক্ত যান দ্বারা সেখানে দেশের পরিবহন পরিকল্পনা করা হচ্ছে যান্ত্রিক যানবাহনকে গুরুত্ব প্রদান করে। যান্ত্রিক যানবাহনকে সার্বাধিক গুরুত্ব প্রদান করায় যাতায়াতের ক্ষেত্রে জনসাধারনের উপর বাড়তি ভাড়া বাবদ অর্থনৈতিক চাপ সৃষ্টি হচ্ছে। যার প্রভাব পড়ছে শিক্ষা, স্বাস'্য, প্রভৃতি সেবার উপর। অথচ আমাদের শারীরীক সুস'তা, পরিবেশ বান্ধব, আর্থিক সাশ্রয়ী হওয়া স্বত্বেও অবকাঠামোগত উন্নয়নের ক্ষেত্রে হাঁটাকে প্রাধান্য দেওয়া হচ্ছে না। তৈরী করা হচ্ছে না হাঁটার উপযুগী পরিবেশ এবং ফুটপাত। তাছাড়া যেসমসৱ ফুটপাত রয়েছে তাও বেশিরভাগ ক্ষেত্রে ভাঙ্গা, অসমান, পথচারী বান্ধব নয়, এবং ফুটপাতগুলোতে গাড়ী পার্কিং করে রাখা হয়। ফুটপাত ও রাসৱায় গাড়ী পার্কিং করায় অনেক ক্ষেত্রে ঝুকিপূর্ণভাবে মানুষ ফুটপাত ছেড়ে রাসৱার মধ্য দিয়ে হাঁটতে বাধ্য হচ্ছে। ফুটপাতের পাশে ডাস্টবিন, ফেলে রাখা কনস্ট্রাকশনের জিনিসপত্র-ময়লা-আবর্জনা পরিবেশকে অস্বাস'্যকর করছে। এসমসৱ কারনে পথচারীরা নির্বিঘ্নে হেঁটে চলাচলের ক্ষেত্রে বাধাগ্রস' হচ্ছে এবং হেঁটে চলাচলে নিরুৎসাহীত হচ্ছে।

দেশের বাইরে যে সমসৱ দেশ সুষ্ঠু পরিবহন ব্যবস'া গড়ে তুলেছে সে সব দেশে হাঁটাকে অগ্রাধিকার দেওয়া হয়েছে এবং হেঁটে চলাচলের জন্য সেখানে প্রশসৱ ফুটপাত রয়েছে। শুধু তাই নয় প্রতিবন্ধি, শিশু ও বয়স্কদের হেঁটে চলাচলের আলাদা নীতিমালা আছে। তাছাড়া দেশের বাইরে যাতায়াতের ক্ষেত্রে পথচারীদের অগ্রাধীকার দেওয়া হয়। পথচারী হেঁটে যাচ্ছে দেখলে গাড়ির গতি থামিয়ে তাকে আগে যেতে দেয়া হয়। মনোমুগ্ধকর পরিবেশ পথচারীদের আকৃষ্ট করে তাই পথচারীদের চলাচলের সুবিধার্তে প্রচুর পরিমানে গাছ লাগানো হয়। নদীর পাশদিয়ে, সেতুতে রেল লাইনের পাশাপাশি হাঁটার জন্য আলাদা লেন বরাদ্দ আছে। হাঁটার পরিবেশ উন্নয়নের লক্ষ্যে বিভিন্ন দেশের বেশ কিছু শহরে সাপ্তাহিক ছুটির দিনে যান্ত্রিক যানবাহন নিষিদ্ধ থাকে।

অবকাঠামোগত পরিবেশ মানুষের মনের উপর প্রভাব ফেলে তাই হাঁটার জন্য সুন্দর, মনোমুগ্ধকর আর প্রাকৃতিক পরিবেশ তৈরী করতে হবে। আর এর জন্য রাসৱার দুইপাশে হাঁটার জন্য প্রশসৱ ফুটপাত তৈরী করতে হবে। যে সমসৱ রাসৱায় ফুটপাত রয়েছে তার বেশীরভাগই ভাঙ্গা এবং অসমান, পথচারী বান্ধব নয়। তাই নির্বিঘ্নে হাঁটার সুবিধার্থে ফুটপাত পথচারী বান্ধব করতে হবে। তাছাড়া বেশীর ভাগ রাসৱায় ফুটপাতগুলোতে গাড়ী পার্কিং করে রাখা হয়। ফলে নির্বিঘ্নে হেঁটে চলাচলের ক্ষেত্রে পথচারীরা বাধাগ্রস' হয়। তাই ফুটপাতে গাড়ী পার্কিং নিষিদ্ধ করতে হবে। ফুটপাতে ছায়ার জন্য পর্যাাপ্ত গাছ লাগানো এবং রাতে হেঁটে চলাচলের সুবিধার জন্য পর্যাপ্ত আলোর ব্যাবস'া থাকতে হবে। ফুটপাতের পাশে ডাস্টবিন সরিয়ে ফুটপাত ময়লা আবর্জনামুক্ত পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন করতে হবে।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন